শাইখ মো. আবু সাঈদ উদ্যমী, স্বপ্নদর্শী ও আশাবাদী মানুষ। নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি। মসজিদে আল কুবার ইমাম ও খতিব। সমাজ, দেশের মাটি ও মানুষের জন্য অবদান রাখতে ভালো উদ্যোগে সম্পৃক্ততার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। রয়েছে সামাজিক উন্নয়নের বড় স্বপ্ন, মানব কল্যাণের ইতিবাচক মন, মানবতার সেবা করার আবেগ এবং সমাজসেবা করার চিন্তা।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন- সাহসী, প্রতিভাবান এবং অনুপ্রেরণাদায়ক তরুণ । বাংলা সাহিত্যে অনার্স মাস্টার্স করেছেন। ইসলামিক স্টাডিজেও মাস্টার্স করেছেন। ফাযিল, কামিলও সম্পন্ন করেছেন। তিনি তার বৈচিত্র্যময় একাডেমিক জ্ঞানকে তার পেশায় ব্যবহার করছেন।
সম্প্রতি ঈদের ছুটি কাটাতে স্বপরিবারে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। জীবন সংগ্রাম নিয়ে তিনি কথা বলেছেন লেখক ও সাংবাদিক আনিসুর রহমান এরশাদ ও আকরামুজ্জামান আসিফের সাথে । ব্যতিক্রমী ও অনুপ্রেরণাদায়ক এই ব্যক্তিত্বের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ পরিবার ডটনেটের পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
ট্রাজেডিপূর্ণ শৈশব
আমার শৈশবটা ভীষণ রকমের ট্রাজেডিতে ভরা। যখন ক্লাস ওয়ানে পড়তাম; দেখতাম প্রায় প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়েই ২ টাকা, ৪ টাকা, ৫ টাকা স্কুলে নিয়ে যেত। চানাচুর, বিস্কিট, চকলেট, আইসক্রিম খেতো! আমারো খেতে মন চাইতো। কিন্তু আমার পরিবারের সে সামর্থ্য ছিল না। ঐ সময় খুব কষ্ট লাগতো। তবে কাউকে কিছু বলতাম না। স্কুলে যেতাম, আসতাম।
পড়াশোনায় মেধার স্বাক্ষর
বইতো সরকার দিতো। কিন্তু খাতা-কলম ঐ বয়সে যে পরিমাণ লাগতো তা পেতাম না। তখন ছিল স্লেটের যুগ। দামি যে স্লেট সেটা আমার ভাগ্যে হয় নাই। নরমাল একটি স্লেট আমাকে কিনে দেয়া হতো। দড়ানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমি প্রথম ছিলাম।
ক্লাস টুতেই লজেন্স বিক্রেতা
যখন ক্লাস টুতে উঠলাম, গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব প্রয়াত মরহুম আবুল হোসাইনের ছেলে বর্তমানে তক্তারচালা মনির হার্ডওয়্যারের স্বতাধিকারী মনিরুল ইসলামের সাথে আমি আমার কষ্টজনক অবস্থা শেয়ার করলাম। তখন গ্রামের বাড়িতে উনাদের দোকান ছিল। উনি বললেন, আবু সাঈদ তুমি আমার কাছ থেকে লজেন্স নিয়ে যাও স্কুলে।
আমি বললাম- ভাই আমি লজেন্স নেব, বিক্রি করবো- এগুলোর টাকা পাবো কোথায়? কিভাবে আপনাকে পে করবো? তিনি বললেন- তুমি লজেন্স আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও। ছেলে-মেয়েদের কাছে লজেন্স বিক্রি করবে। এক প্যাকেট লজেন্স বিক্রি করলে তোমার ৫ টাকা থেকে ৮ টাকা লাভ হবে। আমি তখন ভাবলাম- যাক তাহলে লেখাপড়া করতে আমার কোনো কষ্ট হবে না।
তখন লজেন্সের বেশকিছু নাম ছিল। রুস্তম লজেন্স, তিতাস লজেন্স, প্রিন্স লজেন্স ছিল। প্রতিটির দাম ছিল ২৫ পয়সা। স্কুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাসের ভেতরে একটি টেবিলের ওপরে রাখি। ক্লাস টুতে নিয়মিত লজেন্স বিক্রি করলাম। ক্লাস থ্রিতেও লজেন্স বিক্রি করলাম। লজেন্স বিক্রি করে মনির ভাইকে টাকা দিতাম।
ক্লাস ফোরে পাউরুটি বিক্রেতা
ক্লাস ফোরে ওঠার পরে ছেলে-মেয়েরা বললো- ভাইয়া লজেন্স খেতে আর ভালো লাগে না; জিহ্বা ছিলে যাচ্ছে। তখন বাড়ি থেকে ৩ কি.মি দূরে তকতারচালার উত্তর পার্শ্বে মাজম বাজারের নিকটবর্তী ফ্যাক্টরি থেকে পাউরুটি এনে বিক্রি করা শুরু করি।
ফজরের নামাজ পড়েই আমি ফ্যাক্টরিটিতে গিয়ে ৮০ টাকা দিয়ে ১০০ পাউরুটি আনি, বিক্রি করি ১০০ টাকা, লাভ হয় ২০ টাকা। এভাবে ক্লাস ফোরের এক বছর চলে যায়। পাউরুটি নিয়ে টেবিলে রাখি। সবাই টাকা দিয়ে নিয়ে যায়। কেউ টাকা না দিয়ে পাউরুটি নিছে এমন কোনো রেকর্ড নেই।
মক্তবে আরবী ও কুরআন শেখা
ক্লাস টুতে পড়ার সময় দড়ানীপাড়া কেন্দ্রিয় মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে যেতাম। ঐ মক্তবে আমার উস্তাদ হাফিজুর রহমান ও মূল্যপাড়ার আবু ত্বাহার কাছে আরবী শিখি, কুরআন শিখি। ক্লাস টু থ্রি দুই বছর হাফিজুর রহমানের কাছে কুরআন শিখেছি।
ক্লাস ফাইভে বাদাম বিক্রেতা
ক্লাস ফাইভে উঠার পর ছেলে-মেয়েরা বাদাম খেতে চাইলো। তখন বাড়ি থেকে কমপক্ষে ১০-১২ কি.মি. দূরে সানালিয়া গ্রাম থেকে কাঁচা বাদাম কিনে নিয়ে আসতাম। হেঁটে যেতাম তখন। অন্য কোনো যানবাহন ছিল না।
বাদাম বাড়িতে আনার পর আমার বড় ভাবি, মা, বোন- উনারা ভেজে দিতেন। আমি ছোটো পলিথিনে ছটাক, আদবা, এক পোয়া করে বাদাম ভরে গিট্টু দিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতাম। এভাবে বাদাম বিক্রি করতে করতেই ১৯৮৯ সালে আমি ক্লাস ফাইভ পাস করি।
ক্লাস সিক্সে মাদ্রাসায় ভর্তি
তখন আমার আব্বা-আম্মা বললো, হাইস্কুলে গেলে লেখাপড়া বন্ধ। আমাকে নিয়ে গেলো কামালিয়া চালা আলিম মাদরাসাতে। তৎকালীন প্রিন্সিপাল মাও. আব্দুল করিম সাহেব শিক্ষকদের বললেন, এই ছেলেটিকে দেখেন কোন ক্লাসে ভর্তি করা যায়।
তারা স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণি পাসের প্রত্যয়নপত্র থাকার পরও আরবিতে গ্যাপ থাকার আশংকায় ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হতে বলে। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। উনারা বললো তাহলে ক্লাস ফাইভে। আমি তাতেও রাজি হলাম না। পরে উনারা ইন্টারভিউ নিলো, আরবি পড়তে দিলো; আমি পারলাম। কারণ আমি মক্তব্যে কুরআন পড়েছি আগেই।
পরে আমাকে কন্ডিশন দিয়ে সিক্সে ভর্তি করলেন। যদি প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় সকল বিষয়ে পাস করতে পার তাহলে ক্লাস সিক্সে রাখবো আর কোনো একটি বিষয়ে ফেল করলেই ক্লাস ফাইভে নামিয়ে দেয়া হবে। আমি রাজি হলাম। ক্লাস সিক্সের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি সকল সাবজেক্টে উত্তীর্ণ হলাম। আমার নাম্বার দেখে স্যাররাও হ্যাপী হলেন।
মাদ্রাসার মধ্যে সেরা ফলাফল
ক্লাস সিক্সে ভর্তি রুল ছিল ১৭। শিক্ষার্থী ছিল ৩০ এর ওপরে। ক্লাস সেভেনে ওঠলে রুল হলো তিন। তিন হবার পরে সাহস পেলাম। যেহেতু ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত ফার্স্টবয় ছিলাম, তাই তিন আমার জন্য সমীচীন মনে করলাম না।
পড়াশোনা করতে করতে মাদরাসার সকল ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠলাম। এইট থেকে নাইনেও সারা মাদ্রাসার মধ্যে প্রথম হলাম।
সস্তায় কেনা পুরাতন বই দ্বিগুণ দামে বিক্রি
আমি যখন সিক্সে ভর্তি হই তখন সিনিয়র ভাইদের পুরাতন বই খুব সস্তায় কম টাকায় ক্রয় করি। কোনো গাইড বা নোটবুক কিনি নাই। মূল বই পড়েই পরীক্ষা দেই।
আমার ধারণা মূল বই থেকেইতো সব প্রশ্ন থাকে। মূল বই পড়লে গাইড পড়ার প্রশ্নই আসে না। মূল বইয়ের মধ্যেই কোন প্রশ্নের উত্তর কোন পর্যন্ত হবে তা দাগ দিয়ে রাখতাম।
এতে জুনিয়ররা আমার পুরাতন বই কেনার জন্য পাল্লা-পাল্লি করতো। কারণ আমার বই কেউ কিনলে তার নোট বই বা গাইড বই কিনতে হতো না। তাই পুরাতন বই যে দামে কিনতাম তার দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হতো। এতে আমার পড়াশোনার একটি খরচ ওঠে আসতো।
মাসে ত্রিশ টাকা বেতনে টিউশনী
ফাইভ পাসের সময় থাকা জমানো কিছু টাকা দিয়ে সিক্সে চলতে থাকি। মা-বাবা, ভাই-বোন যৎকিঞ্চিৎ যতটুকু দেন তাতে প্রয়োজনের চারভাগের একভাগ হতো।তখন আমি টিউশনী করা শুরু করলাম। সিক্সে পড়ার সময় থ্রি-ফোরের ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতাম। আমাকে প্রতিমাসে ত্রিশ টাকা বেতন দেয়া হতো।এভাবে করে আলহামদুল্লিাহ সিক্স, সেভেন, এইট শেষ করলাম।
নাইনেই মসজিদের খতিব
ক্লাস নাইনে উঠেও কয়েকটা টিউশনী করি আর নিজের পড়ালেখা করি। কামালিয়া চালার একজন ভদ্র মানুষ, সকলের প্রাণের মানুষ, হাসিখুশি মানুষ মুন্সী আব্দুর রউফ; উনার ছেলে মাও. লোকমান হোসাইন টেঙ্গুরিয়া পাড়া মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক।
মুন্সী আব্দুর রউফ আমাকে বললেন, আবু সাঈদ আমিতো দীর্ঘ আট বছর পূর্ব পৌলি হালিয়াঘাটা গাজি মাস্টারদের মসজিদে আমি জুমআর নামাজ পড়িয়েছি এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ওখানে থেকে পড়িয়েছি। তোমারতো ভয়েস এবং কণ্ঠস্বর খুবই সুন্দর। তুমি রাজি হলে তোমাকে ওখানে জুমআর নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারি।
তখন আমি বললাম, নানা এটা কিভাবে সম্ভব? আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তিনি বললেন, না তোমার দ্বারা সম্ভব। তোমার অনেক মেধা আছে। তুমি কথা বললে সবাই শুনবে। উনি আমাকে বর্ষা মাসে নৌকা দিয়ে সাথে করে নিয়ে গেলেন সেই মসজিদে। ট্রায়াল হিসেবে প্রথম শুক্রবার আমাকে দিয়ে খুৎবা দেওয়ালেন। উনারা পছন্দ করলেন। তারপরের শুক্রবার থেকে আমাকে পার্মানেন্ট করা হলো।
তারা বললো, চার শুক্রবারে চারশত টাকা জুমআর নামাজ পড়ানোর সম্মানী দেয়া হবে। আমি ক্লাস নাইন থেকে ডিগ্রী-ফাজিল পর্যন্ত ঐ মসজিদে জুমআর নামাজ পড়াতাম। প্রাথমিক পর্যায়ে চারশত টাকা দেয়া হতো।পরবর্তীতে সেটি উত্তীর্ণ হয়ে ৬০০, ৮০০ পর্যন্ত দেয়া হতো।
ক্লাস নাইন পড়েই দাখিল পরীক্ষা
ক্লাস নাইনের শেষ দিকে কামালিয়া চালা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুল করিম সাহেব বললেন, আবু সাঈদ তুমি ক্লাস নাইন থেকেই দাখিল পরীক্ষা দাও। আমি বললাম, হুজুর এটা কিভাবে সম্ভব! তিনি বললেন, তুমি সারা মাদ্রাসার মধ্যে ফার্স্টবয়; তুমি দিলে এটা সম্ভব।
আমি বললাম, যারা ক্লাস টেনে পড়ে তারা দুইটি বছর পড়েছে তাদের সাথে আমি কিভাবে পারবো! তিনি বললেন, বইতো একই: পড়তে হয় দুইবছর। তুমিতো ক্লাস নাইনে পড়ছো। তুমি পড়াটা একটু বাড়িয়ে দাও। তুমি ওদের সাথে পারবে।
পরে আমি টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি সিনিয়র ব্যাচের সাথে। আমি ১৯৯৫ সালের পরীক্ষার্থী হলেও ১৯৯৪ সালের পরীক্ষার্থীদের সাথে টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হলো। তখন ক্লাস টেনের ফার্স্টবয় ছিল দড়ানীপাড়ার আবদুল মাজেদ, নয়েছ বাজারে ওষুধের ফার্মেসী আছে।
সিনিয়রদের একজন আমাকে বললেন, তুমি ভালো ছাত্র মানি। কিন্তু এত ভালো ছাত্র হও নাই, ক্লাস নাইন থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে আমাদেরকে হারিয়ে তুমি পরীক্ষায় বেশি ভালো করবে। এই কথায় আমার কষ্ট লেগেছে ঠিকই কিন্তু আমি মনে মনে চিন্তা করেছি, যেহেতু স্যারদের দোয়া আছে আমার, আমি দেখি কিছু পারি কিনা।
আল্লাহর রহমত ও স্যারদের দোয়া
আমি ক্লাস নাইন থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাস করি। সিনিয়ররা অনেকেই অবাক হয়েছে। অনেকেই এতে অপমানবোধ করেছে। এটা ছিল আল্লাহর রহমত, স্যারদের দোয়া, মানুষের দোয়ার কারণেই হয়তো হয়েছে।
সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাস
প্রতিমা বংকী ফাযিল মাদরাসা কেন্দ্রে দাখিল পরীক্ষা দেই। আমি গণিত একটু কম বুঝতাম। দাখিলে গণিত পরীক্ষা এক ঘন্টা দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র ৩৯ মার্কসের উত্তর দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ফেল আসবে।
কিন্তু রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেল আমাদের মাদ্রাসা থেকে কেউ ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি, আমিই সর্বোচ্চ ৫৯৩ নাম্বার পেয়েছিলাম। আর গণিতে ৩৬ পেয়েছিলাম।
আমার উস্তাদযী মাও. আব্দুল করিম সাহেব আমাকে শান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আবু সাঈদ শোনো। সর্বক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা ভালো। ফার্স্ট ডিভিশন সর্বোচ্চ পর্যায়ের, মাঝখানে হলো সেকেন্ড ডিভিশন, আর শেষে থার্ড ডিভিশন। সেকেন্ড ডিভিশন মধ্যমপন্থা। এটা আল্লাহ ও তার রাসূল পছন্দ করেছেন, তাই তুমি চিন্তা করো না।
শিক্ষকদের অকৃত্রিম স্নেহ
প্রয়াত চাচা মমিন সিকদারের ছেলে শ্রদ্ধাভাজন নাজিম উদ্দিন স্যার আমাকে অকৃত্রিম স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন। উনি অংক পড়াতেন। মূল্যপাড়ার প্রয়াত আব্দুল কাদের স্যারের কাছ থেকে বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি যতটুকু শিখেছি, এমন চমৎকার শিক্ষক আজ পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। আল্লাহ আমার ঐ স্যারকে জান্নাতবাসি করুন।
বড় চাচার বাড়িতে দুই বছর
দাখিল পাস করার পর বড় চাচার বাড়িতে থাকতে শুরু করি। বড় চাচার ছয় ছেলে। ছোটছেলে সিঙ্গাপুর চলে যায় ক্লাস নাইন থেকে। তখন আমার চাচি একটু পাগলপারা হয়ে যায়। চাচি মাকে বললেন আমি তোমার ছোট ছেলেকে আমার বাড়িতে রেখে পড়াতে চাই।
দুই বছর বড় চাচার বাড়িতে থেকে কামালিয়া চালাতে ক্লাস করি, আলিম ক্লাসে পড়ি। পূর্ব পৌলি মসজিদে ইমামতি এবং কয়েকটা টিউশনী করে আমার নিজের পড়াশোনার খরচ চালাই।
বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স
কামালিয়া চালা মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দেই। দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। করটিয়া সাদৎ কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাংলায় পড়ার সুযোগ পাই। আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার। আর বাংলা, অংক ও ইংরেজির এদেশে অনেক মূল্য। কারণ এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে বাংলা নেই। এবং এটি বাধ্যতামূলক। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে অনার্স পাস করি। ২০০০ সালে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে মাস্টার্স করি।
ইসলামিক স্টাডিজে এমএ
আমি করটিয়া সাদৎ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ৪০০ নাম্বারের ইংরেজি নিয়ে ডিগ্রি পরীক্ষা (পাস কোর্স বিএ) পাস করি ১৯৯৮ সালে। ১৯৯৮ সালে করটিয়া কলেজের সবগুলো বিভাগ থেকে ৬৬০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৬০ জন পাস করেছিল। ৬০ জনের মধ্যে ২০ জন দ্বিতীয় বিভাগ আর ৪০ জন তৃতীয় বিভাগ পেয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমি সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করি। ২০০২ সালে ইসলামিক স্টাডিজে আবার এমএ পাস করি।
মাদ্রাসা থেকে ফাযিল ও কামিল
কামালিয়া চালা মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করার পরে হাবলা টেঙ্গুরিয়া পাড়া সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা থেকে আমি ফাযিল পাস করি। পরে টাঙ্গাইল দারুল উলুম আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করি।
৮ বছরের লজিং জীবন
আলিম পাস করার পরে টেঙ্গুরিয়া পাড়া উত্তরপাড়া আরওয়াহ শালিনা পাড়ায় চাচাতো বোনের বাড়িতে তিন-চার বছর লজিং ছিলাম। সেখান থেকে পাশের বাড়ি মরহুম হাজী আব্দুল হামিদের বাড়িতে আমি দুই বছর ছিলাম। সেখান থেকে চলে যাই বর্নী, বাঐখোলা থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে। ঐখানে দুই বছর ছিলাম।
একই দিনে একই সময়ে দুই পরীক্ষা!
আমার এমএ’র ৩য় পত্র পরীক্ষা ও কামিল পরীক্ষা একই দিনে শুরু হয়। এমএ পরীক্ষা সকাল ৯টা তেকে ৪ ঘন্টা আর কামিলে বুখারী শরীফের ১ম পত্র পরীক্ষা ১০টা থেকে দুইটা পর্যন্ত। ইসলামিক স্টাডিজের ৫টি প্রশ্নের উত্তর এক ঘন্টায় শর্ট করে লিখে শেষ করি।
কক্ষ পরিদর্শক খাতা নিচ্ছিলেন না, বলতেছিলেন ২ ঘন্টার আগে খাতা নেয়া যাবে না। আমি বলছি, স্যার আমি আর পরীক্ষা দেবো না। পরে উনি প্রিন্সিপালের কাছে গেলেন। তিনি বললেন, পরীক্ষা না দিলে খাতা নিয়ে নেন, আর খাতার সাথে প্রশ্নও নিয়ে নেন। খাতা ও প্রশ্ন কক্ষ পরিদর্শক নিলেন। আমি নিচে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা মটরসাইকেল যোগে পরীক্ষা দিতে টাঙ্গাইল যাই।
আমি হলে ৪৫ মিনিট পরে পৌঁছােই। প্রবেশপত্রে লেখা ছিল পরীক্ষা শুরুর আধা ঘন্টার মধ্যে না পৌঁছালে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে না। সিকিউরিটি গার্ড ঢুকতে দিচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ করে ভেতরে ঢুকি। কিন্তু কক্ষ পরিদর্শক খাতা দিচ্ছিল না, প্রশ্নও দিচ্ছিল না। তিনি বলছিলেন, পৌনে এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে, আপনাকে খাতা দেয়া যাবে না।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উনি চলে যান। পরে প্রিন্সিপাল ও ম্যাজিস্ট্রেট আসলেন। প্রিন্সিপাল যেহেতু আমাকে চিনেন, আমি আমার সমস্যা বললাম। অনেক কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন ও খাতা দিলেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনাকে আলাদা বেঞ্চে বসতে হবে। বেঞ্চের একপাশে আমি বসলাম, আরেক পাশে ম্যাজিস্ট্রেট পুরো তিন ঘন্টা বসে ছিলেন।
আমি সময় শেষ হবার ১৫ মিনিট আগেই খাতা জমা দেই। আমাকে বললেন, তুমি আসলে ১ ঘন্টা পরে, যাচ্ছ ১৫ মিনিট আগে। কী পরীক্ষা দিলে? আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো দিয়েছি। বের হয়ে শুকরানা নামায পড়লাম। আমার আত্মবিশ্বাস হলো- দুটি পরীক্ষাই ভালো হয়েছে।
যখন রেজাল্ট বের হলো দেখা গেলো আমি যে সাবজেক্টে ১ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়েছিলাম সেটাতে পেয়েছিলাম ৩৮। মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস পাই। পরে কামিলের রেজাল্ট হলে দেখি বুখারী শরীফের ১ম পত্রে ৫৮ পেয়েছি। ৬১৩ নাম্বার পেয়ে আমি কামিল পাস করি।
কোচিং সেন্টারে মাস্টারি
আমার তিন লাইনে লেখাপড়া করতে সেই সময়েও কমপক্ষে চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা লেগেছে। আমার একটি হিসাব ছিল, নোটবুকে আমি লেখে রেখেছিলাম।
এর মধ্যে আমার পরিবার থেকে বা বাড়ি থেকে আমি টাকা পেয়েছিলাম সর্বমোট ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর বাকি টাকা আমি নিজে ইনকাম করে আমার খরচ চালিয়েছি। সাদৎ কলেজে পড়ার সময় দোয়েল কোচিং সেন্টারে আমি মাস্টারি করতাম।
রাজাবাড়ি হাই স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক
লেখাপড়া শেষে প্রথম চাকরি হয় মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ভেতরে রাজাবাড়ি স্কুলে। ৩৯ জন আবেদনকারীর মধ্যে লিখিত মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আমার চাকরি হয়ে যায়। দুই বছর চাকরি করি। তবে বেতন হয়নি।
তেলিনা মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষক
পরে তেলিনা দক্ষিণ পাড়া দাখিল মাদ্রাসায় ইন্টারভিউয়ে ফার্স্ট হয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পেলাম। নিয়োগপত্র পাবার পর জয়েন করলাম। রাজাবাড়ি স্কুলে রিজাইন লেটার দিয়ে দেই।
এখানে জয়েন করার দুই মাস পরে এমপিওভুক্ত হয়ে যাই এবং বেতন হয়। একইসাথে রাজাবাড়ি হাই স্কুলেও আমার বেতন হয়; দুই বছরের পুরো বেতন একসাথে পাঠিয়ে দেয় ।
কামালিয়া চালা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা
তেলিনাতে চার বছর শিক্ষকতা করার পরে আমি যে প্রতিষ্ঠান থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেছি কামালিয়া চালা সিনিয়র মাদ্রাসা। সেখানে ইন্টারভিউ দিয়ে ফার্স্ট হয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই। এক পর্যায়ে আমাকে নিয়োগপত্র দেয়া হলো। ২০০৬ সালের ১৯ জুলাই আমি জয়েন করলাম। চাকরি ছাড়লাম ১৮ জানুয়ারি ২০১০।
আমেরিকায় প্রবাস জীবন শুরু
১৯ জানুয়ারি ২০১০ আমি আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত আমি ও আমার পরিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছি। আমার একমাত্র ছেলে, স্ত্রীও আমেরিকান পাসপোর্টধারী; আমেরিকান নাগরিক।
নিউইয়র্কে আমার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে আছেন- বিশ্বস্ত বন্ধু ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাজিম উদ্দিন, বিশ্বস্ত বন্ধু বেলায়েত হোসেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার, বিশ্বস্ত বন্ধু সাদেক আহমেদ চট্টগ্রামের, বিশ্বস্ত বন্ধু মোস্তফা কামাল চাঁদপুরের, আরেকজন বন্ধু সালাহ উদ্দিন আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়া। এরা সুখে-দুঃখে সবসময় আমার পাশে থাকে। উনারা বিভিন্ন সময়ে সর্বক্সেত্রে আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন, হেল্প করেন; আমি তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ আছি এবং সারাজীবন থাকবো। আল্লাহ যেন তাদেরকে হায়াত দারাজ করেন।
তারা আমাকে বলেছেন, আমেরিকাতে সবাই টাকার পেছনে ছুটে। শুধু আপনাকেই পেলাম না টাকার পেছনে দৌঁড়াতে। আমি আজও পর্যন্ত এমনই আছি। যাবার পর প্রথম ছয় মাস শুধু ভিন্ন একটি কাজ করেছি। এরপর থেকে মসজিদেই আছি। প্রথমে ছিলাম নিউইয়র্ক বঞ্চের বাইতুল ইসলাম জামে মসজিদে।
এখানে ইমামতি করার পর চলে যাই নিউইয়র্ক কুইন্সের হযরত শাহজালাল জামে মসজিদে। সেখান থেকে চলে আসি নিউইয়র্ক ব্রঞ্চের মাসুদুল মুমিনিনে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে জয়েন করি নিউইয়র্ক কুইন্সের মাসজিদ আল কুবায়। এখনো সেখানে আছি।
টাকার পেছনে ছুটছি না
টাকার পেছনে ছুটলে অনেক কিছুই করতে পারতাম। কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলকে পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই আমি ঐখানে আছি। আল্লাহ সুনামের সাথে, যশ-খ্যাতির সাথে রেখেছে, আলহামদুলিল্লাহ। টাকা-পয়সা যতটুকু আছে তাতে আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া।
যাদের কাছে কৃতজ্ঞ
আমার মনোমুগ্ধকর কিছু শিক্ষক ছিলেন যাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তন্মধ্যে অন্যতম ছিল আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক জনাব মাও. শামছুজ্জামান সাহেব। যাকে সারাজীবনে কোনোদিনও ভোলা যাবে না। উনার কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে। উনি আমাকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সিস্টেমে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন।
অন্যতম আরেকজন ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক জনাব শাহজাহান সিরাজ। বর্তমানে উনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। উনার কথা জীবনেও ভুলতে পারবো না। নাজিম উদ্দিন স্যারও ছিলেন অত্যন্ত ভালো শিক্ষক। বেলায়েত হোসেন, শফিকুর সাহেব, আব্দুস সামাদ সাহেব ও তারাবাড়ির শামসুদ্দিন সাহেবও যথেষ্ট ভালো শিক্ষক ছিলেন।
প্রিন্সিপাল আব্দুল করিম সাহেব, উনার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ। আহমদ হুজুরের বাচনভঙ্গি অত্যন্ত চমৎকার। উনার তেলাওয়াত, কথাবার্তা খুব মনে পড়ে। উনি সিক্সে আমাকে আরবী সাহিত্য পড়াতেন। আমি আজও ভুলতে পারি না। উনার তেলাওয়াত তখনও আমার ভালো লাগতো, এখনো উনার তেলাওয়াত শুনলে মনে হয় আমি সবকিছু ভুলে যাই। আল্লাহ যেন আমার সকল শিক্ষকদের নেক হায়াত দারাজ করেন, সুস্বাস্থ্য দান করেন।
বাংলাদেশে আমার কয়েকজন বন্ধু আছেন যাদের মধ্যে বিশেষ কয়জন হচ্ছেন- ঘাটাইল পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার শামীম আল মামুন, সরিষাবাড়ি দৌলতপুর ফাযিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক আলাউদ্দিন। আল্লাহ তাআলা যেন তাদেরকেও নেক হায়াত দান করেন।