জেন্ডার বৈষম্যের কারণ প্রভাব ও দূরীকরণে উপায়

নারী পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক হচ্ছে জেন্ডার। শারীরিক পার্থক্য নিয়ে নারী ও পুরুষ জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতি যখন এই পার্থক্য এবং অন্যান্য কারণে তাদের ওপর সামাজিক নানা অর্থ আরোপ করে পৃথক করে ফেলে তখনই তা হয়ে ওঠে জেন্ডার ।

তাই জেন্ডার এক ধরনের সামাজিক নির্মাণ। শারীরিক পার্থক্য জৈবিক বলে সেই পার্থক্য দূর করা যায় না। কিন্তু সামাজিক নির্মাণ বলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য দূর করে জেন্ডারবান্ধব সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।১

নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞাই জেন্ডার। সামাজিক লিঙ্গীয় বৈষম্য প্রকৃতির তৈরি নয়। প্রকৃতি ছেলে ও মেয়ে তৈরি করে। সমাজ তাকে বৈষম্যের ভিত্তিতে পুরুষ ও নারীতে পরিণত করে। সমাজই তৈরি করেছে পুরুষালি ও মেয়েলি বৈশিষ্ট্য।

প্রকৃতি বৈষম্য তৈরি করেনি, তৈরি করেছে নারীর পুনরুৎপাদন কাজের জন্য ভিন্ন অঙ্গ। পার্থক্য শুধুমাত্র এইটুকুই। বৈষম্য তৈরি করেছে মানুষ অর্থাৎ সমাজ। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে বৈষম্য, ব্রাক্ষণ- শুদ্র, কালো-সাদা, নারী-পুরুষের মধ্যে যে ব্যবধান এই সবই সমাজের তৈরি।২

জেন্ডার বৈষম্যের মাশুল শুধু নারীকেই দিতে হয় না, পুরুষ এবং সাধারণভাবে সমাজকেও এর জন্য মাশুল দিতে হয়।৩

নিম্নে প্রসঙ্গত বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হল।

জেন্ডার বলতে কি বুঝায়?

“Nature makes us made and female, but it is the beliefs and values of our culture that determines the kind of man amd woman we become.” (Grant, 1976:147)৪

জেন্ডার ধারণাটি লিঙ্গ শব্দের প্রতিশব্দ নয়। লিঙ্গ শব্দটি শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের মাঝে জৈবিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়। জে.জে ম্যাসিওনিস তার Society গ্রন্থে বলেন “Gender refers to human traits linked by culture to each sex. Gender guides how males and females think about themselves, how they interact with others, and what position they occupy in society as a whole.’ ৫

কমলা ভাসিন তার Understanding Gender পুস্তিকায় বলেন, “Gender refers to the socio-cultural definition of man and woman, the way societis distinguish men and women and assign them social roles.” ৬

জেন্ডার (Gender) শব্দটির আভিধানিক অর্থ লিঙ্গ। সাধারণ ব্যাকরণেও জেন্ডার শব্দটি ব্যবহৃত হয় লিঙ্গ চিহ্নিত করার জন্য। যেমন-পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, ক্লিব লিঙ্গ ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে জেন্ডার এবং সেক্স একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে এলেও সাম্প্রতিককালে উন্নয়ন সাহিত্যে জেন্ডার ভিন্ন ও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত।

সেক্স হচ্ছে প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে সৃষ্ট নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের স্বাতন্ত্র্যতা কিংবা শরীরবৃত্তিয়ভাবে নির্ধারিত নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য যা অপরিবর্তনীয়। আর জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা নারী পুরুষের পরিচয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী পুরুষের মধ্যকার ভূমিকা যা পরিবর্তনীয়।

সেক্স বা লিঙ্গ হচ্ছে নারীত্ব ও পুরুষত্বের জৈবিক বা শারীরিক উপাদান আর নারী ও পুরুষ সম্বন্ধীয় মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোধ হচ্ছে জেন্ডার। ৭

Anne Oakley প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে সেক্স ও জেন্ডার এর মধ্যে এসব মৌলিক ধারণাগত পার্থক্য তুলে ধরেন। এই পার্থক্য অনুযায়ী তাই সেক্স শারীরিক বৈশিষ্ট্য সূচিত এবং একটি নির্দিষ্ট সমাজে নারী পুরুষের জেন্ডার বৈশিষ্ট্য সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে (এর অর্থ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও) নির্ধারিত। ৮

এককথায় জেন্ডার হলো আরোপিত, সমাজ সংস্কৃতিভিত্তিক, আচার-আচারণগত এবং স্থান-কাল- পাত্রভেদে বিভিন্ন সমাজ সাংস্কৃতিতে পরিবর্তনীয় আর সেক্স হলো প্রাকৃতিক শারীরিক, পূর্ব নির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। ৯

জেন্ডার বৈষম্য সংক্রান্ত ধারণা

জেন্ডার সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম, শ্রেণী ভেদে বিভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন রকম হলেও গোটা বিশ্বজুড়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সাধারণত অভিন্ন অবস্থা বিদ্যমান। এগুলো হলো ঃ নারী-পুরুষের দৈনন্দিন কাজ , দায়- দায়িত্ব, ব্যবহৃত সময়ের ক্ষেত্র ভিন্নতা বা অসমতা। অর্থাৎ জেন্ডার ভিত্তিক শ্রমবিভাগ, দ্বিতীয়তঃ পুরুষের তুলনায় সম্পত্তি, অধিকার, পছন্দ, ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা বা সুযোগের অভাব অর্থাৎ সমাজে নারীর অমর্যাদাজনক বা হীন অবস্থান।১০

জেন্ডার বৈষম্য নানান রুপে

বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি বৈষম্য দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত প্রসারিত। খাদ্য, পু্িষ্ট, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিনোদন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে পুরুষরা ভোগ করে প্রচলিত অগ্রাধিকার। আর অন্যদিকে মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কন্যা ভ্রুন হত্যা থেকে যৌতুকের জন্য গলায় দড়ি। ১১

নিরাশার চালচিত্র

‘শিল্পোন্নত বিশ্বের নারীদের চাইতে স্বল্পোন্নত দেশের নারীরা প্রায় ২৭ বছর কম বাঁেচ। ফ্রান্স ও জাপানের নারীরা গড়ে বাঁেচ ৮৩ বছর অথচ সিয়েরা লিওনের নারীদের প্রত্যাশিত আয়ু মাত্র ৩৭ বছর। মালি কিংবা নিগারে মেয়েদের বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। জাপান, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে মেয়েদের বিয়ের বয়স গড়ে ২৭ বছর।

সেনেগালে নারীরা সপ্তাহে ১৭.৫ ঘন্টা সময় পানি আনার জন্য ব্যয় করে। পেরুতে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহের জন্য নারীদের ব্যয় করতে হয় ২.৫ ঘন্টা। মজুরীবিহীন ও মজুরীযুক্ত শ্রমের বিবেচনায় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই পুরুষের চাইতে বেশি কাজ করে থাকে নারীরা। নারীর বৈশ্বিক গড় মজুরী পুরুষের তিন চতুর্থাংশ । তানজেনিয়ার নারীরা পায় পুরুষের মজুরীর ৯২ শতাংশ, বেলজিয়াম, জার্মানী ও যুক্তরাষ্ট্রে নারীর মজুরী পুরুষের মজুরীর ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশে তা ৪২ শতাংশ।

অধিকাংশ আফ্রিকান দেশসমূহে মোট খাদ্য উৎপাদনে নারীর অবদান হল ৮০ ভাগ অথচ তারা ক্ষুদে কৃষকের জন্য প্রদত্ত ঋণের মাত্র ১০ ভাগেরও কম পায়। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের শতকরা ৮৫ ভাগ নারী লিখতে পড়তে পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ও আরব দেশ সমূহের নারী সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৩৪ শতাংশ এবং ৪১ শতাংশ।

প্রতিবছর এশিয়ায় প্রায় ১০ লাখ শিশুকে পতিতাবৃত্তি পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হয়। যাদের অধিকাংশই বালিকা। বিশ্বে চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাসকারী ১৩০ কোটি মানুষের ৭০ ভাগই নারী। যদিও নারীরা মোট ভোটার সংখ্যার অর্ধেক তবুও বিশ্বের জাতীয় সংসদে নারীর আসন মাত্র ১৩ ভাগ। ১২

উচ্চ মজুরীর কর্মসংস্থানে পুরুষদেরই প্রাধান্য দেখা যায় এবং কম মজুরীর কাজে নারীর আয় পুরুষের আয়ের ৫০-৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২০-৫০ শতাংশ কম। বিশ্বের ৯৬ কোটি বা ৯৬০ মিলিয়ন নিরক্ষরের দুই তৃতীয়াংশই নারী। কম মজুরীর নিকৃষ্ট কর্মে নারীর অংশগ্রহণ যতোটা বেড়েছে, উচ্চমজুরী ও উচ্চস্তরের মর্যাদা সম্পন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহন সেই তুলনায় নগন্য মাত্রায়ও বাড়েনি। এই কম মজুরীর শ্রমে নারীর কেন্দ্রীভবন সবচাইতে দৃশ্যমান হলো গার্মেন্টস কারখানায় যেখানে গোটা বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছে নারী এবং তা ম্যানুফ্যাকচার শিল্পের নারীর শ্রমশক্তির এক পঞ্চমাংশকে ধারণ করে।

অন্যদিকে ভালো মজুরীর ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান পে-স্কেলের একেবারে শেষ প্রান্তে। প্রায় দুই তৃতীয়াংশ নারী যারা ম্যানুফ্যাকচারিং এর সঙ্গে জড়িত তারা মূলত শ্রমিক অপারেটর বা প্রোডাকশন ওয়ার্কার মাত্র। মাত্র ৫ভাগ নারী প্রফেশনাল ও টেকনিক্যাল পেশায় নিয়োজিত এবং মাত্র ২% প্রশাসনিক ও ম্যানেজার পদে। অনুরুপভাবে সার্ভিস বা পরিসেবা খাতেও অধিকাংশ নারী শ্রমিক কাজ করলেও মাত্র ১৪% নারী প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক পদে এবং ৬% এরও কম উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক পদে নিযুক্ত। শ্রমঘন ও সরল প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পগুলোতে নারী শ্রমের কেন্দ্রীভবন নারী শ্রমশক্তির কোণঠাসাকরনের সবচেয়ে দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত।১৩

উন্নত দেশগুলোতেও মজুরি বৈষম্য প্রকট। যেমন কেনিয়াতে কৃষিবহির্ভূত কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত নারীর গড় মজুরি হল পুরুষের ৮৪ শতাংশ, জাপানি নারীরা এক্ষেত্রে পুরুষের আয়ের মাত্র ৫১ শতাংশ আয় করে। নারীরা পৃথিবীর জনংখ্যার অর্ধেক, মোট শ্রমশক্তির ৪৮% এবং জাতীয় আয়ের নারীর অবদান ৩০ ভাগ। নারীরা পৃথিবীর মোট কাজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পাদন করে এবং পুরুষের চাইতে প্রায় ১৫গুণ সাংসারিক কাজের বোঝা বহন করে।

কিন্তু মোট সম্পদের মাত্র একভাগের মালিক হলো নারীরা এবং মোট আয়ের ১০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ লাভ করে নারীরা। যেহেতু নারীর সাংসারিক কাজকে উৎপাদনমূলক বা অর্থনৈতিক কাজ হিসাবে গন্য করা হয়না। তাই প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি থেকে নারীর এই অদৃশ্য অবদান স্বরুপ ১১ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়ে যায় অর্থাৎ পরিমাপ হয় না।

প্রতিবছর জেন্ডার বৈষম্যের দরুন দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ মিলিয়ন নারী হারিয়ে যায়। যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবহেলার দুর্ভাগ্যজনক শিকার এবং যারা আজো বেঁেচ থাকতে পারতো। পৃথিবীর ১৫৫ কোটি চরম দারিদ্র জনগোষ্টীর ৭০ ভাগ এবং নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশ নারী। স্কুলে না যাওয়া শিশুদের মধ্যে ৮ কোটি মেয়ে।

যদিও নারীরা দুনিয়ার মোট ভোটারের অর্ধেক কিন্তু সারা দুনিয়ায় মাত্র ১০% নারী জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। মাত্র ৬% নারী মন্ত্রী পর্যায়ে রয়েছেন এবং ৬২ টি দেশে কোন মহিলা মন্ত্রী নেই। বিশ্বের ইতিহাসে এ যাবতকালে সর্বোচ্চ পদাধিকারী ১৮৫ জন কুটনীতিকের মধ্যে ৭ জন নারী, গোটা বিশ্বে প্রশাসনিক পর্যায়ে নারী মাত্র ৫%। ১৪

বিশ্বের সর্বত্র এখনো ‘নারীর কাজ’ বা ‘পুরুষের কাজ’ এভাবে চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক শ্রমকে লিঙ্গীয় ভিত্তিতে পেশাগত পৃথকীকরণ (Occupational Segregation) করা হয়ে থাকে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে ৫০০ ধরনের কৃষি বহির্ভূত পেশার প্রায় ৪৫% ভাগ শ্রমশক্তি লিঙ্গীয় ভিত্তিতে গঠিত। যেখানে হয় শুধু নারী নয়তো কেবল পুরুষ মোট শ্রমশক্তির ৮০ ভাগ।

জাপানে দিবাযত্ন কেন্দ্র, হাসপাতাল কর্মী, নার্স, কিন্ডারগার্ডেন শিক্ষক, গৃহকর্মী  (House-keeper) চাকরাণী, পেশাদার আনন্দদানকারী ইত্যাদি পেশায় ৮০ ভাগই হলো নারী। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের ৮০ ভাগ শ্রমশক্তিই নারী। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে মোট নারী শ্রমিকের ৭১ ভাগ সার্ভিস বা পরিষেবা খাতে নিযুক্ত।

এশিয়া ও আফ্রিকায় অধিকাংশ নারী শ্রমিক বিশেষ করে সাব সাহারা অঞ্চলের ৮০ ভাগেরও বেশি নারী সবচেয়ে কম মজুরিতে কৃষি কাজে নিয়োজিত এবং এক তৃতীয়াংশের বেশি নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। সারা দুনিয়ার নারীরা তাদের সহকর্মী পুরুষের চাইতে অনেক কম মজুরীতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে থাকে। নারীরা শ্রমের বাজারে সবচেয়ে বিলম্বে প্রবেশ করলেও অর্থনৈতিক মন্দার বিরুপ প্রতিক্রিয়া স্বরুপ কর্মচ্যুতির শিকার কিন্তু প্রথম হয় নারীরাই। ১৫

আন্তুর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী বিশ্বের সকল নারীর ৪৫ ভাগেরও বেশি এখন অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। দু’দশক আগে শিল্পোন্নত দেশে মোট কর্মক্ষম নারীর অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক অর্থনৈতিক কাজে স¤পৃক্ত ছিল। পশ্চিম ইউরোপে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের হার ৩৭% , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩০% এবং পূর্ব ইউরোপে ৫০% এর উপরে।

এশিয়ায় কর্মজীবি নারীর হার এখন ৪৯ % থেকে বেড়ে ৫৪% হয়েছে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ৩৮% থেকে হয়েছে ৪০% , দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৪% দু’দশক আগে যা ছিল ২৫%। যেসব অঞ্চলে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের হার তুলনামুলক ভাবে কম ছিল সেসব দেশেও এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ল্যাটিন আমরিকায় ২২% থেকে ৩৪% , উত্তর আফ্রিকায় ৮% থেকে ২১% হয়েছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ নানা সামাজিক ধর্মীয় কারণে নিরুৎসাহিত হলেও ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি কিন্তু এখনও নারীর অর্থনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করেনি। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা আজও বহুমুখী বৈষম্যের শিকার। নিয়োগ ও পদোন্নতির বেলায় অসম মানদন্ড, প্রশিক্ষণের অসম সুযোগ, সমান কাজের অসম মজুরী, ঋণ ও উৎপাদনমূলক সম্পদ লাভের সুযোগ, নির্দিষ্ট কতগুলো পেশায় যোগদান নিষিদ্ধকরণ, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম অংশগ্রহণ ইত্যাদি হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যের আংশিক চিত্রমাত্র। ১৬

বিভিন্ন ভাগে বর্ণিত তথ্য এ ব্যাপারটি আরো সুস্পষ্ট করবে।

অর্থনীতিতে জেন্ডার বৈষম্য

প্রথমে অর্থনীতিতে নারীর চিত্র আলোচনা করব। ১৯৯৪ সাল নাগাদ ১৫ থেকে ৬৪ টি বছর বয়সী বিশ্বের নারীদের প্রায় ৪৫% অর্থনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিল। উন্নত দেশগুলোতে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা পুরুষের চাইতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ৮ মিলিয়ন নতুন নিয়োগের মধ্যে ৭ মিলিয়ন নারী।

মধ্য ও পুর্ব ইউরোপে নারী পুরুষ উভয় শ্রমশক্তির অংশগ্রহনের হার সংস্কারপূর্ব পর্যায় থেকে অনেক হ্রাস পেয়েছে। বিশেষত চেক প্রজাতন্ত্র ও বুলগেরিয়ায় পুরুষের চাইতে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার অনেক হ্রাস পেয়েছে পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের শ্রমমক্তির ৮০ ভাগই হচ্ছে নারী শ্রমিক।

আর্ন্তুজাতিক শ্রমমক্তি স্থানান্তর বা অভিবাসনের (migration) ক্ষেত্রে ফিলিপাইন থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের নারী পুরুষের যাওয়ার অনুপাত হচ্ছে ১২ঃ১ ইন্দোনেশিয়ায় ৩ঃ১ এবং শ্রীলংকায় ৩ঃ২। উন্নত দেশগুলোতে পুরুষের চাইতে নারীরা প্রতিসপ্তাহে কমপক্ষে ২ ঘন্টা বেশী কাজ করে এবং প্রায়শই এই পরিমাণ প্রতি সপ্তাহে বেড়ে দাড়ায় ৫ থেকে ১০ ঘন্টা।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীরা সপ্তাহে ৩১ থেকে ৪২ ঘন্টা মজুরীবিহীন কর্মে নিয়োজিত থাকে। আর পুরুষরা এ ধরণের কাজ করে থাকে ৫ থেকে ১৫ ঘন্টা। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় নারীদের ৭১% পরিষেবা খাতে কেন্দ্রীভূত।

উন্নতদেশগুলোতে ৬০% নারী এই খাতে নিয়েজিত সাব সাহারা আফ্রিকায়, কৃষিখাতে নারী শ্রমকদের পরিমাণ ৮০% ভাগেরও বেশি। এশিয়ায় এই হার কমপক্ষে ৫০%। বিশ্বের সর্বত্রই পুরুষের চাইতে নারীরা কম মজুরী পায় এবং এই নেতিবাচক অবস্থা খুব দ্রুত পরিবর্তনের কোন আলামত নেই । কৃষি বহির্ভূত খাতে অধিকাংশ নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষের মজুরীর প্রায় চারভাগের তিনভাগ আয় করে। শিল্পোন্নত দেশে খন্ডকালীন চাকরির ক্ষেত্রে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

উন্নত দেশগুলোর মোট খন্ডকালীন চাকরীর ৬৫% থেকে ৯০% নারীরা করে। আফ্রিকায় কৃষিখাতের বাইরে এক তৃতীয়াংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কাজে নিয়োজিত। এই হার জাম্বিয়ায় ৭২%, গাম্বিয়ায় ৬২%, কোরিয়ায় ৪১%, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৫% এবং লিমায় (পেরু) ৮০% ভাগেরও বেশি। উন্নত বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ দেশের নারীর বেকারত্বের হার পুরুষের চাইতে অনেক বেশি-সাধারণভাবে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশি। হাঙ্গেরি, লিথুনিয়া এবং শে¬াভেনিয়া ছাড়া কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপে নারীর বেকারত্বের হার এখন অনেক বেশি।

বিশ্বের দারিদ্রদের প্রায় ৭০ ভাগ নারী এবং বিশ্ব নিরক্ষরের ৬৫ ভাগই নারী। ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক ব্যাংক গুলো উন্নয়শীল দেশগুলোকে যে ৫৮০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ গ্রামের মেয়েদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে। এই হিসেবে দেখা যায় ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৫ ভাগ ঋণ গ্রামীণ নারীদের কাছে পৌঁছায়।

সারা দুনিয়ায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে নারী সৈনিক মাত্র ২ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারী শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা ৩১% এবং সারা বিশ্বে ৪৬.৭ শতাংশ। অধিকাংশ দেশে মোটামুটিভাবে মেয়েরা বিনা মজুিরতে পুরুষের চাইতে দ্বিগুণ শ্রমদান করে। ১৭

সমাজ যে নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ এটাই উপরোক্ত বর্ণনা প্রমাণ করে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে এটা সুস্পস্ট হয়। লক্ষ্যনীয় যে, নারী তার অধিকাংশ কাজেই কোন আর্থিক মূল্য পায় না। এমনকি যখন নারীর কাজের আর্থিক মূল্য দেয়া হয়, তখন জাতীয় পরিসংখ্যানে নারীর অবদানকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় না অথবা বাদ দেওয়া হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, পল¬ী অঞ্চলের নারীরা শুধু খাদ্য প্রস্ততই করে না, পরিবারের অধিকাংশ খাদ্য তারা উৎপাদনও করে থাকে।

তাছাড়া পানি, রান্না, জ্বালানি এবং গৃহপালিত পশুর খাদ্য সংগ্রহের দায়িত্বটি সাধারণত পরিবারের কিশোরী এবং নারীদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু নারীর অর্র্থনৈতিক অবদানকে উপেক্ষা করার পেছনে কারণ হল এই যে, তারা মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভূক্ত, যেখানে পদ্ধতিগতভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়না। নারীর শ্রমের হিসাব করার পদ্ধতি উন্নত করলে তা নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরো দৃশ্যমান করে তুলবে এবং এর সুফল তখন বিনিযোগের অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সঙ্গে বিচার করা যাবে।১৮

রাজনীতিতে জেন্ডার বৈষম্য

রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর সরব পদচারনা ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা হয়ে উঠলেও এখনো বিশ্বজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক সম্পদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ খুবই নগণ্য। আজও দুনিয়ার কোথাও নারীরা একজন পুরুষের মত পরিপূর্ণ রাজনৈতিক মর্যাদা উপভোগ করে না।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে নারীর বিযুক্তির কারণ নিহিত বয়েছে আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে। নির্বাচনমূলক রাজনীতিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস খুবই নিকট অতীতের। ফলে রাজনীতির প্রক্রিয়ার সকল দিক সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা ও ধারণা একবারেই সীমিত। অধিকাংশ দেশেরই নারীরা মাত্র বিগত ৩০ বছরের মধ্যে ভোটাধিকার অর্জন করতে পেরেছে। সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও নারীরা ১৯৭১ সালে ভোটাধিকার লাভ করেছে।

বিশ্বের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ। বিশ্বব্যাপী নারীরা সংসদীয় আসনের মাত্র ১০ ভাগ অর্জন করতে পেরেছে। ১৯৮৯-৯৩ পর্বে এই হার প্রায় ৩ ভাগে নেমে এসেছে, বিশেষত সাবেক পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৯৩ সালে ১৭১টি দেশের মধ্যে ১৬০টি জাতীয় সংসদে নারীর আসন ২০ ভাগের বেশি ছিল না। ৩৬টি দেশে নারীরা ০.৪ ভাগের বেশি আসন পায়নি।

বিশ্বজুড়ে মন্ত্রী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৪ ভাগ। ৮০ টিরও বেশি দেশে মন্ত্রী পর্যায়ে কোন নারী নেই । নারী নেতৃত্বাধীন মন্ত্রনালয়গুলোর অধিকাংশ আবার স্বাস্থ্য, কল্যাণ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, নারী ইত্যাদি তথাকথিত ‘নারী বিষয়’ সংশি¬ষ্ট জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে সমস্ত স্তরে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পেছে শুধু মাত্র নরডিক দেশগুলো। এদের মধ্যে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধির হার ফিনল্যান্ড ৩৯%, নরওয়ে ৩৯% সুইডেন ৩৪% ডেনমার্ক ৩৩%। কেবলমাত্র সুইডেনে ১৯৯৫ সাল নাগাদ মন্ত্রিসভায় মোট মন্ত্রীর মধ্যে অর্ধেক নারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

আর এযাবৎকাল বিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধান হতে পেরেছেন খুব কম সংখ্যক নারী। উন্নয়নশীল ৫৫ টি দেশের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের হার ৫ শতাংশ বা তারও কম । ব্যতিক্রম শুধু কিউবা (২৩%), চীন (২১%) এবং উত্তর কোরিয়া (২০%) ১৯৯০ এর শেষে ১৫৯ দেশের মধ্যে মাত্র ৬টি দেশের জাতিসংঘ প্রতিনিধি প্রধান ছিল নারী। জাতিসংঘের ৫ জন উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকের মধ্যে ১ জন মাত্র নারী।

রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বস্তরে নারীরা এত উপেক্ষার শিকার হয়েছেন যে, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়টিকে অনেকে পুরুষের স্থান দখল বলে ভুল করে বসেন। কিন্তু নারীর রাজনৈতিক অধিকার অর্জন নিছক স্থান দখলের স্বার্থে নয় বরং রাজনৈতিক জীবনে নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিত করাটাই এখানে মূল যৌক্তিক অবস্থান।

সাধারণত রাজনীতিতে পুরুষ প্রাধান্যের বিষয়টিকে তত্ত্বগতভাবে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রথমত বলা হয় যে, নারীরা গৃহকর্মে আত্ননিবেদন করতে উৎসাহী বা সংসার সংশি¬ষ্ট কর্মকান্ডে আত্ননিয়োগই হচ্ছে নারীদের সামাজিকভাবে নির্ধারিত পছন্দ। দ্বিতীয়ত হলো প্রচলিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টান্ত উলে¬খ করে রাজনীতিতে পুরুষের ভূমিকা এবং অধিকারের বিষয়টিকে তুলে ধরা। ১৯

আইন ও জেন্ডার বৈষম্য

আইনের চোখে সমতা একটি মৌলিক মানবাধিকার হলেও এখনো তা বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন বাস্তবতায় রুপ লাভ করেনি। সর্বত্রই এখনো নারীরা তাদের হীন অবস্থানের কারণে আইনগত অধিকার ভোগ করতে পারেনা। কেনিয়া, সোয়াজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ের জমি মালিকানা আইনে নারীর জমি লাভের কোন অধিকার নেই। আবার সুইজারল্যান্ডে বিবাহিতা নারীরা তাদের নিজস্ব আয়জনিত আয়কর ফরম পূরণ করতে পারে না। এটি অবশ্যই তাদের স্বামীরা তাদের পক্ষ থেকে পুরণ করে।

ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে ঘোষিত বৈষম্য না থাকলেও নারীরা ঋণ বিশেষত বৃহৎ ঋণ লাভের সুযোগ পায় না। এক্ষেত্রে জমি বা অন্য কোন সম্পদ বন্দক হিসাবে দেখানোর শর্ত আরোপ করা হয়, যেখানে অধিকাংশ নারী কি-না সম্পদহীন । জায়ারে লিঙ্গীয় ভিত্তিতে বেষম্য সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও পারিবারিক আইনে কিন্তু একজন স্ত্রীকে তার সকল আইনী কর্মকান্ডের জন্য স্বামীর স্বাক্ষর নিতে হয়।

সোয়জিল্যান্ডে ছেলেমেয়ে উভয়ই ২১ বছর বয়সে আইনের চোখে সাবালক হলেও কোন মেয়ের পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সেই মেয়ের যে কোন একজন পুরুষ আত্নীয়ের লিখিত অনুমতি দাবি করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত আইন বিভিন্ন দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিধান দ্বারা কোণঠাসা হয়ে নারীর প্রতি বৈষম্য আরোপ করে থাকে । এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী নারীর বিবাহ, তালাক, প্রজনন অভিভাবকত্ব ইত্যাদির অধিকারে প্রভাব, বিশেষভাবে উলে¬খযোগ্য।

জাপানে সমান কর্মসংস্থান সুযোগ আইনের অধীনে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নর নারীর সমতার নীতি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ করলে কি শাস্তি প্রদান করা হবে, তা আইনে অন্তর্ভূক্ত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাত ঘটানোর আইনগত অধিকার থাকলেও এক্ষেত্রে তহবিলের ঘাটতি, জনবলের অভাব, রাষ্ট্রীয় বৈধ বিধি নিষেধ স্বরুপ পিতামাতার সম্মতি, গর্ভপাতের জন্য অপেক্ষা পর্বের ঝামেলা ইত্যাদি লক্ষ লক্ষ গরীব তরুণী মেয়েদের এই গর্ভপাতজনিত পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করে।

বিভিন্ন দেশে নারীর স্বার্থ সংরক্ষণকারী অনেক প্রগতিশীল আইন গ্রহণ করা হলেও অধিকাংশ নারীর সাংসারিক দায় দায়িত্ব ও কাজের বোঝা তাদের এসব আইনের সুযোগ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। কেবল বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন, জেন্ডার বেষম্য নিষিদ্ধকারী আইন প্রয়োগের সাথে সাথে সংশি¬ষ্ট সকল ব্যক্তিদের জেন্ডার সচেতনতা প্রশিক্ষণ ও প্রদান করতে হবে। যাতে তাদের কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্তে নারী সম্পর্কে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিজাত জেন্ডার বৈষম্যমূলক সাং¯ৃ‹তিক মানোভাবকেই প্রতিফলিত না করে। ২০

জেন্ডার বৈষম্যমূলক চিত্রায়ন

গণমাধ্যমের বিপুল ক্ষমতা ব্যবহৃত হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে। নারীকে আরো বেশি করে পণ্য, ভোগের সামগ্রী ও যৌনবস্তুতে পরিণত করছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা তাকে যৌন বস্তুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে। পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য ভোক্তাকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে নারীদেহ প্রদর্শনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে।

নারীরা হয়ে উঠছে পণ্য বিক্রির পণ্য। পণ্যের ভোক্তা এবং প্রবক্তায় পরিণত করা হয়েছে আজ নারীদের। আজ নারীরা কেবল পণ্য বিক্রির হাতিয়ারই নয়, তারা পণ্যের বাজারের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তাও বটে। গণমাধ্যমে নারীর গৎবাঁধা নেতিবাচক ভাবমূর্তি চিত্রিত করে বিদ্যমান জেন্ডার বৈষম্যকে আরো মদদ দিচ্ছে। গণমাধ্যমে নারীকে নেতিবাচক উপস্থাপনা কেবল নারীর ক্ষতিই করে না, সেই সঙ্গে নারীর প্রতি পুরুষ ও শিশুদের বিকৃত মনোভাব গড়ে তোলে।

প্রকৃত বাস্তবতাকে আড়াল করায় যখন নারী ও পুরুষ গণমাধ্যম নির্মিত উৎকট জগতের সঙ্গে বাস্তবে খাপ খাওয়াতে পারেনা, তখনই জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়। নারীকেন্দ্রিক সৌন্দর্য বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটছে, ইহা কেবল প্রসাধনী সামগ্রি বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে পাল¬া দিয়ে বাড়ছে বিউটি পার্লার, ফিটনেস সেন্টার, মেদ কমানোর কেন্দ্র, কসমেটিক সার্জারি ক্লিনিক ইত্যাদি।

এভাবে নারীর সৌন্দর্যকে কেবল দেহগত, মুখশ্রীকেন্দ্রিক, ফর্সা রং এর মধ্যে আবদ্ধ রাখায় তার সৌন্দর্যের অন্যদিকগুলো ঢাকা পড়ছে । নিছক যৌনধর্মী সৌন্দর্যের শৃংখলে কবলিত হয়ে নারীর সত্যিকার সৌন্দর্য বিকশিত হবার পথ রুদ্ধ হচ্ছে। সৌন্দর্য বাণিজ্যের হাতছানিতে প্রলাভিত হয়ে নারী তার দেহের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং প্রচারক বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ২১

জাতীয় বাজেটে জেন্ডার বৈষম্য

রাজস্ব বাজেট থেকে নারীরা যা পায় তা খুবই অপ্রতুল। সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৫ শতাংশ। ফলে রাজস্ব বাজেট বরাদ্ধের সিংহভাগ থেকে নারী বঞ্চিত হয়। ২০০৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের জন্য বরাদ্ধ হয়েছে ৭৪৯ কোটি টাকা । যা মোট বাজেটের ১ শতাংশ। তবে ছাত্রী উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখ ১ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে।

নারী প্রগতি সংঘের তথ্য মতে ২০০১-০২ সালে গৃহীত মোট ৩২৬টি সরাসরি উৎপাদনশীল খাতের প্রকল্পের মধ্যে নারী কেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প ছিল মাত্র ২১টি। ২০০১-২০০২ অর্থ বছরে জেন্ডার অন্ধ প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ২৪২টি। ২০০৫-০৬ সালে এ ধরণের প্রকল্প বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৫৫টি।

অথচ ঐ সময়ে শুধুমাত্র নারী কেন্দ্রিক প্রকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩ টি । মোট সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ সরাসরি নারীর ভাগ্যে জোটে। ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে উৎপাদনশীল ক্ষেত্রের আরো প্রায় ২৩ শতাংশ সম্পদে পুরুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করার সুযোগ ছিল নারীর। কিন্তু এ ধরণের প্রকল্পগুলো থেকে নারীরা সামান্যই পায়।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে উৎপাদনশীল ক্ষেত্রটিতে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ১৪ শতাংশ কেবল নারীর জন্য ছিল। আর ৪৯ শতাংশের মতো বরাদ্দ নারী ও পুরুষের মধ্যে ভাগাভাগি করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশের উপরই নারীর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ২০০১-০২ সালের বাজেটে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে গ্রাস সরবরাহের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু এই ধরণের প্রকল্প বড় আকারে গ্রহণ করা হয়নি। যাতে করে নারীর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো ব্যবসার উদ্যোগ নেওয়ার ঝুকি নিতে পারে।২২

আামাদের প্রচলিত বাজেটেই মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য কোনো পৃথক বাজেট থাকেনা। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মেয়েদের স্কুলে ৩১৯ জন ছাত্রীর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ বিজ্ঞান শাখায় পড়ছে।২৩

২০০৪-০৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নথিভুক্ত কেসের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ২২২টি । এর মধ্যে নারী নির্যাতন সেলে রেফার্ড কেসের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৩৫৮টি। অথচ বেসরকারি হিসাব মতে প্রতিবছর গড়ে ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬০ জন নির্যাতিত হয়। এর মাত্র এক শতাংশ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

২০০৩-০৪ সালে নারীনির্যাতন দমন সেল একটি নারী নির্যাতন মামলার জন্য গড়ে ৪ হাজার ৭৮৩ টাকা ব্যয় করেছে। যদিও মহিলা পরিষদ সুত্র মতে বিভিন্ন নারী নির্যাতন মামলার ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ ২০ থেকে ৭১ হাজার টাকা হতে পারে। নারী নির্যাতন দমনে প্রকৃত ব্যয় বরাদ্দ ২০০৪-২০০৫ সালে ছিল ৬৬.১ মিলিয়ন টাকা। যা নূন্যতম প্রয়োজনের তুলনায় ২৭ গুণ কম।

নারী নির্যাতন দমনের বর্তমান বাজেট বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় অপূর্ণ চাহিদা হলো ৯৬.২৫ শতাংশ । সে অনুযায়ী ২০০৪-২০০৫ সালের বাজেট হওয়া উচিত ছিল ১০ হাজার ২০৪ মিলিয়ন টাকা। কিন্তু ঐ বছর একজন মোট বরাদ্দ করা হয় ২ হাজার ৯৬৪ মিলিয়ন টাকা। স্বাস্থ্য খাতে যক্ষাè রোগ নির্ণয়ে যে বরাদ্দ করা হয় সেখানেও অনেক জেন্ডার বৈষম্য বিদ্যমান।

ক্রীড়া খাতে বাজেট ব্যয় বরাদ্দের চিত্রটিতেও নারীর প্রতি বৈষম্য ভালোভাবেই চোখে পড়ে। ক্রীড়া উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ১০.৩ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ থাকে। ২০০৩-২০০৪ এবং ২০০৪-২০০৫ সালের জেলা ক্রীড়া সংস্থার বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ১৯.৮ শতাংশ ও ২০.৪ শতাংশ । শারীরিক শিক্ষা কলেজের ২০০৪-০৫ সালের বাজেটের ১৮.৭ শতাংশ ছিল নারীদের। ক্রীড়া খাতে নারীর জন্য বরাদ্দের নিম্নতর দশা বাজেটের জেন্ডার অসংবেদনশীলতাকেই তুলে ধরে।২৪

যেহেতু আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হল নারী সেহেতু দেশ ও উন্নত জাতি গঠনের জন্যে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট জরুরি। বাজেটে জেন্ডার সচেতনতার অভাব দূর করা প্রয়োজন । বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটকে আরো জেন্ডার সংবেদনশীল করে পাবলিক সার্ভিসে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

রাজস্ব ব্যয়ের ৩০ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন ভাতা, বোনাস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যয় হয়। নারীরা এই বাজেট বরাদ্দের খুব সামান্য অংশই পায়। কারণ, সরকারী কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সংখ্যক নারী নেই। বাংলাদেশে সরকারী চাকরিজীবী মাত্র ১২ শতাংশ নারী এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উচ্চস্তরে নারীর অংশগ্রহণ মোট চাকরির মাত্র ২ শতাংশ । এ কারণে পেনশন ও গ্র্যাচুয়িটির জন্য ব্যয়কৃত মোট রাজস্বব্যয়ের ৮ শতাংশের খুব সামান্য অংশই নারীরা পেয়ে থাকে। ২৫

বাজেটকে জেন্ডার সচেতন করাটা নীতি নির্ধারকদের অনুকম্পা বা বদান্যতা নয়। যৌক্তিক ও ন্যায্য কারণেই জেণ্ডার সংবেদনশীল সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থা, অবস্থান, ক্ষমতা, অভিগম্যতা, সম্পদ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রধান প্রধান কারণ সমূহ চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুসারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। ২৭

জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে করণীয়

জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অমূল্য অবদান এবং উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অন্তর্ভূক্তির বিষয় বিবেচনা করে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ২৮

বাজেটের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য থাকা অনুচিত। নারীকে শুধু গতানুগতিক কাজে, যেমন ভিজিডি, ডিজিএফ কার্ড ও বিধবা ভাতা ইত্যাদিতে না রেখে সেই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বরাদ্দ বৃদ্ধি করে নারীকে দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে কাজে লাগানো উচিত। শুধু প্রজনন স্বাস্থ্যই নয়, শ্রমবাজারে প্রবেশ করে নারীরা সাধারণ স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও যেসব ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যৌন হয়রানির শিকার হয়, নারী নির্যাতনের বিচারের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুুখীন হয়- বাজেটে তার দিক-নির্দেশনাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে তার উলে¬খ থাকা উচিত।

এছাড়াও নারীর কাজের অধিকাংশ সময়ই যে গৃহস্থালীতে ব্যয় হয়- সেখানে উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা, পানি, বিদ্যুৎ গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা, শ্রমজীবী নারীর পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধিসহ শিশুর দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে , বীজ সংরক্ষণে গ্রামীণ নারীর যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন দরিদ্র্য ও বিত্তহীন নারীর মধ্যেও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা ।

তাই কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে এদের কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যবস্থা ও বরাদ্দ রাখাও দরকার। কেননা নারীরা হল দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্রতম। এছাড়াও তারাই বেশি পরোক্ষ করের বোঝা বয়ে বেড়ায়। তার ওপর যাতায়াত ব্যবস্থা ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাদের ওপর বাড়তি চাপ এসে পড়ে। এ কারণে শুধু নারীকে টার্গেট করে বরাদ্দ করা না হরে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নারী খুব কম সুবিধাই ভোগ করে।

অথচ ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে ৬৫ হাজার ৫ শতাংশ ৫৮ কোটি ১৯লাখ ৯ হাজার টাকার জাতীয় বাজেট পাস হয়, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৮.৪০ শতাংশ বেশি। গ্রামীণ জনগণের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির জন্য এই বাজেটে ৪৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যার মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৩৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং এ কার্যক্রমের আওতায় দুঃস্থ নারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের পর ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।

এছাড়া নারী উন্নয়নে সরাসরি নিয়োজিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন মিলিয়ে ২৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। ২০০১-২০০২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯০ কোটি , ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ, ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে ২৩৭ কোটি টাকা।২৯ প্রয়োজনের তুলনায় যা বড়ই অপ্রতুল ।

জেন্ডার বৈষম্য আচরণের প্রভাব পড়েছে নারীর শিক্ষায়, সম্পদে, স্বাস্থ্যে, পুষ্টিতে, পারলেই অনেক সমাজে এই ভ্রণটিকে গর্ভপাতের মাধ্যমে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হয়। এর পরিণতি অদূর ভবিষ্যতে হবে ভয়াবহ। সমাজে নারীর সংখ্যা কমে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য লোপ পাবে, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তখন নারী যাবে কোথায় ? নারীকে মনে করা হয় সে দুর্বল, তাই সবলের প্রভুত্ব তার ওপর থাকবেই। কিন্তু নারীর শারীরিক গঠন দুর্বলতা নয়, একটি বিরাট শক্তি।

নারীর আছে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য, আছে অত্যন্ত স্নেহ, মায়া-মমতা ও প্রেম-প্রীতিভরা হৃদয় – সর্বোপরি নারীরই আছে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা, যা কিনা পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, করেছে গতিশীল। নারীর প্রতি পরিবারের সমাজের তথা দেশের সবারই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা প্রয়োজন। জেন্ডার বৈষম্য যতদিন পর্যন্ত দূর না হবে ততদিন আমাদের মাতা বধূ-কন্যারা সুস্থ জীবনধারায় আসতে পারবে না। নারী যতদিন তার জীবন চক্রে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হয়ে একই আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকবে, ততদিন তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ৩০

ILO তথ্য মতে-প্রতিবছর ৮ লাখেরও বেশি এশিয় নারী কাজের জন্য বিদেশে গমন করছে। এই নারী শ্রমিকরা বিপুলভাবে বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। বেসরকারী সংস্থা দৃষ্টি প্রদত্ত তথ্যমতে বাংলাদেশের প্রায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার নারী এখন বিদেশে কর্মরত। গত দু’দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানির শিকারের হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

নারীরা কর্মক্ষেত্রে চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, নিম্ন মজুরি, খারাপ কর্ম পরিবেশ, নিম্ন মর্যাদা, অত্যন্ত সীমিত দর কষাকষির ক্ষমতা ইত্যাদি পেশাগত নাজুকতায় ভোগে। ফলে তারা সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। জাতিসংঘ তথ্যমতে শুধুমাত্র পশ্চিম ইউরোপেই এখন ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি নারী ব্যবসা চলে। পুলিশের তথ্যমতে দেশের বাইরে কাজে যাবার নামে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার নারী ও শিশু। নারীরা সামঞ্জস্যহীনভাবে দরিদ্র।

নারী ও পুরুষ দুজনের দরিদ্র হবার কারণ হুবহু এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ভিন্নভিন্নভাবে নারী ও পুরুষ দারিদ্র্যের মোকাবেলা করার বা এর হাত থেকে বাঁচার সক্ষমতাও নারী ও পুরুষের এক নয়। বিদ্যমান জেন্ডার বৈষম্য, নারী পুরুষের অসম ক্ষমতা সম্পর্ক এবং অন্যান্য বৈষম্য ও ক্ষমতাযুক্ত হবার জন্য এই ভিন্নতর সৃষ্টি হয়। ফলে বিশ্বায়নের প্রভাব যেকোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে নারীরা সবচেয়ে অসহায় হয়ে দারিদ্র্যের কবলে পড়ে। ৩১

নারী ও পুরুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমিতি গড়ে তোলে জেন্ডার, যা প্রায়ই বৈষম্যমূলক। আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মতামত প্রদান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয় বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী । সমাজের শ্রেণীবৈষম্যের জগদ্দল পাথরকে উপড়ে ফেলতে না পারলে জেন্ডার বৈষম্য কখনোই দূর করা সম্ভব হবে না।

কাজেই কিছু পথিকৃৎ এগিয়ে আসতে হবে যাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক পরিসরে শ্রেণীবৈষম্যকে ঘৃণা করা হয় এবং তা ভাঙ্গার জন্য বৈপ¬বিক উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমন- পরিবারে ছোটদের মতামতকে সমানভাবে মূল্য দেয়া, পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করা। পরিবারে সহযোগীদের সাথে বিশ্বাস নির্ভর সম্পর্ক গড়ে তোলা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাকে অপরাধ বলে গণ্য করা। ৩২

আমাদের দেশে নারীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ উপকরণ গুলো তাদের সহায়ক হওয়ার পরিবর্তে যেন এ প্রবণতাকে আরো জোরদার না করে সেই চেষ্টাই করতে হবে। কারণ দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলার জন্য দেশের সব জনগোষ্ঠীর সম অংশগ্রহণ জরুরি। এজন্য যোগাযোগ উপকরণে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি পক্ষপাতহীনতা ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে হবে, যাতে কোন পক্ষের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয় এবং অন্যদিকে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যগুলোকেও চ্যালেঞ্জ করে।

যোগাযোগ উপকরণ তৈরির সময় উপকরণের পাত্র-পাত্রী বা চরিত্রগুলোর মর্যাদা রক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপঃ আমাদের দেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী, তাই পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে তৈরি কোনো শিক্ষা উপকরণে নারীদেরকে নির্যাতিত দেখানোটাই স্বাভাবিক। বাস্তবতা বোঝাতে নারীদের নির্যাতিতরূপে উপস্থাপন করাটা জরুরী, কিন্তু এটা করার সময় কিছু বিষয়ে খুবই সচেতন হতে হবে। যেমনঃ নারীদের মর্যাদাহানিকর অবস্থায় দেখানো এড়াতে হবে। বিবস্ত্র অবস্থায়, বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা, ধর্ষিতা হওয়ার সময় নারীর অসহায়ত্ব ইত্যাদি হুবহু দেখানোর দরকার নেই। ৩৩

জেন্ডার বৈষম্য দূর করার মাধ্যমেই সমাজকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের নিজ নিজ ক্ষেত্রে মেধা বিকাশ ও সমাজে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টিতে জেন্ডার বৈষম্য নয় জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

শেষকথা

জেন্ডার বৈষম্য নারীর সার্বিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এতে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে এবং সমাজে এর কুপ্রভাব পড়ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল দায়িত্বের বোঝা পুরুষের কাঁধে চলে আসায় তাদের ওপর অধিক চাপ পড়ছে। এই চাপের কারণে পুরুষদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ এসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য প্রকট হচ্ছে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ এসব ব্যাধিতে তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

বেকারত্ব বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব সর্বপ্রথম নানাভাবে আঘাত হানছে নারীর ওপর। দেখা যাচ্ছে জেন্ডার বৈষম্যের ফলে শুধু নারী নয় বরং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরুষ ও সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল অঙ্গন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জেন্ডার বৈষম্য নিরসন করে একটি সুন্দর সমতাপূর্ণ সমাজ উপহার দিবে – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।৩৪

তথ্যসূত্র

১. জেন্ডার বিশ্বকোষ – সেলিনা হোসেন (কালের খেয়া, সমকাল এর শুক্রবারের সাময়িকী, ৯ নভেম্বর – ২০০৭)
২. সামাজিক বিনির্মাণের প্রেক্ষিতে সেক্স ও জেন্ডার- ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক (AUT Seminar on Contemporary National Issues – University of thought UT)
৩. জেন্ডার বৈষম্যের খেসারত – শাহীন রহমান (উন্নয়ন পদক্ষেপ, জুলাই সেপ্টেম্বর ২০০৩)
৪. Grant ,J.J. Social Problems as Human Concerns, 1976, p-147.

৫. Macionis ,J.J. Chapter-10, ÔSex and Gender’,  Society, p -232
৬. Vasin, Kamla,Understanding Gender, 3rd Edition 2002 p-1
৭. .জেন্ডার বলতে কি বুঝায় জেন্ডার কেন উন্নয়ন ইস্যু-শাহীন রহমান (উন্নয়ন পদক্ষেপ, জানুয়ারী-মার্চ ১৯৯৮)
৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮-২৯
৯. জেন্ডার বলতে কি বুঝায় – প্রাগুক্ত

১০. প্রাগুক্ত
১১. প্রাগুক্ত
১২. Human Development Report 1995-1997 ; UNDP
১৩. অর্থনীতি, রাজনীতি, ও আইন, জেন্ডার প্রেক্ষিত – শাহীন রহমান (উন্নয়ন পদক্ষেপ, জুলাই -সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)
১৪. জেন্ডার বলতে কি বুঝায় –-প্রাগুক্ত

১৫. অর্থনীতি ও রাজনীতি ও আইনঃ জেন্ডার প্রেক্ষিত, প্রাগুক্ত
১৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮
১৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্টা ৪৮-৪৯
১৮. জেন্ডার বৈষম্যের খেসারত, -প্রাগুক্ত
১৯. অর্থনীতি, রাজনীতি, ও আইনপ্রাগুক্ত,

২০. প্রাগুক্ত ৫১-৫২ পৃষ্ঠা
২১. জেন্ডার এবং বিশ্বায়ন (উন্নয়ন পদক্ষেপ, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৬)
২২. নারী ও প্রগতি সংঘ সমীক্ষা
২৩. অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও এইচডিআরসি
২৪. নারী প্রগতি সংঘ সমীক্ষা

২৫. জাতীয় বাজেটে নারী-সীমাদাস (উন্নয়ন পদক্ষেপ , এপ্রিল-জুন ২০০৩)
২৬. জেন্ডার বাজেট:সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা,প্রস্তুতকারী-শাহীন রহমান (উন্নয়ন পদক্ষেপ ,জুলাই ২০০৬)
২৭. জাতীয় বাজেট কীভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল হতে পারে , উন্নয়ন পদক্ষেপ মে-২০০৭।
২৮. জাতীয় বাজেটে নারী-সীমাদাস , পৃষ্ঠা-৪৩।
২৯. প্রাগুক্ত

৩০. জেন্ডার ও নারী স্বাস্থ্য-অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী, (উন্নয়ন পদক্ষেপ, এপ্রিল ২০০৮)।
৩১. জেন্ডার এবং বিশ্বায়ন, প্রাগুক্ত
৩২. চাইলে জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া যায়-শীপা হাফিজ, (উন্নয়ন পদক্ষেপ, মার্চ-২০০৭:)
৩৩. উন্নয়নে জেন্ডার সংবেদনশীল এবং কার্যকর যোগাযোগ উপকরণ – শাহেদা ফেরদৌসী মুন্নী (উন্নয়ন পদক্ষেপ , মার্চ২০০৭:)
৩৪. জেন্ডার সমতা আনার ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা -শাহীনা সুলতানা সুমী (উন্নয়ন পদক্ষেপ, মার্চ-২০০৭)

সহায়ক গ্রন্থ
জেন্ডার প্রসঙ্গ- শাহীন রহমান, স্টেপস্ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট, ডিসেম্বর ১৯৯৮।
বিভিন্ন পত্রিকার কলাম, বাংলা ব্যাকরণ বই।
নারী ভাবনা- পূরবী বসু, ফেব্রুয়ারী ২০০০, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *