অনেকে জাতি গঠন করতে চান, সমাজ বিনির্মাণ করতে চান, আলোকিত মানুষ তৈরিতে কাজ করতে চান। অথচ বেমালুম ভুলে যান জাতি গঠন করতে হলে আগে নিজেকে গঠন করতে হবে, ইনসানে কামেল তৈরি করতে হলে আগে নিজেকে ইনসানে কামেল হিসেবে তৈরি হতে হবে।
কল্যাণ ও উন্নয়নের প্রয়াসে কখনো কখনো প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠাও জরুরি হয়ে পড়তে পারে। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যেকোনো শুভ উদ্যোগকে সার্থক করে তোলতে যে সুস্পষ্ট আন্তরিকতা দরকার তা খুব কম জনেরই থাকে। অনেকে মানব উন্নয়নে প্রশিক্ষণকে অবহেলা করেন অথচ সচেতন সুনাগরিক তৈরি হোক এটা প্রত্যাশা করেন।
কেউ যদি আন্তরিকভাবে ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন আল্লাহ উপায় বের করে দেন; আর কেউ যদি আন্তরিকভাবে খারাপ কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন শয়তান তার উপায়ও বের করে দেন। স্থায়ী জীবনের জন্য অস্থায়ী জীবনকে কাজে লাগাতে পারায় প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করেন যারা তারাই কেবল অস্থায়ী জীবনের জন্য স্থায়ী জীবনকে কাজে লাগাতে পারেন।
ভালোভাবে দ্বীনী খেদমত করার জন্যও সক্ষমতা লাগে, ভালোভাবে মানুষের খেদমত করার জন্যও সক্ষমতা লাগে। মানসিকভাবে নিজে সুস্থ থাকার জন্যই অপরের কল্যাণের জন্য কাজ দোয়া করা দরকার। সফল করার আশা নিয়ে অনেক উদ্যোগ শুরু হয়; কিন্তু উদ্যোগকে সার্থক করে তোলতে সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রচেষ্টা খুব কম জনেই করে।
মানুষে মানুষে চিন্তার ভিন্নতা বা ভিন্নমত আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবেই। কেউ কেউ মনে করে- স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া মানবজাতির মূল সমস্যা; আর কেউ কেউ মনে করে স্রষ্টাকে মনে রাখা মানবজাতির মূল সমস্যা। এই জন্যইতো কেউ আস্তিক, কেউ নাস্তিক।অথচ আলোচনা বিরোধপূর্ণ হওয়ার চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হওয়া দরকার।
লেখক সময়কে কেন্দ্র করে লিখে। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মূলনীতি ঠিক রেখে পদ্ধতিগত সংস্কার-সংশোধন করতে হবে। মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্ক কম হলে কখনোই দীর্ঘস্থায়ীভাবে ব্যাপক প্রভাব ফেলা যায় না। তাই বৈচিত্র্যতাকে ধারণ করা, কাঠামোগত ও প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মরে যাবার পর কিছু মানুষকে মানুষ মনেই রাখে না; এদের মধ্যে যেমন ভালো মানুষ আছে, তেমনি মন্দ মানুষও আছে। আবার মরে যাবার পর কিছু মানুষকে মানুষ মনে রাখে; এদের মধ্যেও যেমন ভালো মানুষ আছে, তেমনি মন্দ মানুষও আছে। খানহজাহান আলী, শাহজালাল, শাহপরাণের কথাও মানুষ স্মরণ করে! আবার খুনি-সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, দুর্ধর্ষ ডন ইমদু ডাকাত এর কথাও মানুষ স্মরণ করে! দুই স্মরণের আবেদন ভিন্ন, অর্থ ভিন্ন!
চিন্তা-কর্মে ধরন বদলালে বিভিন্ন আম্ব্রেলার নীচে যেমন অনেক কাজ হতে পারে; চিন্তা-কর্মে ধরন না বদলালে তেমন একটি আম্ব্রেলার নীচে একটি কাজও হতে পারে। আসলে পদ্ধতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো কাজে যুক্ত করে ব্যস্ত করতে না পারায় অনেকে মূল্যবান সময় মোবাইলে বেহুদা নষ্ট করছে।
শুধু মানি মেকিং সেন্টার করলে ইসলামীকরণও হয় না, সামাজিকীকরণও হয় না। যারা শীর্ষ স্কলারদের কাজকে পরিচিত করাতে চায় তাদের নিজেদেরও ব্যাপক পড়াশোনা ও প্রস্তুতি থাকা দরকার। স্কুল অব থটসগুলোকে অন্যদের কাছে পরিচিত করাতে হলে আগে এগুলোর সাথে নিজেকে ভালোভাবে পরিচিত হতে হবে।
কিছু মানুষের মধ্যে দ্বিচারিতা প্রবল। অথচ দ্বিচারিতা আর মূল্যবোধ ভীষণ সাংঘর্ষিক! যেখানে দ্বিচারিতা বেশি, সেখানে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরিও হয় সহজেই! মুখে দাঁড়ি কিংবা মাথায় টুপি পরেও ঘুষ খাচ্ছেন। দোয়া-জিকির ও ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত ব্যক্তিও সুদ খাচ্ছেন!
যারা বেশ-ভূষা আর হজ্ব-উমরা করায় মানুষের কাছে বিশ্বস্ত হচ্ছেন, অধিকতর আস্থাশীল হচ্ছেন; অথচ মানুষকে অধিকার বঞ্চিত করছেন, অধীনস্তদের ন্যূনতম মানবিক মান-মর্যাদাও ক্ষুন্ন করছেন- তারা আসলে ধার্মিক সেজে ধর্মের ক্ষতি করছেন!
আবার অনেকে জাতীয় প্রয়োজনের কথা বলে মানুষের সহানুভূতি নিচ্ছেন, মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা করছেন। জনসেবার কথা বলে বা মানবসেবার কাজের কথা বলে মানি মেকিং সেন্টার বানাচ্ছেন। যে যেটা করছেন, সে কেন সেটা গোপন করতে চায়! যে যেটা নয়, সে কেন সেটা প্রমাণ করতে চায়!
মানুষকে বোকা বানানো, মোহাচ্ছন্ন করে রাখার প্রয়াসতো কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্যক্তিস্বার্থ বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনই যার কাছে বড়, সে কেন ইসলামের প্রয়োজনের কথা বলে বা দেশ-জাতির সেবার কথা বলে বিভ্রান্তি-ধোঁয়াশা বাড়ায়! মন-মগজ-মুখ সবকিছুরই গতিপথ একই হওয়াটাই ভালো!
দ্বিচারিতা যে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে দেখা যায় তা নয়; আন্তর্জাতিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও দেখা যায়! নিজে একপন্থী হওয়ায় আরেকপন্থী শিক্ষার্থী সেরা রেজাল্টধারী হওয়ার পরও নিয়োগ না দিয়ে অবিচার করছেন! আসলে কাউকে অবৈধ সুবিধা দেয়া মানেই কাউকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা! দ্বিচারিতা পলিসি লেভেলেও হয়, মাঠ পর্যায়েও হয়!
শুন্যতা-ঘাটতি পূরণে অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা করে কাজ করাটা কঠিন; যখন যে বিষয় সামনে আসে তখন সেই বিষয়েই ব্যস্ত হওয়াটা সহজ! উত্তম বিকল্প দেয়ার জন্য সুচিন্তিত-সুপরিকল্পিত কাজ হতে হয়; আর সমালোচনা করার জন্য কোনো যোগ্যতা-সাধনা লাগে না! গঠনমূলক সমালোচনার জন্য অবশ্য যোগ্যতা-সাধনা লাগে; কিন্তু যেখানে কাজের চেয়ে কথা বেশি, সেবার চেয়ে রাজনীতি বেশি- সেখানে অযোগ্যতাই বড় যোগ্যতা!
এমন প্রচলিত অনেক সিস্টেম রয়েছে; যে সিস্টেমে পরিচালিতদের বয়স বাড়লেও প্রাজ্ঞ হয় না। আবার যে যতটুকু জানছে বা জানতে পারছে তার চেয়ে যদি বেশি ঔদ্ধত্য হয়; তাহলেও হিতে বিপরীত হয় । আসলে সাধারণের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমেই মানুষ অসাধারণ হয়ে ওঠতে পারে! সবকিছুতেই শুধু খারিজ করার সহজ সিস্টেমের জয়জয়কারের চেয়ে গ্রহণ করার কঠিন সিস্টেম বেশি জরুরি।
আমরা যত জনে যত বেশি সফলদের গুণকীর্তন আর সফলতার জয়কীর্তন করি; ততজন ততবেশি সফলতার জন্য যে পদ্ধতি-প্রক্রিয়া তারা গ্রহণ করেছেন তা নীতি-আদর্শের মানদন্ডে ফেলে ছেঁকে গ্রহণ করতে পারি না। একধরনের মিথ্যা স্বপ্নসৌধ নির্মাণ করে যারা নবীন প্রজন্মের সরলতা-অনভিজ্ঞতা-আবেগকে পুঁজি করে শূণ্য হাতে হিমালয় পর্বতের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন; তারা মূলত আগামীকে নড়বড়ে ও তুচ্ছ করে ফেলেন।
পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য শুধু পাহাড়সম আশা-স্বপ্ন জাগানোই যথেষ্ট নয়, যথাযথ কর্মকৌশল-কর্মপরিকল্পনাও থাকতে হবে। নিজের অদূরদর্শীতা-অযোগ্যতা-অপরিপক্কতার কারণে নেয়া সিদ্ধান্তের ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দিলে কখনোই নিজের ভুল-ত্রুটির সংশোধন হবে না; পরিশুদ্ধতার জন্য আত্মসমালোচনা-আত্মপর্যালোচনার কদর এ কারণেই বেশি! অনেকেই যতটা বলতে চায়, যতটা লিখতে চায়, যতটা করতে চায়; ততটা প্রস্তুতি নিতে চায় না, সংগ্রাম করতে চায় না।
চিন্তন প্রক্রিয়া বদলে ফেলার মাধ্যমে কাজ বদলে ফেলা যায়; আর কাজ বদলে ফেলার মাধ্যমে পরিচয় বদলে ফেলা যায়। যার চিন্তা করার ক্ষমতা আছে অথচ চিন্তার বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই; তার যুক্তি-কল্পনা কাজে লাগতে পারে, আবার কাজে নাও লাগতে পারে। সকল চিন্তাই কাজে প্রতিফলিত হবে এমন নিশ্চয়তা নেই; তবে যার চিন্তা যত বেশি কাজে প্রতিফলিত হবে, সে তত বেশি অগ্রসর হবে!
যার আত্মপরিচয় নেই, সে জাতিসত্তার সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে না। ভাষাগত দক্ষতা মানে শুধু ভাষার ওপর দখল নয়; ভাষাকে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সঠিক স্থানে ব্যবহার করতে পারার সক্ষমতাও। সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে উপেক্ষা করলে বিদ্যমান সমাজকে পড়া যাবে না। তবে যা দেখছি তা যদি হয় মেকি, যা বলছি তা যদি হয় সারহীন, যা ভাবছি তা যদি হয় অযথা- তাহলে তার ফল ভালো হবে না। বানানো ইতিহাস শুনার চেয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাস লেখাটা ঢের কঠিন!
যার যেটা গুরুত্ব দেয়ার কথা সে সেটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিছু মুসলমান কুরআনকে গুরুত্ব না দিয়ে ফিকাহকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যে ইস্যুতে শক্তিশালী অবস্থান নেয়া দরকার সে ইস্যুতে দুর্বল অবস্থান নিচ্ছে। নেতৃত্বের যে ব্যাখ্যা দেয়া দরকার তা না দিয়ে গোলমেলে ব্যাখ্যা দিচ্ছে। যে ফিল্ডে কাজ করা দরকার সে ফিল্ড গুরুত্বই পাচ্ছে না; আর যে ফিল্ডে কাজ করার কোনো দরকারই নেই তাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যে সেক্টরে অনেক কাজ হওয়া দরকার, সে সেক্টরে এগিয়ে আসার আগ্রহ নেই; যে সেক্টরে অনেক কাজ হয়েছে, সে সেক্টরেই কাজ করতে ঝাপিয়ে পড়ছে।
অনেকেই আফসোস করে বলেন- সাহসী কলমের খুবই অভাব। অনেকেই জ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগের জন্য ব্যাপক আগ্রহ দেখান। অনেকেই শক্তিশালী লেখা তৈরির বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। কিন্তু এই অভাব-শুণ্যতা পূরণে কেউ উদ্যোগ নেন না, কেউ এগিয়ে আসলে সহযোগিতাও করেন না। সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কলাকৌশল নিয়ে কথা বললে অনেকেই শুনতে রাজি, তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কাজে ত্যাগ স্বীকারে রাজি নন।
গণমানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বলাবলি-লেখালেখির চেয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তোষামদী বলাবলি-লেখালেখিকেই অনেকে গুরুত্ব দেন। সংকীর্ণতা-সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠে নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরে চিন্তা করার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিই করেন না। বিভিন্ন দিক-বিভাগে বিদ্যমান সংকট চিহ্নিতকরণ এবং সংকট থেকে উত্তরণের সর্বাধুনিক পথ-পদ্ধতি অণ্বেষনই করেন না।
চিন্তার বিনিময় হওয়া খুব জরুরি। জ্ঞানচর্চার ভালো প্লাটফর্ম খুব বেশি দরকার। এতে একজন চিন্তা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও আরেকজনের মাধ্যমে বড় কিছু হয় বা সম্মিলিতভাবে চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটে। জ্ঞানের পিপাসা সবার সমান নয়! অনেকে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে জ্ঞানের পিপাসা মিটাচ্ছে, অনেকে বই থেকে মিটাচ্ছে, অনেকে আড্ডা বা বিভিন্ন পাঠচক্র থেকে মিটাচ্ছে। জ্ঞান পিপাসা মিটানোর জন্য সময়োপযুগী কনটেন্ট তৈরি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বদলে যাওয়া অভ্যাসের সাথে আমাদের জ্ঞানকে মানিয়ে নিতে হবে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারে জানার প্রবণতা বাড়াতে হবে। জ্ঞানাহরণের জায়গাগুলোতে জ্ঞান স্থানান্তরে সমন্বয় করা দরকার হবে। কোনো জ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ ধীরে চললেও যাতে শুরু হয়ে বন্ধ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সময়ের দাবি পূরণে কোয়ালিটি সম্পন্ন কাজ করতে হবে। সবাই যা করে, যেভাবে করে; তার চেয়ে মানের হতে হবে, ব্যতিক্রমী হতে হবে।
যারা রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয় আর যারা রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত- উভয় পক্ষই সমানভাবে চিন্তা করতে পারে না। চিন্তা-কর্ম ভিন্ন হলে আগ্রহ-ইচ্ছাও ভিন্ন হয়। অন্তত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একইরকম হলে একসাথে কাজ করা যায়; তবে পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় ঐক্যমত হতে পারলেই কেবল দীর্ঘসময় একসাথে একইপথে চলা যায়। তাইতো জ্ঞান বিতরণের আগে জ্ঞানের পিপাসা আছে কিনা তা জেনে নিতে হয়!
সংখ্যালঘিষ্ট হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণের কাঠামো তৈরি করতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে সবার আগে যথাযথ অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করতে পারাটা জরুরি। যা নিয়ে সমালোচনা হয় তার উত্তম বিকল্প দিতে পারে খুব কম মানুষই। সময়ের সাথে সাথে অন্যরা কিভাবে পরিবর্তন করেছে বা কী পরিবর্তন করেছে, কিভাবে গণভিত্তি রচনা করেছে- তা বুঝাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সেক্টরের জন্য উপযুক্ত রূপরেখা-উপায় অনুসন্ধান করতে হলে সারা পৃথিবীকে পর্যালোচনা করতে হবে। মূল্যবোধভিত্তিক জ্ঞানকান্ড ও জ্ঞানচর্চা দরকার!
উদ্যোক্তাদের তৎপরতার ওপরই সংশ্লিষ্ট অন্যদের প্রচেষ্টার মাত্রা নির্ভরশীল। কাজ সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। পদ্ধতি সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। বিশ্বায়নের এই যুগে নবীন প্রজন্মের অনেক ইসলামপন্থী যেমন বামপন্থী হয়ে যাচ্ছে, আবার অনেক বামপন্থীও সম্পূর্ণ ইসলামপন্থী হয়ে যাচ্ছে! কখন কোন পন্থার দিকে ঝুঁকপ্রবণতা দিন দিন বাড়বে তা নির্ভর করে সেই পন্থীদের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্ম নবীন প্রজন্মের পালস ধরার সক্ষমতার ওপর!
সচেতন নাগরিক ও বিবেকবান মানুষ তৈরিতে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু-বিষয়ে চিন্তা-দৃষ্টিভঙ্গি আদান-প্রদানের মাধ্যমে বোঝাপড়াকে আরো শাণিত- পরিশীলিত করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সারা দুনিয়ার অ্যাডভান্স-আপডেট একাডেমিক আলোচনা-পর্যালোচনাকে সময়ের দাবি অনুযায়ী সময়োপযুগী-সহজবোধ্য করে একাডেমিক পরিসরের বাইরে পাবলিক পরিসরে আমজনতার কাছেও লেখা-বলা-কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নিয়ে আসা দরকার।
যে শুধু নিজের স্বার্থে কাজ করে সে কেন বলে মানুষের স্বার্থে কাজ করছি! যে শুধু দলের স্বার্থে খারাপ কাজও করে সে কেন বলে দেশের কল্যাণে কাজ করছি! যে নিজের পরিবারের বা আত্মীয়-স্বজনের বাইরে বৃহত্তর সমাজের মানুষের কল্যাণের কথা ভাবারও সময় পায় না, সে কেন বলে জাতির প্রয়োজনে কাজ করছি! মূলতঃ এমন বলার মধ্য দিয়ে নিজের গুরুত্বকে বাড়াতে চায়, পরিসরকে বিস্তৃত করতে চায়।
যেসব শিক্ষকেরা শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণায়-লেখালেখিতে সংশ্লিষ্ট আছেন তাদেরকে পৃষ্টপোষকতা দেয়া দরকার! যারা নিজ পেশার পাশাপাশি গবেষণায়-লেখালেখিতেও সংশ্লিষ্ট তাদেরকেও উৎসাহ দিয়ে আগ্রহী করে গবেষণায়-লেখালেখির সুযোগ করে দেয়ার মতো সংগঠন থাকা দরকার। যেকোনো পেশাজীবীই তার নির্ধারিত কাজের বাইরে সমাজ-দেশের বৃহত্তর প্রয়োজন পূরণে ভালো কন্ট্রিবিউশন রাখতে চাইলে তাকে সুযোগ করে দেয়া বা তার আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত।
জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনে সবার সব প্রত্যাশা কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে অধ্যয়ন ও গবেষণায় আগ্রহী পরের প্রজন্মের জন্যও যাতে বর্তমানের অধ্যয়ন-পাঠদান-গঠনে প্রথিতযশা বিজ্ঞ-পন্ডিতেরা সুনির্দিষ্ট গবেষণাপদ্ধতি ও তত্ত্ব অনুসরণ করে বিভিন্ন ইস্যুতে বিস্তৃত পরিসরে কিছু গবেষণা করে যান বা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়ক হতে পারে এমন লেখা মৃত্যুর আগেই লিখে যান সেটি নিশ্চিত করাকে গুরুত্ব দেয়া দরকার।
এমন কিছু দেশীয় স্কলারদের একসাথে কাজ করা দরকার, যারা অধ্যয়নের বিস্তৃত পরিধির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও একাডেমিক ডিসকোর্সে স্বীকৃত হয়েছে বা হবার সক্ষমতা সম্পন্ন। যাদের লেখনী ভবিষ্যতেও তরুণ অধ্যয়নকারীদের উজ্জীবিত করবে, অধ্যয়নের পরিধি বিস্তৃত হবে এবং জ্ঞানচর্চায় আরো সমৃদ্ধ করবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আগ্রহীদের ধারণা সুস্পষ্টকরণে অবদান রাখার মতো বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে পরিচালিত সংগঠন থাকা দরকার। একক প্রচেষ্টায় বড় পরিসরে কাজ করা যায় না!
চিন্তকদের মধ্যে শক্তিশালী সেতুবন্ধন তৈরি হওয়া দরকার। চিন্তা-অনুশীলন-অধ্যয়ন-গবেষণার প্রতি দায়বোধ-দায়বদ্ধতা-দরদ ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এবং দীর্ঘমেয়াদে আদর্শিক-কল্যাণের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিদেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি চিন্তকদেরকেও সাথে যুক্ত করে গ্রহণযোগ্যতার নতুনমাত্রা দেয়া এবং বৈচিত্রতা আনা যেতে পারে।
বুদ্ধিবৃত্তিক যৌথ উদ্যোগের সাথে থাকতে আন্তরিকভাবে যারা আগ্রহী এবং যাদের চিন্তা-লেখনি-ভূমিকার গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ততার মাধ্যমে চিন্তায় পরিপূর্ণতা অর্জনে কাজে লাগতে পারে- তাদেরও এগিয়ে আসা দরকার। যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চিন্তাজগতে কন্ট্রিবিউশন রাখতে চান। গুড সিটিজেনশীপ এন্ড সোশ্যাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্স চালু করা দরকার।
আধুনিক যুগে এসেও অনেকের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অনাধুনিক। বিদ্যমান চিন্তাকে না বুঝেই অনেকে নতুন চিন্তাকে হাজির করার দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকেন। কোনো প্রকার প্রস্তুতি না নিয়েই সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চান। সমকালীন বাস্তবতাকে বিবেচনা না করেই ব্যক্তিজীবনকে গড়ে তোলতে চান।
উত্থান যেমন আছে, তেমনি পতনও আছে। তবে যারা অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে ভিত্তি নিয়ে প্রবল প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে লড়তে চান, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ছাড়া তাদের আর কোনো শক্তিশালী মাধ্যম নেই! সংকট আসবে, সংকট থাকবে; সংকট মোকাবেলা করেই সংকটমুক্ত পথ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে একক প্রয়াস যথেষ্ট নয়; যৌথ প্রয়াস লাগবে।
দুর্বল সংগঠনকেও নেতৃত্বের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হোক, অর্থনৈতিক আগ্রাসন হোক কিংবা রাজনৈতিক আগ্রাসন হোক- আসলে পৃথক ধরনের আগ্রাসন মোকাবেলায় দরকার পৃথক ধরনের প্রস্তুতি বা কৌশল; কোনোটাকেই হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই!
কত কিছুর উদ্ভব হয়! তবে সব কিছুর বিকাশ হয় না! শুধু রাজনীতিই সবকিছু নয়; তবে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়! যার ব্যক্তিত্বই নেই; সে সমাজ বা সংগঠনের বিকাশ ধারা সঠিক গতিপথে রাখতে কখনোই পারে না।
যারা নয়া সভ্যতা বিনির্মাণে পাহাড় কেটে কেটে পথ তৈরি করেছেন; তাদের আলোচনায় আনা দরকার। শুধু সমালোচনা না করে পথ-পদ্ধতির বিকল্প ভাবনা ভাবা দরকার। অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে অসতর্ক তার দ্বারা অপরের অধিকার ক্ষুন্ন হবেই।
মতপার্থক্য থাকবেই। তবে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে কিভাবে ঐক্যমতে আনা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। আসলে গ্রুপিং অধিকাংশক্ষেত্রে সংকট সমাধানের চেয়ে সমস্যা বাড়ায়! জনপরিসরে আলোচিত সমকালীন চিন্তাকে দ্বান্দ্বিকতার অবসানের স্বার্থেই বুঝতে হবে!
সেক্যুলার সমাজ যাকে স্মরণ করতে চায় না, ইসলামী সমাজে সে স্মরণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। আবার ইসলামী সমাজে যে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়; সেক্যুলার সমাজে সে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে! আবার এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের আবেগ-অনুভূতিকে বুঝতে না পারলেও গ্যাপ তৈরি হতে পারে।
প্রবীণের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নবীনেরা তারুণ্যদীপ্তভাবে দৃঢ়পদে এগিয়ে গেলে ভালো কিছু করা বা হওয়া সহজ হয়ে যায়। মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চ সেন্টার বানাতে হলে বিভিন্ন ডিসিপ্লিন থেকে আসা রিসার্চার লাগবে। নলেজ গ্যাপ দূরীকরণে ভূমিকা রাখতে হলে আগে নিজের জানা-শোনার পরিধি বিস্তৃত করতে হবে।