আনিসুর রহমান এরশাদ
টেকসই ভবিষ্যতের জন্য পরিবার বাঁচান এবং সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা বাড়ান। পরিবারকে গুরুত্ব দিন এবং পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করুন। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন, আবেগগতভাবে সংযুক্ত হোন। সম্ভব হলে সপ্তাহে একদিন, সম্ভব না হলে মাসে অন্তত একদিন বাচ্চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেয়ে খোঁজখবর নিন। কেচিং বা প্রাইভেট টিউটর থাকলে তাদের সাথেও সন্তানের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করুন। মাসে অন্তত একবার পরিবারের সব সদস্যের খোঁজখবর নিন। আপনি শহরে কিন্তু পরিবার গ্রামে কিংবা পরিবার দেশে আর আপনি প্রবাসে থাকলে মন চাইলেই তাদের কাছে পাবেন না। তবে মোবাইলে খোঁজখবর নিতে পারবেন, কথা বলতে পারবেন, যোগাযোগ করতে পারবেন- চাইলে প্রতিদিন। সাধ্যানুযায়ী সরাসরি চেহারা দেখার বা দেখানোর চেষ্টাও থাকতে হবে; হোক তা সপ্তাহে কিংবা মাসে কিংবা বছরে কিংবা কোনো উৎসবে।
সাপ্তাহিক ছুটিতে বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান। ছুটির দিনটি পরিবারের সাথে আনন্দময় করে কাটালে পরবর্তী সপ্তাহে কাজের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।সেই সাথে সবার মধ্যে সম্পর্ক আরও মধুর হয়। অফিসের ব্যস্ততা এবং টেনশন দুটো থেকেই মুক্ত থেকে বাসায় সবার পছন্দমতো রান্না করুন অথবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একবেলা বাইরে খান। সন্ধ্যায় কোনো আত্মীয়, বন্ধুর বাড়িতে অথবা পছন্দের কোনো জায়গায় বেড়াতে যান। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও বন্ধুদের চায়ের আমন্ত্রণ করতে পারেন। ছুটির দিনে মান-অভিমান বা মনোমালিন্য করে সময় নষ্ট করবেন না। পরিবারে বয়ষ্ক কেউ থাকলে ছুটির দিনে তাকেও সময় দিন। আর বেড়াতে যাওয়ার সময় তাকেও সঙ্গে নিন।
গাছ লাগান, বাচ্চাদের বাগান পরিচর্যায় উৎসাহিত করুন। চমৎকার শখ ও সুস্বাস্থ্যের মেলবন্ধনের অনন্য উদাহারণ বাগান করা; যা মন ভালো রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যরক্ষায় নানাভাবে অবদান রাখে। বাগানে কাজ করা মানসিক চাপ কমায়। বাগান করা বিষণ্নতা আর দুশ্চিন্তায় লাগাম, হতে পারে সামাজিকতা বাড়ানোর একটি মাধ্যমও। খাবার টেবিলে নিজের বাগানে ফলানো তরতাজা শাক-সবজি-ফলের থেকে মজাদার ও স্বাস্থ্যকর আর কি হতে পারে। হোক সেটা বারান্দায় বা ছাদে টবে কিংবা বাড়ির উঠানে। স্কুলের হোম ওয়ার্কের পর গাছে পানি দেওয়া বা আগাছা পরিষ্কারের কাজটা বাচ্চাদেরকে দিলে শারীরিক কসরতের পাশাপাশি দায়িত্ব নেবার মানসিকতা তৈরি হবে ছোটবেলা থেকেই।
ঘুমানোর সময় ইলেকট্রিক ডিভাইস বন্ধ রাখুন, বিদ্যুতের অপচয় করবেন না। ঘুমানোর সময় মোবাইল ফোন (আইফোন, অ্যান্ড্রয়েড নির্ভর ফোন বা উইন্ডোজ ফোন) বা স্মার্টফোন বালিশের পাশে রাখবেন না, এটি অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। ফোন থেকে নীল রঙের যে আলো নির্গত হয়, তা মস্তিষ্ককে জাগিয়ে রাখে বলে ঘুম ও ঘুম চক্র নষ্ট হয়। মোবাইল থেকে নির্গত হওয়া রেডিয়েশন বা তরঙ্গের বিকিরণে ক্যানসার বা এ-জাতীয় সমস্যা সৃষ্টিরও সম্ভাবনা রয়েছে। রাতের অন্ধকারে ফোনের স্ক্রিনের আলো চোখের রেটিনার পক্ষে ক্ষতিকারক, এই আলো তন্দ্রার জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনকে নিঃসরণ হতে বাধা দেয়৷ফেসবুক চালাতে চালাতে ফোন চালু রেখেই ঘুমিয়ে যাওয়া কিংবা ঘুমানোর আগে দীর্ঘ সময় মেইল ব্যবহার করা বা গেম খেলা মারাত্মক ক্ষতিকর অভ্যাস। এতে মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। আপনার ফোন ব্যবহার সীমিত করুন। যাঁরা অ্যালার্ম ঘড়ি হিসেবে ফোন ব্যবহার করেন তাঁরাও কিছু দূরে কোনো কিছুর ওপরে ফোনটি রাখুন।
ঘুমানোর আগে কক্ষের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল বা লাইট বন্ধ করুন। ওয়াইফাই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ইলেক্ট্র ম্যাগনেটিক ওয়েভের ফলে মানব শরীরের বৃদ্ধির ক্ষতি হয়; মনোযোগের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, মাঝেমধ্যেই মাথা যন্ত্রণা, কানে ব্যথা ও ক্লান্তি দেখা দেয়। বেডরুম বা রান্নাঘরে ওয়াইফাই’র রাউটার বসাবেন না। যখন ব্যবহার করছেন না ওয়াইফাই বন্ধ রাখুন। মাঝেমধ্যে কেবল-এর সাহায্যে ফোন ব্যবহার করুন। ঘুমানোর সময় ওয়াইফাই কানেকশন বন্ধ রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া লাইট ও ফ্যান বন্ধ রেখে বিদ্যুতের অপচয় রোধ করুন।
দুর্ঘটনা এড়াতে গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখুন, পানির অপচয় রোধ করুন। বাইরে যাওয়ার সময় কিংবা রান্না শেষে গ্যাসের চুলার চাবি ঘুরিয়ে ঠিকভাবে গ্যাস বন্ধ করুন। জ্বলন্ত চুলার ওপর কোন অবস্থাতেই কাপড় শুকাতে দিবেন না। গ্যাসের চুলা থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে- গ্যাসলাইনের ছিদ্র বা চুলার চাবি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং গ্যাসের চুলা চালু করে অন্য কাজ করা বা এর ওপরে কাপড় শুকাতে দেওয়া। লাইনের ছিদ্র বা চুলা থেকে গ্যাস বেরোলে শব্দ হবে। গ্যাসের একটা গন্ধও আছে। এগুলো অনুভব করুন। গ্যাসলাইনে লিক সমস্যা হলে দ্রুত তিতাস গ্যাসকে জানান। গ্যাসের চুলায় সমস্যা থাকলে, নবটা ঠিক না থাকলে দ্রুত বাড়িওয়ালাকে জানান ও দক্ষ কারিগর দিয়ে সারিয়ে নিন। চুলা সব সময় ত্রুটিমুক্ত রাখুন। রান্নাঘরের জানালা ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখুন; এতে মশা-মাছির উৎপাত বাড়লে জানালার গ্রিলে নেট লাগিয়ে নিন।
অনেক দিন ঘর বদ্ধ থাকলে বাসায় ঢুকেই আগুন জ্বালাবেন না। জানালা খুলুন, ঘরে বাতাসের আসা-যাওয়া স্বাভাবিক হলে চুলা জ্বালুন। বাথরুমে প্রচুর গ্যাস থাকে, সব কিছু বন্ধ করে কখনোই মোমবাতি, ম্যাচ জ্বালাবেন না। রান্নাঘরে ইলেকট্রিক ওভেন বা ফ্রিজ রাখা উচিত নয়। এতে আটকে পড়া গ্যাসে অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে। ফ্রিজ ২৪ ঘণ্টাই চলে, পেছনটা গরম হয়; এই গরম হাওয়া বের হওয়ার ব্যবস্থা রাখবেন। শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বেলে রাখবেন না। ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য চুলা জ্বালিয়ে রাখার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। অনেক সময় পুরনো চুলার অফ-অন নবগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। অর্থাৎ চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করলেও গ্যাস লিকেজ হতে থাকে। আবার যেসব এলাকায় সব সময় লাইনে গ্যাস থাকে না, সেখানে চুলা বন্ধ করার ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের ঔদাসীন্য কাজ করে। এসব খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা। রান্নাঘরে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। আদরের চেয়ে শাসন বেশি করবেন না। অতিরিক্ত শাসনে সন্তানের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় সন্তান ভালো হওয়ার বদলে বিপথে চলে যায়। কারণে-অকারণে বকাঝকা ও করলে সন্তান বাবা-মাকে ভয় পেতে শুরু করে। তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে সবকিছু আড়াল করতে চায়, মিথ্যা বলায় পটু হয়ে ওঠে, উদ্ধত আচরণ করে। এর ফলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। তারা নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তাই কচি ও কোমল সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া প্রয়োজন। তারা কোনো ভুল করলে সেটিকে শুধরে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে যেন এ রকম না হয় সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করে দিতে হবে। সন্তানদের পাশে থেকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, স্নেহ-মমতার সঙ্গে ভালো-মন্দের শিক্ষা দিতে হবে, কাদের সাথে মিশে, কোথায় যায়- খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানকে বড়দের শ্রদ্ধা করতে এবং ছোটদের স্নেহ করতে শিখান।
গর্ভবতী নারী ও শিশুর বিশেষ যত্ন নিন। গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উপর গর্ভস্থ সন্তানের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৩ বেলা খাবারের সাথে নিয়মিত কমপক্ষে এক মুঠ বেশি খাবার খেতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম , দুধ, কলিজা, ঘন ডাল, গাঢ় সবুজ শাক-সব্জি ও মৌসুমী দেশী ফল খেতে হবে। রান্নায় যথেষ্ট পরিমাণ তেল ব্যবহার করতে হবে। গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হবার সাথে সাথে প্রতিদিন রাতের খাবারের পরপরই ১টি করে আয়রণ ফলিক এসিড ট্যবলেট খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় ৩ মাসের পর থেকে প্রতিদিন ২টি করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরা পেটে খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নিতে হবে। গর্ভবতী মহিলাকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিতে রাখতে হবে। ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কষ্টকর পরিশ্রম বর্জন করতে হবে। আয়োডিন যুক্ত লবন খেতে হবে।
প্রথম ৩ মাসের পর প্রয়োজনে ১ টি কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। টিটেনাস টিকার ৫টি ডোজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রসবের পর থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের বিশেষ সেবা প্রয়োজন। কারণ এই সময় শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য মায়ের শরীরের ক্ষয় হয়। শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান মায়ের দুধে বিদ্যমান; যা শিশু মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। এজন্য এ অবস্থায় মায়ের শরীর সুস্থ রাখার জন্য দুগ্ধদানকারী মাকে সব ধরনের পুষ্টি সমৃদ্ধ (আয়রণ, ভিটামিন-এ, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) খাবার খেতে হবে। শিশুকে ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ দিতে হবে এমনকি এক ফোটাঁ পানিও না। শিশুর জন্মের পরপরই (১ ঘন্টার মধ্যে) শিশুকে শালদুধ খাওয়ানো বিশেষ প্রয়োজন।
এসব যত্ন ও সতর্কতার পাশাপাশি প্রবীণবান্ধব হোন, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য নিশ্চিত করুন। যৌতুক-সহিংসতা-নির্যাতন ও বৈষম্য মুক্ত পরিবার গড়ুন। পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তুলুন। যেখানে পরিবারের বিভন্ন বয়সীদের উপযোগি বই থাকবে। অন্যদের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি নিজেরও যত্ন নিন। মাদক ও ধূমপান মুক্ত পরিবার গড়ুন। বিলাসী দ্রব্য ও আভিজাত্যের ছোঁয়া নেয়ার পূর্বে পরিবারে সবার পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করুন। আরামদায়ক ও আনন্দদায়ক জীবন নিশ্চিতই যথেষ্ট মনে না করে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন।