বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন। অথচ দেশের প্রবীণ নিবাসগুলোয় প্রবীণদের জন্য আবাসন রয়েছে মাত্র ২ হাজারের মতো। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটি, ২০৫০ সালে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। ক্রমবর্ধমান এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদানুযায়ী দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সেবা কেন্দ্র তৈরি না হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধ ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক ও সামগ্রিক নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। যা ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে প্রবল সামাজিক সংকটে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য যে পাঁচটি প্রধান বৈশ্বিক ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে তন্মধ্যে ‘বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি’ অন্যতম।
জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩-তে ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জ্যেষ্ঠ নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রবীণ ব্যক্তিরা হচ্ছেন তিন ধরনের। ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়স হচ্ছে নবীন-প্রবীণ, ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়স মধ্যম-প্রবীণ এবং ৮০’র উপরের বয়সীরা হচ্ছেন অতি-প্রবীণ। একজন বাংলাদেশির গড় আয়ু ১৯২১ সালে ছিল ২০.৯ বছর, ১৯৫০ সালে ছিল ৩৭ বছর, ১৯৭১ সালে ছিল ৪৭ বছর, ১৯৯০ সালে ৫১.৮ বছর, ২০১০ সালে ছিল ৬৭ দশমকি ৭ বছর, ২০১১ সালে ৬৯ বছর ও ২০১২ সালে ছিল ৬৯ দশমকি ৪ বছর; বর্তমানে তা হয়েছে ৭১ বছর ছয় মাস। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ সাফল্যে বর্তমান বিশ্বে মানুষ প্রায় ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তার মানে গড় আয়ু দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা, ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। তাই প্রবীণ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরও দায়িত্বশীল ও সচেতন করার প্রয়াস চালানো সময়ের অপরিহার্য দাবি। প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে স্বস্তিদায়ক কর্মমুখর জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে তাদের জীবনকে অর্থবহ করতে হবে।
১৯১১ সালে বাংলাদেশে মোট প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ, ১৯৬১ সালে ছিল ২৪ লাখ, ১৯৭৪ সালে ছিল ৪০ লাখ ৫৬ হাজার, ১৯৮১ সালে ছিল ৪৯ লাখ তিন হাজার, ১৯৯১ সালে ছিল ৬০ লাখ ৪৫ হাজার, ২০০১ সালে হয় ৭৬ লাখ, ২০১১ সালে ছিল এক কোটি। ১৯৯০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০০১ সালে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়ায়। বর্তমানে বিভিন্ন হিসেবে বয়োবৃদ্ধের সংখ্যা ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। প্রবীণের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ। ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি থাকবে। ২০৫০ সালে পাঁচজনে একজন ষাটোর্ধ্ব বয়সী থাকবেন অর্থাৎ ২০ শতাংশ নাগরিক হবেন প্রবীণ যখন শিশুসংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ। আমাদের দেশে দুই তৃতীয়াংশ প্রবীণই দারিদ্র, আটান্ন ভাগ প্রবণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই। কোনো অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ প্রবীণ হলে ওই জনসংখ্যাকে বার্ধক্য জনসংখ্যা ধরা হয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে বার্ধক্য জনসংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- প্রবীণের সংখ্যা বাড়লেও প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই প্রবীণদের অধিকার ও যাপিত জীবনের বাস্তবতা অনুধাবনের মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে, তাদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তায় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
ভাবতে হবে প্রবীণরা বোঝা নন; বরং আশীর্বাদস্বরূপ। অবসরের পরও প্রবীণদের মেধা, প্রজ্ঞা ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগালে অনেক সুফল আসবে। প্রবীণদেরও আধুনিক বিষয়গুলো গ্রহণ করতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। প্রবীণরা আগেই সন্তানদের সম্পদ না দিলে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের আগ্রহ থাকবে। শিক্ষাক্রমে প্রবীণদের সহানুভূতির বিষয়গুলো আনতে হবে। এরপর প্রবীণদের সঠিক মূল্যায়নে সামাজিক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সমন্বিত প্রয়াস চালাতে হবে। আমার মা-বাবা আমার সঙ্গে থাকেন না বলে, বলতে হবে- আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকি। কর্মক্ষম প্রবীণদের উপযুক্ত কাজে নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা বার্ধক্যে মানুষের সামাজিক বিচরণের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। সন্তান-সন্ততিরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সমবয়সী আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কমে যায় এবং সর্বোপরি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে প্রবীণেরা ধীরে ধীরে প্রয়োজনহীন, মূল্যহীন, অকেজো, উপেক্ষিত ও অবহেলিত হিসেবে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে প্রতীয়মান হয়। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রবীণদের ৫৮ শতাংশের দারিদ্র্যের কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণেরই সামর্থ্য নেই।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রবীণবান্ধব করতে হবে, ডোর টু ডোর গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে, প্রবীণদের উপযোগী হেলথ ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম চালু করতে হবে।সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রবীণদের জন্যে পৃথক কাউন্টার খোলতে হবে, তাদের জন্যে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ সিট সংরক্ষণ করতে হবে, নির্ভেজাল পুষ্টিকর খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। প্রবীণদের চিকিৎসাখাতে ৫০ ভাগ ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে প্রবীণদের চিকিৎসায় প্রচলিত মেডিকেল শিক্ষা পাঠ্যক্রমে ‘বার্ধক্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে প্রবীণ চিকিৎসা কর্ণার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হেলথ অ্যাকসেস ভাউচার, হেলথ সার্ভিস কার্ড চালু করতে হবে। তাদের প্রতি অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সেই ব্যাপারে সর্বস্তরে সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়াতে হবে। নবীন-প্রবীণদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান, মধ্যম -প্রবীণদের জন্য হালকা কাজকর্ম এবং অতি-প্রবীণদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাও করতে হবে।
প্রবীণদের জন্য খাদ্যের নিরাপত্তা, সেবা দেয়া, সঙ্গ দেয়া, স্বাধীনতা দেয়া ইত্যাদি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণরা যেভাবে থাকতে চান, সেভাবে থাকতে দিতে হবে। প্রবীণদের ভাতাও আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সংসারে প্রবীণ যেন কষ্ট না পান সেজন্য আচরণে সতর্ক থাকতে হবে, সম্মান দেখাতে হবে, ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। নন-কমিউনিকেবল ডিজিজগুলো প্রিভেনশন করতে ব্যায়াম বা লাইফস্টাইলের পরিবর্তনে সহায়তা করতে হবে। সমাজের দরিদ্রতম, সুবিধাবঞ্চিত, প্রতিবন্ধী, শারীরিকভাবে রুগ্ন-দুর্বল এবং পারিবারিকভাবে সামর্থ্যহীন প্রবীণদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করে বিশেষ কল্যাণ কার্যক্রম চালাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় প্রবীণ কল্যাণ তহবিল বা ফান্ড গঠন করতে হবে। প্রবীণকল্যাণে সর্বাত্মক সহায়তায় প্রবীণ ব্যক্তি বিষয়ক ট্রাস্ট, দানশীল ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্প্রসারণে সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোকেও অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। প্রবীণের নিরাপদ ও মর্যাদাজনক জীবন নিশ্চিত করে অসহায়ত্ব দূরীকরণে নবীনদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে-আজকের তরুণই কিন্তু আগামী দিনের প্রবীণ।
প্রবীণ সমস্যাটির সমাধানে কিছু সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। রাস্তার পাশে বেঞ্চ পেতে দিলে প্রবীণ বসতে পারেন। প্রবীণবান্ধব মানসিকতা থাকলে কোনো প্রবীণকে বাসে উঠে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না । প্রবীণদের জন্য সরকার বাসের ভাড়া অর্ধেক করতে পারে, প্রতিটি বাসে কমপক্ষে তিনটি সিট বরাদ্দ রাখতে পারে, ইমিগ্রেশন আলাদা করতে পারে। প্রবীণদের নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা শহরে কাজ করতে পারে কিংবা গ্রাম পর্যায়েও কাজ করতে পারে। প্রবীণরাও আত্মনির্ভরশীল হতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। সংকটাপন্ন প্রবীণদের জীবন-মান উন্নয়নে প্রবীণ স্বাস্থ্য সেবা ক্যাম্প, কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণ এবং প্রবীণবান্ধব আয়বর্ধক প্রকল্প বাড়াতে হবে। তাদেরকেও সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রবীণদের দেখতে হবে, বুঝতে হবে, কাছে যেতে হবে, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, প্রবীণদের কল্যাণে কাজ করতে বা টাকাপয়সা খরচ করতে আগ্রহী হতে হবে; উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সরব হতে হবে। জাতীয় বাজেটে প্রবীণদের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রবীণদের জন্য বিনোদনমূলক ক্লাব বা পার্ক স্থাপন করতে হবে।
প্রবীণের প্রজ্ঞা দেশের সম্পদ। সমাজের বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞতার ভান্ডার প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নবীনদের সামনে এগিয়ে যাওয়া দ্রুততর হবে। প্রবীণদের বিনোদনের কথাও ভাবতে হবে। প্রয়োজনে যে কোনো প্রবীণ যাতে বয়স্ক ভাতা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবীণদের জন্য ব্যাংকিংসেবাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। আশির ওপরের প্রবীণদের প্রতি ইনটেনসিভ কেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবীণদের জন্য উপজেলাভিক্তিক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারিভাবে বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপিত বৃদ্ধ নিবাসেও সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। এনজিওগুলোরও প্রবীণদের নিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। নগর জনপদে প্রবীণদের পক্ষে যানবাহনে চড়া, অফিস-আদালত-ব্যাংক-হাসপাতালে যাওয়া-আসা, হাঁটাচলা করা, রাস্তা পার হওয়া, বাজারঘাট ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করা অত্যন্ত কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবীণদের প্রাপ্য অধিকার, চাহিদা ও সামর্থ্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শহরের স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। প্রবীণদের আনুষ্ঠানিক সেবার প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। একটা সময় একজন কর্মক্ষম মানুষকে তিনটি প্রজন্মের দায়িত্ব নিতে হবে – তার নিজের, তার আগের (মা-বাবা) এবং তারও আগের (দাদা-দাদী)। তিনটা প্রজন্মের দায়িত্ব নেয়ার মত অর্থনৈতিক অবস্থাতো সবার থাকবে না। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রেরও প্রবীণদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।
নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা না থাকায় সন্তান বাবা-মাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ এই সময়ে পরিবারের সান্নিধ্য তাদের বেশি দরকার হয়। তারপরও যদি বিকল্প না থাকে সে সকল অসহায় প্রবীণদের বিভিন্ন কাজে লাগাতে বিত্তবানদের একটা মিশন এবং ভিশন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক জেলায় প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং, সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম করে প্রবীদের পূনর্বাসনের বিষয়ে জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। প্রবীণদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা হতে হবে। নবীন-প্রবীণের সম্পর্ক স্থাপন করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। যুগোপযোগী প্রবীণবান্ধব নীতিমালা ও প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও প্রবীণবান্ধব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার ব্যাপকতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এজন্যে সচেতনতা তৈরি, সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধ, বিনিয়োগ ও পেশাদারিত্ব – কোন ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়া যাবে না। প্রবীণদের ইতিবাচক, সৃজনশীল, অর্থবহ এবং দেশ ও সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবে চিত্রায়িত করে তুলে ধরে সাধারণ মানুষের প্রবীণদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে গণমাধ্যম।
মানবিক সমাজ বিনির্মানে গণমাধ্যমকে প্রবীণ ইস্যুতে বেশি বেশি অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোকে প্রবীণবান্ধব করতে হবে। রাষ্ট্রীয় নীতি ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের সময় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর চাহিদার কথা মাথায় রাখতে হবে। নগর ও গ্রামে যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবা কর্মসূচিগুলোকে প্রবীণবান্ধব করতে হবে। প্রবীণবান্ধব জীবিকায়নে আবর্তনশীল তহবিল ও সরঞ্জাম বিতরণ করতে হবে। প্রবীণবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনযাপন বন্ধ করতে হবে। বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথ পরিবারের চর্চা বৃদ্ধি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করতে হবে, আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। গণদারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শ এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন, যুব শ্রেণীর গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর, শিল্পায়ন ও নগরায়ন, পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি কারণে যেভাবে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকছে- এই সমস্যার সমাধানের উপায় বের করিতে হবে।
প্রবীণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচার-আচরণের কারণ প্রবীণদের অনুৎপাদনশীল, অক্ষম, দুর্বল ও ব্যধিগ্রস্ত মনে করা; চিন্তা-চেতনায় সেকেলে, পরিবর্তনবিমুখ মনে করা। এ থেকে উত্তোরণে প্রবীণদের কল্যাণে দেশব্যাপী কাজ করতে হবে। মহানগরগুলোকেও প্রবীণবান্ধব হয়ে উঠতে হবে। এ কাজে রাজনৈতিক নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রবীণদের কল্যাণে কর্মসূচি দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে পরিচালিত কার্যক্রমে প্রবীণদের অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তার প্রতি সুনজর দিতে হবে। প্রবীণের বিভিন্ন ইস্যুকে ইতিবাচকভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরলে এবং যার যার জায়গা থেকে এখনই কাজ শুরু করলে রাষ্ট্র ও সমাজ দ্রুত প্রবীণবান্ধব হয়ে উঠবে। জীবন সায়াহ্নে এসে মানবেতর দিন কাটাতে হবে না, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনির ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না, নিশ্চিত হবে ন্যায্য অধিকার। সমাজ ও পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে অবহেলা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার না হন, সে লক্ষে আইনগতভাবেই সম্পত্তিভোগের অধিকার নিশ্চিত করতে স্বেচ্ছাসেবী, উন্নয়ন সংস্থা এবং উপযুক্ত সংস্থার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবীণদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হলে আইন প্রয়োগকারি সংস্থাকে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। পরিবার যদি কাউকে সমাদর না করে, সম্মান না দেয় তা হলে সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে সমাদর বা সম্মান না পেলে সেই মানুষটি থাকে জীবম্মৃত।
আমরা চাই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি বাবা-মাকে ফেলে এককভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখবেন না। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীনভাবে গড়ে উঠা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে খাদ্য, চিকিৎসা, বিনোদন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। বৃদ্ধরা দয়া চায় না, অধিকার চায়, পূর্ণ অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়, সুখের সাথে মৃত্যু চায়। সেজন্য খাস জমিতে বৃদ্ধ ব্যক্তিদের কৃষির সাথে সংযুক্তি করা যেতে পারে, কর্ম সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে কম্পিউটারাইজড লাল রঙ্গের পরিচয়পত্র প্রদান করা যেতে পারে। কেয়ার হিভার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, জেরিয়াট্রিক কেয়ার ইউনিট, কর্মসংস্থান সম্বলিত বৃদ্ধ নিবাস ও ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করে প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও মাল্টিপারপাস ব্যবহারের উপযোগি করা যেতে পারে। কারণ প্রবীণ ব্যক্তির person centred care প্রদানে যে দক্ষতা ও যোগ্যতা আবশ্যক তা আমাদের চিরাচরিত গৃহস্থালী কাজে সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তিদের নেই। প্রবীণদের যেন ডোর টু ডোর সেবা দিতে পারে সে জন্যে প্রবীণদের জন্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও ভাতা বাড়ানো যেতে পারে।
এদেশের প্রবীণদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অগণিত সমস্যার মধ্যে স্বাস্থ্যগত, বার্ধক্যজনিত, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও একাকিত্ব সমস্যা উল্লেখযোগ্য। প্রবীণদের সঙ্গ দেয়া, তাদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন ও সম্মান জানানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করলে তারা একটু ভালো থাকতে পারবেন। পেনশন, বয়স্ক ভাতা, ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সুবিধাদি চালু করার মাধ্যমেও প্রবীণদের কিছুটা সুবিধা বাড়ানো সম্ভব। শিশুবান্ধব পরিবেশে পারিবারিক জীবনের নির্মল আনন্দে কাটানোর ব্যবস্থা নিতে আবাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি শিশু পরিবারগুলোতে তাদের জায়গা করে দেয়া যেতে পারে। সরকারি আবাসনের ক্ষেত্রে প্রবীণদের স্বচ্ছন্দে থাকার জন্য আলাদা কক্ষও তৈরি করতে হবে। বেসরকারি আবাসনের ক্ষেত্রে নতুন করে তৈরি করা আবাসিক ভবনে প্রবীণদের জন্য আলাদা কক্ষ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে অসহায়-জরাগ্রস্ত ব্যক্তিদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিহ্নিত করে সুবিধাভোগী বানাতে হবে, ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩’ ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩’ ‘প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন’ কার্যকর করতে হবে। যাতে সকল প্রবীণ নিরাপদ বার্ধক্যে স্বস্তিময় জীবনে আনন্দময় থাকতে পারে।
খাদ্য ও পোশাক কেন্দ্রিক ফ্যাশনের দোকান প্রবীণের জন্যও হতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তি উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরলে ঠাট্টা করার মানসিকতা দূর করতে হবে। শহরাঞ্চলে প্রবীণদের জন্য প্রবীণবান্ধব বাড়ি ও সিঁড়ি নির্মাণ করতে হবে। বাবা-মায়ের জন্য আলাদা কক্ষ বরাদ্দ রাখতে হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানেও প্রবীণদের উপযোগী খাবার রাখতে হবে। সরকারি হাসপাতালে জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ড চালু করতে হবে এবং জেরিয়াট্রিক বিশেষায়িত ডাক্তার বাড়াতে হবে। গণপরিবহনে প্রবীণের জন্য আসন বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষা-প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এবং নতুন প্রযুক্তি বা জ্ঞান গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবীণদেরও সুযোগ দিয়ে নবীন-প্রবীণের মাঝে জেনারেশন গ্যাপ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রবীণ বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পরও কাজ করতে চান; তাদের নিতে নিয়োগকর্তাদের আগ্রহী থাকতে হবে। শিশু পরিবারগুলোতে বয়স্কদেরও থাকার ব্যবস্থা চালু করে আন্তঃপ্রজন্ম যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। প্রবীণদের প্রতি অন্যায় আচরণ সংঘটিত হতে দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবিধানের জোরালো ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রবীণদের জীবন হবে না নিরাপত্তাহীন, সন্তানের সাথে দেশে বা প্রবাসে অবস্থান করতে পারবে, পরিবার-পরিজনহীন একাকী জীবন কাটাতে হবে না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে নতুবা চেনাজানা পরিবেশ ছেড়ে শহরের বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে ভিক্ষাবৃত্তি বা শ্রম বিক্রি করে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তাঁদের জন্য ইউনিভার্সাল ননকন্ট্রিবিউটরি পেনশন স্কিম চালু করা হবে, আবাসনসহ সব ভৌত অবকাঠামো প্রবীণদের উপযোগী করা হবে। যাতে প্রবীণেরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, কেয়ারগিভার ও আত্মীয়স্বজন দ্বারা অবহেলা ও অপব্যবহারের শিকার না হয়। বয়সের ভারে রোগে-শোকে আক্রান্ত প্রবীণকে কষ্টসাধ্য উপার্জন কাজে নিয়োজিত করা যেমন, সম্পদ ও বাড়িঘর পাহারা দেওয়া, বাজার করা, রান্না করা, শিশুদের দেখভাল ও স্কুলে আনা-নেওয়া করা ইত্যাদি সাংসারিক কাজে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করা কোনোক্রমেই সমীচীন নয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করা এবং কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ দেওয়া জরুরি।
পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন স্তরের সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া যায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। শুধু তাই নয় ডাক্তারের টাকা, হাসপাতালের টাকা, এমনকি ওষুধের টাকাও আসে সরকারি তহবিল থেকে। তারপর পয়ষট্টির পর থেকে বাসের ভাড়া, প্লেনের ভাড়া, ট্রেনের ভাড়া, কাপড় চোপড়ের দাম, জুতোর দাম সবকিছুতে ছাড় দেওয়া হয়। সময় সময় সরকার তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য ভ্রমণভাতাও দেয়। অথচ আমাদের দেশে এসবের বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা নেই একজন বৃদ্ধলোকের। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশের প্রবীণরাও ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পাবে। আমৃত্যু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাবে, বার্ধক্য মানেই পরমুখাপেক্ষী-পরনির্ভরশীলতা হবে না। সন্তানের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও বয়স্ক মানুষদের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব নেওয়া প্রয়োজন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে সকল সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। কেননা তাঁরা দেশের জন্যে কাজ করেছে, দেশের মানুষের জন্য সারাজীবন স্ব স্ব অবস্থান থেকে শ্রম দিয়েছেন।
পরিশেষে আমরা চাই-এদেশে বার্ধক্য হবে সফল, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রবীণবান্ধব পরিবেশ থাকবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা প্রয়োজন। বয়সের ভারে নিস্তেজ হয়ে আসা সময়টুকুতে প্রবীণরা একটু সহানুভুতিতে বেঁচে থাকবে, প্রবীণরা সুখ-শান্তি এবং মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে- এটাই প্রত্যাশা করি। আসুন সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করি, প্রবীণদের ভালোবাসি, সফল বার্ধক্যের স্বার্থে তাদের অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হই, শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করি, নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিই এখন থেকেই। প্রবীণদের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, আত্মতৃপ্তি, সেবাযত্ন ও দেখভালের বিষয়টি গুরুত্ব পাক। প্রবীণবান্ধব দেশ তৈরি করতে হবে সবাই মিলে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সব বয়সীর বসবাসের জন্য সমান উপযোগী, সমান সুরক্ষিত এবং উপভোগ্য একটি অনিন্দ্য সুন্দর রাষ্ট্র।