রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন গ্রামীণ জনপদের চিত্র পাল্টে গেছে। গ্রামের উপরে পরিবর্তন যতটা দৃশ্যমান, ভেতরটা ঠিক ততোটা না বদলালেও কিছুটা বদলেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়ন ও ডিজিটাল ছোঁয়ায় গ্রামে আর্থসামাজিক পরিবর্তন এমন যেন এক বদলে যাওয়া জনপদ! গ্রামীণ জনপদ এখন অবয়বে শহুরে জনপদে রূপ নিয়েছে।
যুগান্তকারী পরিবর্তন যাতায়াত ব্যবস্থায়
মায়ের সাথে ভোরে হাটতে হাটতে পাটজাকের রোডে গেলাম। আগে যাতায়াতব্যবস্থা দেখেছিলাম খুবই নাজুক। এখন যথেষ্ট ভালো। তক্তারচালা থেকে পাথরঘাটা ও কামালিয়া চালার রাস্তা ছিল আগে খুবই খারাপ। আর এখন সাপুড় থেকে কাশেমবাজার, তকতারচালা থেকে বংশীনগর তথা গ্রামাঞ্চলের ভেতরের সড়কগুলোও পাকা।
আগে কাঁচা রাস্তার পাশাপাশি কিছু ইট বিছানো রাস্তা দেখতাম। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সাপুড় থেকে তালিম ঘরে যেতেও পিচঢালা পথ দেখলাম; যা স্পষ্ট করে অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাটগুলোও যথেষ্ট ভালো। এসব রাস্তায় যানবাহনেরও কমতি নেই।
বদলে গেছে ঘর-বাড়ি
কয়েক বছর আগেও কামালিয়া চালা, ভালিকা চালা, খুদিয়াজুরি, দড়ানীপাড়া, ডৌহাতলী, তক্তারচালায় খুব কমই পাকা দালান ছিল। মাটির কোঠা ঘর ছিল। ছনের-বাঁশের ঘরও দেখা যেতো। মরচে ধরা টিনের ঘরও দেখা যেত।
বর্তমানে আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে বলেই বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল আর দেখা যায় না। ছনের বা খড়ের চৌচালা ছাউনি ও বাঁশের বেড়াও চোখে পড়ে না। মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনির গৃহ মনে হয় বিলুপ্তই হয়েছে।
গ্রামীণ ঘরবাড়ির নির্মাণ কাঠামো ও বিন্যাস প্রকৃতি অনেকটাই বদলে গেছে। দৃষ্টিনন্দন বাড়িগুলোই বলে দিচ্ছে বদলে গেছে বাড়ির বাসিন্দা- অধিবাসীদের রুচি-পছন্দ বা অবস্থাও। বৃহৎ ও অভিজাত বাড়িগুলো মালিকের সুস্পষ্ট সম্পদশালী হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ করছে।
ঘর বাঁধা কিংবা কুটীর নির্মাণে কুঁড়েঘরে ধানের খড় কিংবা পাটকাঠির প্রচলন ছিল চার দশক পূর্বে। আমার শৈশব স্মৃতিতেও আছে মাটি-বাঁশ আর ছনের তৈরি ঘর। আর এখন বাঁশ, খড়, শন, পাটকাঠি, গোলপাতা, মাটি ব্যবহার করে ঘরবাড়ি তৈরী আর নেই বললেই চলে। কালের বির্বতনে হারিয়ে যেতে বসেছে ছনের চালের মাটির ঘরবাড়ি।
এখন পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত মানুষ। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে ঢেউটিনকে। ঘরের খুঁটি, রুয়া, পাইড় তথা ঘরের কাঠামো তৈরীতে বাঁশ কিংবা কাঠের ব্যবহার অবশ্য এখনো একেবারে উঠে যায়নি। ঘরের সম্মুখভাগে ছোট বারান্দা ঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলছে।
আগে অবস্থাসম্পন্নরা বারান্দাসহ কাঠের দোতলা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করতো এবং ঘরের চৌকাঠগুলি নানা ধরনের খোদাই করা নকশায় সজ্জিত করতো। এখন ধনী ও সচ্ছল লোকেরা গ্রামেগঞ্জেও শহরের ন্যায় একতলা থেকে শুরু করে ইট দিয়ে বহুতল ভবন করছেন। প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে পাকা ও সুদর্শন বাড়িঘরের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে।
ইট, বালু, সিমেন্ট, লোহার প্রচলন বেশ বেড়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ গ্রামে না থাকলেও চমৎকার বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন, বাড়ির আঙিনায় নানা ধরনের ফল ও ফুল গাছ লাগিয়ে সৌখিন বাগান গড়ে তুলছেন।
গ্রামীণ জনগণ ঘরবাড়ি নির্মাণে যে আকার, নকশা ও রূপকে নির্ধারণ করছেন তা শহরের কিংবা বিদেশের বাড়িঘরের প্রভাব পড়েছে। গ্রামীণ এলাকার অনেক বাড়িঘরের কাছে পুকুর রয়েছে। বসতবাড়ির চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল ও কুলের মতো বহুবর্ষজীবী গাছ লাগানোর রীতিও রয়েছে।
আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন গ্রামেও খাবার পরিবেশন করা হয় ডাইনিং টেবিলে। সোফা, ফ্রিজ, টেলিভিশন ও ডিস লাইন ঘরে ঘরে। খাদ্যাভাসে, রান্নার রেসেপি ও খাবার আইটেমেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। রুচির পরিবর্তন দৃশ্যমান হয় হাতে হাতে দামি স্মার্টফোনে, অভিজাত আসবাবপত্রে। রান্নাঘর, গোয়ালঘর, হাঁসমুরগির ঘর, পাখির ঘর ও খামার ঘর পৃথক করে নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়।
হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ফল
প্রাকৃতিক ও মানুষ্যসৃষ্ট কারণে ঐতিহ্যবাহী দেশীয় ফল গ্রামীণ জনপদ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশীয় একেক ফলের একেক স্বাদ। শৈশবে ডেউয়া ফল খেলেও এখন বাজারে ডেউয়া কিনতে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলের বাজারগুলোতে এখন বিক্রি হচ্ছে আমদানিকৃত বিদেশি ফল কমলা, আপেল, মাল্টা, আঙ্গুর, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, বেদানা, থাই পেয়ারা।
আমড়া, বেল, কামরাঙ্গা, জলপাই, লটকন, আম, কলা, পেয়ারা, আনারস, পেঁপে, লিচু, কুল, নারকেল, বিভিন্ন লেবু ও কাঁঠাল এসব পাওয়া গেলেও পাওয়া যায় না- তেঁতুল, করমচা, পুতিজাম, গাব, হরীতকী, বহেড়া, শালুক, সফেদা, আতা, অরবরই, বিচিকলা ও চালতা।
সুস্বাদু ও রসাল ফল ডালিম আগে অনেক বাড়ির আঙিনায় দেখা গেলেও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নয়নাভিরাম তাল গাছ ও ফল হারিয়ে যাচ্ছে! পঞ্চ ফলের অন্যতম ফল কালো জাম হারিয়ে যাচ্ছে।হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা সুস্বাদু ফল কদবেল। পাওয়াই যায় না অন্যতম মিষ্টি ও সুস্বাদু ফল গাব ফল; যা বিলুপ্তির পথে।
হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ শিল্প
বাঁশের তৈরি বিভিন্ন উপকরণকে জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে আঁকড়ে রাখতো কিছু কারিগররা। কিন্তু দিন দিন বাঁশের তৈরি কুলা, চালুন, খাঁচা, মাচাং, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুঁড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, মাথাল, বইপত্র রাখার র্যাকসহ বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পন্যের চাহিদা বা কদর কমে গেছে।
ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাশঁশিল্প। এক সময় বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র ব্যবহার করা হলেও এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে চিরচেনা সেই চিত্র।
বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মহিষ
অর্থনৈতিকভাবে উপকারী হলেও গ্রামীণ জনপদ থেকে মহিষ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ গরুর পাশাপাশি মহিষ পালনেও বেশ তৎপর ছিলেন।
গুণগত মানের দিক দিয়ে গরুর দুধ ও মাংসের তুলনায় মহিষের দুধ ও মাংস বেশি স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিগুণও বেশি। গরুর মাংসে যেমন অনেক বেশি পরিমাণ চর্বি জমে, মহিষের মাংসে তেমন চর্বি থাকে না। মহিষ কোরবানি করতেও মানা নেই।
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কাঁথা
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কাঁথা। পরিবারের গৃহবধূ, কিশোরীদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরী হতো গ্রামীণ কাঁথা। এই কাঁথায় তাদের হাতের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা হতো নানা নকশা। কাঁথা সেলাই অনেকের বাড়তি আয়ের উৎস ছিল।
গ্রামের নারীদের আড্ডা আর খোস গল্পের ছলে কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে সচারচর আর চোখে পড়ে না। পুরাতন শাড়ি, লুঙ্গি বা ওড়না কাপড়ে রং-বেরঙ্গের সুতা দিয়ে সুনিপুণ হাতে তৈরি করা হয় এ কাঁথা। গ্রামের নারীরা মনের মাধুরী মেশানো অনুভুতিতে নান্দনিক রূপ বর্ণ-বৈচিত্রে এই গ্রামীণ কাঁথা বুনন করতেন।
নারীদের সুক্ষম হাতে সুচ আর লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদসহ কয়েক রংয়ের সুতায় নান্দনিকতার বৈচিত্রে সেলাই করা হয়ে থাকে কাঁথা। হাতে তৈরি নানা রকমের ফুল-ফল, পশু-পাখি, গাছ-পালা এবং প্রকৃতির নকশায় সজ্জিত হয়ে উঠত কাঁথা।
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলা হা-ডু-ডু
গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা হা-ডু-ডু এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। গ্রামের কাচা রাস্তায়, মাঠ, বাগানে বা খোলা স্থানে জমজমাট ও উৎসবমুখর পরিবেশে হতো এ হা-ডু-ডু খেলা।
কিন্তু কালের আবর্তে কোনো উৎসবে বা বিশেষ দিবসে সেই খেলা এখন আর দেখা যায় না। আধুনিক খেলা এবং যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততার কাছে হেরে গেছে এ গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এ খেলাটি। তাই নতুন প্রজন্ম জানে না এ খেলা সম্পর্কে। ভুলতে বসছেন অন্যরাও। তাই নতুন করে খেলোয়াড়ও তৈরি হচ্ছে না।
একসময় হা-ডু-ডু খেলার আয়োজন জমজমাট ছিল। গ্রামজুড়ে চলতো মাইকিং প্রচার-প্রচারণা। দূর-দুরান্ত, পাড়া-মহল্লা থেকে মানুষ হা-ডু-ডু খেলা দেখতে আসতেন। রঙিন কাগজ ও পতাকায় সাজানো হতো খেলার মাঠ ও আশ-পাশের এলাকা। খেলা শেষে বিজয়ী দলকে দেওয়া হতো রঙিন বা সাদা কালো টেলিভিশন, রেডিও, চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, স্বর্ণ বা রূপার মেডেলসহ বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় পুরস্কার।
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ঢেঁকি
গ্রামের ঘরে ঢেঁকির শব্দ একটা সময় খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। প্রতিটি উৎসবে নানা ধরনের পিঠা তৈরি হতো বাংলার ঘরে ঘরে। কৃষাণীদের ঘরে ধানের নতুন চাল ভাঙা বা চাল গুড়া করার ধুম পড়ে যেত।
তবে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেঁকির সেই শব্দ। ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আগের মতো আর চোখে পড়ে না। ঢেঁকির ব্যবহার কমে গেছে। ফলে বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ জনপদের কাঠের তৈরি ঢেঁকি। ঢেঁকি ছাঁটা চাল পুষ্টি সমৃদ্ধ ও খেতেও খুব সুস্বাদু। বর্তমান প্রজন্ম সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত।
হারিয়ে যাচ্ছে মহিষ বা গরুর গাড়ি
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের গাড়ি বা গরুর গাড়ি। একসময় গরু বা মহিষের গাড়িতে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানে সকল শ্রেণির মানুষ যাতায়াত করতেন।
কৃষকরা তাদের জমিতে উৎপাদিত ফসল পরিবহনের জন্য এবং ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজেও ব্যবহার করতেন গরু ও মহিষের গাড়ি। কিন্তু সময় বেশি লাগায় মানুষ এখন নছিমন, করিমন, অটোরিকশা ব্যবহার করছে।
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খাবার
গ্রাম-বাংলার কিছু সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার হচ্ছে কটকটি, বাতাসা, তিলের খাজা, জিলাপি, বালুসা, জাম, ও খাস্তা। গ্রামের হাট-বাজারে এসব খাবারের পসরা সাজিয়ে বসতেন ব্যবসায়ীরা। গ্রামের বিভিন্ন হাটে ছোট-বড় নিমকি, পুরি,ভাজা মটর কালাই, গুড় ও চিনি দিয়ে তৈরি খুরমা, বাদাম, চানাচুর, পিয়াজু ব্যাপক বিক্রি হতো।
হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার গজা, কলাপাতায় খাওয়ার ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যবাহী হাওয়াই মিঠাই। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ ও শীতের রসের পিঠা। খেজুর গাছের অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মুখীন। হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ এবং এর সাথে জড়িত গ্রাম-বাংলার নানা ঐতিহ্যবাহী লোকাচার ও সংস্কৃতি।
হারিয়ে যাচ্ছে গরুর হাল
হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী গরুর হাল। অথচ প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক গরু দিয়ে হালচাষ, যা ছিল গ্রামীণ কৃষকের ফসল ফলানোর একমাত্র অবলম্বন।
কৃষক পরিবারগুলো কামারের এক টুকরো লোহার ফাল, ছুতার বা কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল আর বাঁশের তৈরি মুটিয়া, ইঁশ, পাতার, গরুর মুখের টোনা পেন্টি বা গরু শাসনে পাচুনি লাঠি, মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করত।
হালচাষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে গরু-মহিষ পালন করা হতো। মাঠ-প্রান্তরে হরহামেশাই চোখে পড়ত গরু দিয়ে হালচাষ। নিজের সামান্য জমিতে হালচাষের পাশাপাশি জীবিকার উৎস ছিল। এসব চিত্র এখন দেখা যায় না।
বিলুপ্তির পথে কাচারি ঘর
বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী কাচারি ঘর। একসময় গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ গৃহস্থের বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। কাচারি ঘর ছিলো গ্রাম বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ। কালের বিবর্তনে আজ কাচারি ঘর বাঙালির সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গেস্টরুম কিংবা ড্রয়িং রুমের আদি ভার্সন কাচারি ঘর।
কাচারি ঘরের কনসেপটা ছিল প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। এখন আর গ্রামীণ জনপদে কাচারি ঘর দেখা যায় না। আদিকালে মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে আলাদা খোলামেলা জায়গায় কাচারি ঘরের অবস্থান ছিল। অতিথি, পথচারী কিংবা সাক্ষাৎপ্রার্থীরা এই ঘরে এসেই বসতেন। প্রয়োজনে এক-দুই দিন রাত যাপনেরও ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরে।
কাচারি ঘর ছিল বাংলার অবস্থাসম্পন্ন ও মধ্যবিত্তের গৃহস্থের আভিজাত্যের প্রতীক। আগের দিনে দিনে যার কাচারি ঘর যত সুন্দর তাকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো। চারিদিকে ঢেউ টিনের বেড়া সঙ্গে কাঠের কারুকাজ করে উপরে টিন অথবা ছনের ছাউনি থাকতো কাচারি ঘরে। যা অতি প্রাকৃতিকবান্ধব পরিবেশ দিয়ে আবেষ্টিত ছিল।
তখনকার যুগে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকলে কাচারি ঘড় ছিল আরামদায়ক শীতল পরিবেশ। তীব্র গরমেও কাচারি ঘরের খোলা জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস বইতো। আলোচনা, শালিস বৈঠক, গল্প-আড্ডার আসর, বসতো কাচারি ঘরে।
আগের দিনে নিজেদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে মানুষজন বেশি হলে ছেলেরা কাচারি ঘরে থাকতেন আর মেয়েরা থাকতেন ভিতর বাড়িতে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারি ঘরে বসতো পুঁথি পাঠ ও জারি গান। পথচারীরা এই কাচারি ঘরে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতেন। বিপদে পরলে রাত যাপনের ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরে।
গৃহস্থের বাড়ির ভিতর থেকে খাবার পাঠানো হতো কাচারি ঘরের অতিথিদের জন্য। আবাসিক গৃহশিক্ষকের (লজিং মাস্টার)ও আররি শিক্ষার ব্যবস্থার জন্য কাচারি ঘরের অবদান অনস্বীকার্য। মাস্টার ও আররি শিক্ষকগণ কাচারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা থাকার ব্যাবস্থা করা হত। কোনো কোনো বাড়ির কাচারি ঘর সকাল বেলা মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
চলবে