আনিসুর রহমান এরশাদ
সমৃদ্ধ ও উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজন অবাধ তথ্যপ্রবাহ, নৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী, উত্তম আদর্শ ও শিক্ষার সমারোহ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিনিময় ও সঠিক ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণ, নিত্যনতুন উদ্ভাবন আর আবিষ্কার। উন্নত সমাজে পারস্পরিক একতা থাকে, ভ্রাতৃত্ব থাকে, সমতা থাকে, ন্যায় ও কল্যাণের মূল্যবোধে মানুষ উজ্জীবিত থাকে। উজ্জ্বল ঐতিহ্যের মহৎ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সেই সমাজের চেতনাকাঠামো নির্মিত হয়; রুচিশীল সংস্কৃতি-মননশীল সাহিত্য ও সৃষ্টিশীল মনের আশাবাদী মানুষের আধিক্য থাকে।
সদাচরণের ভিত্তিতে স্বপ্নবান মানুষ ন্যায়ভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজকে উত্তরোত্তর শান্তি-সুখের প্রশান্তিময় আবাসে পরিণত করে। ন্যায় বিচার ও যৌক্তিক আচরণকারীকে যথাযথ সম্মান ও সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এনে দিতে সৎ পেশাজীবীরা পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করে। উন্নত সমাজ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তির মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর অফুরন্ত সুযোগ। উন্নত মনের ও সুস্থ দেহের বিবেকবান মানুষ এমনভাবে গঠন হয়; যারা একটি উন্নত সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হয়। একটি উন্নত, সুশিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের সোপান রচনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বর্তমান প্রজন্মই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি কাঙ্ক্ষিত সমাজ রেখে যেতে পারে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে বিদ্যমান সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, পরের স্বার্থ দেখতে হবে, ভবিষ্যত ভেবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে, পাওয়ার লোভের চেয়ে দেয়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজকে জাগ্রত করতে হবে;যাতে তারা যৌতুকের জন্যে লালায়িত না হয়, দুর্বলকে আঘাত করে অট্টহাসি না দেয়, অন্যের অধিকার হনন করে আনন্দিত না হয়, অপরাধ করেও মানসিক তৃপ্তিবোধ না করে, বিভ্রান্তিকর হাতছানিতে সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট না করে। জীবন ও সমাজকে উন্নত করতে মানুষের চিন্তা ও কার্যক্রমে ইতিবাচকতার চর্চা বেশি প্রয়োজন হয়। পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতৃত্ব দরকার হয়।
পরিবেশ অধিকাংশ ব্যক্তির আচরণের রূপরেখা গড়ে থাকে। খুব কম সংখ্যক মানুষই পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা ও বিদ্যমান বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঘটনার মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়। একই পরিবেশে মানুষ লালিত পালিত হয়েও একেকজন ভিন্নরকমের আচরণ করে থাকে। পরিবেশ স্থির থাকে না, এটি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। প্রকৃত উন্নত সমাজে স্বচালিত বা স্বনির্ভর মানুষ বেশি থাকে; পরনির্ভরশীল ও নতজানু মানসিকতার মানুষ কম থাকে। যেকোনো সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দ্বন্দ্বমুখর মানব জীবন, সমাজ জীবন, সাংস্কৃতিক জীবনের গতিধারা প্রবাহমান থাকবে, অব্যাহত থাকবে। তবে সুন্দর সমাজ গঠনে সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের মানুষের বিকল্প নেই।
মানসম্মত ও উন্নত গঠনমূলক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে তারা বিশ্বের যেকোন প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। মানসম্মত শিক্ষা না হলে জ্ঞানভিত্তিক উন্নত ও আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। উন্নত সমাজ গঠনে বৈষম্য দূরীকরণের বিকল্প নেই, শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, দেশের অর্থনৈতিক- বাণিজ্যিক- রাজনৈতিক- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিচালনা জরুরি। তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া, প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন পর্যায়ে জ্ঞানের ব্যবহার, জ্ঞান তৈরিতে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমাদেরকে উদ্দেশ্য বিবেচনায় এনেই শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতে হয়। একজন মনীষী বলেছিলেন, একজন ব্যক্তি গোটা মানবজাতির কণ্ঠরোধ করলে তার যে অপরাধ হবে গোটা মানবজাতির একজন ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করলে তাদেরও সেই অপরাধ হবে।
সংখ্যাধিক্যের মতামতই সব সময় সঠিক হওয়াটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা জেনেছি গোটা মানবজাতি একসময় মহানবী (সা) এর বিপক্ষেই ছিল। তিনি একাই এক পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তার অবলম্বন সঠিক ছিল। ফলে পরবর্তীতে অনেকেই তার পক্ষে চলে এসেছে। গ্যালিলিও কে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সমাজ সংস্কারক, বড় বড় মহামানবরা অনেকেই বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছেন, অধিকাংশ মানুষই তাদের বিরোধীতা করেছে, স্বল্প সংখ্যকই করেছেন সমর্থন। গণতন্ত্রে সংকট হচ্ছে- প্রতিটি নাগরিক ভোটার যদি সজাগ ও দূরদর্শি না হয় তবে তাদের অধিকাংশের মতামতও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত হতে পারে। তাই উন্নত সমাজের মানুষ কোনো দলের সমর্থক কত বেশি তা দেখে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে না বরং সেবাধর্মী ও জনকল্যাণধর্মী কর্মকান্ডে কে অগ্রগামী এবং কোন দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি বেশি গণমুখী তথা জনবান্ধব সেটিই বিবেচনা করে। জ্ঞানীরা শুধু মাথা গুনে হিসেব করে না, মস্তিষ্কের উর্বরতা ও তার প্রয়োগে ফলাফলটা বিচার করেই মূল্যায়ন করে ব্যক্তিকে।
উন্নত সমাজের মানুষ অতি লোভে অন্যের ক্ষতি করে না, উন্নত মন নিয়ে নিজের জীবনের মতই অন্যের জীবনকেও ভালোবাসে , সময়কে কাজে লাগায়। অর্থের জন্য জীবন নয় বরং জীবনে জন্য অর্থ প্রয়োজন বলে মনে করে। অর্থের অতিরিক্ত লোভে অনেক সময় বন্ধুও শত্রুতে পরিণত হয়, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেয়। স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শত্রুর সাথেও গলাগলি ধরে চলতে আপত্তি থাকে না। এমন বদ স্বভাবের চরিত্রহীন লম্পট মানুষ দিয়ে আর যাই হোক সমৃদ্ধ সমাজ হয় না। সমাজ সমৃদ্ধ হয় ব্যক্তির ত্যাগে, উদারতা ও মহত্তের গুণে। অর্থ প্রেম অনেক মানুষকে মানবিকতা বিবর্জিত যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করে। ফলে উন্নত সমাজের মানুষ পরশ্রীকাতর ও হিংসুক হয় না, টাকা কামানোর মেশিন হয় না; তার অবসর থাকে, বইপড়া-শরীরচর্চা-গানশুনা-কবিতা পড়ার সময় থাকে। বেহুদা কাজ আর অনুৎপাদনশীল ও অকল্যাণকর কাজে সময় দেবার প্রবণতা থাকে না। তারা বুঝে কাউকে যত টাকা চাইবে তা দিলেও সে একজন টমাস আলভা এডিসন কিংবা আলবার্ট আইনস্টাইন দিতে পারবেন না। ফলে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যে কিংবা সামান্য অর্থ-সম্পদের লোভে নিজের মাথা বিক্রি করা তাদের দ্বারা সম্ভবপর হয় না।
উন্নত সমাজ একটি যুক্তিসঙ্গত ও যাচাই বাছাইকৃত মৌলিক বিশ্বাসের উপর সংগঠিত এবং সমাজের প্রতিটি ধ্যান-ধারণাই এই মৌলিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে যুদ্ধ-কলহ উন্নত সমাজে থাকে না, সামষ্টিক তথা বৃহৎ ও মহৎ স্বার্থের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকে। দুর্বল রুগ্ন দেহ আর অসুস্থ মানসিকতা নয় বরং আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের সংখ্যাধিক্যে সমাজের গুণগত পরিবর্তন সুনিশ্চিত হয়। সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল গঠনমূলক কাজে উন্নত সমাজের সবাই নিয়োজিত হয় আর বেহুদা কাজে অঝথা সময় ও মেধা নষ্ট করে না। সুন্দর হোক সমাজ, হৃদয়গুলো হোক আলোকিত, মনের প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ুক কর্মবীরদের দেহে আর পরিবেশটা হোক ভারসাম্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সুস্থ দেহ ও সুন্দর মনের পরিশ্রমী-কর্মপ্রিয়-ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ বৃদ্ধি পাবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি।