দুরন্ত সময়ের যাত্রা বলিষ্ঠ পথে

গ্রামের পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে, গাছে-বাঁশে কাটানো শৈশব বেশ মজার ছিল! গাছে ওঠে আম পাড়ার আনন্দই ছিল আলাদা! এমন কখনো হয় না যে- মন গ্রামের সবুজ প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চায় না! যত বার যাই, ততই যেতে ইচ্ছে করে! যত দেখি ততই মুগ্ধ হই! আনমনে বসে থাকায় তৃপ্তি, নির্মল বাতাস টেনে বুক ভরায় সুখ! তবু শহরে চলে আসতে হয় শরীর নিয়ে, কিন্তু গ্রামে পরে থাকে মন!

ছেলেবেলার টুকরো স্মৃতি

ছেলেবেলার দিনগুলি ছিল নানা রঙের, নানা উচ্ছ্বাসের! হারিয়ে যাওয়া টুকরো স্মৃতি নিয়ে পথ চলি আজও। চলতে চলতে মনের গভীরে মৃদুস্বরে বেজে চলে পাখির কলরব, বর্ষায় মনকে শীতল করে তোলা পানির স্রোতের উথাল-পাথাল ঢেউ।

 হারিয়ে যাওয়া অতীত

কখনো নীরবতায় চোখ দুটো বন্ধ করে হারিয়ে যাই অতীতের সেই দিনগুলোতে! অনেক স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে থাকা কত মুখ! হৃদয়ের গভীরে বহুকাল ধরে ঘুমিয়ে থাকা কত দৃশ্য! অমলিন হয়ে থাকা জীবনের মুহূর্তগুলো!

পথিকের হেঁটে যাওয়া দেখতে চর্মচোখের দরকার পড়ে, কিন্তু জীবনের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তের অনন্তের দিকে হাঁটা দেখতে হলে অন্তর চোখের প্রয়োজন হয়! চলমান জীবনের বহমান ধারায় কেউ আসে, কেউ যায়! নতুন গতি চালু হয়, পুরাতন গতি থেমে যায়!

উপলব্ধির ভিন্ন মোড়

সময়ের ব্যবধানে উপলব্ধিও ভিন্ন বাঁক নেয়! সময়চক্রে কত অনুভবও ভিন্ন মোড় নেয়! জীবনে চলার বেগ কখনো বাড়ে, কখনো কমে! কখনো সন্দেহ দানা বাঁধে, কখনো বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়! কখনো যাকে অপরিহার্য মনে হয়, কখনো তার থেকে দূরত্ব বাড়ানোই অনিবার্য হয়ে ওঠে!

সাধারণত সুখের সময়গুলো দ্রুত বেগে বয়ে চলে, আর দুঃখের সময়গুলো বড্ড ধীরে বয়ে চলে! প্রকৃত মানুষের কাছে- সৃষ্টির জন্য ভাঙাও আনন্দের, আর ধ্বংসের জন্য গড়াও নিরানন্দের! যখন আবেগ সামনে এসে বিবেককে পেছনে ঠেলে, তখনই মানুষ ধীরে ধীরে মনুষত্ব হারাতে থাকে!

মনের ভ্রান্ত অনুভব

মনের ভ্রান্ত অনুভব সাময়িক স্বস্তি কিংবা অস্বস্তি যাই বয়ে আনুক না কেন, সত্যের উপলব্ধি ঠিকই দীর্ঘমেয়াদে প্রশান্তি নিশ্চিত করে। অধিকার হরণ করা যতটা ঘৃণার, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ততটাই প্রশংসার!

আধিপত্য যখন হয় জবরদস্তিমূলক, সাম্যের চেতনা তখন পটল তোলে! চিন্তা-চেতনা যদি হয় সংকীর্ণতায় ভরা, চলায়-বলায় উদারতা আশা করা তখন বোকামি! নীরবতা-নিঃস্তব্ধতা যেখানে উচ্চকণ্ঠের চেয়ে শক্তিশালী হয়, স্বাভাবিক পরিবেশ সেখানে বজায় থাকে না!

জীবনে চলার পথে বাঁকে বাঁকে

জীবনে চলার পথে বাঁকে বাঁকে পাওয়া শিক্ষা যখন কাজে লাগে তখন অভিজ্ঞতার মূল্য হয় অনেক বেশি! আর ক্ষণে ক্ষণে রূপ-বৈচিত্র্য পাল্টানো কোনো গাঢ় ছাপ ফেলে না, চেনা-জানার পরিসরও বিস্তৃত করে না।

কারো উন্নতি তাকে টেনে পেছনে নেয় আবার উন্নতি কাউকে আরো সামনে এগিয়ে দেয়! এমনটি ঘটে- নিজের অবস্থার পরিবর্তন বা পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারা বা না পারার কারণেই!

মানুষ মায়াজালে পড়ে আবার মায়াজাল ছিন্নও করে! মূলত বুদ্ধিমান-সাহসীরাই ঝাপসা-অস্পষ্ট মসৃণ পথে হাঁটার চেয়েও সঠিক-স্পষ্ট বন্ধুর পথে হাঁটতেও স্বাচ্ছন্দবোধ করে!

কিছু প্রিয় সময় বা ভালোলাগার মুহূর্ত

আপন রেখা যখন স্বার্থের কারণে পর হয়ে যায় কিংবা বর্তমানের দোরগোড়ায় যখন অতীত এসে ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দেয়- তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না!

কিছু প্রিয় সময় বা ভালোলাগার কিছু অনন্য মুহূর্ত জীবনে আসে কিছু প্রিয় মুখের কম-বেশি অবদানেই। সেই অবদানকে অস্বীকার করা বা ভুলে যাওয়া শুধুমাত্র আমিত্বে আসক্তদের পক্ষেই সম্ভব! সময়ের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে অকৃতজ্ঞ হওয়া বা অকৃতজ্ঞ থাকা যৌক্তিক বিবেচনাবোধ সম্পন্নদের পক্ষে অসম্ভব!

ছোটবেলার স্মৃতি

আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে লুকোচুরি খেলা আছে, সত্য-মিথ্যার লড়াই আছে, বিজয়ী-পরাজিতের চিরচেনা রূপ আছে, সবল-দুর্বলের বাস্তবতার স্পর্শ আছে, আসা-যাওয়ার পাথেয় আছে, প্রাণসঞ্চারী জীবনবোধে বেঁচে থাকা আর প্রাণহরণকারী মরণবোধে পথ হারাতে দেখার দৃশ্য আছে!

স্মৃতিতে শুধু পূর্ণিমা রাতের স্নিগ্ধ আলোয় আকাশে জেগে থাকা অসংখ্য তারারাই নেই, আছে মনের আকাশে ঘুরে বেড়ানো কালোমেঘরূপী অমানুষদের পৈশাচিক কাণ্ডের বর্বরতাও!

শৈশব-কৈশরের দিনগুলো

এখন আর সবুজ ঘাসে ভরা মাঠে খালি পায়ে হেঁটে নরম ঘাসের স্পর্শে স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করা হয় না। ভোরের বাতাসে মাটির স্পর্শে যাওয়া হয় না। তবে হালকা বাতাসের ছোঁয়ার ঘাসের গন্ধ নাকে লাগলে যে নাড়ির স্পর্শ পাওয়া যায় তা অনুভব করা যায়!

ফুলের কুঁড়ি যেমন কোমল, ফসলি জমির সবুজ তেমন সুন্দর! তার চেয়েও বেশি সৌন্দর্য আমার কাছে তাদের- ছোটবেলায় যাদের হাত ধরে, আবার কখনো ঘাড়ে চেপে এখানে-সেখানে গেছি। বুকের ভেতরের শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রটায় এখনো শৈশবের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো আছে! ছোট চোখ দুটির দূরবীনে ধরে রাখা সাজানো দৃশ্যে কৈশরের দিনগুলো মহামূল্যবান!

জীবনস্মৃতির এ্যালবাম

জীবনস্মৃতির এ্যালবামে রয়েছে- বৃষ্টিতে ভেজা, কর্দমাক্ত মাঠে খেলা, মাটির আঁকা বাঁকা মেঠো পথে চলা, হলুদ সরিষা ফুলের ক্ষেতের পাশে হাঁটা, বর্ষার পানিতে নৌকা থেকে ফোঁটা শাপলা দেখা ও তোলা।

খেজুর রস ও গুড়

কুয়াশা চাঁদরে মোড়া শীতের সকালে মাটির হাড়িতে খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহকৃত সুস্বাদু খেজুর রসে গলা ভেজাতাম! উত্তাপে খেজুরের কাঁচা রস ঘন থেকে শক্ত পাটালিগুড়ে পরিণত হতো!

তবে এই পরিবর্তনের নানা ধাপে স্বাদেও ছিল ভিন্নতা! রসের রং লালচে হতে শুরু করলে ও টেনে আসলে একরকম, আর উত্তপ্ত রস শীতল করলে আরেকরকম! বাজার থেকে কিনে খেয়ে সেই বৈচিত্র্য স্বাদ আস্বাদন অসম্ভব।

আখ ও আখের গুড়

তখন জমিতে আখ চাষ হতো। আখকে দাঁত দিয়ে ছিলে চিবিয়ে মিষ্টি রস বের করে কাঁচাই খেতাম। যন্ত্রের মাধ্যমে আখ মাড়াই করে আখের রস বের করার পরেও খেতাম! টিনের তৈরি বড় খোলা পাত্রে ছেঁকে রেখে বড় একটি চুলায় আগুনে জ্বাল দেয়া হতো, টগবগ করে ফুটতো!

বাদামি রংয়ের ফেনা থেকে তৈরি আধরসি বা দানাদার ঝোলা গুড় মাটির হাড়িতে রাখা হতো! বড় বড় পাটালি গুড় তৈরি করা হতো! পুরো প্রক্রিয়াটা কৌতুহলী দৃষ্টিতে নিবিড়ভাবে দেখতাম, মিষ্টি গন্ধে বিমোহিত হতাম, আর নানা ধাপের নানা স্বাদ নেয়ার সুযোগও পেতাম! আখের ছোবড়া শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হতো।

পাটশাক পাটখড়ি ও পাটের আঁশ

তখন পাট চাষ হতো। পাট শাক খেতাম। জলাশয়ে পঁচানোর জন্য ছোটো ছোটো আটি বেধে রাখা হতো পাট! দাদীর সাথে বসে পাট কাঠি থেকে আঁশ ছাড়ানো, আঁশগুলো পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দেয়া, পাটখড়ি বা পাটকাঠি ও পাটের আঁশ বাড়িতে নিয়ে আসার স্মৃতি রয়েছে। পাটকাঠির ব্যবহার হতো- ঘরের বেড়ায়, ছাউনি তৈরিতে, জ্বালানি হিসেবে। পাটের আঁশ দিয়ে রশি তৈরি হতো।

ধান খড় ও  ঘাস

ধানকাটার স্মৃতি আছে! ধান ঘরে তোলতে মাথায় করে নিয়েও এসেছি! গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজে অংশ নিয়েছি। খড় শুকিয়ে গোখাদ্য হিসাবে মজুদ করায় সহযোগিতাও করেছি। ধানের খড় শুকিয়ে পালা দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতাও করেছি। গরুকে খাওয়ানোর জন্য বাঁকা চাঁদের মতো গঠনের হাতলওয়ালা কাস্তে দিয়ে ঘাস কেটেছি।

চাষবাস নয় পড়ালেখা

তবে অনিয়মিত এসব কাজ কখনই আমার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না! আমার চাষবাসে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস-ইচ্ছাও কখনো অভিভাবকদের মাঝে দেখা যায়নি! একমাত্র ও শুধুমাত্র পড়ালেখাটাই ছিল তখন অবধারিত কাজ!

তবুও কখনো শখের বশে, কখনো কৌতুহলবশত, কখনো আমি যে যথেষ্ট বড় হয়েছি সেই দাবির পক্ষে প্রমাণ হাজিরের অভিপ্রায়ে করেছি! তবে প্রবাসী বাবার বড় ছেলে হিসেবে মাকে পাশে থেকে সহযোগিতা করার দায়িত্ববোধও যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই সময় প্রভাব ফেলেনি- এমনটাও বলা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক হবে না!

শিক্ষকরা শ্রদ্ধেয়

শিক্ষকরা মানবাত্মা গঠনকারী মিস্ত্রী, তিল তিল করে ভবিষ্যতের জন্য নির্ভুলভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনকারী, জীবনে সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত বড় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তারকারী, মস্তিষ্ক থেকে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে সহায়তা দানকারী, সঠিক ভাবনা ও যথাযথ চিন্তা করায় সক্ষমতার উন্নয়নকারী, আলোকিত মানুষ তৈরির দক্ষ কারিগর।

শিক্ষকরাই অনুপ্রেরণার মূলচাবিকাঠি, উত্তম পথপ্রদর্শক, গুণ ছড়িয়ে দেওয়ায় দক্ষ, সফলতার শিখরে পৌঁছে দেয়ার সহযোগী। যারা আশা জাগান, স্বপ্ন দেখান, কল্পনা করতে শেখান, শেখার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করেন, মনকে উন্নত করেন এবং চরিত্রকে শক্তি দেন। তাই শিক্ষকরা সমাজের সর্বাধিক দায়িত্বশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। একজন ভালো শিক্ষক শুধু একজন মানুষকেই বদলে দেন না, একটি সমাজকে তথা পুরো বিশ্বকেও পরিবর্তন করতে পারেন।

বাবা-মা যেমন সন্তানদের ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করেন, ঠিক তেমনি প্রকৃত শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। তাঁদের শিক্ষার আলো যেমনি শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে আরও সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষার্থীদেরকে অনুসন্ধানী, সৃষ্টিশীল ও উদ্যোগী করে গড়তে শিক্ষকদের অবদান অপরিসীম।

শিক্ষক শিক্ষার্থীর জন্য পাঠ্যপুস্তকের মতোই। অনেক সময় পাঠ্যপুস্তকের চেয়েও শিক্ষকের কাছ থেকেই বেশি শিখেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনেন। সুন্দর মনের মানসিকতা গড়ে সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনয়নে ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। শিক্ষকের দক্ষতার কম-বেশি থাকতে পারে, তবে তাদের কারো ভূমিকাই সামান্য নয়! কারণ ভালো ছাত্র খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকেও অনেক বেশি শিখতে পারে।

শিক্ষকদের অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে মানব জাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদও (সা.) শিক্ষক হিসেবে গর্ব অনুভব করতেন। তিনি তার অন্যতম দোয়ায় বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি শিক্ষকদেরকে ক্ষমা করুন, তাদেরকে দান করুন দীর্ঘ জীবন।’ আমিও সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করছি- আমার শিক্ষকদেরকে তিনি উত্তম প্রতিদান দান করুন। যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানান। যারা জীবিত আছেন তাদের নেক হায়াত তথা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ দান করুন।

গ্রামীণ শিক্ষা অবকাঠামো

আমি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলাম তার অবকাঠামোর মজবুতি তখন ছিল না। তবে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ছিল, দরদ ছিল। চিন্তার উত্কর্ষ সাধন ও অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোকে বিকশিত করতে প্রচেষ্টা ছিল। শিক্ষার্থীরাও তখন শিক্ষকদেরকে বাবা-মায়ের মতোই যথেষ্ট সম্মান করতো, শ্রদ্ধা করতো। তারাও জ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করানোর পাশাপাশি মনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে উদ্যোগী ছিলেন।

ছোটবেলায় গ্রামীণ শিক্ষা অবকাঠামোকে যেমন দুর্বল দেখেছি তাতে তা গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার উপযোগী ছিল না। এখন হয়তো গ্রামেও শিক্ষাব্যবস্থা সেই সময়ের তুলনায় কিছুটা উন্নত ও আধুনিক হয়েছে; তবে বর্তমান অবকাঠামোও প্রয়োজনের তুলনায় নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া পাঠদান পদ্ধতিও ছিল খুব সাদামাঠা! ক্লাসরুমে প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করানোর ব্যবস্থাও ছিল না।

তখন খেলাধুলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছিল না, এমনকি আলাদা করে খেলাধুলা করার রুটিনও ছিল না। অবশ্য খেলাধুলার জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পর্যাপ্ত জায়গা না থাকলেও, আশেপাশে মাঠে শিক্ষার্থীরা ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলা করতো। প্রতিষ্ঠানের ছোট মাঠটিতেও বিকেলে ভলিবল খেলা হতো! স্বাভাবিক শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার জন্য যথাযথ পরিবেশ ছিল না। তারপরও সামাজিকীকরণে তা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল।

প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও সহশিক্ষা কার্যক্রম

তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকও হয়তো ছিল না। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক খুব বেশি পরিবর্তন হতো! অথচ ভালোমানের শিক্ষকের চেয়ে উত্তম ও মূল্যবান আর কেউ হতে পারে না। বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘যদি তুমি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাকো তাহলে মনে রাখবে তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিলো যে তোমাকে সাহায্য করেছিলো।’

যাতায়াত করার রাস্তা কাঁচা হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে যাওয়া-আসা করতে অনেক কষ্ট হতো। পাঠাগার-লাইব্রেরি বা আলাদা পড়ার স্থানের অস্তিত্ব ছিল না। বার্ষিকী বা দেয়ালিকা প্রকাশ করতেও দেখিনি! অথচ সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই দরকার! আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিশীল প্রকাশ এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত করা হলো শিক্ষকের সর্বপ্রধান শিল্প।’

শিক্ষার মান ধরে রাখা

আমার যতটুকু মনে পড়ে- শিশু শ্রেণিতে বসার মতো প্রয়োজনীয় বেঞ্চ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল থাকার কারণে চট বিছিয়ে লেখাপড়া করানো হয়েছে! অথচ প্রাথমিক শিক্ষা ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ধরে রাখতে অবকাঠামো পরিকল্পিত হওয়া খুব দরকার। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হওয়া দরকার।

সহপাঠীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়তে দেখতাম! অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক লেভেলেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা শিক্ষার সুযোগই পেতেন না। ২য় শ্রেণিতে আমাদের সহপাঠী কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল। গ্রামাঞ্চল থেকে এমনিতেও উঠে আসা কঠিন! জনি, সাত্তার, সালমা, লিটন, কালাম, জাকির, আলিম,মিন্টুসহ অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বানিজ শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়েছেন।

যদি বসার জায়গা থাকে অপ্রতুল, ভাঙাচোরা শ্রেণীকক্ষে গাদাগাদি করে বসতে হয়; তাহলে পড়াশোনার আগ্রহ কমে যায়! অথচ আমার মনে আছে- তখন ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির ক্লাস হতো মাটির তৈরি কোঠা ঘরে। ৩য় শ্রেণিতে কোঠা ঘরের বেড়া এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল যে- সেই ফাঁকা দিয়ে শিক্ষার্থীরা বাইরে-আসা যাওয়া করতো!

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *