ধর্ষণকে না বলুন, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন

ধর্ষণ প্রতিরোধ কীভাবে? ধর্ষণের ঘটনার সম্ভাবনা আছে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা উচিৎ। যেমন, অপরিচিত ব্যক্তি, অনিরাপদ/ নিরিবিলি স্থান। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তির যৌন উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করা এবং সে অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রস্থান করা, দৌড়ানো এবং যত জোরে সম্ভব চিত্কার করে আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার।ইলেকট্রনিক বিপদসঙ্কেত যন্ত্র বা বিশেষ বাঁশি বহন করা যা উচ্চৈঃশব্দে আওয়াজ তৈরি করতে পারে এবং প্রয়োজনে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।

মরিচ গুঁড়া/ ঝাঁঝালো স্প্রে, প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষামূলক হাতিয়ার সঙ্গে রাখা এবং প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করা। যেমন, আশে পাশে পর্যবেক্ষণ করে পরিকল্পনা এবং করণীয় ঠিক করা। আক্রান্ত হবার আগেই চাবির গোছা, ব্যাগ বা হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে আক্রমণকারীকে আঘাত করা, কারাতে কৌশল জানা থাকলে তা প্রয়োগ করা ইত্যাদি। পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য সবসময় বিকল্প পরিকল্পনা করতে হবে।

ধর্ষণের পর ভিকটিমের যা করণীয় –১. ধর্ষণের পর একা থাকবেন না, কোনো বান্ধবী বা আত্মীয়ার সাথে যোগায়োগ করুন, ঘটে যাওয়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলুন এবং তাঁর সাহায্য নিন৷ ২. গোসল, খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়া – সম্ভব হলে এ সব বন্ধ রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে চলে যান৷ অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে যাবার আগেই ডাক্তারি পরীক্ষা করান৷ ৩. হাসপাতালে যাওয়ার পর যদি ‘এমারজেন্সিতে’ কারো সাথে এ বিষয়ে কিছু বলতে না চান, তাহলে শুধু ‘আমাকে এক্ষুনি একজন স্ত্রী বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে হবে’– এ কথা বললেও চলবে৷ ৪. ধর্ষণকারী যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, তার সব তুলে রাখুন৷ যেমন অন্তর্বাস, প্যাড ইত্যাদি৷ সম্ভব হলে এ সব জিনিসের ছবিও তুলে রাখুন৷ ৫. নিজেকে দোষী ভাববেন না৷ কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে, শুধু সে একাই এর জন্য দায়ী, অপরাধী৷ আপনি নন৷

ধর্ষিতাকে যেভাবে সহায়তা করবেন- আপনার পরিচিতি বা প্রতিবেশী কেউ যদি ধর্ষণের শিকার হন তখন ধর্ষণের ঘটনাটি নির্ভরযোগ্য কাউকে জানান যিনি নির্যাতিতাকে মানসিক সাহস দিতে পারবেন। সাক্ষী হিসেবে কাজে লাগানো যায় এমন কোনো বিশ্বস্ত মানুষকে জানান সে আত্মীয়, বন্ধু, পুলিশ, চিকিৎসকও হতে পারেন। দ্রুত নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করে অভিযোগ জানান। অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ‘মেডিকেল টেস্ট’ ডাক্তারি পরীক্ষা করালে – ধর্ষকের কোনো অসুখ ছিল কিনা বা সে এইচআইভি আক্রান্ত ছিল কিনা জানা যাবে, ধর্ষণের ফলে কোনো নারী গর্ভবতী হলে, সেটা দ্রুত আটকানোর পন্থাও (একটা সাধারণ ট্যাবলেটের মাধ্যমে) নেওয়া সম্ভব হবে৷ সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মেডিকেল পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হয় এবং তা বিনামূল্যে হয়। পরবর্তী চিকিৎসাও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে হয়। কোনোভাবেই নির্যাতিতাকে গোসল করে আলামত নষ্ট করতে দেবেন না। তাতে শারীরিক আলামতগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি পরনের কাপড়ও পরিষ্কার করা যাবে না। কাপড়গুলো পলিথিনে রাখা যাবে না বরং সেগুলো কাগজের ব্যাগে বা কাগজে মুড়িয়ে থানায় নিয়ে যেতে হবে। একজন ধর্ষিত মেয়ে যদি তাৎক্ষনিক কোন সহায়তা পান, তাহলে তার শরীর এবং পোষাক থেকেই অপরাধী সনাক্তকরন এবং প্রমানের জন্য যথাযথ আলামত সংগ্রহ করা যাবে। যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনিই মামলার প্রধান সাক্ষী। তাঁর জবানবন্দি পুলিশকে গ্রহণ করতে হবে। তবে কোনো ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি বাধ্য নন।

কোথায় আইনি সহায়তা পাবেন? প্রথমেই ভিকটিম পুলিশের কাছ থেকে সব রকম সহায়তা পাওয়ার অধিকারী। জেলা জজের আওতায় প্রতিটি জেলায় আইন সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে আবেদন করলে ভিকটিম আর্থিক অথবা আইনজীবীর সহায়তা পেতে পারেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে শেল্টার, আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। থানায় এবং হাসপাতালে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে’ আইনগত ও চিকিৎসা পেতে পারেন। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা একজন নির্যাতিত নারীর পরিচয় গোপন রেখেই তাকে ন্যায় বিচার, ধর্ষণ পরবর্তী শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা এবং আইনগত সুবিধা দেয়ার কাজ করে। এই ক্ষেত্রে মায়া ভয়েস এর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড ডায়াসপোরা ফিলানথ্রোপি অর্গানাইজেশন আছে নাম দৃষ্টিপাত, এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।

ধর্ষণ কেন ঘটে? ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় রয়েছে পর্নগ্রাফি। ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে একজন মানুষ যখন পর্নগ্রাফি দেখে, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে হরমোন নিঃসরণ হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যৌনাচারে উৎসাহিত হয়। এমনও হয় প্রেমিক-প্রেমিকা ডেটিংয়ে গেছে, প্রেমিকার আড্ডা-আলাপ লক্ষ্য; কিন্তু পর্নগ্রাফিতে আসক্ত প্রেমিক জোর করে, যা অনেক সময় প্রেমিকার শরীর আর মনের বিরুদ্ধে যায়। এমন অনেক মাদক রয়েছে যা সেবীকে যৌনতায় প্রবৃত্ত করে। কিছু কিছু অশ্লীল নাটক, চলচ্চিত্র, গান ব্যক্তিকে ধর্ষণে উৎসাহিত করে। একান্ত সময় কাটানো ও নিরিবিলি পরিবেশও যৌনতায় প্রলুব্ধ করে। পারিবারিক-সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ না থাকলে কৌতুহল মেটাতে বা সাময়িক আনন্দ উন্মাদনায়ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে।

ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে- পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করুন। সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা দূর করুন। অশিক্ষা- কুশিক্ষা নয়, সুশিক্ষিত হোন। দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্যোগী হোন। কর্মব্যস্ত থাকুন, কর্মব্যস্ত রাখুন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করুন, ধর্ষকের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত দিন। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা বাড়ান, সুষ্ঠু ধারার বিনোদন নিশ্চিত করুন। কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকাণ্ড বাড়ান। ধর্ষককে সামাজিকভাবে বয়কট করুন, ধর্ষকের প্রতি সর্বোচ্চ ঘৃণা সৃষ্টি করুন। পারিবারিকভাবে বিবাহযোগ্যদের দ্রুত বিয়ে দিন। আইন প্রণয়ন, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করুন। নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করুন এবং ধর্মীয় শিক্ষার ওপর জোর দিন। পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার চেতনাবোধ জাগ্রত করুন। সচেতন নাগরিকরা ঐক্যবদ্ধ হোন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। মিডিয়ায় ধর্ষণ বিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালান। ধর্ষকদের পক্ষে আদালতে লড়ার মানসিকতা আইনজীবীরা বাদ দিন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালান, রাজনৈতিক বিবেচনায় সুবিধা দেয়া যাবে না। ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু ধর্ষণ হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত কারো দ্বারা, এবিষয়ে মা-বাবারা সচেতন থাকুন।

নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোন। ধর্ষণের ঘটনায় আপস-মীমাংসা করবেন না, ধর্ষককে ছেড়ে দিবেন না। হাসপাতালে ডিএনএ পরীক্ষাসহ ধর্ষণের চিহ্ন নিশ্চিত করার বিশেষ কিছু ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে ধর্ষককে নখের আচড় বা খামচি দিলে নারীর নখ কেটে পরীক্ষা করেও ধর্ষককে চিহ্নিত করা যায়৷ অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার রোধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত ছেলের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্ক থাকতে হবে।ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটে কোন সাইট দেখছে, কাদের সাথে মিশছে- এ ব্যাপারে অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে হবে, এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ভাঙতে পুরুষদের সঙ্গে নিয়েই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার এবং নারীদের সচেতনতাও বাড়াতে হবে। হোটেল, রেস্তোরাঁগুলোতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরদারি বাড়াতে হবে। কখনোই কোন ধর্ষণের ঘটনায় আপোষ মিমাংসা করা যাবে না।

ভিকটিমের সাথে আচরণে সতর্কতা অবলম্বন করুন। ভিকটিমের প্রয়োজন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷ ধর্ষণের শিকার নারীকে সহানুভূতির সাথে সহযোগিতা করা একটা মানবিক দায়িত্ব। ভুক্তভোগীর শারীরিক ও মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে এবং আইনী সহযোগিতা পেতে আত্মীয়, বন্ধু এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর পক্ষ থেকে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা অত্যাবশ্যক। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক চাপের কারণে ভুক্তভোগীর মানসিক বিপর্যয় না ঘটে। এ বাধা দূর করতে ধর্ষণের শিকার নারীর কঠোর নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা নিশ্চিত করা অতি জরুরি। তার পরিচয়মূলক তথ্য কখনোই প্রকাশ করা যাবে না। প্রয়োজনে গোপনীয়তার আইন সংশোধন করে কঠোর করতে হবে। নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা নিশ্চিত হলে ভুক্তভোগী স্বস্তির সাথে বিচারের জন্য, শারীরিক ক্ষতি এবং মানসিক বিষণ্নতা দূর করতে সাহায্যপ্রার্থী হবে।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *