আনিসুর রহমান এরশাদ
‘কী সবচেয়ে সুন্দর’ জিজ্ঞাসা করলে কেউ বলবে- জোৎস্না রাতে চাঁদ-তারায় ভরা আকাশ, কেউ বলবে ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত হয়েছে তবে সবুজে আচ্ছাদিত এমন দৃঢ়তার প্রতীক পাহাড়, কেউ বলবে সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার ঢেউ, কেউ বলবে রঙ বেরঙের ফুল, কেউ বলবে হরেক রকমের পাখি, কেউ বলবে শিশুরা, কেউ বলবে মায়ের মুখ, কেউ বলবে প্রিয়-প্রিয়ার মুখ, কেউ বলবে বই।
তবে যে ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না তা’ হচ্ছে- টাকা সবার কাছেই সুন্দর। যে যাই বলুক আসলে টাকার সৌন্দর্যেই হোক, প্রয়োজনে হোক কিংবা টাকার ক্ষমতায় হোক-অনেকেই টাকার প্রেমে পাগল। মুখে বলবে ‘অর্থ অনর্থের মূল’ ‘আমি টাকার পেছনে ছুটি না’ ‘আমি টাকার কাঙাল নই’-কিন্তু খাওয়া-নাওয়া-ঘুম ভুলে টাকার পেছনে অবিরাম ছুটে চলবে।
টাকার জন্যে মানুষ মিথ্যা বলে, ঠকায়, চুরি করে, মানুষ মারে, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। টাকা সংগ্রহের জন্যে জীবনটাকেও গুরুতর হুমকির মুখে ফেলতেও পিছপা হয় না। টাকা জমিয়ে টাকার পাহাড় করার নেশা পূরণে টাকার কুমিররা নিয়োজিত হয়। যার যত বেশি টাকা,তার ক্ষমতা তত বেশি; সাধারণত মানুষ তাকে সম্মানও করে সেই অনুপাতে। যে যত বেশি আয় করে তার সাথে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা দেখা যায়। টাকা- আনে মান-সম্মান, তোলে জাতে। তাইতো টাকার অনেক শক্তি। বলা হয়ে থাকে- টাকা দিলে বাঘের দুধ মেলে। অনেকের ভাবতো এমন যে- ‘টাকা সমস্ত শক্তির উত্স। টাকায় কি না হয়। টাকার কাছে ক্ষমতার পরাজয় হয়। প্রভাবশালীও কুর্নিশ করে টাকার শক্তি কে।’ টাকার যে কী আশ্চর্য ক্ষমতা তা’ আমাদের দেশে খুব ভালোভাবেই বোঝা যায়। টাকার ক্ষমতার কাছে অনেক সময় মানুষের ক্ষমতাও হেরে যায়। আপনি যতই টাকাওয়ালা হোন না কেন- অহংকার যেন সংকীর্ণতার মধ্যে বদ্ধ করিয়া না রাখে, নত এবং বশীভূত করিয়া না রাখে।
অনেকেই বলবেন আসলে টাকার কাছে সেসব জ্ঞানীই হেরে যাচ্ছেন যারা প্রকৃত জ্ঞানী নন, জ্ঞানীর মুখোশ পরে আছেন মাত্র। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেলে, নোট-চোথা পড়ে প্রশ্ন কমন পেয়ে পাস করলে সার্টিফিকেট অর্জন হলেও জ্ঞানার্জন হয় না। তাছাড়া কোচিং-প্রাইভেট টিউটরের মাধ্যমে শেখানো বুলি অনেক সময়ই অনর্থের জন্ম দেয়। শুধু ছাত্রজীবনেই নয় কর্মজীবনে, পারিবারিক বা সামাজিক জীবনেও অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ বা শেখানো বুলি হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনে। তাই শিক্ষিত মূর্খ নয়, জ্ঞানী মানুষ চাইলে মুখস্ত বিদ্যা যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। জাগতিক উন্নতির স্বার্থে নামকাওয়াস্তে সার্টিফিকেট অর্জন বা জগৎ সংসারের প্রতি অনাসক্তি সৃষ্টির ফলে পাঠাভ্যাস বিমুখ হওয়া-কোনোটিই কল্যাণকর নয়। মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ গঠন তখনই সম্ভব হবে যখন পুথিঁগত জ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় হবে। তারপরও কথা থেকে যায়, আমরা ব্যক্তিকে দোষারোপ করব নাকি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করব। এক্ষেত্রে দায় এড়াতে সাধারণত নিরাপদ কৌশলই অবলম্বন করে থাকে নীতি-নির্ধারকরা।
ডিগ্রিই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মনকে জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করা,যার কাছে জানা বা জ্ঞান অর্জন করার চেয়ে বস্তুগত প্রাপ্তিই বড় হয়ে ওঠবে না। মনে রাখতে হবে- পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক জ্ঞান আহরণে সীমাবদ্ধ রাখলে বা থাকলে সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন হয় না। তাই অর্থপূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে সকল স্তরের শিক্ষার্থীকে জীবনোপযোগী কৌশল বা দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বোঝা ও চিন্তা করার ক্ষমতা আর তোতা পাখির মতো বুলি আওড়ানোর মধ্যেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং ব্যক্তিত্বহীন মানুষের প্রভেদ ধরা পড়ে। অবশ্য অনেকে আছে শিক্ষাজীবনে অসাধারণ মেধার সাক্ষর রেখেছেন অথচ কর্মজীবনে এসে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যান। সার্থকতার চেয়ে সাফল্য লাভই বড় হয়ে গেলে নেতা-নেত্রীর সুদৃষ্টির আশায় নিজের বিবেকও গৌণ হয়ে যায়, বসকে খুশি করার আশায় ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেয়া যায়, পদোন্নতির লোভে সহকর্মির বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র করা যায়, সুদ-ঘুষ দেয়া-নেয়াকেও মেনে নেয়া যায়, মিথ্যা ও প্রতারণারও আশ্রয় নেয়া যায়।
সততার চেয়েও যেখানে মূল্যবান বাড়ি-গাড়ি, পরোপকারের চেয়ে যেখানে বিলাসীতা-আরাম-আয়েশ, ত্যাগ ও সাধনার চেয়ে যেখানে ভোগ ও সুখই মূখ্য; সেখানে জ্ঞান নয় জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা বিবেচনার কেন্দ্রে অবস্থান করে। ফলে টাকার জোরে অপরাধীও সম্মান পায়, নিরপরাধীও শাস্তি পায়, সন্ত্রাসীও সমর্থন পেয়ে নির্বাচিত হয়, খুনীও জননেতার তকমা পায়, হিংসুক-ষড়যন্ত্রকারীর নেতিবাচকতাও নেতা-কর্মীর নিবেদিত প্রাণের স্বীকৃতি পায়। মামা-খালুর জোর কিংবা দলীয় বিবেচনায় চাকরি মিললে, পেশীশক্তি ও কালোটাকার জোরে নমিনেশন মিললে আর যাই হোক মেধার মূল্যায়ন হয় না। যে সমাজে টাকার কাছে জ্ঞান অসহায় হয়ে পড়ে, টাকাওয়ালার কাছে জ্ঞানী পরাজিত হয়; সেই সমাজ আর সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ থাকে না।