বাংলাদেশ নদী প্রধান তথা নদীমাতৃক দেশ। এই দেশবাসীর জীবন বাঁচাতে হলে নদীকেও বাঁচাতে হবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে আর দেশ বাঁচলে দেশের মানুষও বাঁচবে। সবার জীবন এবং অনেকেরই জীবিকা সম্পূর্ণভাবে পানির ওপর নির্ভরশীল। নদ-নদীর পানিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ দেশের মানুষের জীবনধারা। তাই নদীগুলোকে বিপদে রেখে আমরা নিরাপদে শান্তিতে ঘুমুতে পারব না। এই দেশটা যদি হয় আমাদের মায়ের মতন তবে নদীগুলো তার শিরা ধমনী।
নদী মহান স্রষ্টার এমন এক অপূর্ব সৃষ্টি যার ওপর মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্ভরশীল। এজন্যই পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলো ও বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। নদীকে ঘিরেই মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ। কিন্তু বর্তমানে নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ছেদ পড়েছে। এমতাবস্থায় মৃত নদীগুলোকে পুনরায় জীবনদান এবং মৃতপ্রায় নদীগুলোর যৌবন ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে উপযুক্ত আবাস নিশ্চিত করা সম্ভব।
আমরা যদি নদীর পক্ষে দাঁড়াই তবে নদীই আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবে, সমৃদ্ধির পথ দেখাবে। নদী মরলে আমাদের কৃষি মরবে, কৃষকের আর্তনাদ বাড়বে, বৃদ্ধি পাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বিপর্যস্ত হবে জনজীবন, হুমকির মুখে পরবে জীববৈচিত্র। ফলে দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে নদীগুলোর প্রাণ রক্ষা করে প্রাণচাঞ্চল্য মুখর আগামীর পথ রচনায় হোক আমাদের অঙ্গীকার।
আমাদের নদী ও বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ‘প্রায় এক হাজার বছর আগে দেশে নদী ছিল দেড় হাজার। আর খাল ছিল লক্ষাধিক। ষাটের দশকে এসে নদীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫০টিতে। আর খাল অর্ধলক্ষাধিক। বর্তমানে দেশে নদী রয়েছে ২৩০টি এবং খাল রয়েছে ২০ হাজার। দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৮০ হাজার ছোট-বড় খাল।’ এর ফলে নদনদী ও মিঠা পানির প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ে এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দেশে নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। মাত্র ৪২ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটারে। আর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রবাহ কমে গেলে আরও একশটি নদীর নাব্যতা হারানোর আশঙ্কা করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে ১৭৪টি ছোট-বড় নদী বিপদাপন্ন।ভয়াবহ পানি শূন্যতার ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পলি জমে কমপক্ষে ৯৫টি নদী বিলুপ্তির অপেক্ষায় ধুঁকছে। এছাড়া আরও ৪২টি নদ-নদী পলি সঞ্চয়ের দরুন চরের চাপে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সারাদেশের নদীগুলোর বাস্তবতা বুঝার স্বার্থে আমরা বুড়িগঙ্গাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে সামনে আনতে পারি। যে বুড়িঙ্গার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর লিখেছিলেন, বর্ষাকালে যখন নদীটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো। সেই বুড়িগঙ্গার অবস্থান বিশ্বের দূষিততম ১০টি নদীর মধ্যে চতুর্থ বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘লিস্ট ডোজ’।
যেই বুড়িগঙ্গার তীরে ১৬১০ সালের কোনো এক পূর্ণিমা রাতে সামরিক নৌ-বহর ভিড়িয়ে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঘোষণা করেছিলেন, সোনারগাঁও নয়, এখানেই হবে বাংলার রাজধানী। কালের আবর্তে বুড়িঙ্গার সেই সৌন্দর্য এখন ইতিহাস। প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার টন কঠিন বর্জ্য এ নদীতে ফেলা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে প্রতিলিটারে দশমিক ৪৭ মিলিগ্রাম। কোথাও কোথাও অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এক সময় যে নদীকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল ঢাকার নগরায়ন, সে নগরায়নই ক্রমশ নিঃশেষ করেছে বুড়িগঙ্গাকে।
ঢাকার চারপাশের তুরাগ, বালু, টঙ্গীখাল, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার অবস্থাও এখন প্রায় একই রকম। রাজধানীর ভেতর ও বাইরে ছোট-বড় ১৮টি নদী, অভ্যন্তরের ৪৩টি খাল থাকলেও সবই আজ বিলীন।
আমাদের পরিবেশ ও বর্তমান বাস্তবতা
আমাদের দেশের পরিবেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই নানা দূষণের চিত্র। বিশেষ করে পরিবেশকে উপেক্ষা করে যত্রতত্র ইটভাটা র্নিমাণ আমাদের পরিবেশকে মারাত্ত্বক ঝুকির মধ্যে ফেলেছে। ফসলি জমির টপসয়েল ও পাহাড় কেটে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কচি কচি গাছ কেটে ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে।
বিশেষ করে বাশের গোড়া ইটভাটায় পোড়ানোর ফলে বাশ এখন বিলীনের পথে। এভাবে আমরা পরিবেশের কথা না ভেবে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য জন্য গোটা পরিবেশকে নিজ হাতে হত্যা করছি। আমরা ভাবছি না আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা। তাদের জন্য আমরা কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছি আমরা সেচিন্তা করছি না।
বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পাশ হয়েছে।
পরিবেশ ও জীবনমানের ওপর এর কুপ্রভাব বিষয়ে ইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যে বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করেছেন তাতে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০১৪-এর এক তথ্য প্রকাশে জানা যায়, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৬৯তম।
জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব বায়ুর মান, কৃষি, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র ও বাসস্থান, আবহাওয়া এবং জ্বালানি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৫.৬১। শুধু বায়ুদূষণের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে মাত্র ১৩.৮৩। এ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান হবে সবার শেষে অর্থাৎ ১৭৮তম।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পরিবেশের ওপর স্থায়ী হচ্ছে দিন দিন। এছাড়াও আরো অন্যান্য পরিবেশ সমস্যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, নদীভাঙন, বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানির আগ্রাসী ব্যবসা পরিচালনা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ইত্যাদি। বিভিন্ন নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের বিলুপ্তি ও ক্ষীণস্রোতা হয়ে আসায় জনজীবন ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমাগত নদ-নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায়, তা বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব ফেলবে৷ এর ফলে খাদ্য ঘাটতিও বেড়ে যাবে বহুল পরিমাণে এবং হুমকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য৷
নদীগুলিতে দূষণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, প্রতি বছর নাকি ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার মাছ কম উৎপাদন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড.আতিক রহমান৷ নদী শুকিয়ে গেলে নৌ-পথে চলাচল কমবে, সড়কপথের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে, জ্বালানী তেলের ব্যবহার ও আমদানি বাড়বে। পাখিসহ অনেক বন্যপ্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল বলে, বিলুপ্ত হয়ে যাবে তারাও৷ কমবে পদ্মার মোহনায় ইলিশ মাছের প্রজনন৷ কমে যাবে গবাদি পশু৷ যার প্রভাব পড়বে কৃষিতেও৷ আর মিষ্টি জলের প্রবাহ কমে যাওয়ায়, জোয়ারের নোনতা জল ক্রমশই ঢুকবে ভিতরে৷ যার ফলে, মাটিও হারিয়ে ফেলবে তার স্বাভাবিক গুণ৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর প্রবাহ কমে গেলে অববাহিকা অঞ্চলের মাটিও শুকিয়ে যায়৷ আর তাই, কৃষিকাজ সহ যাবতীয় বিষয় হয়ে পড়ে ভূ-গর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভরশীল৷ কিন্তু, এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ জলের ওপর চাপ বাড়তে থাকায়, জলের স্তর ধীরে ধীরে নীচে নেমে যায় এবং নদীর তলদেশের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে অল্প পরিমাণ জলেই দেখা যায় বন্যা৷
ইটিপি ব্যবস্থাপনা ও শক্তিশালী মনিটরিং: অনেক টেক্সটাইলেই ইটিপি নেই। আবার অনেকে ইটিপি বসানোর পরেও সঠিক নিয়মে সবসময় এটাকে চালু রাখেনা। টেক্সটাইল বর্জ্যরে কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকাসহ সারাদেশের টেক্সটাইল কারখানাসংলগ্ন নদী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিবেশ। আর এ কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে দেশের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য।
টেক্সটাইল বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল টুডে’র দেয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, শুধু ঢাকা এবং এর আশপাশ এলাকার নদীগুলোতে ২ হাজারের বেশি টেক্সটাইল, ওষুধ, রাসায়নিক এবং ট্যানারি কারখানা বিষাক্ত বর্জ্য ছাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক ন্যাশনাল রিসোর্স ডিফেন্স কাউন্সিলের (এনআরডিসি) রেসপন্সিবল সোর্সিং ইনিসিয়েটিভের দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে সাড়ে তিন হাজারের মতো টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় রয়েছে প্রায় এক হাজার কারখানা। এনআরডিসির দেয়া হিসাবে এক টন পরিমাণ টেক্সটাইল পণ্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করতে গড়ে ২০০ টন পানির প্রয়োজন হয়। একদিনে সারাদেশের টেক্সটাইল বর্জ্যরে পরিমাণ গড়ে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৮ কিলোলিটার।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ গঠন এবং ১৯৭৭ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে। ১৯৮৯ সালে বন বিভাগ এবং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। ১৯৯০ সালকে পরিবেশ বর্ষ ও ১৯৯০-৯১ সালকে পরিবেশ দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত কর্মকৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে এবং তখন থেকে এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা (নিম্যাপ, ১৯৯১) প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় পরিবেশ নীতি (১৯৯২), জাতীয় পরিবেশ অ্যাকশন প্ল্যান (১৯৯২), বননীতি (১৯৯৪), বনায়ন মাস্টার প্লান (১৯৯৩-২০১২) ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) উল্লেখযোগ্য। জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (National Conservation Strategy) এবং বিশেষত জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা অ্যাকশন প্ল্যান সকলের সহযোগিতায় প্রণীত হয়েছে।
পৃথিবীতে ১৩০ কোটি মানুষ বিদ্যুৎ, প্রায় ৭৭ কোটি মানুষ বিশুদ্ধপানি এবং ২৫০ কোটি মানুষ উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত।
খাদ্য উৎপাদনের প্রধান উৎস পানি। পানি ছাড়া কৃষিখাত একেবারেই অচল। এক ক্যালরি খাবার উৎপাদনে এক লিটার পানি দরকার।বর্তমান বিশ্বে কৃষিখাতে পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ। এক কেজি চাল উৎপাদনে ৩,৫০০ লিটার এবং এক কেজি গরুর মাংসের জন্য ১৫,০০০ লিটার পানি ব্যয় হয়।যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ছে, সেহেতু খাদ্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ৬০ ভাগ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে ১০০ভাগ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অর্থ পানির ব্যবহারও বৃদ্ধি।
নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে কৃষিপ্রধান দেশও। বাংলাদেশে যদি এতো নদী ও জলাশয় না থাকত, তবে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হতে পারত না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনও সম্ভব হতো না। অন্যদিকে এসব নদী, নালা, খাল-বিল মৎস সম্পদেরও আঁধার। অর্থাৎ, খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টি ঘাটতি দূর করতেও পানির গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশ পানিনির্ভর একটি দেশ। একসময় নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাই ছিল বাংলাদেশের প্রধান যাতায়াত মাধ্যম। কালের বিবর্তনে আমাদের বিধ্বংসী পরিকল্পনা, অজ্ঞতা ও লোভাতুর দৃষ্টিভঙ্গি নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। নদী শাসন ও নদী ড্রেজিং এর নামে প্রতিবছরই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু সে অর্থ পানির মত খরচই হয়, তার সুফল প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে বড়-বড় মালবাহী নৌ-জাহাজ আসত। কিন্তু নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়া এবং নদীর উপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে নীচু করে সেতু নির্মাণ করায় বড়-বড় নৌ জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বা মংলা সমুদ্র বন্দর এরপর আর আসে না। এতে মালামাল পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে, যা সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে।
মূলত, সড়কনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে নদীগুলোর উপর এমনভাবে সেতু তৈরি করা হয়েছে, যাতে ক্রমান্বয়ে নদী ধ্বংস হয়েছে। এতে একদিকে শুস্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় বড় বড় নৌজাহাজ গুলোর আসা বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে নীচু সেতু’র কারণে হওয়ায় বড় বড় জাহাজগুলো আসতে পারে না।
শুধু নৌ যাতায়াত নয়, অনেক অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ খাবার পানিসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। বৃহত্তর রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলায় ভূগর্ভে পানির স্তর অনেক নীচে নেমে যায়। এ সময়ে অনেক টিউবওয়েল-এ পানি আসে না। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে ক্রমশ গভীর থেকে গভীরে যেতে হচ্ছে। মূলত, ভূ-উপরিভাগের জলাশায় (পুকুর, নালা, ডোবা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, নদনদী, ইত্যাদি) দখল ও দূষণ, ভরাটের শিকার হয়ে সংকুচিত বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে বা নীচে যাবার সুযোগ পাচ্ছে না।
ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ ও নদীর গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে ২১ বার নদীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন_ সূরা বাকারার ২৫, ৭৪, ২৬৬; সূরা আলে ইমরানের ১৫, ১৩৬, ১৯৫, ১৯৮; সূরা নিসার ১৩, ৫৭ ১২২; সূরা মায়িদার ১২, ৮৫, ১১৯; সূরা আরাফের ৪৩; সূরা তাওবার ৭২, ৮৯, ১০০; সূরা ইউনুসের ৯; সূরা রাদের ৩৫; সূরা ইবরাহিমের ২৩ ও সূরা নাহলের ৩১ নম্বর আয়াতে।
একটি আয়াত ছাড়া প্রায় সব আয়াতেই নদীর সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতদ্বয় দ্বারা বোঝা যায়, জান্নাতের পবিবেশ সুন্দর ও স্বচ্ছ করার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বাগিচায় নদী রাখবেন। নদী এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই পৃথিবীতেই শুধু নয় পরকালে এমনকি জান্নাতেও নদীর দেখা মিলবে।
বর্তমান বাস্তবতা
উন্নয়নের পরিবেশ বিধ্বংসী ধারাকে থামাতে হবে। পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডকে রুখে দিতে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে সক্রিয় করতে হবে। নদী ভরাটের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণকে আরো সচেতন করতে হবে। নিজ নিজ উদ্যোগে নদী ও পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।পরিবেশ রক্ষায় সরকারকেও আইনি শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। যাতে ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষায় বা আর্থিক লাভের জন্য পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।
সব ধরনের উন্নয়ন, উপার্জনের কেন্দ্রবিন্দু করা হচ্ছে ঢাকা নগরীকে। ফলে জমির দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে, হাউজিং কোম্পানিগুলো জলাশয় ভরাট করে অ্যাপার্টমেন্ট বানাচ্ছে। যেটুকু জলাশয় এখনও দেখা যায় সেগুলো মূলত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। যে কোন অজুহাতে ঢাকা মহানগরীর নদী-খাল-লেক-জলাশয়, খোলা জায়গা, খেলার মাঠ ও পার্ক সমূহ দখলের চলছে মহোৎসব।
আশি’র দশকে উপকূল অঞ্চলে চিংড়ি চাষের পরামর্শ ও তার জন্য ঋণ সরবরাহ করে বিশ্বব্যাঙ্ক, আর এ উদ্দেশ্যে নদী-খাল লিজ প্রদান শুরু করে জেলা প্রশাসন, যে নীতি পরবর্তিতে সারাদেশেই গ্রহণ করা হয়। নদী-খাল লিজ নিয়ে সেগুলি বাঁধ দিয়ে আটকে মাছের ঘেরে পরি নত করে লিজ গ্রহণকারীরা, যা কখনও জেলাপ্রশাসন দেখভাল করে নি, বরং অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছে। আর এ ভাবে প্রায় তিন দশকের ব্যাবধানে আজ সারা দেশের নদী-খাল শুকিয়ে মৃতপ্রায়।
পরিবেশ অধিদফতরের নাকের ডগায় শত শত শিল্প-কলকারখানা থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হওয়া শিল্পবর্জ্য ও নানা রঙের দূষিত পানি আছড়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের ।এক সময়ের স্বচ্ছ পানি প্রবাহের বুড়িগঙ্গা এখন আর চেনার উপায় নেই। বুড়িগঙ্গার বুকজুড়ে এখন শুধু কালো আলকাতরার মতো ছপছপ ক্ষত চিহ্ন। কোথাও তা দুর্গন্ধময় রঙিন পানিতেও রূপ নিয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে- বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর পানিতে পাওয়া গেছে অ্যামোনিয়া, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম হাইড্রো অক্সাইড, সালফিউরিক এসিড, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, তামা, দস্তা, আর্সেনিক, ব্রোমিন, সিসা, নিকেল, স্ট্রংশিয়াম, ক্যাডমিয়াম, রবিডিয়াম, থ্যালিয়াম ও ক্রোমিয়াম। সরকারি হিসেবে বুড়িগঙ্গার পানিতে প্রতিদিন যে পরিমাণ দূষিত পদার্থ পড়ছে তার ৬০ শতাংশই শিল্প বর্জ্য। এর ফলে নদীতে ভয়াবহ দূষণ ঘটেছে।
শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জেও শিল্প দূষণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। শীতলক্ষ্যায় ভয়াবহ দূষণ এক নির্মম বাস্তবতা। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে শীতলক্ষ্যার পাগলা পয়েন্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি আর শোধন করতে পারছে না ঢাকা ওয়াসা।
শিল্প বর্জ্যরে কারণে ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার খাল-বিল, পুকুর এমনকি ফসলি জমিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এলাকাবাসী বলছেন, এ ভয়াবহ দূষণ রোধ করতে পরিবেশ অধিদফতরের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ঢাকা ওয়াসার প্রধান তথ্য কর্মকর্তা জাকারিয়া আল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে শীতলক্ষ্যা থেকে আনা পানিতে তিনগুণ ক্লোরিন দিয়েও পরিশোধন করা যায় না। পানিতে স্বল্প হলেও দুর্গন্ধ থেকে যায়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ১৭টি পরিবেশবাদী বেসরকারি সংস্থার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ এ তিন নদী আজ বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত, দুর্গন্ধময়, অপরিষ্কার ও হতশ্রী নদীগুলোর অন্যতম। এ তিন নদীর পানি দিন দিন হয়ে যাচ্ছে আলকাতরার মতো কালো, ঘন ও আঠালো। এ পানিতে গোসল করলে চর্মরোগ দেখা দেয়। পানি পান করার ফলে প্রতি বছর শত শত মানুষ জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অকালে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশের ৯০ ভাগ পানির ব্যবহার নাই। দীর্ঘদিন নদ-নদীগুলো ড্রেজিং করা হয় না। আর তাই নদ-নদীগুলোর নাব্যতা নাই। আর নদীগুলো আর মানুষের ব্যবহারযোগ্য নাই। পড়েছে দখল ও দূষণের কবলে। একদিন যে নদীকে ঘিরে ঢাকা মহানগর গড়ে উঠেছিল, সেই নদীকেই মেরে ফেলেছে অপরিকল্পিত কথিত উন্নয়ন, শিল্পবিকাশ ও নাগরিক সভ্যতা।
শিল্প বর্জ্য দূষণ এখন নদীর প্রাণহরণের বড় কারণ। ঢাকার চারপাশে ঘিরে থাকা বৃত্তাকার পথের পাঁচ নদী তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরীর মৃতদশা প্রমাণ করে রাষ্ট্রাচার কি বৈকল্যমান দুর্বৃত্তায়নকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বড় বড় দুর্বৃত্তরা বড় বড় নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে স্থাপনা গড়ে তুলেছে। ‘ঢাকার নদী দখল ও দূষণ’ মডেল হিসেবে দেখা দিয়েছে সারা দেশে।
নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সেচ ও পানীয় জলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় আর্সেনিকে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলকার মানুষ। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে দেশের মৎস্যসম্পদ ও নৌপরিবহনে।
আমাদের প্রত্যাশা
বাংলাদেশ হবে পরিবেশবান্ধব আধুনিক এক দেশ। আমরা আমাদের শস্য শ্যামল জলায়জ শীতল সুপেয় পানির গ্রাম বাংলাকে ফিরে পেতে চাই।
পৃথিবী নামক এ বসুন্ধরার প্রকৃতি ও পরিবেশ সুন্দর করার জন্যও নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী আল্লাহ তায়ালার অমূল্য সৃষ্টি। মহান আল্লাহ তায়ালা নদী দিয়েছেন মানুষসহ সব সৃষ্টি জীবের ব্যবহারের জন্য।
নদীর পানিতে গোসল করবে, নদীর পানি পান করবে, নদী দিয়ে নৌকা বেয়ে মাছ শিকার করবে, নদীর বুক চিরে বড় বড় জাহাজ, স্টিমার দিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে জীবিকার সন্ধানে সফর করবে। নদীর পানি দিয়ে মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য ধান, গম ইত্যাদি চাষ করবে ইত্যাদি।
আমাদের করণীয়
নদী, জলাভুমি দখল ও দূষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন , নৌপথকে সচল করতে নদীগুলোতে ড্রেজিং , সকল নদী ও জলাভূমি সি এস ম্যাপ অনুযায়ী খাসজমি হিসেবে অক্ষুন্ন , আর এস বা এস এ ম্যাপে খাসজমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে দেখালে তা বাতিল , জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে নদী ও জলাভূমির সকল প্রকার লীজ প্রদান বন্ধ , গ্রামাঞ্চলে নদী দূষণ রোধের জন্য ফসলে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার , প্রাকৃতিকভাবে কীট ধ্বংসকারী পাখীদের আবাস স্থল সংরক্ষণ , মহানগরীর নদী ও জলাভমির দূষণ রোধ করার জন্য শিল্পবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ ও খুলনা-ঢাকা স্টীমার পুনরায় চালু করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রায়ই পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে সাধারণ জনগণের অসচেতনতাকে দায়ী করা হয়। দেশের মানুষের সচেতনতার ওপরও নির্ভর করে পরিবেশের সুরক্ষা।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, নদীর সীমানা কমিয়ে সেসব জায়গা দখল করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে লেনদেন হচ্ছে । নদীর প্রবাহ বন্ধ করে যে সমস্ত বাড়ী করা হয়েছে তা অপসারণ করতে হবে। গায়ের জোরে নদীকে মেরে ফেলা অপরাধ। এটা করা যাবে না। নদীর ভেতর খুঁটি গেঁড়ে নদীগুলো দখল করা হচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় আইন ও পদ্ধতির প্রণয়ন, ও এগুলোর প্রয়োগ
বাংলাদেশের জলাভূমি, বনভূমি ও পাহাড় রক্ষায় পর্যাপ্ত আইন রয়েছে।
নদী রক্ষায় তেমন কোনো আইন না থাকলেও যেসব প্রতিষ্ঠানকে নদী রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যদি প্রত্যয়ী হয় তাহলে দেশের নদীগুলো রক্ষা করা সম্ভব।
রুখে দাঁড়াতে হবে বিবিধ স্বেচ্ছাচারী পরিবেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে। যার যার জায়গা থেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সচেতন হতে হবে।
দেশের মানুষের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও মানসিকতার সঙ্গে দেশের পরিবেশেরও গভীর যোগাযোগ রয়েছে। পরিবেশের দূষণকে এখনই ঠেকানো হবে।
শেলা নদীতে যে তেল ডুবির ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
বিশ্ব ঐতিহ্য পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ১৯৯২ সালে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে বিশ্ববাসীর জন্য এক চরম উদ্বেগের বিষয়।
বিভিন্ন অজুহাতে সুন্দরবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। একদিকে যেমন সুন্দরবনের জমি দখলের চক্রান্ত, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন। অবিলম্বে সুন্দরবনে জীব বৈচিত্র রক্ষার্থে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করতে হবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর প্রধান সমস্যা হচ্ছে দখল এবং দুষণ। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় বুড়িগঙ্গা দুষণের ৬০% হচ্ছে শিল্পবর্জ্য থেকে। ৩০% হচ্ছে ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারী প্রতিষ্ঠানের ডামপিং থেকে। আর মাত্র ১০% দায়ী হচ্ছে জনসাধারণ। অবিলম্বে সুন্দরবনে জীব বৈচিত্র রক্ষার্থে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করতে হবে। ধানমন্ডি মাঠসহ দেশের সকল খেলার মাঠ দখল মুক্ত,দুষণ মুক্ত, জন সাধারনের জন্য উন্মক্ত এবং খেলার উপযোগী মাঠ নিশ্চিত করতে হবে।
সুশাসন ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করা
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের পানি খাত অনেক জটিল এবং এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কমপক্ষে ১৩টি মন্ত্রণালয় যুক্ত। যদি পানি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন ও শুদ্ধাচার নিশ্চিত করা না যায় তাহলে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্প উন্নয়ন, বস্তুসংস্থানসহ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হবে।’
দূষণ রোধ ও অবৈধ দখলমুক্ত করা
টিআইবি ও বাউইনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো— বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩-এর আশু বাস্তবায়ন করা, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পানি সম্পর্কিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা, নদীতে বেআইনি দূষণ রোধ ও অবৈধ দখলমুক্ত করা, শিল্পবর্জ্য নির্গমনের বিধিমালা তৈরি করা, পানি সম্পদের অপব্যবহার রোধে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতা শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রমুখ।
পরিবেশবান্ধব নীতিমালা ও জনস্বার্থ সুরক্ষা
নদীকে স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে। গাছ কাটা,পাহার কাটা,পাথর উত্তোলন,কৃষিতে ব্যাপক রাসায়নিক সার ব্যবহার, বন উজাড়করণ বন্ধ করতে হবে। নদী পরিবেশ ধ্বংসকারী টিপাইমূখ বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, ফারাক্কা,তিস্তা এ বিষয় সমুহ নিয়ে ভারতের সঙ্গে পানি বন্টন সংক্রান্ত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে।
পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ আইন,জলাধার সংরক্ষন আইনসহ পরিবেশ সংরক্ষনের জন্য যে সমস্ত আইন রয়েছে তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি সমন্বিত জাতীয় জ্বালানী নীতি প্রণয়ন করে এর আওতায় পরিবেশবন্ধব ও জনস্বার্থের পরিপুরক কয়লানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
নাগরিক আন্দোলন ও আইনের প্রয়োগ
নদী উদ্ধারও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষের উপর বহুমুখী চাপ অব্যাহত রাখতে নাগরিক আন্দোলন প্রয়োজন। নদীগুলোর ব্যাপারে নিজস্ব নথিপত্র প্রণয়ন ও তথ্যভান্ডার গড়ে তোলায় মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ সংরক্ষণ ও আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ২০০০ সালের জলাধার আইন অনুসারে জলাশয় ভরাট ও নদী ভরাট বেআইনি। এ আইন অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
সরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিক ব্যবস্থা গ্রহণ
ঢাকার চারপাশের চার নদী বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশনা দেন। পটুয়াখালীর গলাচিপার রামনাবাদ নদীতীর ভরাটের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৪ মে হাইকোর্ট নির্দেশনা দেন। ২০১২ সালে কপোতাক্ষ নদ ভরাটের ওপরও হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেন। ২০১০ সালে কর্ণফুলী নদী দখলমুক্ত করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। পাবনার বেড়া উপজেলার ইছামতি নদীর তীর দখলমুক্ত করতে ২০১৩ সালে নির্দেশনা দিতে হয় হাইকোর্টকে।
কিন্তু এখনো দখলমুক্ত হয়নি সে জায়গা। এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আদালতের আদেশ দিয়ে নদী রক্ষা করা যাবে না। আন্তরিক হতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থাকে। দূষণমুক্ত করার জন্য শিল্পবর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর নদীর তীর রক্ষায় দখলমুক্ত করতে হবে।
উপসংহার
নদী হচ্ছে একটি জাতির সভ্যতা ও অস্তিত্বের অংশ। নদী না বাঁচলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। দেশ-মাটি ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ব সবার। তাই এ দায়িত্ব সবাইকে পালন করা উচিত। নদী রক্ষায় আমাদের আরো সোচ্চার হতে হবে। দখলদারদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে। সুইডেনের স্টকহোমে ৭ দিন ব্যাপী World Water Week-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে, “আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা যখন আরো ৩০০ কোটির মতো বেড়ে যাবে তখন পানি সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হল নদী আর এর জন্যই এদেশের জমি যথেষ্ট উর্বর৷ অথচ এই নদী খাতের এমন দুর্বাবস্থা নজিরবিহীন। সুস্থ জীবনযাপন, বিশুদ্ধ পরিবেশ, স্বাস্থ্যবান সন্তান-সন্ততি এবং সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গেলে আমাদের পরিবেশ ও নদীগুলোর কথা ভাবতেই হবে। আমাদের নদী ও পরিবেশকে বিপন্ন রেখে আমরা কিছুতেই উদ্বেগ উৎকন্ঠামুক্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না।
নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। নদীকে বাঁচাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের নদ-নদী, ও পরিবেশ রক্ষার কাজ কোন অংশেই মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে কম গুরত্বপুর্ণ নয়। আমাদের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে না পারলে আমাদের অস্তিত্বের বিলয় ঘটবে। একের পর এক এভাবে আর কোনো নদীর মৃত্যু হোক তা আমরা আশা করি না, এটা অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। নদী বাঁচানোর জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।