চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মহা অপরাধ

সন্ত্রাস, চরমপন্থা, বোমাবাজি ও আত্মঘাতী হামলা মানবতা বিবর্জিত, ইসলামে সর্বাপেক্ষা বড় অপরাধ বলে বিবেচিত। মধ্যমপন্থা, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ ও অবস্থা মুসলমানদের চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চরমপন্থী আচরণ, নির্বিচারে মানুষ হত্যা, আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি, কোনো স্থাপনা ধ্বংস করা, রক্তারক্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ বিশ্বে অস্থিরতা সৃষ্টি ফাসাদী কর্ম; যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল কুরআন বারবার ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। তাই উগ্রতা, ফেতনা, ফ্যাসাদ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে ইসলাম মোটেই সমর্থন করে না।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

মানুষ হত্যা সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ

হাদিসে উল্লেখ আছে, দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা (তিরমিজি)। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সা: বিনা অপরাধে একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। ইসলাম কেবল মুসলমানের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা দিয়েই ক্ষ্যন্ত হয়নি; বরং মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুরও নিরাপত্তা দিয়েছে সমধিক। আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের (রা.) বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো যিম্মীকে (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন কাফেরকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বছরের দুরত্ব থেকেও পাওয়া যাবে।’ (বুখারী : ৩১৬৬, ৬৯১৪)

একজনকে অন্যায়ভাবে হত্যায় মানবজাতিকে হত্যা

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব বিনির্মাণে কুরআন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে সবাইকে। যেকোনো অবৈধ হত্যাকাণ্ড গোটা মানবজাতিকে হত্যার শামিল। পবিত্র কুরআনে হত্যাকাণ্ডকে মহা অপরাধ সাব্যস্ত করে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করলে তার কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্যায়ভাবে অন্য ধর্মের কাউকে বিনা অপরাধে হত্যা করবে। আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা আন নিসা, আয়াত ৯২-৯৩)।

অন্যায়ভাবে হত্যাকারী বিশ্বের সবাইকে হত্যাকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে চিহ্নিত। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো হত্যার বিনিময় ব্যতীত অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করলো, আর কেউ কারো প্রাণ বাচালো সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো।’ (সূরা মায়িদা : ৩২)।

ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ঠিকানাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট

চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী শুধু মানুষের কাছেই ঘৃণিত নয়, আল্লাহর কাছেও ঘৃণিত। ইসলামী শরীআহ সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। মানব হত্যার দণ্ডবিধিকে কঠোর করার তিনটি লক্ষ্য- ১. জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২.শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা। ৩. নাগরিকদের সচ্চরিত্রবান করা ও বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষ করা।

সন্ত্রাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন সে শাসকের আসনে বসে, তখন পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে ব্যাপৃত হয় এবং ফসল ও প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে দিতে প্রবৃত্ত হয় অথচ আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।’

আল্লাহ বলেন, ‘যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য রয়েছে লানত এবং মন্দ আবাস বা নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (সূরা রা’দ : ২৫)।

চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী হয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে বারণ করে কুরআন বলছে, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না’ (সূরা আরাফ : ৫৬)।

অশান্তি সৃষ্টিকারির প্রতি স্রষ্টার অসন্তোষ

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘ফিতনা (অর্থ : প্রলোভন, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, শিরক, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদি) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর’ (সূরা বাকারা : ১৯১)।

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আর যখন তারা ফিরে যায়, তখন চেষ্টা করে যেন সেখানে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ধ্বংস ও প্রাণনাশ করতে পারে। মূলত আল্লাহ তাআলা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না। (বাকারা : ২০৫)

কোনো ব্যক্তিকে অস্ত্র দ্বারা ভীতি প্রদর্শন নিষিদ্ধ। মহানবী সা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের প্রতি অস্ত্রের দ্বারা ইঙ্গিত না করে।’ (বুখারী, মুসলিম)

‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে লোহার অস্ত্র দ্বারা ইংগিত করলো তখন সে অস্ত্র হাত থেকে ফেলে না দেয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকেন।’ (বুখারী)

দুনিয়া ও আখিরাতে অপমান-শাস্তি

কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও দুশমনী করে এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড বা শূলিবিদ্ধ করে হত্যা করা অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা নির্বাসিত তথা কারাগারে নিক্ষেপ করা। এতো হলো কেবল তাদের পার্থিব অপমান। পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়ঙ্কর শাস্তি।’ (মায়েদাহ : ৩৩)

জাহান্নামই এসব চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের আবাসস্থল হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘আর তারা সঙ্গত কারণ ব্যতিত তাকে হত্যা করে না যাকে হত্যা করা আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন এবং লিপ্ত হয় না ব্যভিচারে। যারা এ অপরাধ করবে, তারা সম্মুখীন হবে কঠিন শাস্তির। তাদের এ শাস্তি বর্ধিত করা হবে এবং তথায় তারা থাকবে চিরকাল।’ (ফুরকান : ৬৮-৬৯)

যুদ্ধ নয়, মীমাংসা ও ন্যায়বিচারকেই অগ্রাধিকার

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘আর যদি মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তাহলে যে দলটি বাড়াবাড়ি করবে, তার বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না সে দলটি আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। তারপর যদি দলটি ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে মীমাংসা কর এবং ন্যায়বিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন।’[সূরা আল-হুযরাত, আয়াত : ০৯।]

উগ্রতা ও চরমপন্থী তৎপরতা উম্মাহর ধ্বংসের কারণ। মহানবী সা. বলেছেন,‘সাবধান ! কঠোরতাকারী চরমপন্থীরা ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে’। (মুসলিম, আহমদ, আবু দাউদ)। সুতরাং চরমপন্থা সর্বদাই নিন্দনীয়।

অন্যের প্রাণ নিলে যাবে নিজের প্রাণ

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘হে ঈমানদারগণ! মানব হত্যার ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান ফরজ করা হয়েছে। (কিসাসের বিবরণ হলো) স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যার বদলে স্বাধীন, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস, নারীর বদলে নারীকে হত্যা করা হবে। তবে যদি তার ভাই তথা মৃত ব্যক্তির ওয়ারীশদের তরফ হতে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তার দেয় আদায় করবে। এটা তোমাদের প্রভুর তরফ হতে হত্যাকারীদের উপর সহজ করণ ও অনুকম্পা। এরপরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। হে বোধ সম্পন্ন লোক সকল! কিসাসের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন। যাতে তোমরা হতে পার সাবধান।’ (বাকারা : ১৭৮-১৭৯)

ইচ্ছাকৃত হত্যার পরিবর্তে হত্যা কিংবা মুক্তিপণ

শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদিনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি মদিনা সনদ। এ সনদের একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসীদের হাত সমবেতভাবে ওইসব ব্যক্তির হাতে উত্থিত হবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায়, পাপাচার, সীমালঙ্ঘন, বিদ্বেষ অথবা দুর্নীতি ও ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে। তারা সবাই সমভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, যদিও সে তাদেরই কারো আপন পুত্রও হয়ে থাকে।’

আরেকটি শর্তে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে তা প্রমাণিতও হবে তার ওপর কিসাস গ্রহণ করা হবে- হত্যার পরিবর্তে তাকে হত্যা করা হবে।’ মুফাস্্সরিীনে কিরাম লিখেছেন- ‘কেউ যদি কাউকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, নিহত ব্যক্তি যে ধর্মেরই হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, স্বাধীন হোক, আর ক্রীতদাস হোক হত্যাকারীকে মৃত্যদণ্ড দেয়া হবে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে সরকার ও প্রশাসন। কোনো ব্যক্তি, পঞ্চায়েত বা সংগঠনের এ বিধান কার্যকর করার এখতিয়ার ও অনুমতি নেই। আর যদি নিহত ব্যক্তির ওলী ও উত্তারাধিকারীগণ কিসাস না নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে তাও পারবে। এটা তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। স্থান, কাল ও অবস্থা ভেদে প্রশাসন তার ব্যবস্থা নিবে।’ (মাআরিফুল কোরআন : ১/৪৮৪-৪৮৬; বুখারী : ২/১০১৪-১০১৬; মুসলিম : ২/৫৮-৬১)

সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই, ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই

মহানবী সা: বলেছেন, ‘হত্যাকারীর ফরজ, নফল কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না’ (তিরমিজি)।

মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের উপর (কোনো মুসলমানের উপর) অস্ত্র উত্তোলন করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’(বুখারী : ৬৮৭৪, ৭০৭০; মুসলিমু : ১৬১)

রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানকে গালি দেয়া ফিসক আর তাকে হত্যা করা কুফরী কাজের অন্তুর্ভুক্ত।’ (বুখারী : ৪৮,৬০৪৪; মুসলিম : ১১৬)

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সরল পন্থা অবলম্বন কর, চরমপন্থা বর্জন কর, সুসংবাদ দাও এবং ঘৃণা কর না’ (বুখারী)।

‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি যার কথাবার্তা (জবান) ও কার্যকলাপের অনিষ্ট থেকে মুসলমানরা নিরাপদে থাকে’ (আবু দাউদ)।

‘ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে’ (সুরা বাকারা : ২৫৬)।

রক্তপাতের বিচার আগে, ফলাফল জাহান্নাম

রাসুল সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষের মধ্যে হত্যা তথা রক্তপাত সম্বন্ধে বিচার করা হবে’ (বুখারি : ৬৫৩৩, ৬৮৬৩; মুসলিম: ১৬৭৮)।

সাহাবী আবু হুরায়রার (রা.) বর্ণনায় মহানবী সা: বলেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! মানুষ এমন এক যামানার মুখোমুখী হবে, যখন হত্যাকারীও জানবে না যে, কেন সে হত্যা করল। নিহত ব্যক্তিও জানবে না যে, কেন তাকে হত্যা করা হলো। জিজ্ঞাসা করা হলো, এমনটি কিভাবে হবে? রাসূল সা. উত্তর দিলেন, হত্যাযজ্ঞ ব্যাপক আকার ধারণ করার ফলে। এই হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই হবে জাহান্নামী। (মুসলিম : ২৯০৮)

জুলুম-নির্যাতনের পথ ধ্বংসের পথ

মাত্র ২০ বছর বয়সে রাসুল সা: ‘হিলফুল ফুজুল’ সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি জুলুম নির্যাতনের প্রতিরোধ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন- ‘সাবধান! যে কেউ কোন যিম্মীর (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন কাফেরের) প্রতি অবিচার করবে অথবা তার প্রাপ্য অধিকার কমিয়ে দিবে বা সামর্থ্যরে বাইরে কোন কাজ চাপিয়ে দিবে কিংবা তার আত্মিক তুষ্টি ব্যতিত তার সম্পদ ভোগ করবে, কিয়ামত দিবসে আমি তার প্রতিপক্ষ হয়ে তার অন্যায় অপরাধ প্রমাণ করব।’ (আবু দাউদ : ৩০৫২)

বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে মহানবী সা. বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের জান মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম করা হলো।’ (বুখারী, আবুদাউদ, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘ হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও একে হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ [মুসলিম : ৬৭৪০।]

আত্মহত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারাম

আত্মঘাতি বোমা হামলাসহ যাবতীয় আত্মঘাতি কর্ম ইসলামে অনুমোদিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যা নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা আত্মহত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর অতীব দয়ালু।’ (সুরা নিসা : আয়াত নং ২৯) সূরায়ে বাকারায় আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন কর না।’

মহানবী (সা) বলেন, যে ব্যক্তি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, দোজখে বসেও সে অনবরত উচ্চ স্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে বসেও অনন্তকাল বিষপান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়ে নিজেকে কোপাতে থাকবে। যে ব্যক্তি নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামের মধ্যে নিজের শ্বাসরুদ্ধ করবে। আর যে নিজেকে আঘাত করবে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামেও নিজেকে আঘাত করবে।

তিনি আরো বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই সে একখানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করল, ফলে রক্তপাত হয়ে সে মারা গেল। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দা নিজের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করলো। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারী)

সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীরা নির্বোধ

ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেছেন, ‘শেষ জামানার এমন একটি গোষ্ঠীর আবির্ভাব হবে যারা বয়সে নবীন, বুদ্ধিতে অপরিপক্ব ও নির্বোধ। তারা পবিত্র কোরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালিও অতিক্রম করবে না। তারা সৃষ্টির সেরা মানুষের কথাই বলবে। কিন্তু দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন ধনুক থেকে তির শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। (তিরমিজি অধ্যায়-২৪)।

যুদ্ধেও বেসামরিক মানুষের ক্ষতি নয়

যুদ্ধ ক্ষেত্রেও সামরিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া বেসামরিক কাউকে হত্যা করা ইসলামে পুরাপুরি নিষেধ। মহানবী সা. বলেছেন- ‘সাবধান! অতি বৃদ্ধ, শিশু এবং কোন মহিলাকে হত্যা করো না।’ (আবু দাউদ) ‘যাও খালেদকে বলে দাও, কোনো মহিলা ও কোনো খাদেমকে যেন হত্যা না করা হয়।’ (আবু দাউদ) ইসলামের যুদ্ধ আইনানুযায়ী নারীদের উত্যক্ত করা, বাগ বাগিচা ও ক্ষেতের ফল নষ্ট করা, আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস করা, ফলবান বৃক্ষ কেটে ফেলা যাবে না। সে অবস্থায় সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষের বাড়িঘর, মালামাল, স্থাপনা ইত্যাদি ধ্বংস করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

সেনাবাহিনীর প্রতি হযরত আবু বকরের রা.’র নির্দেশ ছিলো- ‘মানুষের হাত-পা কেটে দেহ বিকৃত করবে না। শিশুদের হত্যা করবে না, যুদ্ধে অসমর্থ বুড়ো মানুষকে হত্যা করবে না। নারীদের একেবারেই উত্যক্ত করবে না। বাগ-বাগিচা ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট করবে না, আগুন লাগাবে না, কোন ফলবান বৃক্ষ কাটবে না। খাবার প্রয়োজনে কোনো অতিরিক্ত পশুকে জবাই করবে না। বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে যারা নিজেদেরকে উপাসনায় নিয়োজিত রেখেছে, তারা যে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে দেবে এবং তারা যে কাজ করার জন্য মনোনিবেশ করেছে তা করতে কোন রকম বাধা দেবে না।’ (মোস্তফা আস সিবায়ী, ‘মিন রওয়ায়িয়ে হাযারাতিনা’, ৭ম অধ্যায়)

শত্রুর অধিকারও ক্ষুণ্ন করা যাবে না

কোনো দূতাবাস ও তার লোকজনের জান-মালের ব্যাপারে ইসলাম খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। যিনি বা যারা দূতাবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার মুসায়লামার দূতকে মহানবী সা. বলেছিলেন- ‘যদি দূতকে হত্যা করা নিষিদ্ধ না হতো তাহলে আমি তোমাদের গর্দান মেরে দিতাম (অর্থাৎ হত্যা করতাম)।’ (আহমদ ও আবুদাউদ/ মিশকাত, বাবুল আমান; হাদিস নং ৩৮০৫)

ইসলাম প্রতিটি মানুষের জান মাল ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা দানকে অপরিহার্য করেছে। ইসলামে মানুষের প্রাণ ও রক্ত পবিত্র এবং সম্মানার্হ। বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবি রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমর বিন রবিয়ার খুনের দাবি রহিত করলাম। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আমার পরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে কাফেরসুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিও না। কাউকে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় বা সামরিক স্বার্থ ব্যতীত হত্যা করা পৈশাচিক ও ঘৃণ্য কাজ। ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক কেবলমাত্র অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা যে নিষিদ্ধ তা নয় বরং নিজেকে বা আত্মহত্যা করাও নিষিদ্ধ। কোন অবস্থায় নিজেকে ধ্বংস করা যাবে না।

উগ্রতা ও সন্ত্রাসে আদর্শ যায় বনবাসে

নিরপরাধ মানুষকে ভয় দেখানো, তাদের মনে আতংক সৃষ্টি করা, তাদেরকে হত্যা করা, কোন দূতাবাসে আক্রমণ করা, তাদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে জিম্মি করা, কোন স্থাপনা ধ্বংস করা, বিমান ছিনতাই করা সবই নিষিদ্ধ কর্ম,অত্যন্ত গর্হিত কর্ম। অর্থাৎ সমস্ত রকমের সন্ত্রাসই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার কল্যাণের আদর্শ। কাজেই বিক্ষুদ্ধ হয়ে ইসলামের বিপরীত পন্থায় কোন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই।

যেখানে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই নারী, শিশু, বয়স্ক লোক ও বিভিন্ন উপাসনালয়ে নিয়োজিত পুরোহিতকে হত্যা করা যায় না, সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে তাদের হত্যা করাতো আরো অধিক নিষিদ্ধ হবে। তাছাড়া ইসলামের যুদ্ধ আইনানুযায়ী নারীদের উত্যক্ত করা, বাগ বাগিচা ও ক্ষেতের ফল নষ্ট করা, আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস করা, ফলবান বৃক্ষ কেটে ফেলা যাবে না। সে অবস্থায় সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষের বাড়িঘর, মালামাল, স্থাপনা ইত্যাদি ধ্বংস করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।

মধ্যপন্থায় মুক্তি

ইসলাম হচ্ছে মধ্যপন্থার ধারক- সিরাতুল মুস্তাকিম। কাজেই উগ্রতা ও চরমপন্থা উম্মাহর ধ্বংসের কারণ। আত্মঘাতি বোমা হামলাসহ যাবতীয় আত্মঘাতি কর্ম ইসলামে অনুমোদিত নয়। কেননা, ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। কোন মুসলমানকে তো হত্যা করা যাবেই না এমনকি চুক্তির আওতাধীন (বর্তমান যুগে প্রায় সব অমুসলিম দেশের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর কূটনৈতিক চুক্তি ও সম্পর্ক রয়েছে) কোন অমুসলমানকেও হত্যা করা মারাত্মক গোনাহের কাজ।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *