গ্রামের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। গ্রামই জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড ও মূল উৎস। গ্রামই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। সুন্দর ও উন্নয়ন অগ্রতির প্রতীক এ দেশের গ্রাম।
সাংস্কৃতির আদি উৎস গ্রাম। গ্রাম প্রাকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি। গাছ-গাছালি বনের লতা-পাতা, বাশঁ-বেত, খাল-বিল, পুকুর-নদী, কাঁচা-পাকা রাস্তা ও ক্ষেত কৃষি নিয়ে গ্রামের মানুষের জীবন। যদিও এখন গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
গ্রামীণ প্রকৃতি
একসময় গ্রামে পেতাম শান্ত পরিবেশ, ধীর হাওয়া এবং হৃদয়ের গভীর তলদেশের প্রতিধ্বনি। প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক নিবিড়। প্রকৃতির অমূল্য দান পানি, বায়ু, উর্বর মাটি ও মূল্যবান প্রকৃতির সম্পদ আমাদের জীবন ও জীবিকার চালিকাশক্তি। প্রকৃতির সাথে গ্রামীণ জনমানুষের জীবনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
বিপন্ন পরিবেশ ও বিনষ্ট ভারসাম্য
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাবে আমরা হারাতে বসেছি প্রতিবেশের সেবা, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং মাত্রাতিরিক্ত সম্পদের ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে সর্বাগ্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল গ্রামীণ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী।
পরিবেশ দূষণ
গ্রামীণ জনপদেও প্রকৃতি (Nature) আর আগের অবস্থায় নেই। গ্রামেও ঘটছে ব্যাপকভাবে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, ভূমিদূষণ, শব্দদূষণ। কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে দূষণ ঘটছে। আবার কৃষিজমি, লোকালয়ে যত্রতত্র স্থাপিত ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশদূষণ ঘটছে ব্যাপক মাত্রায়।
ইটভাটার ধোঁয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং বায়ুতে তাপ বেড়ে যায়। অন্যদিকে ভাটার তাপে তপ্ত হয় সংশ্লিষ্ট এলাকা। এতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। উৎপাদনও কমে যাচ্ছে।
মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস
গ্রামাঞ্চলে যানবাহন হিসেবে ভটভটি, নছিমন, কাঁকড়াজাতীয় বাহনের সংখ্যা বাড়ছে, যা শব্দদূষণ ঘটায় ব্যাপক হারে। ইটভাটার মাটি সংগ্রহের জন্য কৃষিজমির উপরিভাগ কেটে ফেলার জন্য উর্বরতা শক্তিসম্পন্ন মাটি চলে যাচ্ছে, যা পূরণ করতে দীর্ঘদিন বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ বালু তোলা হচ্ছে ব্যাপক হারে। এতে ভূমিকম্পে সংশ্লিষ্ট এলাকা দেবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া
আগে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর গাছ, ঝোপজঙ্গল ও ছোট ছোট বন ছিল। কিন্তু সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। ভিনদেশি বৃক্ষ জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কৃষিকাজে পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপক হারে তোলা হচ্ছে। ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে দ্রুত। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াটা অশনি সংকেত।
ফলজ গাছের জায়গায় বিদেশি গাছ
নদ-নদী, খাল-বিলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বন-জঙ্গল উজার হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাণীবৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আগেও গ্রামীণ নারীরা বৃক্ষরোপণ করতেন এবং এখনো করেন। তবে ফলজ গাছের চেয়ে অনেকের মধ্যে ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি ও পাইনের মতো বিদেশী গাছগুলো লাগিয়ে তা পরিচর্যা করে থাকেন।
ইকোসিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস
ইউক্যালিপটাস গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সমস্যা তৈরি করে। জৈববৈচিত্রের জন্য তা ভালো হয় না। এই গাছের পাতায় পেট্রলিয়াম জাতীয় পদার্থ আছো। গাছটিতে বেশি যত্ন লাগে না আর ছাগলেও খায় না। দ্রুত কাঠ হিসেবে বিক্রি করা যায় এবং বিক্রয়মূল্য ভালো।
কাঠের মানও ভালো, ফলে আয় হয় ভালো। অথচ এর ভয়ংকর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কেউ ঠিকভাবে জানে না। ইউক্যালিপটাসের কারণে মরুময়তা সৃষ্টি হয়। লোকাল ভ্যারাইটিকে ক্ষতির মুখে ফেলে এ গাছটি। এটি ইকো সিস্টেমের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবেশ বিপর্যয়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস
ইউক্যালিপটাস, ম্যালেরিয়া ও আকাশমনি গাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই তিনটি গাছের পাতা ও ফুলের রেণু প্রাণীদেহের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। ফলে এসব গাছে পাখিও বাসা বাঁধে না। এই গাছগুলো মাটির গভীর থেকে প্রচুর পানি টেনে নেয়ার কারণে আশেপাশে অন্য গাছ পানির অভাবে বড় হতে পারে না এবং যতটুকু ফলন হওয়ার তার চেয়ে অনেক কম হয়। বিদেশি গাছ লাগানো মাটির উর্বরতা, ওজনস্তর নষ্ট, অসহনীয় তাপমাত্রা, জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রম নষ্ট, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।
বনজ ও ফলজ বৃক্ষ লাগানো
এই ক্ষতি এড়াতে নদীর পাড়ে রাস্তার ধারে নিম, অর্জুন, সেগুন, গামারি, কড়ই, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তাল ইত্যাদি বনজ ও ফলজ বৃক্ষ লাগানো যায়। নদীর ঢালুতে হিজল, তমাল, গাব, বট, পাকুড় ইত্যাদি জলজ বৃক্ষ লাগানো যায়।
অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে তালিপাম, নলি, ধূপ, বওলা, রিটা, লটকি, রুটিফল, সিঁদুর, ভূজপত্র, কোকো, আমলকি, মাইমুসপত্র, বাঁশপাতা ইত্যাদি বিপন্ন ভেষজ উদ্ভিদ লাগানো যায়।
বাড়ির আঙিনায় ও বাসার ছাদে তুলসী, বহেরা, ঘৃতকুমারী, পাথরকুচি, লজ্জাবতী, স্বর্ণলতা, চিরদা, আকন্দ, বাসক, কুঁচ, জারুল, নিশিন্দা, লবঙ্গ ইত্রাদি ভেষজ ও ঔষধী গাছ লাগানো যায়।
গ্রামীণ মানুষ
গ্রামের রূপান্তর গ্রামীণ মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান জমি অধিগ্রহণ করছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা স্থাপনে গ্রামের দিকে নজর দিচ্ছে। ক্ষমতাধরদের ভূমি দখল নিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।
কৃষির ভবিষ্যৎ নষ্ট
চাষাবাদের জমি কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু কৃষক কর্মক্ষমতা থাকার পরও জমি চাষ করা ছেড়ে দিয়েছেন। নানা ফসল উৎপাদন করে জমির অতিব্যবহার করা, ভূমির সহনক্ষমতা নষ্ট কার ফলে কৃষির ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশগত ক্ষতি প্রকৃতির বিপদ ডেকে আনছে।
ডিজিটাল লিটারেসির হার কম
গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে ডিজিটাল লিটারেসির হার খুবই কম থাকায় গ্রামীণ এলাকার ডিজিটালাইজেশন তাদের পুরোপুরি কাজে লাগছে না। গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। সাইবার ক্রাইম বাড়ছে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে।
ছেয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের সংস্কৃতি
গ্রামাঞ্চলেও শহরের মতো অট্টালিকা নির্মাণ হওয়ায় বিজ্ঞাপনের সংস্কৃতি ছেয়ে যাচ্ছে। বড় বড় বিলবোর্ড, বিভিন্ন উক্তিসংবলিত বিজ্ঞাপন, সিমেন্ট, বাল্ব, দেয়ালচিত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
গ্রাম এলাকায় বিশৃঙ্খলা
গ্রাম এলাকায় বিভিন্ন ধরনের বাসাবাড়ি, বহুতল ভবন, কনভেনশন হল এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। ফায়ার স্টেশন, পেট্রল পাম্প, কোল্ড স্টোরেজ এবং বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপিত হচ্ছে । যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ এবং স্থাপনা নির্মাণের আইন না থাকার ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।
গ্রামে টিভি ফ্রিজ ও ইটের দালান
গ্রামাঞ্চলের মানুষ দাঁত মাজার কাজে মাজন বা মেসওয়াকের ব্যবহার এখন করে না বললেই চলে। এখন সবাই টুথপেস্ট ও টুথব্রাশ ব্যবহার করে। অধিকাংশ বাড়িতেই টিভি বা ফ্রিজ আছে। গ্রামে অনেকে চারদিকে উঁচু দেয়ালঘেরা ইটের দালান তৈরি করছে।
গ্রামেও বহুমুখী কাজ
গ্রামের অনেক উদ্যোক্তারা বহুমুখী কাজে জড়িত। গ্রামবাসীরাও একাধিক কাজে জড়িত; যারা কৃষিকাজ ও অকৃষিকাজ এক সঙ্গেই চালাচ্ছেন। চাকরির পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বা পুকুর লিজ নিয়ে ফল চাষ, মাছ চাষ, বিভিন্ন খামার করছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সহজ হয়েছে গ্রামীণ মানুষের লেনদেন।
ভাড়াভিত্তিক ব্যবসা
গ্রামে এখন কৃষিযন্ত্রের ভাড়াভিত্তিক ব্যবসা চলে। অনেকে মোবাইল ও নানা ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র মেরামতে জড়িত হচ্ছেন। পরিবহন, নির্মাণ সামগ্রী, স্যানিটারি সরঞ্জাম, গ্যাস স্টোভ এবং আসবাবপত্রের দোকান বাড়ছে। চায়ের দোকানের পাশাপাশি ছোট ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁও সামাজিক আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছে।
বদলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রাম ধারনা
সড়কের উন্নয়ন, মোটরচালিত যানবাহন, মুঠোফোন ও টেলিভিশনের কারণে প্রত্যন্ত গ্রাম ধারনাই বদলে গেছে। সেই ১৯৮০ সালের দিকে গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন থেকে গ্রামীণ বাংলাদেশের রূপান্তর শুরু। কৃষিজমিতে ইলেকট্রিক ওয়াটার পাম্প এবং পরে শ্যালো মেশিন দিয়ে যন্ত্রচালিত সেচ শুরু হয়।
পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, স্বয়ংক্রিয় শস্য রোপণের ব্যবস্থা প্রসার পায়। ক্ষুদ্র ঋণের প্রসার শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ঘটে অনেক মানুষের। এরপর প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।
গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো
গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশদের আধিপত্য
১৭৬৩ সালে বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত হয়। গ্রামীণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকার কারণে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসক ও প্রতিনিধিদের প্রভাব বিস্তৃত ছিল না। কিন্তু ১৭৯০ সাল থেকে ১৭৯৩ সময়ে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে কাঠামোগতভাবে গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আধিপত্য কেন্দ্রীয়ভাবে পাকাপোক্ত হয়।
দারোগা পদ্ধতি ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
১৭৯২ সালে প্রবর্তিত দারোগা পদ্ধতি ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্ত রাখার স্থানীয় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরোনো জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ শাসকদের আদলে জমিদারি ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। এ সময় গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় স্থানিক মানুষদের ভূমিকাকে গৌণ করে রাখা হয়।
চৌকিদারি অ্যাক্ট
১৮৭০ সালে চৌকিদারি অ্যাক্ট নামে পুরোনো পঞ্চায়েত প্রথাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ব্রিটিশ প্রশাসকদের মনোনয়নের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন এ পঞ্চায়েত গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট একটা শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল।
লোকাল বোর্ড প্রতিষ্ঠা
১৮৮২ সালে লর্ড রিপন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সংস্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের স্থানীয় পর্যায়ে ‘লোকাল বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রতিনিধি নির্ধারণের মধ্য দিয়ে স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি
১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। এ আদেশের অধীনে ১৯৬০ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ কাঠামোর সবচেয়ে নিচের স্তর ছিল ইউনিয়ন। প্রতিটি ইউনিয়নে নয়জন মৌলিক গণতন্ত্রী জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতো।
পাশাপাশি মনোনীত হতো চারজন। এ নির্বাচিত নয়জন ও মনোনীত চারজন ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচন করত। গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর স্বাধীন ও স্থানিক সৌন্দর্য কেন্দ্রীয় রাজনীতি প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
রিলিফ চেয়ারম্যান নিয়োগ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় দাপট দেখাতে শুরু করে। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য আসতে শুরু করে। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছে দেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক মনোনীত স্থানিক পর্যায়ে ‘রিলিফ চেয়ারম্যান’ নিয়োগ দেয়া হয়। তৈরি হয় রাজনৈতিক আশ্রয়ে স্থানিক ক্ষমতা কাঠামোর নতুন শ্রেণী।
প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এসব রিলিফ চেয়ারম্যানের প্রায় সবাই অংশগ্রহণ করে অধিকাংশ পরাজিত হয়। যদিও এরা ক্ষমতার ছায়াতলে বসে এদের অনেকেই ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের মাধ্যমে নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে ফুলেফেঁপে ওঠেছিল।
এদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষের সমর্থন থেকে দূরে ছিল। গ্রামীণ এলাকার বিচার-সালিস, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাকাঠামোয় প্রভাবশালী অনুষঙ্গ জমির মালিকানা
১৯৭০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে এ ধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় ভূমির মালিকানা, বংশীয় পরিচিতি, জ্ঞাতিসম্পর্ক, পারিবারিক ঐতিহ্য প্রভৃতি নির্ধারক আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে।
জমির মালিকানা ক্ষমতাকাঠামোয় সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুষঙ্গ হয়ে যায়। স্থানিক দরিদ্র মানুষের একটা বড় অংশ নিজেদের জীবন ধারণের নিশ্চয়তা বিধানে এসব ভূমি মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
শিক্ষক ও ইমামরা ছিল সম্মানিত
১৯৮০-এর দশকে এসে গ্রামীণ ক্ষমতার নির্ধারক হিসেবে ভূমি মালিকানার পাশাপাশি শিক্ষা, ধর্মীয় জ্ঞান, নগদ অর্থ, কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয় সামনে চলে আসে। এ সময় গ্রামীণ সমাজে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের পাশাপাশি মসজিদের ইমামরা অনেক বেশি সম্মানিত ছিল।
বিভিন্ন দেশে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গতি
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসন প্রক্রিয়াও আশির দশকে গতি পায়। কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কারণে কৃষি প্রযুক্তির মালিকানা, সার ও উচ্চফলনশীল বীজের ডিলার, সেচের ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোও এ সময়ে স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা
উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৮৪ সালে উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সালকে অনেকেই বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ
সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে দাতা দেশ ও সংস্থার কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতির পরিপ্রেক্ষিতে আশির দশকে বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তথা এনজিওর ভূমিকা বিস্তৃত হতে থাকে। এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্থানীয় পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ১৯৯৭ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারীরা সরাসরি অংশ নেয়।
গ্রামীণ ক্ষমতার নির্ধারকে পরিবর্তন
১৯৯০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, সরকারি চাকরি, ব্যাংকে চাকরি, ওকালতি, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অভিবাসন, পাকা বাড়ি প্রভৃতি বিষয় গ্রামীণ ক্ষমতার নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকে অনেকে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে নতুন নতুন ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিল। এদের অনেকেই নব্বইয়ের দশকে নিজেদের ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হয়। যাদের প্রভাব গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় এ সময়ে দৃশ্যমান হয়।
গ্রামীণ ক্ষমতার উপাদান
২০০০ সালের শুরু থেকে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোতে ক্ষমতার প্রভাবক হিসেবে জমির মালিকানার গুরুত্ব কমতে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, নগদ অর্থ, সামাজিক পুঁজি, শহরে বাড়ির মালিকানা বা স্থায়ী নিবাস, অনুদান প্রদানের সক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় গ্রামীণ ক্ষমতার উপাদান হিসেবে এ সময় ক্রিয়াশীল ছিল।
পাশাপাশি টেলিভিশন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ডিভাইসের মালিকানা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও স্থানিক পর্যায়ে প্রভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখত। এ সময় গ্রাম ও শহরের মধ্যে দূরত্ব ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
তরুণ ও যুবক বয়সীদের নেতৃত্বে আসার প্রবণতা
২০০০ সালের পর থেকে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় অপেক্ষাকৃত তরুণ ও যুবক বয়সীদের নেতৃত্বে আসার প্রবণতাও শুরু হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামীণ বাংলাদেশ ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে ক্ষমতাকাঠামো অনেকটা স্বাধীন ও কেন্দ্রীয় প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করেছে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রার্থীরা মানুষের সেবক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে অধিক মনোযোগী থাকত।
গ্রামের সাধারণ বাসিন্দারা গৌণ
২০০৯ সাল থেকে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও শাসনের প্রভাব বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ততা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা, সন্ত্রাস সৃষ্টির সামর্থ্য, পেশিশক্তি, পরিবারের কোনো সদস্যের পুলিশ বা প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি প্রভৃতি বিষয় গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতাকাঠামোর প্রভাবক হিসেবে সামনে চলে আসে। গ্রামের সাধারণ বাসিন্দাদের মতামত, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সম্পৃক্ততার বিষয়টি গৌণ হতে শুরু করে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার
২০১৬ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয়। এতে গুরুত্ব পেতে থাকে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় নেতার ব্যক্তিগত ‘পছন্দ-অপছন্দ’। বিভিন্ন স্থানে দলীয় ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে যারা সর্বমহলে জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান ছিল, তারা ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে থাকে। প্রার্থীরা জনগণের প্রার্থীর পরিবর্তে হয়ে ওঠেন দলীয় প্রার্থী।
গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোয় স্থানিক উপাদানের প্রভাব
ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো ছিল অনেক বেশি স্থানিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও প্রথম চার দশকে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোতে জমির মালিকানা, বংশগত ধারা, শিক্ষা, ধর্ম, পেশা, জ্ঞাতিসম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আসছে।
বর্তমানে যা পরিবর্তিত হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদভিত্তিক বিভিন্ন স্তরবিন্যাসের আলোকে ক্রিয়াশীল রয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় বা সম্পৃক্ততার বাইরে মনে হয় আজকে গ্রাম সমাজ বা আলাদা করে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো বলতে কিছু নেই।
চলবে