আনিসুর রহমান এরশাদ
অসুন্দর ও অভব্যকে সব সময় পুলিশ দিয়ে দমন করা যায় না, এর বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। অশোভন আচরণ, খারাপ আচরণ, অসভ্য আচরণ, বর্বর আচরণ, অযৌক্তিক আচরণ, উদ্ভট আচরণ, অসংযত আচরণ কিংবা অভব্য আচরণ যাই বলেন এসব কখনও সব সময়ের জন্য সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সাময়িক স্বার্থে কিংবা লোভে এসব ব্যাপারে বৃহত্তর জনগোষ্ঠি নিরবতা দেখালেও পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিক্রিয়ারও রুপ পাল্টায়। কাণ্ডজ্ঞান মানে প্রাথমিক জ্ঞান নয়, ব্যবহারিক জ্ঞান, পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক আচরণ করার জ্ঞান। যা বোধ, অভিজ্ঞতা ও সচেতনতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। প্রকৃতিগতভাবে আত্মপরাজয়মূলক এবং অসংলগ্ন আচরণকে মানসিক ব্যাধি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কাণ্ডজ্ঞানের অভাব এমন ধরণের এক ব্যাধি যা শরীরকে আক্রান্ত না করলেও সামাজিক আচরণে সুস্থতা বিঘ্নিত করে।
বাংলাদেশেও ক্রিকেটের সাফল্যের উচ্ছ্বাসে ক্রিকেটীয় চেতনার বাইরে গিয়ে গ্যালারিতে দর্শকদের অভব্য আচরণ অনেকেরই মনে আছে। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট খেলার সময় কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় কাগিসো রাবাদাকে ‘বর্ণবাদী’ কটাক্ষের অভিযোগ উঠেছিল কিছু দর্শকের বিরুদ্ধে। শুধু দর্শকই নয়, মাঠে অভব্য আচরণ করে নায়ক থেকে খলনায়কও হয়েছেন অনেকে। মাঠে অভব্য আচরণ করে নিষিদ্ধ হওয়ার নজির সাকিব আল হাসানও রেখেছেন। জাতীয় দলের আরেক তারকা অলরাউন্ডার নাসির হোসেন উইকেট পাবার পর প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্যে একাধিকবার কটূক্তি করেছেন। মোহাম্মদ শহীদের বলে বোল্ড হবার পর একেবারেই ‘গায়ে পড়ে’ তাঁর সাথে ঝগড়া বাঁধিয়েছেন পেসার আল-আমিন হোসেন। বারাসতে চার্চিল ব্রাদার্স ম্যাচে রেফারিকে অশালীন মন্তব্য করেন ইস্টবেঙ্গল সহকারী কোচ। ম্যাচ শেষে রেফারির দিকে তেড়েও যেতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। বিভিন্ন তীর্যক বাক্য, পাগলাটে আচরণ আর মাদক বিতর্কের পর এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির হরিণ শিকার গুরুতর এক অভিযোগ উঠেছিল ‘ফুটবল ঈশ্বর’ আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়াগো ম্যারাডোনা বিরুদ্ধেও! মনোবিকারগ্রস্ত হলে সাধারণত চিন্তাশক্তি, অনুভূতি এবং আচরণের সুস্পষ্ট অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু উদ্ভট চিন্তা, ভগ্নমনস্কতা, সামঞ্জস্যহীন আচরণ এবং আবেগ প্রবণতা ও বু্দ্ধিমত্তার অবনতি দেখলেই কি মনোবিকার বলা যায়!
দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, অযৌক্তিক ব্যবহার নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দিল্লির একটি বিজ্ঞাপনী অনুষ্ঠানে এসে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলির প্রতিপক্ষকে এক বিন্দু ছাড় না দেয়ার আক্রমণাত্মক মেজাজ ও আগ্রাসী মনোভাবের সমালোচনা করেছিলেন। মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে নায়ক হওয়া আর ভালো ক্রিকেটারের পাশাপাশি ভালো মানুষ হতে পারা একই কথা নয়। শুধু খেলোয়াড়ই নয়, পাবলিক স্পেসে অভব্য আচরণ করে অনেক নন্দিতরাই নিন্দিত হয়েছেন। অভব্য আচরণ করায় বিমান থেকে সেলিব্রিটি নারী-পুরুষকে নামানোর ঘটনা ঘটেছে। অপ্রীতিকর বা অভব্য আচরণ করলেই যাত্রীর হাতে প্লাস্টিকের হাতকড়া পড়িয়ে তা সিটের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ। একজন অল্প বয়সী মেয়ের সঙ্গে অভব্য আচরণ করার জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পপ গায়ক রেমো ফার্নান্ডেজকে। অভব্য আচরণ, মদ্যপ অবস্থায় থাকা, শ্লীলতাহানি, ক্লিভেজ বা বক্ষ বিভাজিকা তথা স্তন বেশি উন্মুক্ত হয়ে থাকা, এমনকী বোরখার মতো পোশাক পরার জন্যও বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অনেক।
‘বেগম জান’-এর প্রচারে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে আসলে নায়িকা বিদ্যা বালানের সঙ্গে এক অনুরাগী সেলফি তুলতে চান। সেলফি তোলার সময় ওই ব্যক্তি বিদ্যাকে হঠাৎই জড়িয়ে ধরেন। অভব্য আচরণের পর সংবাদমাধ্যমকে বিদ্যা বলেন, ‘যখন কোনও অচেনা মানুষ আপনার গায়ে হাত দেন তিনি পুরুষ হোন অথবা নারী, অস্বস্তি তো হবেই। আমরা পাবলিক ফিগার, পাবলিক প্রপার্টি তো নই।’ ফালাকাটায় কলেজের অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী শুভশ্রীকে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল। মদ্যপান করে বিমানে ‘অভব্য’ আচরণ করায় কপিল শর্মাকে ‘সতর্ক’ করেছে এয়ার ইন্ডিয়া। চিৎকার-চেঁচামেচি,তর্কাতর্কি, বকাঝকা, গালিগালাজ সবই করেছিলেন তিনি। দক্ষিণী অভিনেতা শ্রীজিত রবিকে শ্রীঘরে যেতে হয়েছিল এক দল স্কুলছাত্রীকে যৌনাঙ্গ দেখানোর কারণে। পরে এক লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন পেয়েছিলেন তিনি। বিমানে এক সহযাত্রীর অভব্য আচরণ ও অশোভনভাবে গায়ে হাত দিয়ে শারীরিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন ভারতের ছোট পর্দার অভিনেত্রী টিনা দত্ত। দিল্লির বাসিন্দা বলিউড অভিনেত্রী তাপসী পান্নু একদিন শুটিং শেষে বাড়ি ফেরার পথে জনাকয়েক যুবককে এক তরুণীর সঙ্গে অভব্য আচরণ করতে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই তরুণীকে উদ্ধার করে নিজের গাড়ি করে তাকে বাড়িও পৌঁছে দেন। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অভিনেত্রী খুশি মু্খার্জী অমর বিলাস হোটেলে রাতে ঘুমিয়েছিলেন। ঠিক তখনই হোটেলের এক কর্মচারী তার রুমে ঢুকে অভব্য আচরণ করতে শুরু করে। নিত্যনতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড আর পাগলাটে আচরণ দিয়ে পপ সুপারস্টার লেডি গাগা (স্টেফানি জারমানোটা) সব সময়ই থাকছেন লাইমলাইটে। মিউজিক মির্চি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ভারতের মডেল ও অভিনেত্রী পুনম পাণ্ডে ক্যামেরার সামনে বেশ সচেতনভাবেই অফ শোল্ডার পোশাকের ঘেরওয়ালা অংশটির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পোশাকটিকে সরিয়ে দেয়ায় গোপনাঙ্গ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, বিশ্রীভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল তার অন্তর্বাসও।
অনেক সময় পাগলেরও ভক্ত জোটে, পাগলামীকেও মানুষ পছন্দ করে। পাগলাটে আচরণ ও বিতর্কিত বক্তব্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দারুণ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল, যা প্রেসিডেন্ট হবার পথকে মসৃণ করেছে । শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সফরসঙ্গীদের সঙ্গে কূটনেতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে অভব্য আচরণ করেছিল চীনা কর্মকর্তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনেই চিৎকার করে এক নারী সাংবাদিককে বেজিংয়ের কর্মকর্তারা বলেছিল, ‘এটাই চীন। এটাই আমাদের দেশ। আর এটা আমাদের বিমানবন্দর।’ নারীর সঙ্গে অভব্য আচরণের পৃথক অভিযোগে ভারতে দু’জন সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন বিজেপি’র বিহারের এমপি তুন্নাজি পান্ডে ও জামিয়া নগরের অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির এমপি আমানাতুল্লাহ খানকে আটক করেছিল পুলিশ। জুয়ায় মত্ত যুবকদের অভব্য আচরণের প্রতিবাদ ও জুয়া খেলায় বাধা দেওয়ায় প্রতিবাদী যুবককে মারধরের অভব্য আচরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নারী যাত্রীর সঙ্গে অভব্য আচরণের জন্য গাড়ি চালক কাসেত আলি সেখকে গ্রেফতার করেছিল নিউটাউন থানার পুলিশ। আমেরিকান সঙ্গীত ঐতিহ্যে নতুন ধরণের কাব্যিক গান যোগ করার জন্য এ বছর মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হওয়াকেও নোবেল কমিটির একজন সদস্য ‘অভব্য আচরণ’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। এখানেই বুঝা যায় একজনের কাছে যা অভব্য আচরণ, আরেকজনের কাছে তা’ সভ্য আচরণ বলে বিবেচিতও হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশের অনেক সমাজে চুমু খাওয়ার বিষয়টিকে অশালীন ও উদ্ভট আচরণ হিসেবে দেখা হয়।
ছাত্রীকে স্কুলে নিজের ঘরে ডেকে প্রধান শিক্ষকের চুমু খাওয়া, প্রধান শিক্ষিকার নির্যাতনে হাসপাতালে ভর্তি ও ছাত্রীর মাথার চুল কেটে দেয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওড়িশার উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস চত্বরের বাইরে মদ খেয়ে কলেজ ছাত্রীদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করেছিলেন এবং কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন গৃহ শিক্ষক বিনোদ কুমার। প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় ছাত্রীকে অশালীন ইঙ্গিত করেন, নিজের প্যান্টও খুলে ফেলার চেষ্টা করেন। নিজের এক বান্ধবীকে ডেকে এনে হাতে লাঠি তুলে নিয়ে মদ্যপ ওই শিক্ষককে উত্তম মধ্যম দিয়েছিলেন দুই ছাত্রী। মনুষ্যত্ববোধ না হারালে কি করে স্কুল পড়ুয়া শিশুর পিঠকে সেতু বানিয়ে জুতা পায়ে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যান জনপ্রতিনিধি, পরিমলের মতো শিক্ষক তৈরি হয় কিভাবে! আবার এমপি জনসম্মুখে প্রধান শিক্ষককে কানে ধরিয়ে ওঠবসই বা করান কিভাবে? এ অপকর্ম শুধু ব্যথিতই করে না লজ্জিতও করে। কারণ এ ঘটনার জন্য দেশে বিদেশে আমাদের পরিচয় দাঁড়াবে অসভ্য জাতি হিসেবে। এসব ছাড়াও মন্ত্রী হয়েও স্কুলের বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে হাজার মানুষের সামনে মঞ্চে বসে আরমসে ধুমপান করা, অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত হয়েও নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়া ভালো দেখায় না। আসলে যে যত বড় ব্যক্তিত্বই হোক না কেন পাবলিক প্লেসে যথাযথ আচরণ করতে না পারলে তা’ হাস্যরস সৃষ্টি করে, লজ্জাস্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে, বিড়ম্বনা ও বিরক্তি উদ্রেক করে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ‘অসভ্য ও অভদ্র’ আচরণ লক্ষ্য করছি তা পৃথিবীর কোথাও নেই। দলগত স্বার্থের কারণে আমরা এক বিন্দুতে মিলিত হতে পারছি না। সমাজে যখন মূল্যবোধ কম থাকে বা একেবারেই থাকে না তখন দেখা দেয় সামাজিক অনেক ধরনের সমস্যা বা ভারসাম্যহীনতা। একজন সভ্য মানুষ কখনো গালি দেন না, তিনি কখনো অশ্লীল কথা বলেন না, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন না। অসভ্য-অভদ্র মন্দ মানুষ যখন রেগে যায় তখন সে ভুলে যায় ভদ্রতা-সভ্যতা এবং তার পাশবিক রূপ বেরিয়ে আসে। সে তখন গালি দেয়, ব্যক্তি আক্রমণ করে, যুক্তিহীন পাশবিক আচরণ করে। অনেকসময় দেখা যাচ্ছে অফলাইনের সভ্য মানুষটিই অনলাইনে এসে অসভ্য-অভদ্র-বর্বর-অশোভনীয় আচরণ করছে। মতের অমিল হলে গালাগাল ককরছে, অযৌক্তিক ও অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করছে, অশ্লীল ছবি বা ভিডিওর লিঙ্ক শেয়ার করছে, মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে, কারো ছবি বা লেখাকে এডিট করে হেয় করার কাজে ব্যবহার করছে, প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র না দিয়ে অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে, অঝথা যাচাই বাছাই না করে লাইক-শেয়ার দিচ্ছে, সময় অপচয় করছে, অধিক প্রশ্ন করছে ও বেশি কথা বলছে, নিজেকে বড় ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরছে, না বুঝে হইচই করছে, নোংরা অডিও-ভিডিও শুনছে-দেখছে ও চর্চা করছে, অল্প জেনে যাচাই না করেই বিশ্বাস করছে। হাসি-তামাশা ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালিগালাজ করা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় কিংবা আলোচিত-সমালোচিত হবার প্রত্যাশায়- মন যা চায়, তাই করা অনুচিত। কারণ সাময়িক আনন্দ বা তৃপ্তি দীর্ঘ সময়ের জন্য বেদনার কারণও হতে পারে।