প্রফেসর. ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তুরষ্কের প্রয়াত রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। এই মহান পুরুষ ছিলেন কর্মবীর, স্বয়ম্ভর তুরস্ক ও ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর স্বপ্নদ্রষ্টা, গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, দক্ষ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কুরআনের হাফেজ, আলেম ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা। তার সমৃদ্ধ গবেষণা তুরস্ক জাতিসত্তার এক অমূল্য সম্পদ। একদিকে সততা, অন্যদিকে দৃঢ়তা তাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম করে তোলে।
অনলবর্ষী বক্তার জাদুময়ী ভাষা ব্যবহার, যুক্তির অবতারণা ও স্বপ্ন দেখানোর যোগ্যতা জনগণের মনে জায়গা করে দেয় তাকে। তার্কির রাজনীতিতে ইসলামের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটির সম্মান অত্যন্ত বেশি। আস্তিক-নাস্তিক- জাতীয়তাবাদী সকলেই তাকে এরবাকান হোজা তথা এরবাকান উস্তাদ বলে। ক্ষমতায় থেকে হোক আর না থেকেই হোক কাউকে পরোয়া না করে মুসলিমদের সহায়তায় সর্বদা পাশে দাড়িয়েছেন এই কিংমেকার। সময়ের সাহসী অসাধারণ এই সংগঠক একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রেরণাদায়ক প্রতিষ্ঠান। ইনসাফ, ন্যায়নীতি ও উন্নয়নের পথে এগোনোর প্রেরণা।
প্রাথমিক জীবন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালে ১৯২৬ সালের ২৯ অক্টোবর উত্তর তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর উপকূল সংলগ্ন সিনপে এরবাকানের জন্ম। পিতা মোহম্মদ সাবরি এরবাকান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা; যিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হতেন। মায়ের নাম খায়ের।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
প্রাথমিক শিক্ষা কায়সেরি শহরে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে। গৃহশিক্ষকের কাছে পেয়েছেন ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ। ইস্তাম্বুল বয়েজ কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মেধা, মনন ও প্রতিভাগুণে অনেক শিক্ষক ডাকতেন ‘দরিয়া নাজমুদ্দিন’ বা ‘জ্ঞানের সাগর’ বলে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পুরো তুরস্কের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। ভর্তি হন ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং শিক্ষানবীশ শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
১৯৫১ সালে জার্মানির Aachen Technical University থেকে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। পুনরায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ইস্তাম্বুলেরই টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার আগে মাত্র ২৭ বছর বয়সে আর কোনো ভাগ্যবানের কপালে এমন কৃতিত্ব জোটেনি।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সালে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং পরবর্তী ৬ মাস লেফটেনেন্ট হিসেবে কাজ করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ কওে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং গুমুশ মোটর নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটাই ছিল সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি।
পারিবারিক জীবন: দাম্পত্য সঙ্গী নার্মিন এরবাকানের জন্ম ১৯৬৭ সালে এবং মৃত্যু ২০০৫ সালে। তাদের সন্তান জয়নাফ, এলিফ ও ফাতিহ।
রাজনৈতিক জীবন
নাজমুদ্দিন আরবাকান ছিলেন সংকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী এক মহান ও প্রজ্ঞাবান চিন্তানায়ক। বার বার তার পার্টিকে নিষিদ্ধ করলেও প্রতিবারই তিনি নতুন নামে পার্টি করে আইনসিদ্ধ পন্থায় পুনরায় তৎপরতা শুরু করেছেন।
আরবাকান ১৯৬৯ সালে সুলেমান দেমিরেলের আদালত পার্টি থেকে নমিনেশন চেয়ে পাননি। কিন্তু কোনিয়া থেকে নির্বাচন করে স্বতন্ত্র হিসেবে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।
প্রখ্যাত আলেম জাহেদ আহমেদ কুতকু এর পরামর্শে ১৯৬৯ সালে ১০ জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন অরাজনৈতিক দল মিল্লি গুরুশ (জাতীয় ভিশন) আন্দোলনের।
এরবাকান মিল্লি নিজাম পার্টি বা ন্যাশনাল অর্ডার পার্টির নেতৃত্ব দেন ২৬ জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে ২০ মে ১৯৭১।
মিল্লি সালামেত পার্টি বা ন্যাশনাল সলভেশন পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। আর দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০ অক্টোবর ১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
রাফাহ পার্টি বা ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতৃত্ব দেন ১১ অক্টোবর ১৯৮৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯৮ পর্যন্ত।
ফজিলত পার্টি বা ভারচু পার্টিও সাথে সক্রিয় ছিলেন ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত।
সা’দাত পার্টি বা ফেলিসিটি পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ২০০৩ সালের ১১ মে থেকে ২০০৪ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং ২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মিল্লি গোরুশ
তুরস্কে তখন ইসলামী অনুশাসনের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। মুসলমানরা নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করতো। আল্লাহর দেয়া ফরজ কাজসমূহ পালনের ক্ষেত্রে সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো। এরবাকান- সেই দুঃসময়কে পাল্টে দিতে চাইলেন। সময়ের বিপরীত স্রোতে চলার অবিচল মনোবল দেখালেন। তুরস্কের মানুষের ভেতরে ইসলামী ধ্যান-ধারণা জাগ্রত করার লক্ষ্যে কাজ করলেন। বৃহৎ তুরস্ক গড়ার লক্ষ্যে এবং জায়োনিজমের বিষদাত ভেঙ্গে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখলেন।
প্রখ্যাত আলেম জাহেদ আহমেদ কুতকু এর পরামর্শে ১৯৬৯ সালে ১০ জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন মিল্লি গুরুশ (জাতীয় ভিশন) আন্দোলনের। ‘মিল্লি গরুশ’ এর অর্থ ‘জাতীয় ভিশন’। ‘জাতি’ বুঝাতে তিনি তুরস্ক ও মুসলিম উম্মাহর মিশন-ভিশনকে এক করে দেখেছেন। লক্ষ্য ছিল, তারুণ্যের ভেতর জাগৃতির মন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া, আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া, জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পন্ন করা, উম্মাহর ঐক্য চেতনায় ভর করে সাম্রাজ্যবাদ ঠেকানো।
ওয়েলফেয়ার পার্টি
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হয় কল্যাণ পার্টি নামে একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল। আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে এটাই প্রথম ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত কোনও ইসলামিক রাজনৈতিক দলের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়। ইসলামী সংগঠন ‘মিল্লি গোরুশ’ এর রাজনৈতিক শাখা ছিল এ দলটি।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব
তিনি তুরস্কের উপ-প্রধামন্ত্রী ছিলেন- ১৯৭৭ সালের ২১ জুলাই থেকে ১৯৭৮ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত, ৩১ মার্চ ১৯৭৫ থেকে ২১ জুন ১৯৭৭ পর্যন্ত এবং ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৪ থেকে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৪ পর্যন্ত।
১৯৯৬ এর ২৮ জুন থেকে ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তুরষ্কের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন।
তুরস্কে ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তখনকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে স্মারকলিপি দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে তুর্কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রনীতিতে ইসলামপন্থী প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে তুর্কি সংসদ তাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় যেভাবে
ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ আর সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার না করেই অর্থাৎ প্রত্যক্ষ সামরিক শক্তি ব্যবহার না করেই প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে বন্দুকের নলের মাথায় সামরিক বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক পদচ্যুত হন, তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। উত্তর আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থান নামে পরিচিত এই অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রত্যক্ষ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছিল তখনকার গণমাধ্যম, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো।
এরবাকান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে কী ঘটল?
কল্যাণ পার্টিকে যথেষ্ট সেক্যুলার না হওয়ার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়।
এরবাকানসহ পার্টির নেতৃস্থানীয় বাক্তিদেরকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সেনা সমর্থিত নতুন সরকার ধর্মীয় মত প্রকাশের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই শুরু করে।
সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় রক্ষণশীল লোকদের বের করে দেয়।
ড্রেস কোড আইন কার্যকর করে। হিজাব পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হিজাব পরিহিত ছাত্রীদের ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। সাড়ে তিন হাজার নারী শিক্ষককে চুল ঢেকে রাখার জন্য বরখাস্ত করা হয়। এগারো হাজার শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তিনহাজার পাঁচশ সাতাশ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
সশস্ত্রবাহিনীর ধর্মীয় ভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের ব্যাপকহারে ছাটাই করা হয়। ওই সময় ১ হাজার ৬২৫ জন বাহিনীর সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়ে এবং আরও ২ হাজার ৫০০ জন অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সব সদস্যদের স্ত্রীদেরকে হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয়।
প্রায় এক হাজার মানুষকে ভুয়া অভিযোগে জেলে পুরে রাখা হয়। প্রায় ১ কোটিরও বেশি লোক এবং অনেক সিভিল সোসাইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।
পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে রজব তাইয়েব এরদোগানের নেতৃত্বে এরবাকানেরই দল থেকে বেরিয়ে আসা একদল লোক। আর তখন থেকেই শুরু বর্তমান ক্ষমতাসীন একে পার্টির অধ্যায়।
এরবাকানের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও অভিযোগ ছিল
এরবাকান ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রদায়, সামরিক ও গণমাধ্যম দেশটির মুসলিম পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করতে চায়। এরবাকান একটি রক্ষণশীল সামাজিক গোষ্ঠির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
এরবাকান মুসলিম দেশগুলিতে সফর করেছিলেন।
এরবাকান মুসলিম দেশগুলির মধ্যে জি-৭ এর আদলে বাংলাদেশসহ সাতটি উন্নয়নশীল মুসলিম দেশ নিয়ে ডি-৮ আন্তঃরাষ্ট্রীয় পারস্পারিক সহযোগী আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ গঠন করেন। প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির সাথে সখ্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশসমূহ সফর করে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
এরবাকানের দল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি ধ্বংস করতে চায়। এরবাকানের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতা বিলীন যাচ্ছে, দেশে শরীয়ত আসছে।
ধর্মীয় সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের জন্য পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের চেয়ও বড় হুমকি। গাজায় বিশেষভাবে সাহায্যকারী আলোচিত তুর্কি এনজিও আইএইচএইচ প্রতিষ্ঠা করেন।
শরিয়তভিত্তিক সরকার কাঠামো গঠন করবেন এবং সেভাবেই দেশ চালাবেন।
এরবাকানের অবদান
তার্কির অবকাঠামো উন্নয়ন
পুনরায় মাদ্রাসা স্থাপন
৫০০০ এর বেশী কুরআন কোর্স চালু করা
মুসলিম দেশসমূহ থেকে পাশ করে আসা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেওয়া
তুরস্ককে ওআইসির অন্তর্ভুক্তিকরন
ইসলামীক ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন
তুরস্কে সুদ মুক্ত ব্যাংক চালু করা (বর্তমানে যেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অবস্থিত)
ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা। ২৭০টির বেশি ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেন
নতুন বৃহৎ তুরস্কের পরিকল্পনা
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ বছরের ভিশন পেশ
তুরস্ক এবং ইরানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি
ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা
মুসলিম দেশগুলোর কমন মার্কেট ধারণার উদ্ভাবন
তুর্কি জনগণের ইসলামি ভাবধারাকে জনপ্রিয় করে তোলা
মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত কারখানা-
১৮টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি
১৬টি সার-কারখানা
১৪টি চিনির ফ্যাক্টরি
২৩টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি
৬টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরী
৭৭টি বৃহৎ শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠান
৬৩টি সুপরিকল্পিত শিল্প অঞ্চল
২৫৩টি ছোট শিল্প-কারখানা
৩২টি বৃহৎ মেশিনারী ফ্যাক্টরী
৪টি নৌ কারখানা
১০টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরী
১১টি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল শিল্প-কারখানা
৩টি গবেষণা সেন্টার(প্রাকৃতিক সম্পদ)
৪টি ইলেক্ট্রোনিক শিল্প-কারখানা
ফ্যাক্টরী বানানোর ফ্যাক্টরী তাকসান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যান্য ফ্যাক্টরী বানাতে হলে যা সরঞ্জাম লাগবে তা এই ফ্যাক্টরি সরবরাহ করবে।
তবে এরবাকানের প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানার অধিকাংশই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে যা তার্কির নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার শামিল। এরবাকান হোজার নির্মিত বিখ্যাত তাকসান ফ্যাক্টরি যখন বিক্রি করে দেয় সরকার, সেসময় তা নিয়ে তার্কির পত্রিকা রিপোর্ট করেছিলো- ‘শিক্ষক তৈরী করেছিলো, আর ছাত্ররা বিক্রি করে দিল।’
বসনিয়ার স্বাধীনতায় অবদান
বসনিয়াকে স্বাধীন করার জন্য মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ এবং সেখানে অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করায় সহযোগিতা করেন এরবাকান। বসনিয়ার নিপীড়িত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ান। বিরোধীদলে থেকেও সবরকমের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন।
বসনিয়ার বিখ্যাত নেতা আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচ যখন তার কাছে সাহায্যের জন্য আসেন। এক মাসের মধ্যে ৩৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সেসময়ে বসনিয়ার একটি স্ট্র্যাটিজক পজিশনে অবস্থিত মার্সিডিজ ফ্যাক্টরীকে অস্ত্র ফ্যাক্টরীতে রুপান্তর করেন। সেই সাথে আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচের পার্টির প্রধান কার্যালয়ের ভাড়া পর্যন্ত এরবাকানের রেফাহ পার্টি বহন করতো।
৫৪তম সরকারের অবদানসমূহ (১১ মাস)
সরকারী চাকুরীজীবীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করা
কৃষকদেরকে ২০০ ভাগ বেশী ভর্তুকি দেওয়া
সকল প্রকার কর্মচারীর বেতন ভাতাকে ৩০০ গুন বাড়িয়ে দেওয়া
ব্যাল্যান্স বাজেট করা (তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম, এর আগে এবং পরে আর কেউ করতে পারেনি)
অর্থনীতিকে সুদ মুক্ত করার লক্ষ্যে নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সুদকে সম্পূর্ণ রূপে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা। সেই সাথে তার্কির সুদের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বনিম্নে নিয়ে এসেছিলেন।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন ফান্ড গঠন। এক্ষেত্রে ভ্যাট না নিয়ে, ঋণ না নিয়ে শুধু মাত্র ১ বছরে দেশীয়ভাবে ৬ মাসের মধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করা।
তুরস্কের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল বিদেশী সৈন্যকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া।
এরবাকানের চিন্তাধারা
মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন কীভাবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দেশকে স্বনির্ভর করার ক্ষেত্রে নিজেদের উৎপাদন বৃদ্ধি করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি মুসলিম বিশ্বকে সেদিকেই বেশি জোর দেয়ার কথা বলেছেন বারবার।
তিনি বলতেন- ‘আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য নয় বরং সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতি করি।’ তার লক্ষ্য ছিলো একটি বাসযোগ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য তিনি কাজ করে গিয়েছেন আজীবন।
১৯৯৭ সালে তার ক্ষমতাকালে ইসরাইল কোনো হামলা করার সাহস পায়নি ফিলিস্তিনে। তাই সে সময়ের ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, আপনারা কী কারণে হামলা করেননি। উত্তরে সে বলেছিলো- ‘যে ব্যক্তি একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে সাইপ্রাস দখল করে নিতে পারে, তার ক্ষমতাকালে ফিলিস্তিনে হামলা করা আত্মহত্যার শামিল।’
আজ পর্যন্ত তার মতো কেউ সাহস করেনি আমেরিকার সকল ঘাটি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে তার্কির পতাকা উড়িয়ে দেওয়ার। মাত্র ৫ বছরের ক্ষমতাকালে তিনি তার্কিকে যে শক্ত ভিত দিয়েছেন তার উপর নির্ভর করেই তার্কি আজ এ পর্যন্ত এসেছে। ইনসাফের সমাজ নিয়ে, প্রায়োগিক রাজনীতির কর্মকৌশল ও ধরন নিয়ে তার জীবনভিত্তিক লেখা ‘দাওয়াম’ বা ‘আমার সংগ্রাম’ অনেকেরই প্রেরণা হয়ে আছে ।
মৃত্যু
এরবাকান ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ১১:৪০ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আঙ্কারার চানকায়ায় গুভেন হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত তার জানাজায় ব্যাপক লোক সমাগম হয়। তার ২ ছাত্র তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল লাশের খাটিয়া ধরে তার লাশ বহন করেন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেন।