চিন্তার দর্পণ থেকে

জীবিত থাকা মানে কর্মব্যস্ত থাকা। কাজে ব্যস্ততা মানে সক্রিয় থাকা। অলসতা, কর্মহীনতা, উদ্যমহীনতা ও কর্মবিমুখতা জীবন্ত মানুষকেও লাশে পরিণত করে। কর্মবিমুখতায় বাড়ে হীনমন্যতা, হতাশা, বিমর্ষতা, স্বপ্ন বিলাসিতা, ভােজনপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা ও সত্য গোপন করে মিথ্যা বলার প্রবণতা।

বড় স্বপ্ন দেখুন, যদি বড় হতে চান। ছোট থাকতে চাইলে ছোট স্বপ্ন দেখুন! যে স্বপ্ন দেখতেই ভয় পান, সেটি কখনোই পূরণ হবার নয়! ছোট স্বপ্নদর্শীও বড় কাজের সূচনা করতে পারে, তবে কাজ সুসম্পন্ন করতে স্বপ্নকে ক্রমাগত বড় করতে হয়। ছোট থেকে সার্থকতা পাবার মানে অযোগ্য-অপদার্থ থাকা নয়, বড় মানুষ হয়েও মনকে অহংকারমুক্ত রেখে ঔদ্ধত্যপনা থেকে বেঁচে থাকতে পারা!

কর্মেই জীবনের প্রকৃত মূল্য, আসল পরিচয়। মানুষ পরজগতে গিয়েও এ জগতে বেঁচে থাকে কর্মে। কর্ম ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা, কর্মহীনতায় শুধুই অন্ধকার। আয়ু অর্থবহ হয় কর্মে। যে নিজের সময়কে মূল্য দিতে শিখেনি সে সমাজে অবমূল্যায়িত হবার যোগ্য! প্রকৃত মূল্য টাকায় নয় কাজে-কর্মে।

সফলতার জন্য সমস্যার সমাধান জরুরি। সার্থকতার জন্য সম্ভাবনার বিকাশ জরুরি। যারা শুধু সমস্যায় মনোযোগ দেন ও তা সমাধানে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন; তারা সম্ভাবনা বিকাশের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারেন না।

সমস্যা আছে, সমস্যার সমাধানও আছে। নিজের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই সমাধান দক্ষতা বাড়িয়ে সমস্যা সমাধানকারী হয়ে ওঠতে হয়। মানুষের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজলে নিজের সমস্যার সমাধান হয় সহজেই; আর অন্যের সমস্যা বাড়ানোর প্রয়াসে নিজের সমস্যাও জটিল আকার ধারণ করে!

শুধু নিজে ভোগ নয়, পরের জন্যও ত্যাগ স্বীকার করুন। স্বার্থ হাসিলে নয়, স্বার্থ ত্যাগে প্রকৃত সুখ খুঁজুন! ভোগের জন্য আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য দরকার, ত্যাগের জন্য দরকার আত্মশুদ্ধি আত্মত্যাগ ও পরিশুদ্ধ মন।

তথ্যের আধিক্য মনোযোগ কমিয়েছে। স্ক্রীন আসক্তি এত প্রবল যে মেডিটেশন করেও মনোযোগ ধরে রাখা যাচ্ছে না। মনোযোগে মনোযোগী হতে পারছে না অনেকেই। গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনছে না, নিজের কাজে মনোযোগী থাকছে না, গুরুত্বপূর্ণ ফোকাসে মনোযোগ রাখতে পারছে না। নানান ইস্যু ও নানান কনটেন্টের ভিড়ে মনোযোগের অভাব দেখা দিচ্ছে। মনোযোগহীনতা বাড়াচ্ছে বিরক্তি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, স্মৃতিহীনতা ও মূর্খতা।

আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ায় নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব যাদের; তারাই জ্ঞানের ব্যাপারে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করছেন। দেশীয়-দেশজ কিছু প্রমোট করতে হীনমন্যতায় ভোগছেন। বিদেশমুখী প্রবণতার নতজানু মানসিকতা তীব্র দৈন্যতারই প্রকাশ। যেন চিন্তায়-কর্মে বিদেশিদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করছেন।

অনেকে জিততে চায়, অথচ প্রতিযোগিতায় লড়ার দক্ষতা অর্জন করে না। মিষ্টি ফল খেতে চায়, অথচ চারাগাছের যত্নে পর্যাপ্ত সময় দেয় না। লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়, অথচ সামর্থ্য বাড়াতে দুর্বলতা দূর করে না ।

যারা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন চায়, সংস্কার চায়; পরিবর্তিত সমাজ ও মানুষের মনন বিশ্লেষণের সামর্থ্য তাদের থাকতে হবে। সময়ের দাবি অনুযায়ী সঠিক কলা-কৌশল নির্ধারণে চিন্তা-গবেষণা করতে হবে। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার পদ্ধতি বুঝতে সুনির্দিষ্ট গবেষণালব্দ তথ্য ও উপাত্ত দরকার হবে।

অধিকাংশ ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগেই বৃহৎ পরিসরে অবদান রাখার সুযোগ সীমাবদ্ধ। সাধারণত অনুদান নির্ভর যাত্রাপথ মসৃণ হলেও আয়বর্ধক প্রকল্প প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকে মজবুত করে। নিয়মিত কাজ ছাড়া শুধু প্রজেক্ট কেন্দ্রিক কাজে প্রতিষ্ঠানের গতিশীলতা কমে, কাজ হয় মন্থর, প্রাণহীন হয় কর্মপরিবেশ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রেমওয়ার্ক দেয়, মডেল দেয়। নিয়মানুযায়ী গবেষণা কম্প্রিহেনসিভ হয়, সুনির্দিষ্ট হয়, ক্ষুদ্র এরিয়া ঠিক করে গভীরে যেতে হয়। মৌলিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই বহু গবেষণার শাখা-প্রশাখার সন্ধান মিলে।

যার ফোকাস ঠিক নেই। আইডিয়াও শাণিত নয়। আইডিয়ার উন্নয়নও ঘটাতে পারেনি। স্ট্রাক্চার অনুসরণেই যে সীমাবদ্ধ। স্ট্রাক্চারাল সিটির বাইরে বের হয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের জন্য কাজ করা তার জন্য বড্ড কঠিন!

অপেক্ষা থেকে আক্ষেপ তৈরি হয় তা একপাক্ষিক হলে; তবে অপেক্ষা দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক হলে সহমর্মিতা চলে আসে, আফসোস থাকে না। শিশিরকণার মতো স্বচ্ছ ও ঘাসের বিছানার মতো পরিপাটি জীবনকেও বিষিয়ে তোলতে পারে যোগাযোগহীনতা। বারবার যে খোঁজ নেয়, যে ফোন করে, আন্তরিকতা নিয়ে অপেক্ষা করে; তার প্রতি ভ্রু কুচকানো, ব্যস্ততা দেখানো, উপেক্ষা করা, মুখ ফিরিয়ে নেয়া বা অবহেলা করতে সাধারণত দ্বিধা হয়। যাদের দ্বিধা হয় না তাদের একসময় শূন্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!

সিংহের বন্ধুত্ব শিয়ালের সাথে হয় না। ইঁদুরের যোগ্যতা নিয়ে সিংহের সাথে কাজও করা যায় না। বাঘ বাঘের সাথেই চলে, বেড়ালের সাথে চলে দক্ষতার প্রমাণ দেয়ার প্রয়োজন বাঘের হয় না।

যেখানে যে যত বড় দায়িত্বে সে তত বড় তেলবাজ, যে যত বেশি প্রভাবশালী সে তত বেশি ধান্ধাবাজ- সেখানে ব্যক্তিত্ববানরা চুপচাপ থাকেন! যেখানে কর্মীর চেয়ে কূটচাল-পলিটিক্সে পারদর্শিরা সেরা, সেখানে প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে ও ভঙ্গুর।

অক্ষমতায় পরনির্ভরশীলতা বাড়ে, সক্ষমতায় মর্যাদা বাড়ে। দক্ষতায় সামর্থ্য বাড়ে, প্রশিক্ষণে বাধা মোকাবেলার সাহস বাড়ে। সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন, টেকসই অর্জনে মনোযোগী করে।

অধিকার নয় কর্তব্য আগে। অধিকারের ভিত্তি যেহেতু কর্তব্য; সেহেতু কর্তব্য সম্পাদন করলেই কেবল অধিকার ভোগ করা যায়! কর্তব্য অধিকারের পূর্বশর্ত; ফলে যে কর্তব্য পালন করে না তার কোনো অধিকারও তৈরি হয় না। কর্তব্য পালনে সচেতন না হয়ে অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া অনর্থক!

সবাই নিজ নিজ কর্তব্য পালন করলে সবার অধিকারই এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মানুষ কর্তব্য পালনেই মানুষ। যে কর্তব্য পালন করে না সে প্রকৃতপক্ষে মানুষ নয়। কর্তব্য পালনের জন্যই মানুষের সৃষ্টি। স্রষ্টা দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন; দায়িত্বহীনভাবে কর্তব্য পালন হয় না।

সময় ব্যবস্থাপনার জ্ঞান না থাকলে যোগ্য মানুষও সংবেদনশীলতা হারান! প্রকৃত জ্ঞানী অর্থবহ জীবনযাপন করেন সময়ের পরিকল্পিত ব্যবহার করে। কম সময়ে বেশি কাজ করতে পারেন বলেই উন্নত দেশের কর্ণধারেরা বা বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ীদেরও দেখা যায় দৌড়াতে, সাঁতার কাটতে, গল‌ফ খেলতে, টেনিস খেলতে, সাইকেল চালাতে ও হাঁটাহাঁটি করতে। অথচ আমাদের অনেকের এত ব্যস্ততা, অবসর নেই, সময়মতো খাওয়ারও সুযোগ নেই!

ব্যস্ততা আপেক্ষিক! যে যাকে গুরুত্ব দেয় তার জন্য সে ব্যস্ত নয়! কে গুরুত্বপূর্ণ বা কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ তার অগ্রাধিকারের ওপরই ব্যস্ততা নির্ভর করে। সীমিত সময়তো আর সবার জন্য বা সব কাজের জন্য বরাদ্দ রাখা যায় না। ব্যস্ত আছি বলার চেয়ে ব্যস্ত আছি শোনা কষ্টকর!

যারা ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদলায়, তাদের আশ্বাস কচুপাতার পানির মতো স্থায়ী! সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে না পেরে যারা বারবার রঙ বদলায়, তাদের প্রতিশ্রুতি রংধনুর মতো হঠাৎ মিলিয়ে যায়। আত্মবিশ্বাসহীন ও পরনির্ভরশীল মানুষের সান্নিধ্য যতটা উপভোগ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বিরক্তিকর!

সব সুযোগকে গ্রহণ নয়, প্রত্যাখ্যানও করতে হবে। হ্যাঁ বলাটা যত সহজ, না বলাটা তত কঠিন। সময় কাজে লাগাতে সুন্দরভাবে না বলাও একটা আর্ট। সার্থকতা পেতে ‘না’ বলা শিখতে হবে।

টাকাকে ভালোবেসে কাজ করলে, যে কাজে বেশি টাকা আসে সে কাজই অগ্রাধিকার পায়। আর কাজকে ভালোবেসে কাজ করলে, যে পছন্দের কাজে ভালোলাগা বেশি সে কাজই অগ্রাধিকার পায়।

জ্ঞানীরা যে পথে চলতে আতঙ্ক বোধ করে, মূর্খরা সে পথে চলতে ভিড় করে। শিক্ষা-অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে জ্ঞানীরা সামনে এগিয়ে যায়। আর সার্টিফিকেট ও দক্ষতা কাজে না লাগায় আফসোস করে মূর্খ!

পদ খালি থাকবে না। চেয়ারে কেউ না কেউ বসবেই। যোগ্যরা দায়িত্ব এড়ালে অযোগ্যরা বসবে! সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ না বসলে পাগল বসবে! মানুষ না বসলে ছাগল বসবে!

তেলযুক্ত খাবারে শরীর নষ্ট। তেলযুক্ত কথায় সমাজ নষ্ট। তেলে মাথায় তেল দেয়ায় সম্পর্ক নষ্ট। যা অতি পছন্দের ও স্বাদে মিষ্টি; তার প্রভাবও তিক্ততা ও বিস্বাদপূর্ণ হতে পারে।

মগজই সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই মূল্যবান সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারই সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। সংগ্রামী হতে প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত। আপনার সিদ্ধান্তেই জগতের পরিবর্তন। নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান।

দলপ্রেমী না হয়ে দেশপ্রেমী হোন। দলের চেয়ে দেশ বড়। ব্যক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে আদর্শকে প্রাধান্য দিন। মানবতার কল্যাণে সচেষ্ট থাকুন। সাধ্যানুযায়ী অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান; স্বার্থপরতা কেটে যাবে, নেতিবাচকতা দূর হবে।

যার চিন্তা সঠিক নয়, তার ওপর আস্থা রাখা চরম ঝুঁকিপূর্ণ। যার চিত্ত পোড়া ও ভয়যুক্ত; তাকে দায়িত্ব দেয়া বিপজ্জনক। যার কাছে জগতের চেয়েও নিজস্বার্থ বেশি মূল্যবান, সে জীবনেও বৃহত্তর স্বার্থে সঠিক কাজটি করতে পারে না।

পৃথিবীটা কারো কাছে খেলাঘর, কারো কাছে পরীক্ষাক্ষেত্র। জগতের খেলাঘরে কেউ বড় খেলোয়াড়, কেউ ছোট খেলোয়াড়। খেলা শুধু মাঠে বল নিয়েই হয় না; খেলা হয় মন-আবেগ নিয়ে, খেলা হয় প্রাণ-জীবন নিয়ে। কেউ সত্য নিয়ে খেলে, কেউ মিথ্যা নিয়ে খেলে। কেউ ভয় দেখায়ে খেলে, কেউ ভয় জয় করে খেলে! কেউ নিরব দর্শক হয়ে খেলা দেখে আর কেউ চোখ বন্ধ করে মনোজগতে খেলতে থাকে! খেলাকে সিরিয়াসলি নিয়েও কেউ হেরে যায় আবার হালকাভাবে নিয়েও কেউ জিতে যায়! খেলোয়াড়ের উদ্দেশ্যগত ভিন্নতার কারণে একই খেলার একইরকম ফলাফলও ভিন্নরকম প্রভাব ফেলে।

বি.দ্র. লেখাটি আনিসুর রহমান এরশাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *