কোনো ধর্মই সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম বা জাতি নেই। সন্ত্রাসীর পরিচয় সে শুধুই সন্ত্রাসী। ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইসলামকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই; যা ইসলাম বিদ্বেষীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্তেরই ফসল। শান্তি-মানবতা-কল্যাণের ধর্ম ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে চিত্রায়িত করছে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ-চরমপন্থার ধর্ম রূপে। মুসলিম উম্মাহকে আখ্যায়িত করছে সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী-উগ্রবাদী-চরমপন্থী হিসাবে। অথচ এ জাতীয় কর্মকাণ্ড ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম বলেই বিবেচিত। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য প্রকৃত ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক প্রচার প্রসার, পারিবারিক মূল্যবোধ জাগরিতকরণ, সম্মিলিত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়। সমাজে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, অনিরাপত্তা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো ঘৃণ্যতম কাজকে ইসলাম কখনো অনুমোদন করে না। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘোষিত হয়েছে।
অশুভ কর্মের বীজ বপনকে রুখে দেয়া
আল্লাহ-রাসুলের বাণীর মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যাতে জিহাদের নামে চরমপন্থা, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসের মতো নানা অশুভ কর্মের বীজ যাতে বপন করতে না পারে। যারা ধর্মের সঙ্কীর্ণ ধারণা বা অপব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদের নামে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবধর্ম তথা মানবতাকে বিপন্ন করছে, দেশের সুনাম বিনষ্ট করছে, তারা সত্যিকার অর্থে কোনো ধর্মের অনুসারী নয়। এদও বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে, নিজে সতর্ক থাকতে হবে, অন্যকেও সতর্ক করতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিতে হবে।
ইসলামের সত্যিকারের শিক্ষা সম্প্রসারণ
যতদিন না পর্যন্ত ইসলামের সত্যিকারের শিক্ষা থেকে সাধারণ মানুষ দূরে, ততদিন তরুণরা বেশি বিভ্রান্ত হবে, মুসলিমরা বিপদের সম্মুখীন হবে। কেউ বিপথগামী হবে না যদি তার হৃদয় ইসলামের আলোকে উজ্জল থাকে। নবীন প্রজন্মেও মাঝে ধর্মেও মূল স্পিরিট যে মানব কল্যাণ এটা খুব ভালোভাবে পৌঁছানোর দায়িত্ব নিতেই হবে। নবী এসেছিলেন জগতবাসীর জন্য শান্তি ও রহমত স্বরূপ। ইসলাম বিদ্বেষীদের অপপ্রচার, প্রপাগাণ্ডা ও মিথ্যাচারে যাতে সরলমনা মুসলিমরা বিভ্রান্ত না হন, সেজন্য চাই সঠিক প্রচারণা।
মধ্যমপন্থা অবলম্বন ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ
যে ব্যক্তি শরীরে বোমা বেধে নিজের জীবন দিয়ে দেয় সে কিন্তু কখনোই দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে এটা করে না। তার মধ্যে কিছু একটা আছে। তা হল অত্যাধিক তাকওয়া, প্রবল ঈমানী চেতনা, অতিরিক্ত পরহেযগারিতা, অতিরিক্ত আবেগ। একমাত্র জান্নাতের আশায় আল্লাহকে রাজিখুশী করার জন্যই এটা করে। কিন্তু পদ্ধতিটি ভুল হওয়ায় জাহান্নামই নিশ্চিত করে মাত্র। অনেক মুসলমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের শাসকদের ব্যাপক সমালোচনা করে কিন্তু বিধর্মী শাসকদের সমালোচনা করেন না। রাসূল সা: বলেছিলেন- ‘এরা মুসলিমদের হত্যা করবে আর কাফেরদের ছেড়ে দেবে’। আসলে অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। মধ্যমপন্থা অবলম্বন ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করা উচিৎ।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা
হযরত উসমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ) এর হত্যাকারী মুসলমান ছিল। তারা উসমান (রাঃ) পেছনেই জামাতে নামাজ পড়েছেন। হযরত উসমান রাঃ কুরআন পাঠ অবস্থায় স্বস্ত্রীক নির্মমভাবে শহীদ হন। আমর ইবনুল হামক লাফিয়ে উঠে তার বুকে চেপে বসে ছয়বার অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে এই মহান খলিফাকে শহীদ করে। হত্যাকারী বলেছিল- ‘আজকের দিনের ন্যায় কোনো কাফেরের এত সুন্দর মুখমন্ডল কখনো দেখিনি এবং এরকম অধিক সন্মানীয় কাফেরের বাসস্থানও দেখিনি’।
হযরত আলী (রাঃ) এর হত্যাকারী আবদুর রহমান মুলজিম ধরা পড়ার পরে বলেছিল, ‘আমি আল্লাহর নিকট ওয়াদা করেছি দু’জন নিকৃষ্ট কাফেরকে হত্যা করে জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করব। এক আলীকে মেরেছি আর মুআবিয়াকে মারার পর আমাকে হত্যা কর। তারপর আমি জান্নাতে যাবো।’
দেখছেন আকীদার অবস্থা! কত বড় মুমিন, কত বড় আল্লাহওয়ালা! বর্তমানে এই যে মাজারে বোমা, সিনেমা হলে বোমা, মসজিদে বোমা মারে এরা মুসলিমদের মুসলিম মনে করে না। এরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি-অতিরঞ্জন করে, মতভেদের সময় উগ্রবাদী মনোভাব দেখায় ও কট্টরবাদী সমালোচনা করে। দ্বীন সন্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকার ফলেই এমনটি ঘটে।
আবেগপ্রবণ নয়, বিবেকবান প্রজন্ম গড়া
মহানবী সা. বলেন, ‘অচিরেই শেষ যামানায় একটি নির্বোধ যুব-দল হবে, যারা লোক সমাজে সবার চাইতে উত্তম কথা বলবে। কিন্তু ইমান তাদের গলদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না।’ [বুখারী/৩৬৫৪; মুসলিম, মিশকাত/৩৫৩৫]
জ্ঞানীগণ বলেন, ‘বাতিলের উপর যা প্রতিষ্ঠিত, তা নিজেও বাতিল’। অথচ জঙ্গীবাদী ও চরমপন্থী যুবকরা হয় আবেগপ্রবণ, বেশি উদ্যমী, অনভিজ্ঞ, কম প্রজ্ঞাবান, ধর্মবিষয়ে বিভ্রান্তিতে ভরপুর। এরা জানে না, মঙ্গল আনয়নের চেয়েও অমঙ্গল দূরীকরণ অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত। একই কাজে যদি লাভ-ক্ষতি দুই থাকে তাহলে লাভ না করে ক্ষতি যাতে না হয় তারই চেষ্টা করতে হয়।
মন্দকে মন্দ দিয়ে দূর করা যায় না। পেশাব দিয়ে পায়খানা ধুয়ে পবিত্রতা অর্জন হয় না। আগুনকে আগুন বা পেট্রল দিয়ে না নিভিয়ে পানি দ্বারা নিভাতে হয়। কোনো মন্দ দূর করতে গিয়ে অধিকতর মন্দ সৃষ্টি হলে সেই মন্দ দূর করা বাঞ্ছনীয় নয়। আঙ্গুলের ব্যাথা দূর করতে গিয়ে যদি সারা শরীরে ব্যাথা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা হয় অথবা মৃত্যুর ভয় থাকে, তাহলে সেই ব্যথা দূর করা নিশ্চয় ভালো নয়।
ছোটবেলা থেকেই রাসূলের আদর্শে গড়ে তোলা
আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ২১)।
তাওহীদের দাওয়াত প্রদান করা এবং কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে মানুষকে প্রশিক্ষিত করা ‘তাসফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’ নামে পরিচিত। প্রথম যুগের মুসলিম যোদ্ধাদেরকে মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাদ্রী, পুরোহিতদেরকেও আক্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছিল (আহমাদ হা/২৭২৮)।
ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে রাসুল সা. ও সাহাবাদের দেখানো পথেই। আর উনারা এই কাজ করছেন সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে, সুন্দর কথা বলে ভয় দেখিয়ে নয়, নিরিহ মানুষ মেরে নয়। রাসূল (সা) তার নৈতিক আদর্শ, মহানুভবতা, সহনশীলতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলেন সর্বোত্তম একটি মানবীয় সমাজ। রাসূল (সা)-এর জীবন ছিল সহনশীলতা ও ক্ষমার এক অনুপম আদর্শ। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনো তিনি কাউকে আঘাত করেননি, কখনো কটু কথা বলেননি।
রাসূল ও সাহাবিদের জীবন সম্পর্কে জানা
ইসলামের স্বভাব সম্পর্কে জানতে হলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন করতে হবে। মহানবী সা: কখনো একজন মানুষকে গুপ্তহত্যা করেননি বা কাউকে এ কাজ করতে বলেন নি। তিনি বলেছেন, তোমরা আগে অস্ত্র উত্তোলন করো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতি প্রদর্শন করো না। ইসলামের যুদ্ধনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়, এমনকি প্রতিশোধমূলকও নয়। জেহাদ মানেই যুদ্ধ নয় বা হুট করে গিয়ে কাউকে হত্যা করা নয়। জেহাদ মানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টায় সব ব্যক্তিই নিজ নিজ কুপ্রবৃত্তি দমনের ক্ষেত্রে আজীবন সংগ্রাম করবেন। আর সমরাস্ত্রের ব্যবহার হবে প্রকাশ্য ময়দানে এবং ঘোষণা দিয়ে আক্রান্ত অবস্থায় দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে। ইসলামে জেহাদের অর্থ কাউকে নির্মূল করাকে বোঝায় না। ইসলাম মানুষকে ভালোবাসতে বলে, হত্যা করতে নয়।
সচেতনতা বাড়াতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস
ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যারা যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। দেশের আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খতিবগণ উদ্ভূত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ অবস্থান রেখে ধর্মপ্রাণ জনগণকে সচেতন করতে পারেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর হলেই আর এ সমস্যা থাকে না। ধর্মপ্রাণ মানুষকে সচেতন ও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রচারণামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া।
জঙ্গি নিয়োগ, প্রশিক্ষক, আর্থিক জোগান ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সকলে একসাথে রুখে না দাঁড়ালে এর মোকাবিলা করা অসম্ভব। দেশের জনগণকে সব ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সাধারণ মানুষের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতায় সব ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। সন্ত্রাসের মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সহযোগিতাও বাড়াতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানসিকতায় পরিবর্তন
বর্তমানে তরুণ সমাজ উগ্র চরমপন্থার দিকে যাচ্ছে। তাদের মগজধোলাই করা হচ্ছে অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করলে পুণ্য হবে বলে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তরুণ সমাজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তাদের মধ্যে ভিন্নতাকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়।
অন্য ধর্ম, অন্য বর্ণ, অন্য গোত্র ও অন্য জাতির মানুষকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে আরো কঠোর হতে হবে। এখন জঙ্গিবাদে যারা জড়িত হচ্ছে তারা প্রান্তিক মানুষ নয়। জড়াচ্ছে বুয়েট, মেডিকেল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা। অর্থাৎ জাতি মন-মানসিকতায়, চিন্তা-চেতনায় অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে।
নবীন প্রজন্মকে সময় দেয়া
কেবল সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিই নয়; সন্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক-ধর্মীয়-সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। যত বেশি সঠিক তথ্য পাবে, তত বেশি তারা জানতে ও বুঝতে পারবে। বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক গল্প করতে হবে, সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। মা-বাবারা যত দিন বাচ্চাদের তাদের বাহুতে মাথা নিয়ে গল্প করবেন না, একসঙ্গে গান শুনবেন না, তত দিন এ সমস্যা থেকে যাবে। মুখে মুখে ভালোবাসা নয়, সন্তানের অন্তরে জায়গা করে দিতে হবে। তার মনের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করাতে হবে।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বাড়ানো
ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে কু-শিক্ষার দিকে ধাবিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সন্তানদের বিপথগামী হওয়া ঠেকাতে একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের বেশি পরিমাণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদেরকে ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি অভিভাবক সম্মেলনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে জঙ্গি দমনে সজাগ থাকতে হবে।
মৌল মানবিক গুণে গুণাণ্বিত হওয়া
অবাধে অন্যায় অবিচার, অনাচার, পাপাচার, নৈরাজ্য ও ধ্বংস সাধনে লিপ্ত মানবরূপী হিংস্র পশুদের সাথে আপস করার মানসিকতাকে কোনভাবেই মহানুভবতা বলা যায় না, তা হচ্ছে নিছক কাপুরুষতা, ভীরুতা, আত্মগ্লানি ও সত্যের অবমাননা। আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর প্রাণের শত্রুকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার সাথে সাথে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন একইসঙ্গে চরমপন্থা ও কঠোর আচরণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। অতএব তার অনুসারী হিসেবে কারো সাথে কঠোর ব্যবহার করার সুযোগ আমাদের কোথায়?
আত্মঘাতী বোমা হামলা হারাম ঘোষণা
আত্মঘাতী বোমা হামলা ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সে কারণে আলেমরা আত্মঘাতী বোমা হামলাকে সর্বসম্মতভাবে হারাম ও অনৈসলামিক বলে ফতোয়া দিতে পারেন। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে পবিত্র যুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণার কোনো এখতিয়ার নেই। এসব আত্মঘাতী হামলা নিষিদ্ধ। বোমা হামলার মাধ্যমে ইসলামের মূল শিক্ষা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই ফতোয়া ব্যাপক প্রচার হলে সহিংসতা কমবে, সমাজের স্থিতিশীলতা বাড়াবে। সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক হবে।
সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন
মসজিদের খুতবা, ওয়াজ মাহফিল সহ বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে ইসলামে যে কোন সন্ত্রাসের স্থান নেই তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে হবে। বিক্ষুব্ধ হলেই আইন হাতে তুলে নেয়া যায় না, মানুষকে হত্যা করা যায় না। যারা জিহাদ ও কিতাল সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে বিকৃত করে মানুষ মারার লাইসেন্স খুঁজছে তারা যে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। তারা অতীত জমানার খারেজিদের মতো মুসলমানদের রক্তপাতকে হালাল করার চেষ্টায় আছে। খারেজিরা এতটা উগ্র ছিলো যে হযরত আলীর রা. মতো ব্যক্তির রক্তকেও হালাল মনে করেছিল এবং জনৈক খারেজির হাতেই তিনি শাহাদত বরণ করেন। আজকের যুগে নব্য খারেজি ভাবধারা সম্পন্ন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
যুব সমাজকে সতর্ক করা
ইসলামের দুশমনদের পাতানো ফাদে পা দেয়া থেকে বিক্ষুদ্ধ যুব সমাজকে সতর্ক করতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশে নিয়মতান্ত্রিক পথের বাইরে গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না যে কারণে গোটা ইসলাম ও উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর টার্গেট হচ্ছে আধুনিক তরুণদের রিক্রুট করা যারা মূলত বর্তমান ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। যারা ইসলাম সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখে তাদেরকে জিহাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে পরকালে বেহেশত লাভের পথ দেখায়।
তারা জানে না যে অমুসলমানকে হত্যা করলেই বেহেশতে যাওয়া যায় না বরং এর মাধ্যমে তারা মারাত্মক পাপে লিপ্ত হচ্ছে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সমূহ ক্ষতি সাধন করছে। ফলে জাহান্নামে যাওয়ার পথই তারা প্রশস্ত করছে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে এমন সুযোগ ইসলামের দুশমনদের দেয়া যাবে না যাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে তারা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সন্ত্রাসী ভাবধারা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।
ব্যাপক জনমত তৈরি
সন্ত্রাসের অন্যতম উদ্দেশ্য আলেম সমাজ ও ইসলামি দলগুলোকে দুর্বল করা। তাই আলেম সমাজ ও ইসলামী দলগুলোকে এর বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। ধর্ম বিষয়ে বাড়াবাড়ি, উগ্রতা ও চরমপন্থা নিজেদের ও উম্মাহর ধ্বংসের কারন। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার প্রসারই হচ্ছে চরমপন্থা ও সন্ত্রাস মোকাবিলার প্রকৃষ্ট পথ।
মুসলিম দেশে যারা ইসলামের শিক্ষার প্রসারকে উন্নতি, অগ্রগতি ও শান্তির অন্তরায় মনে করে তারাও চরমভাবে ভ্রান্ত। সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে তরুণদের রক্ষা করতে হলে ইসলামের মহান ও মানবিক বাণী তুলে ধরতে হবে; সমাজে মানবিকতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে; জাতি-ধর্ম-দলমত নির্বিশেষে সবাইকে কল্যাণ আকড়ে ধরে সমাজ থেকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা নির্মূলে এগিয়ে আসতে হবে।
সংগঠন গড়ে তোলা ও শান্তি চুক্তি সম্পাদন
বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত মহানবী সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেও চরমপন্থা ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ‘হিলফুল ফুজুল’ সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছেন। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদিনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত ইহুদিদের সাথে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন।
মদিনা সনদ হিসেবে খ্যাত এ সনদের একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসীদের হাত সমবেতভাবে ওইসব ব্যক্তির হাতে উত্থিত হবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায়, পাপাচার, সীমালঙ্ঘন, বিদ্বেষ অথবা দুর্নীতি ও ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে। তারা সবাই সমভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, যদিও সে তাদেরই কারো আপন পুত্রও হয়ে থাকে।’
আরেকটি শর্তে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে তা প্রমাণিতও হবে তার ওপর কিসাস গ্রহণ করা হবেÑ হত্যার পরিবর্তে তাকে হত্যা করা হবে।’
সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
চরম পন্থার মতবাদগুলোতে বলা হয় যে, যদি সত্যিকারের মুসলিমই হতে হয় তাহলে তোমাকে তো জিহাদ করতে হবে। আর জিহাদ করতে হলে তোমাকে আশেপাশের মানুষদের হত্যা করতে হবে। নাহলে তুমি তো মুনাফিক, আর অন্য যারা এর বিপক্ষে সবাই মুনাফিক, তারা বিক্রি হয়ে গেছে। তারা আসলে মুসলিমই না। তো প্রথমেই তাদেরকে যেটা বুঝানো হয় যে আশেপাশের সবাই আসলে মুনাফিক, তারা কাফির হয়ে গেছে, তো তারা কি বলল না বলল এতে কিছু আসে যায় না।
প্রথমে তারা এই তরুণদের তাদের নিজেদের সমাজ, নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এরপর তাদের জন্য সহজ হয়ে যায় যত রকমের ঘৃণা তাদের মনে ঢুকানো। কোন এলাকা কিংবা রাষ্ট্রে যদি মানুষের বসবাস, চলাচল ও কাজ-কর্ম নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করা হয়, যদি সে এলাকা বা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা হয় নিরপেক্ষ ও সুদৃঢ় আর নাগরিকগণ বেড়ে উঠে সুপথে ও সচ্চরিত্রবান হয়ে, তাহলে সে এলাকা বা রাষ্ট্রে কখনো সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা, উগ্রবাদ ইত্যাদি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।
সন্ত্রাসবাদ দমনে দেশগুলোর ঐকমত্য
চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে সরকার প্রধানদের। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দেশগুলোর মধ্যে মতৈক্য হতে হবে, নেতৃবৃন্দকে ঐকমতে আসতে হবে। টেররিজম এবং এক্সট্রিম ভায়লেন্সের বিষয়ে পলিসি গ্রহণে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে হবে। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কোনো দেশ যে কর্মকাণ্ড গ্রহণ করছে, যে যে ক্ষেত্রে ও যে যে উদ্যোগ গ্রহণ করে সুফল পাচ্ছে তা’ তুলে ধরতে হবে। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতাও বাড়াতে হবে। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থাকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। বিভিন্ন দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
মিডিয়ায় প্রচারণার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা
চরমপন্থী-সন্ত্রাসীরা সব সময় প্রচার চায়। তারা আতঙ্ক ছড়াতে চায়। এ জন্য তারা জনবহুল এলাকায় আস্তানা গড়ে। এসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। এ জন্য মিডিয়ায় এ-সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন ও প্রচারের বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে। সংবাদে তাদের ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত হবে না।
এসব অপরাধ কমাতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু পুলিশের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না; সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়ার দায়বদ্ধতা আছে জনগণের কাছে। কারণ মানুষের জন্য রাজনীতি, মানুষের জন্য গণতন্ত্র, মানুষের জন্যই গণমাধ্যম। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ধর্মপ্রাণ মানুষকে সচেতন ও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রচারণামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
সন্তানদের সময় দেয়া
পরিবার থেকেই সন্তানদের সচেতন করে তুলতে হবে। সন্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। আমরা যত বেশি তাদের সঠিক তথ্য দেব, তত বেশি তারা জানতে ও বুঝতে পারবে। আমাদের আরো বেশি বেশি সময় দিতে হবে, বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক গল্প করতে হবে। এখনকার প্রজন্ম সন্তানদের বেশি সময় দেয় না। মা-বাবারা যত দিন বাচ্চাদের তাদের বাহুতে মাথা নিয়ে গল্প করবেন না, একসঙ্গে গান শুনবেন না, তত দিন এ সমস্যা থেকে যাবে। মুখে মুখে ভালোবাসা নয়, সন্তানের অন্তরে জায়গা করে দিতে হবে। তার মনের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করাতে হবে।
শিক্ষকদের তত্ত্বাবধান ও সহশিক্ষা কার্যক্রম
ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে কু-শিক্ষার দিকে ধাবিত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একাডেমিক পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের বেশি পরিমাণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিতের পাশাপাশি অভিভাবক সম্মেলনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা
দেশের সর্বস্তরের জনগণকে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ প্রত্যাখ্যান করতে হবে, এসবের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে রুখে দাঁড়াতে হবে। সাধারণ মানুষের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতায় সব ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কঠোর হলেই এ সমস্যা কমে যায়। জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’।
শুধু তা-ই নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে দেশে ঘাঁটি গড়তে না পারে, এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব সময়ই সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিপক্ষে। দেশের আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। মৌলবাদ ও সহিংস চরমপন্থার বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নকে সরকার আরও শক্তিশালী করেছে।
আলেমদের সোচ্চার ও বলিষ্ঠ অবস্থান
ইসলামে চরমপন্থাকে নিরুৎসাহিত করার পরও নবী করিম সা: এর ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ইসলামের তিনজন বিশিষ্ট খলিফাকে আততায়ীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ইসলামের শত্রুদের প্রদত্ত আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানেও কিছু চরমপন্থী এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করে যাচ্ছে, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে। দেশের আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খতিবগণ উদ্ভূত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার ও বলিষ্ঠ অবস্থান রেখে আমাদের ধর্মপ্রাণ জনগণকে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।