সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক গৌরবমন্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি।
-রুশো
দৃষ্টিনন্দন এই পৃথিবীর বিমুগ্ধ সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হচ্ছে কৃষি। কৃষি মানুষের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত পেশা। প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে কৃষির উৎপত্তি হয়।১
কৃষিই সর্বাপেক্ষা দৃশ্যমান ও অপরিহার্য উৎপাদন উপহার দেয়। আর বাংলাদেশ একটি কৃষি ও গ্রামপ্রধান দেশ। এদেশে কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় ৮০ লক্ষ হেক্টর।২
কৃষিই এদেশের অর্থনীতির প্রাণস্পন্দন, সভ্যতার ঊষা, উন্নয়নের দিশা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম নিয়ামক শক্তি কৃষিই আমাদের বেচেঁ থাকার অবলম্বন। শুধু কৃষিই নয়, কৃষক আমাদের গর্বের ধন, সাহসের প্রতীক। তাই কৃষককেও বাচাঁতে হবে। কেননা, বৈজ্ঞানিকগণ যে কোন উন্নত জাতের ফসল বা পদ্ধতি আবিষ্কার করুক না কেন, যে পর্যন্ত কৃষকরা এসব গ্রহণ করে বাস্তবায়িত না করবে, সে পর্যন্ত এসবের তেমন কোনো মূল্য নেই। ৩
ফলে রক্তের দামে কেনা সবুজ শ্যামল প্রিয় বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে যিনি রৌদ্রে পুড়ে; বৃষ্টিতে সে / ভিজে, দিবা-রাতি/ মোদের ক্ষুধার অন্ন যোগায়/চায় নাক সে খ্যাতি ৪- সেই কৃষক এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড তথা প্রাণশক্তি কৃষি – দুটোকেই বাঁচাতে হবে।
কৃষির বহুবিধ উন্নয়নে নাগরিক
উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা।
– প্রয়াত অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক
বাংলাদেশকে ভবিষ্যত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিচারে ফ্রন্টিয়ার ফাইভ শীর্ষক তালিকায় পাঁচটি দেশের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্বখ্যাত সংস্থা জেপি মরগ্যান। আন্তর্জাতিক সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাচ – এর প্রধান অর্থনীতিবিদ জেমস ও. নেইল এর ভাষায়, বাংলাদেশ হচ্ছে ব্রিক-এর ( ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীন) পরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় নেক্সট ইলেভেন বা পরবর্তী ১১টি দেশের অন্যতম একটি।
স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর বা এসঅ্যান্ডপির মতো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশকে সভ্রেন ক্রেডিট রেটিং বা সার্বভৌম ঋণমান নির্ণয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে। যে যাই বলুক আমরা জানি, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র কৃষির সাথেই দেশের সিংহভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত । জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি , আমাদের প্রাণের উৎস কৃষিকে অবহেলা করা মানে নিজেদের সমস্যার সমাধান ও সম্ভাবনার বিকাশকে স্থবির করে তোলা । তাই কৃষির বহুবধি উন্নয়নে দেশের সকল নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে।
কৃষির ব্যপারে উদাসীনতা মুর্খতারই নামান্তর
দেশের প্রতিটি নাগরিকের এব্যাপারে সচেতন হতে হবে যে, কৃষির উন্নয়ন, অগ্রগতি, সম্প্রসারণ ছাড়া কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেননা আমাদের জনগণের অধিকাংশই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। কৃষকের যাদুকরী হাতের পরশেই মাঠে নেমে আসে সোনালী ফসলের হাসি। বড়ই বেশি মাটিপ্রেমী সেই মানুষটার এই প্রেমকে বরাবরই উস্কে দেয়া হয়েছে সর্বন্তকরণে।
দেশের সব সফল কৃষক যারা নিষ্ঠা ও মাটির প্রতি গভীর প্রেম দিয়ে আলোকিত করে চলছেন মাতৃভূমি। সব প্রাপ্তির দাবিদার তারাই। তাই তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের কেন্দ্র সবখানে ধ্বনিত হতে হবে কৃষকের অধিকার। আমাদের অর্থনীতি ও জীবন জীবিকার এই গুরুত্বপূর্ণ কৃষির ব্যাপারে উদাসীনতা মুর্খতারই নামান্তর হবে। সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গঠনে কৃষির কোনো বিকল্প নেই।
কৃষি বিপ্লবই অগ্রগতির পূর্বশর্ত
মনে রাখতে হবে, কৃষি ও কৃষক বাচঁলে দেশ ও জাতি বাঁচবে । কৃষিতেই উন্নয়নের শেকড় প্রোথিত। কৃষির উন্নয়ন অগ্রগতি ছাড়া সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়না বলেই কৃষিকে সর্বাংশে টেকসই করার তাগিদ এখন অত্যন্ত বেশি ।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বাস্থ্যকর রেসিপিটা হচ্ছে প্রথমে কৃষি বিপ্লবের সম্পূরক হিসেবে শিল্পায়নের পত্তন। কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের ব্যর্থতার মুখে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষি বিপ্লবের সম্ভাবনা আটকে গেছে ।
তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানো সহ কাজে সমন্বয় সাধন দরকার। কারো অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, কারো মেধা উদ্ভাবন, কারো শ্রম- সবমিলিয়ে একটি সম্মিলিত প্রয়াসেই সম্ভব কৃষির বহুবিধ উন্নয়ন সাধন। সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে।
যে যার যার অবস্থান থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচেষ্টাতো চালাবেই তবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাও অনেক বেশি গুরুত্বের দাবিদার। তিনি গবেষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, লেখক, সাংবাদিক কিংবা নীতি প্রণেতা হোক, বৃদ্ধ কিংবা নবীন হোক, নারী কিংবা পুরুষ হোক- সবার ভূমিকাই জরুরি। কৃষির বহুবিধ উন্নয়ন চাইলে কারো গুরুত্বকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
নতুন প্রজন্মের গ্রামমুখী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দেশের চাষের জমির উপর সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের আলো ফেলিবার দিন আসিয়াছে।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নতুন প্রজন্মরে গ্রামমুখী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে দুটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত: শহরমুখী হওয়ায় সৃষ্ট সমস্যা অনুধাবন। দ্বিতীয়ত: গ্রামমুখী হলে তার সুফল সংক্রান্ত সচেতনতা । ভাবতে হবে, কেন গ্রাম ছেড়ে আসা মানুষদের ভিড় বাড়ছে শহরের রাস্তায়? যেখানে আমাদের স্বাভাবিক নির্ভরতা কৃষির ওপর। সেই কৃষিকে অবহেলা , উপেক্ষা করে আমরা একপাও এগুতে পারছি না বরং পিছায়ে পরছি ।
ভারতের স্বাধীনতার আগেই মহাত্মা গান্ধী জনগণকে গ্রামে ফিরে যেতে বলেছিলেন। আজ শুধু গ্রামরে উন্নয়নের কথা চিন্তা করেই গ্রামে যেতে হবে তা নয়, এখন শহরের অধিবাসীদের চরম দুরবস্থার কথা ভেবেই শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে হবে। দেশের প্রায় সব শহরগুলোতে জনতায় সয়লাব। শহরগুলোতে না আছে সুষ্ঠু স্যানিটেশন ব্যবস্থা, না আছে সবার বসবাসের উপযোগী বাসস্থান। জনসংখ্যার চাপে শহরের সেবামূলক পরিকাঠামোগুলো ধ্বংসের মুখে।
জনসংখ্যার চাপের মধ্যেও গ্রাম থেকে লোকজন শহর অভিমুখে আসছে । গ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা ভালো নয়। খেটে খাওয়া মানুষের সারা বছর চলার মতো কাজ নেই। তাই লোকেরা শহরে এসে বাসা বেঁধেছে। এরপর নদী ভাঙনে লোকজন বসতবাড়ি ও জমি-জিরাত হারিয়ে কিছু উর্পাজন করে বাঁচার আশায় শহরগুলোতে এসে ভিড় জমাচ্ছে। শহরে আসার এই প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে শহরগুলো বৃহৎ বস্তিতে পরিণত হবে। রোগ-বালাইসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে শহরবাসীকে দিন যাপন করতে হবে। তাই শহরগুলোকে বাঁচাবার জন্য এবং গ্রামগুলোর মানুষ যাতে গ্রামেই থাকতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষপে গ্রহণ জরুরি।
এমতাবস্থায় নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখী করতে হলে, গ্রামে মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে গ্রামে অধিকহারে কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা এবং এতে মায়েদের বেশি করে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। হাঁস, মুরগী, গরু,ছাগল-পালন, মৎস চাষ ও কুটিরশিল্প স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী ভাঙা লোকদের সুদবহিীন ঋণ দিতে হবে, এদের বাসস্থানের জন্য জায়গা, জমি এবং ঘর তৈরির সরঞ্জাম দিতে হবে। কিছুদিনের ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ্রামের আইন-শৃংখলার উন্নতি ঘটাতে হবে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। মানুষকে মোটিভেট করে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার যথাযথ র্কাযক্রম গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনকে যতোটা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক শক্তিশালী করতে হবে।
শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে নিত্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না; সবার আগে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য যেখানে যে কৃষিপণ্য বেশি হয় সেখানে সে ধরনের কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুললে একদিকে বেকার সমস্যা দূর হবে, কৃষক পণ্যের সঠিক দাম পাবে এবং শহরমুখি হওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়ার মতো প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি গ্রামে কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
ভুলে গেলে চলবে না যে, গরিব মানুষ তার আর্থিক প্রয়োজনেই অভিবাসন করে। গ্রাম থেকে শহরে আসে অর্থনৈতিক কারণে । ঢাকা শহরের লাখ লাখ মানুষ বাস করে বস্তিতে এবং লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। বাংলাদেশে এক-চর্তুথাংশ মানুষ শহর বা নগরবাসী। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে এ মাত্রা অর্ধেক, ২০৫০ সালের মধ্যে ৭০-৭৫ ভাগ মানুষ শহরবাসী হবে।
ঢাবির পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ড. মো: আতাহারুল ইসলামের মতে, ২০৫০ সালের দিকে জনসংখ্যা হবে কমপক্ষে ১৮.৮ কোটি এবং সর্বোচ্চ ২৪.৪ কোটি। কোনো কোনো সংস্থার মতে- ২০৫০ সালে ২৮ কোটিও নাকি হতে পারে। অনুমান করা যায় ২০৫০ সালে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১০ হাজার ছোট, মাঝারি, বড় নগর থাকবে , থাকবে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ গ্রাম।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট এর গবেষণায় দেশের খাদ্য সংকটের যে চিত্রটি দেখা যায়, ৫০% পরিবার বছরের কোন না সময় খাদ্য সংকটে থাকে,২৫% পরিবার নিয়মিত ভাবে সারা বছর খাদ্য সংকটে থাকে,১৫% পরিবার ১ বেলা খেয়ে পরের বেলায় খাদ্য নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকে,৭% পরিবার কখনই তিন বেলা খেতে পায় না।
আমাদের দেশের ৩৬ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সব সময় জোগাড় করতে পারে না। এজন্যই প্রয়োজন দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের নিশ্চয়তা,প্রকৃত খাদ্য নিরাপত্তা। আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন না বাড়িয়ে বাংলাদেশের কোনো উপায় নেই। বর্তমানে গ্রাম ও শহরের এসব বাস্তবতাকে দেখলে কিংবা ভবিষ্যতকে নিয়ে ভাবলে নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখী করার বিকল্প কোনো পথ দেখা যায় না।
বর্তমান বাস্তবতা ও নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখী করতে করণীয়
মৃত্যুর চেয়ে জীবনের দাবি অনেক বড়,
মৃত্যুর আঘাত মানুষকে বিহ্বল করে, শোকগ্রস্থ করে,
কিন্তু জীবদের দাবি মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড.আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য এবং কৃষির ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের কৃষির ওপরই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
প্রফেসর ড. জহুরুল করিম বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যেই উপকূলীয় অঞ্চলের ১.৭০ লক্ষ হেক্টর জমি লবণাক্ত হয়েছে এবং ওইসব জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে না। দিনদিন লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওইসব এলাকার কৃষিজীবী মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে এলাকা ত্যাগ করে শহরমুখী হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আশা ভরসার জায়গা একমাত্র মাটিই। বাঁচতে হলে মাটির বুকেই ফলাতে হবে শস্য। তাই মাটি যাতে তার জীবন যৌবন হারিয়ে না ফেলে, যে মাটিতে ফলবে ফসল সেই মাটিকেকে বাচাঁতে হবে। কৃষি নিয়ে আশা ভরসা করতে হলে মাটির হারানো স্বাস্থ্য মাটিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
প্রসব বেদনার উপশমের আগেই আরেক ফসলের গর্ভধারণে মাটি হয়ে গেছে বিবর্ণ, হলুদ। মাটির স্বাদ এখন অম্ল। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিষময় ঝাঁঝ। রাসায়নিক সার, কীটনাশক আর নপুংসক হাইব্রিড বীজ ব্যবহারে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে পুরো কৃষিব্যবস্থাকে। যেখানে মাটির জৈব পদার্থ তাকা দরকার অন্তত পাঁচ ভাগ, সেখানে এদেশের মাটিতে আছে একভাগেরও কম। মাটিকে তার উর্বরা শক্তি ফিরিয়ে দিতে হবে।
ড. সদরুল আমীনের মতে, একমাত্র দস্তার অভাবেই আমাদের ফলন কম হচ্ছে অন্তত ৩০ ভাগ। অধিক ফলনের জন্য সার, পানি এবং মাটির গুণাগুণ রক্ষা সবচেয়ে দরকারি।
বাংলাদেশের কৃষি কাঠামোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারী কৃষি কর্মকর্তা , প্রযুক্তি বিক্রেতা এবং ধনী কৃষক লাভবান হচ্ছে; আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক।৫
উচু এবং মধ্যবিত্ত শোষণে নিম্নবিত্তরা ভূমিহীনে পরিণত হয়। ৬
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে জমির ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ অসম। অল্প সংখ্যক কৃষক ধনী , অধিকাংশই দরিদ্র। ৭
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মতো বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না বরং প্রযুক্তি ব্যবহৃত এলাকার সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্যাট্রন – ক্লায়েন্ট সম্পর্কেও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তা প্রভাব ফেলছে। আধুনিক প্রযুক্তি গৃহাস্থলীর প্রয়োজনীয়তাকে হ্রাস করে, তাই নারী কৃষিকাজ হতে একেবারেই বিযুক্ত হয়ে পরে। প্রযুক্তির মালিকানা, দক্ষতা, পরিচালনা ব্যবস্থা-এগুলো পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা হতে নারী দূরে সরে যাচ্ছে। স্বচ্ছল গৃহস্থালীর নারীরা কৃষি কাজ হতে বিযুক্ত হয়ে সংসারের কাজ, যেমন-রান্না, সন্তান পালন, ঘর পরিষ্কার এসব কাজের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।৮
এই যে বাস্তবতা ও নয়া নয়া চ্যালেঞ্জ এসব মোকাবিলায় নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে হবে। নতুন প্রজন্ম গ্রামমুখী হতে এগিয়ে না আসলে আগামীর পরিণতি হবে ভয়াবহ। যেহেতু, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে বাংলাদেশের। অনেক ভুমি সমুদ্র গর্ভে চলে যাবার আশংকা রয়েছে। আসবে খাদ্য উৎপাদনে আঘাত। উদ্বাস্তু ভুমিহারাদের চাপ কমাবে আবাদী জমি।
বাংলাদেশে ১ কোটি সাড়ে ১২ লাখ ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষী রয়েছে। দেশে নিরন্তরভাবে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে নিম্নবিত্ত, ভাসমান মানুষ ও বস্তির সংখ্যা।
সেহেতু করণীয় হচ্ছে :
দারিদ্র্যের পকেট খ্যাত আইলা সিডর বিধ্বস্ত ও মঙ্গা এলাকাগুলোতে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ করা জরুরি। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে উন্নত ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এসএমই, দারিদ্র বিমোচন, প্রতিবন্ধী , নারী উদ্যোক্তা ও কৃষি উৎপাদনে ঋণ প্রবাহ বাড়লে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
প্রতিবছর ১৮ লাখ নতুন মুখ শ্রম শক্তিতে যোগ হচ্ছে। এরপরও বহু যুবক বেকার থেকে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নতুন প্রজন্মকে বিভিন্নক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা দরকার। নবীনদের মেধা ও প্রবীনের অভিজ্ঞতাকে জাতির উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে- উৎপাদন উপকরন বাজার রেগুলেশনের আওতায় রাখা। সেচের জন্য বিদ্যুত এবং ডিজেল সরবরাহ নিশ্চিত করা। পরিবেশবান্ধব এবং দেশী জাতের প্রাধান্য রক্ষা করে এমন প্রযুক্তগিত গবেষণায় র্অথ বরাদ্দ বাড়ানো এবং সমতাভমিুখী প্রবৃদ্ধির জন্য অবশ্যই ভূমি সংস্কার ও আবাদ যোগ্য জমির সদ্ব্যবহার। এসব নিশ্চিতিকরণে নতুন প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে ।
বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে পর্যাপ্ত সেবাকে কৃষকদের দোরগোড়ায় সহজসাধ্য ও সময়মত পৌঁছে দিতে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন।
পর্যাপ্ত খাদ্যসংস্থান করতে দেশে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনায় বিকেন্দ্রীকরণ নীতি অনুসরণ করতে হবে। গোটা দেশের ভৌত পরিকল্পনা ভাবতে হবে। জাতীয়ভাবে সমগ্র দেশের জন্য যেমন, তেমনি প্রতিটি শহর ও গ্রামের পরিচালন ব্যবস্থা উন্নত হতে হবে।
ডাটাভিত্তিক নেটওয়ার্কে গড়া কৃষির পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজতর হবে । কৃষক সংগঠন বা কৃষি ক্লাব গঠন করে আইটির সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে যাতে কৃষক জ্ঞানভিত্তিক কৃষি সেক্টর বিনির্মাণ করতে পারে।
রুগ্ন হয়ে পড়ছে আমাদের কৃষককুল। পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি এখন ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে।
পানির জন্য হাহাকার বাড়ছে, অথচ এককেজি ধান উৎপাদনে আমরা অপচয় করছি আড়াই থেকে তিন হাজার লিটার পানি। এ অপচয় রোধ করা সম্ভব ইরি উদ্ভাবিত এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করে।
কৃষক পরিবারের শিশুশ্রম একটি গুরুতর ও জটিল সামাজিক সমস্যারুপে বিরাজ করছে । বেঁচে থাকার অধিকার, নিরাপত্তা লাভের অধিকার এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডের অধিকার থেকে বঞ্চিত যেকোনো শিশুই শিশু শ্রমিক। ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং নিরক্ষরতামুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার পূরণে এই কৃষক পরিবারের শিশুকেও শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
কৃষির অন্যতম প্রধান উপকরণ সার, বীজ, সেচ, বিদ্যুৎ , জ্বালানি তেল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কৃষকের সংকট এবং ফসল উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণের নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো এবং সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আগামীর নিরাপত্তার জন্য বাংলার উর্বরা মৃত্তিকার বুক চিরে আমাদের সোনার ফসল ফলাতেই হবে। হেক্টর প্রতি ৫-৬ টন ফলন বৃদ্ধির পথই আমাদের ভরসা। এজন্য কৃষি গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে এবং গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে কৃষির মাঠ কেন্দ্রীক নিবিড় যোগাযোগ বাড়িয়ে সম্প্রসারণ পদ্ধতিকে সত্যিকার অর্থে দ্বিমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা টেকসইভাবে জোরদার করার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে অর্থনৈতিক অনিয়ম রুখে দিতে দরকষাকষির সামর্থ্য ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হওয়া উচিৎ। এছাড়া আগামীর নি:স্ব গরিব কৃষিকে গতিশীল, টেকসই ও উৎপাদনমুখী করার জন্যে পুঁজির প্রবাহকে দরিদ্রমুখী করতে হবে।
বাংলাদেশের ৬৩% কর্মসংস্থানের যোগানদাতা দরিদ্র কৃষক ও খামারিরা। তাদের নানা ঝুঁকি কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যোমে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। ঘাম ও রক্তের সম্মিলনে কৃষককে ক্ষেতে দেখতে হলে শস্যবীমা , কৃষিবীমা চালু করতে হবে।
কৃষিকে ভিত্তি করেই রচিত বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য যা আজ নিরন্তর স্থবিরতার মধ্যে নিমজ্জিত। কৃষি-কৃষকের সার্বিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবিলায় কৃষি গর্ভানেন্স প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য।
National Adaptation Programme of Action- NAPA কে কার্যকরী ও গতিশীল করতে হবে। কৃষি, পরিবেশ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গুলোকে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কার্যকরী ও অর্জনযোগ্য রোডম্যাপ অনুযায়ী কৃষিখাতের উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করে যেতে হবে।
নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখী করতে শুধু সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আর লেখালেখি কিংবা টকশো করে লাভ হবে না; যদি না গ্রামভিত্তিক কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কাংখিত পরিবেশ সৃষ্টি করা না যায়।
শেষ কথা
যখন সবকিছু হারিয়ে যায়, ভবিষ্যত তখনও থাকে।
– জ্ঞানবীদ বোভি
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে প্রবৃদ্ধির সুফল সকল মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি। কৃষকের কল্যাণ ও গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন ছাড়া দারিদ্র্য ঘোচানো আর বৈষম্য দূরীকরণ কোনো দিন সম্ভব নয়।
নতুন প্রজন্ম চায় দেশের প্রত্যেক মানুষ কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন পরিচালনার জন্য চাহিদা ও পছন্দানুযায়ী সব সময় যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাবে, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা পাবে, মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজ পতাকার মান অক্ষুণ্ন থাকবে, স্বাধীন আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উচুঁ করে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দেব এটাই প্রত্যাশা। শ্রুতিসুখকর কথামালা নয়, রাষ্ট্রের অঙ্গীকার, দূর দৃষ্টি সম্পন্ন লাগসই পরিকল্পনা, উৎকর্ষিত প্রযুক্তি প্রয়োগে দক্ষ নিবেদিত কর্মী বাহিনী, সহজপ্রাপ্তি, নিরবচ্ছিন্ন তদারকি ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্ষিত জমির উপর জ্ঞানের আলো ফেলে কাঙ্খিত সোনা ফসল ফলাতে হবে।
আগামী এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। তবে আমাদের সমাজের চাহিদার আলোকে আমাদের নেতৃবৃন্দ, নীতি নির্ধারকগণ গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলে এবং নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখি করা গেলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই সামনে এগিয়ে চলার গতিকে থামাতে পারবে না ।
তথ্যসূত্র ও তথ্যনির্দেশ
১. De,Anil K.2009.Environment and Ecology, New Age International (P) Ltd.
২. BBS,2006,Year book of Agricultural Statistics of Bangladesh , Dhaka:
Bangladesh Bureau of Statistics, Government of Bangladesh
৩. বি.আর.সেন
৪. কাজী নজরুল ইসলাম
৫. Hartman.B & Boyce. J 1983 A Quite Violence : View from a Bangladesh Villege. Dhaka: University press limited..
৬. বাট্রসি, পিটার জে ১৯৭০. অস্পষ্ট গ্রাম. ঢাকা: ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব লোকাল গভর্ণমেন্ট, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর ( অনুবাদ ১৯৯২)
৭. জাহাঙ্গীর, বোরহান উদ্দিন খান ১৯৯৩. ঊাংরাদেশের গ্রামাঞ্চল ও শ্রেণী সংগ্রাম. ঢাকা: সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮. পার্থ,রঞ্জন সাহা, ‘আধুনিক‘ কৃষি প্রযুক্তি ও লিঙ্গায়িত গৃহস্থালী পরিসর, নৃবিজ্ঞান পত্রিকা, সংখ্যা ১৩, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,২০০৮
এছাড়াও সহায়তা নেয়া হয়েছে,
৯. রহমান ,আতিউর, অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন,অন্য প্রকাশ,একুশের বইমেলা ২০০৪
১০.জনভাষ্য-৪,হৃদয়ে মাটি ও মানুষ,চ্যানেল আই, এপ্রিল ২০০৯
১১.জনভাষ্য-৫, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ,চ্যানেল আই, এপ্রিল ২০১০
১২.পল্লী উন্নয়ন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী,অক্টোবর-২০০১ ইং
১৩.আতিউর রহমান,বাংলাদেশে উন্নয়নের সংগ্রাম,প্রবর্তক প্রকাশনী, ১৯৯১
১৪.মাহবুব-উল-হক, উন্নয়ন অন্বেষণ,পালক পাবলিশার্স, সেপ্টেম্বর ১৯৯৯