কাজ খাদ্য পানি ও লবণের নিশ্চয়তা দিতে হবে : নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা।  অবিসংবাদিত এক রাষ্ট্রনায়ক। বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে এক কিংবদন্তী। দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ও জাতির জনক। তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়কদের একজন, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত উদারতা এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবন কাহিনী—এসব মিলিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। ম্যান্ডেলার বাবার নাম গাডলা হেনরি এমফাকানিসিওয়া (১৮৮০-১৯৩০)। তিনি ছিলেন থেম্বু গোত্রের প্রধান। এই গোত্র খোসা ভাষায় কথা বলে।  ম্যান্ডেলার মা নোসেকেনি ফ্যানি ছিলেন তাঁর স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী ।

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। তখন ম্যান্ডেলাকে সবাই চিনতেন তাঁর গোত্র নামেই, রোহিলালা। রোহিলাহলার অর্থ ‘ট্রাবল মেকার’। পিতৃবিয়োগের পর, জঙ্গিনাতাবা ডালিন্ডিয়েবো নামে উচ্চপদস্থ থেম্বু রিজেন্ট দত্তক নেন ম্যান্ডেলাকে। উদ্দেশ্য, থেম্বু ট্রাইবের পরের নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলাকে গড়ে পিঠে নেওয়া।

নেলসন ম্যান্ডেলার প্রাথমিক জীবন

ম্যান্ডেলার বাবা ছিলেন ইস্টার্ণ কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা ম্যান্ডেলা। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার আপামর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’।

ম্যান্ডেলা যখন খুব ছোট, তখন একটি ঘটনা তাঁদের পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। এক ব্যক্তি শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করেন যে হেনরির একটি ষাঁড় তাঁর খেতের ফসল নষ্ট করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট হেনরিকে তাঁর অফিসে তলব করেন। হেনরি ছিলেন একগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ।

তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে অস্বীকার করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর বিরুদ্ধে অবাধ্যতার অভিযোগ আনেন। সেই সঙ্গে তাঁকে গোত্রপ্রধানের পদ থেকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁর গবাদিপশু ও জমি-জিরাত বাজেয়াপ্ত করেন। তারপর পৈতৃক ভিটা ছেড়ে তিনি পার্শ্ববর্তী কুনুতে বসতি গড়েন।

 ৯ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু

ম্যান্ডেলার বয়স যখন মাত্র ৯ বছর, তখন তাঁর বাবা ফুসফুসের রোগে মারা যান। মৃত্যুর কিছুদিন আগে হেনরির বন্ধু জঙ্গিনটাবা (টেম্বু রাজার প্রতিভু) তাঁকে দেখতে আসেন। হেনরি জঙ্গিনটাবাকে তাঁর ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন।

জাঙ্গিনটাবা তাঁকে কথা দেন, রোহিলাহলাকে তিনি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। বাবার মৃত্যুর পর ম্যান্ডেলা জঙ্গিনটাবার কিউহিকিজ্যুইনির গ্রেট প্যালেসে আশ্রয় পান। জঙ্গিনটাবা তাঁকে নিজের ছেলের মতো প্রতিপালন করেন। ম্যান্ডেলা জঙ্গিনটাবার ছেলে জাস্টিস ও সাবাটা এবং মেয়ে নেমাফু ও জিজোর মতো রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে বড় হতে থাকেন।

কয়লাখনিতেও কাজ করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা

গোত্রপ্রথা অনুযায়ী কৈশোরোত্তীর্ণ ম্যান্ডেলা ও জাস্টিসকে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খৎনা করানো হলো। অনুষ্ঠান শেষে জঙ্গিনটাবা তাঁদের ডেকে বললেন, তোমরা এখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছ। তোমাদের বিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। আর এই কর্তব্য আমি খুব শিগগির শেষ করতে চাই। দুশ্চিন্তায় পড়লেন ম্যান্ডেলা ও জাস্টিস।

এখন কিছুতেই তাঁরা বিয়ে করবেন না বলে পণ করলেন। কিন্তু জঙ্গিনটাবার আদেশের অন্যথা হওয়ারও তো কোনো জো নেই। অগত্যা তাঁরা জোহানেসবার্গে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই, কী করা যায়? শেষমেশ চুরি করে জঙ্গিনটাবার কয়েকটি গরু বিক্রি করে রওনা হলেন জোহানেসবার্গের ট্রেন ধরতে।

টিকেট কাটতে গেলে স্টেশনমাস্টার তাঁদের পারমিট দেখতে চাইলেন। ওই সময়ে বর্ণবাদী সরকারের আইন ছিল, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হতো। কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের তত্ত্বাবধানে ভ্রমণ করলে কৃষ্ণাঙ্গদের পারমিটের প্রয়োজন হতো না। তাঁরা স্টেশনে অপেক্ষমাণ জোহানেসবার্গের যাত্রী এক শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধার শরণাপন্ন হলেন। বৃদ্ধাকে অনুনয়-বিনয় করলেন তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বৃদ্ধা রাজি হলেন, তবে টাকার বিনিময়ে।

গরু বিক্রি করে যে টাকা তাঁরা পেয়েছিলেন, তার প্রায় পুরোটাই বৃদ্ধাকে দিতে হলো। জোহানেসবার্গে পৌঁছে তাঁরা বৃদ্ধার গৃহভৃত্যদের সঙ্গে রাত কাটালেন। পরদিন কাজের সন্ধানে বের হলেন এবং কাজ জুটলো একটি কয়লাখনিতে। জঙ্গিনটাবা এত প্রভাবশালী ছিলেন যে শ্বেতাঙ্গরাও তাঁকে বেশ সমীহ করতেন। সহজেই তিনি তাঁদের খোঁজ পেলেন। তাঁর পরামর্শেই খনি থেকে ম্যান্ডেলা ও জাস্টিসকে ছাঁটাই করা হলো।

নেলসন ম্যান্ডেলার শিক্ষাজীবন

নেলসন ম্যান্ডেলার পরিবারে তিনিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেন। ম্যান্ডেলা  প্রাইমারি স্কুল শেষ করেন আঞ্চলিক এক কনভেন্ট থেকে। সেখানে স্কুলের  একজন শিক্ষক তার ইংরেজী নাম রাখলেন নেলসন । তখন আফ্রিকার ছাত্রদের ইংলিশ নাম দেবার একটা চল ছিল। ম্যান্ডেলা মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মেথডিস্ট প্রতিষ্ঠান, ক্লার্কবারি বোর্ডিং আর হিল্ডটাউনে কাটান।

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৩৯ সালে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখনকার আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের জন্য একমাত্র পশ্চিমা উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত সেখানেই ছিল। সেখানেই দেখা হয় বন্ধু এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্য সহযোগী (১৯১৭-১৯৯৩) অলিভার টেম্বোর সঙ্গে। দুজনকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ভঙ্গের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ।

নেলসন ম্যান্ডেলার চিন্তাধারা

‘যখনই আমরা কেউ দেশের মাটি স্পর্শ করি, তখনই ব্যক্তিগতভাবে নবজীবন প্রদানের উপলব্ধি সঞ্চারিত হয়। মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবেগ-অনুভূতিরও পরিবর্তন ঘটে।

ঘাসগুলো যখন সবুজ হয়ে ওঠে, যখন ফুল ফোটে, তখন আমরাও আনন্দ অনুভব করি এবং উজ্জীবিত হই। সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত হোক, শান্তি নিশ্চিত হোক। সবাইকেই কাজ, খাদ্য, পানি ও লবণের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

সবাই জানবেন, প্রত্যেকের পূর্ণ বিকাশের জন্য আপনাদের সবারই দেহ-মন-আত্মার মুক্তির নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। কখনো নয়, আর কখনো নয়, এই সুন্দর দেশের কোনো মানুষ আর কখনো অন্য কারও দ্বারা নির্যাতিত হবে না, বিশ্বের নোংরা মানুষ বলে কারও দ্বারাই অপমানিত হবে না। স্বাধীনতাই হবে আমাদের শাসক। এমন গৌরবমযয় মানবিক অর্জন কখনো সূর্যাস্তের আঁধারে হারাতে পারে না।

আমাকে আমার সফলতার দ্বারা বিচার করো না। আমাকে বিবেচনা করো কতবার ব্যর্থ হয়েও তা সমর্থন করে পুনরায় শুরু করেছি। ঘৃণার কারণে মন অন্ধকার হয়ে যায়, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি কাজ করে না।

নেতা হতে হলে তুমি ঘৃণা করতে পারবে না।  দেরীতে হবে কিন্তু ঠিকই হবে, তুমি যা চাও তাই হবে। মনে রেখো তোমার সময়টা খারাপ তোমার জীবন নয়। তুমি অপেক্ষা করো সময় সবকিছু ফিরিয়ে দিবে।’

‘দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ, তারা আজ স্বীকার করে নিয়েছেন যে বর্ণবাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন আমি দেখি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। এটা এমন এক আদর্শ, যেটির আশায় আমি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু যদি দরকার হয়, এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।

কোনো মহান ব্যক্তি হিসেবে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছি আপনাদের একজন বিনীত সেবক হিসেবে। আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে। ’

নেলসন ম্যান্ডেলার কর্মজীবন

নেলসন ম্যান্ডেলা যখন খবর পান বাড়িতে তাঁর বিয়ের তোড়জোড় চলছে, তখন পালিয়ে নাইটগার্ডের চাকরি নেন। পরে আইনের পড়াশোনা শেষ করে, আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করেন। এরই মধ্যে আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি, যোগ দেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি)।

নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরদার করতে শুরু করেন ১৯৫২ সাল থেকে।  বর্ণবাদী আইনের শিকার ব্যক্তিদের স্বল্পমূল্যে আইনি সহায়তা দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইন পরামর্শ কেন্দ্র খোলেন।  ১৯৫৫ সাল থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার নিয়ে লোকজনকে বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করতে থাকেন ম্যান্ডেলা।

নেলসন ম্যান্ডেলা সহ আরও ১৫৫ জন আন্দোলনকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ডিসেম্বর ৫, ১৯৫৬তে গ্রেফতার করা হয়। যদিও ১৯৬১ সালে সকলে ছাড়া পেয়ে যান, ততদিনে অন্তর্কলহে দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে ম্যান্ডেলার দল। নতুন একটি দল তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দুই দলকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বর্ণবাদী সরকার। ম্যান্ডেলা বুঝতে পারেন, এবার ঘোড়ার চাল দেবার পালা।

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬১ সালে স্পিয়ার অফ দ্য নেশন নামে এএনসির নতুন একটি সশস্ত্র অংশের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। এই সময় তিনি বেআইনিভাবে দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন। ইথিওপিয়ায় আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতাদের এক সম্মেলনে অংশ নেয়। আলজেরিয়ার পৌঁছে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণও শেষ করেন।

নেলসন ম্যান্ডেলা দেশে ফেরার কিছু পরেই ১৯৬২ সালের পাঁচ আগস্ট, বেআইনিভাবে দেশ ছাড়া ও ১৯৬১ এর শ্রমিক অসন্তোষ উস্কে দেবার অভিযোগে গ্রেফতার হন। ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে  সশস্ত্র ষড়যন্ত্রেরর অভিযোগ আনা হয়। প্রমাণ ও হয়, অল্পের জন্য ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই পান তাঁরা। ম্যান্ডেলা ও তাঁর সঙ্গীদের রিভোনিয়া ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ম্যান্ডেলার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়

ম্যান্ডেলার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। ছিলেন রাখাল, মিশনবয়, খনি পুলিশ, ল ফার্মের কেরানি, মুষ্টিযোদ্ধা, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, গেরিলাযোদ্ধা, বিপ্লবীনেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক। বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ম্যান্ডেলা অলিভার ট্যাম্বো ও ওয়াল্টার সিসুলুকে নিয়ে এএনসির যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

যুবসমাজকে বর্ণবাদী আইন অমান্য ও স্বেচ্ছা কারাবরণে উদ্বুদ্ধ করে চলমান আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে দেশজুড়ে কর্মীদের সংগঠিত করেছেন, ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করে আফ্রিকার নানান দেশ সফর করেছেন। ওই সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে এএনসির জন্য সমর্থন, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করেছেন।

যৌবনে নেহেরুর আদর্শে প্রভাবিত

যৌবনে নেহেরুর আদর্শ তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রায়ই তিনি নেহেরুকে উদ্ধৃত করে বক্তৃতা শেষ করতেন, ‘স্বাধীনতার সোজাসাপটা কোনো পথ নেই। আপনারা দেখেছেন, পৃথিবীর কোথাও সহজভাবে স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। পাহাড়ের শীর্ষদেশে আরোহণের আগে আমাদের বারবার ছায়ামৃত্যু উপত্যকার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।’

সোয়েটো হত্যাকাণ্ডের পর জেল থেকে তিনি সহযোদ্ধাদের কাছে মর্মে বার্তা পাঠান যে ‘যারা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা আকঁড়ে থাকতে চায়, তাদেরকে অস্ত্র দিয়েই বিতাড়ন করতে হবে।’

গান্ধীবাদে উদ্বুদ্ধ ম্যান্ডেলা

পরিণত বয়সে আমরা ম্যান্ডেলাকে গান্ধীবাদে উদ্বুদ্ধ হতে দেখি। বন্দিজীবনে বর্ণবাদী সরকারের মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তারা তাঁকে অসংখ্যবার শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেন।

কিন্তু প্রতিবারই তিনি সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি লড়াই করবেন। তাঁর এ দৃঢ়চেতা মনোভাব তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত করে।

ম্যান্ডেলা তাঁর সম্মোহনী শক্তি দিয়ে গোটা জাতিকে অহিংসা ও ক্ষমার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করলেন। এতে তিনি বর্ণবৈষম্য একেবারে মুছে দিতে না পারলেও কালো-শ্বেতাঙ্গদের সহাবস্থানের অনন্য এক নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না।

তরুণ বিপ্লবী নেলসন ম্যান্ডেলা

তরুণ বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা চলে আসেন জোহানেসবার্গে, সেখানে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে।

একই সঙ্গে তিনি কাজ শুরু করেন একজন আইনজীবী হিসেবেও। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অলিভার টাম্বোর সঙ্গে মিলে তিনি তার অফিস খোলেন জোহানেসবার্গে।

১৯৬০ সালে শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন নিহত হলে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আদৌ আর লাভ হবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

এসময় এক বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, সরকার যখন নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধবিহীন মানুষের ওপর পাশবিক আক্রমণ চালাচ্ছে, তখন সরকারের সঙ্গে শান্তি এবং আলোচনার কথা বলা নিস্ফল।

এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নেলসন ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করা হয়, বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়। শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে তাঁর দীর্ঘ কারাজীবন।

নেলসন ম্যান্ডেলা জেলে ছিলেন ২৭ বছর। তাঁর ১৮ বছর কেটেছে রবেন জেলে। কেপ টাউনের একটু দূরে কুষ্ঠ রোগীদের কলোনি ছিল সেটা একসময়। শুধু স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে দেখার অনুমতি ছিল তাঁর। তাও ছমাসে একবার। এর মাঝেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের স্নাতক ডিগ্রি পেয়ে যান। নিজের আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম এর ছদ্মবেশে রাজনৈতিক ইশতেহারও বাইরে পাঠান তিনি। ১৯৮২ সালে ম্যান্ডেলাকে মূল ভূখণ্ডের পলসমুর জেলে নিয়ে আসা হয়।

দুঃখ দুর্দশার বন্দিজীবনে ম্যান্ডেলা

১৯৬৪ থেকে ১৯৮২, আঠেরো বছর ধরে রবেন আইল্যান্ড কারাগারের আট বাই সাত-এর সঙ্কীর্ণ কুঠুরিই ছিল ম্যান্ডেলার স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলা ছিলেন ৪৬৬ নম্বর বন্দি। আঠেরো বছর ধরে তাঁর কোড ছিল ৪৬৬/৬৪।  বাকি ন’বছরে কখনও তিনি ছিলেন কুখ্যাত পলসমুর জেলে, কখনও বা ভিক্টর ভারস্টার কারাগারে।

ছোট্ট কুঠুরিতে শয্যা বলতে ছিল খড়ের মাদুর। সারা দিন চলত হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দিনে তেরো ঘণ্টা শ্রম দিতে হত। কখনও পাথর ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে রাস্তা নির্মাণে, কখনও চুনাপাথরের খনিতে। খনিতে কাজ করতে করতে ম্যান্ডেলার দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ কর্তৃপক্ষ তাঁকে রোদচশমা ব্যবহার করতে দেয়নি।

প্রথম দিকে ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘ডি’-শ্রেণির বন্দির তকমা দিয়েছিল। ছ’মাসে একটা চিঠি আর এক জন মাত্র ভিজ়িটরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল। কারণ ১৯৬২ সালে রিভোনিয়া ট্রায়ালের রায়ে, নেলসন ম্যান্ডেলাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বহু লড়াইয়ের পর তাঁকে ‘এ’-শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেওয়া হয়।

এমনকি ১৯৬৮ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু এবং বড় ছেলের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁদের শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।

২৭ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পান ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা এবং এএনসির শীর্ষ নেতাদের কারাবন্দী করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ টাউনশীপগুলোতে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াই অব্যাহত থাকে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শত শত কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ। নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে থাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লু  ডি ক্লার্ক এএনসির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। তিনি নিজের দলের রক্ষণশীল অংশের সাথে গাঁটছড়া ভেঙ্গে, এক বর্ণবাদবিহীন আফ্রিকার স্বপ্ন দেখান জাতিকে।  শেষ পর্যন্ত তিনি মুক্তি পান ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী, দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর।

সেদিন কারাগারের সামনে দেয়া বক্তৃতায় নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই কথা, যা তিনি তাঁর বিচারের সময় আদালতে বলেছিলেন। ম্যান্ডেলা বলেন, এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে এক সঙ্গে থাকতে পারবে। “এটা এমন এক আদর্শ, যেটির আশায় আমি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু যদি দরকার হয়, এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।”

পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন আফ্রিকা গড়ার কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তার সাবেক শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শুরু হলো এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পথ চলা। মুক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের সঙ্গে নতুন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু হয়, যেখানে সব বর্ণ এবং সব জাতির সমানাধিকার থাকবে। এর পথ ধরেই ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা।

ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত জীবন

রাজনৈতিক জীবনের মতো, নেলসন ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। ১৯৯৪ সালে তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেসকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। দ্বিতীয় স্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা উইনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটি ছিল তার জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তগুলোর একটি। ৮০ তম জন্মদিবসে তিনি তৃতীয়বার বিয়ে করেন মোজাম্বিকের সাবেক ফার্স্ট লেডি গ্রাসা মার্শেলকে।

ম্যান্ডেলার উত্তরাধিকার

অবসরে যাওয়ার পরও নেলসন ম্যান্ডেলার ব্যস্ততা থামেনি, স্বাধীনতা এবং বিশ্ব শান্তির এক আইকন বা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি, সুতরাং তাঁর ডাক পড়তে থাকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে।

তাঁর এক ছেলে মারা গিয়েছিলেন এইডসে। এ ঘটনার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে সোচ্চার হন। বাকী জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দারিদ্র দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।

নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাকে কিভাবে মনে রাখলে খুশী হবেন তিনি?  তাঁর উত্তর ছিল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে।”

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী

বর্ণবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সালের ১০ই মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মাত্র এক দশক আগেও সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ছিল এক অকল্পনীয় ঘটনা।

এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৩ সালে ডিসেম্বর তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা

১৯৯৪ সালে ভোটকেন্দ্রে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের ঢল নামে। নেলসন ম্যান্ডেলাকে তাঁরা তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন।  নেলসন ম্যান্ডেলা ১০ মে ১৯৯৪ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ।

তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন সংবিধান আসে। কেন্দ্রীয় সরকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ছিল এই সংবিধানের মূল কথা। একই সাথে ছিল, দুর্বলের ওপর অত্যাচার করা যাবেনা, চামড়ার রঙ সাদা বা কালো যাই হোক না কেন।

ম্যান্ডেলার সহাবস্থানের নীতি

ম্যান্ডেলার সহাবস্থানের নীতিকে খোদ এএনসির অনেক নেতাই মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু ম্যান্ডেলা দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছেন। তাই আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো ‘শ্বেতাঙ্গ খেদাও’ আন্দোলনে তিনি যাননি।

এমনিতেই দক্ষিণ আফ্রিকা সন্ত্রাস ও দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট, তার ওপর দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা। ফলে সংগত কারণেই ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গদের তাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিতে ধস নামার ঝুঁকি নিতে চাননি। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ খেদাও আন্দোলনে গিয়ে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকেও চটাতে চাননি।

১৯৯৪ সালের নির্বাচনে এএনসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও জাতীয় সংহতির স্বার্থে তিনি পরস্পরবিরোধী প্রতিপক্ষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বশেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পি ডব্লিউ বোথাকে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট করলেন। কট্টর শ্বেতাঙ্গবিরোধী এবং দাঙ্গাবাজ জুলুনেতা মনগোসুথু বুথেলজিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন।

সবার কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন ম্যান্ডেলা

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, ম্যান্ডেলা যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন দেশের ক্ষমতা হাতছাড়া করবেন না। কিন্তু তিনি এ ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে প্রার্থীই হলেন না।

ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে যে জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে অনেক নেতাই পরবর্তীকালে স্বেচ্ছাচারী একনায়কে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু ম্যান্ডেলা ছিলেন ব্যতিক্রম। মাহাত্মা গান্ধীর পর সম্ভবত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে ক্ষমতার ক্লেদ স্পর্শ করতে পারেনি।

আর তাই ম্যান্ডেলা তাঁর দেশের সীমা ছাড়িয়ে সবার কাছে এক আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন। যে আদর্শ বিশ্ববাসীকে ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি নির্মোহ থাকতে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদরেখামুক্ত এক মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে।

বাংলাদেশে এসে ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালের ২৫শে মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেটাই ছিল বাংলাদেশে তার প্রথম এবং শেষ সফর। তিনদিনের সেই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি ছিলেন ঢাকায় তখনকার হোটেল শেরাটনে, যা এখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল নাম নিয়েছে।

তিনি বলেছিলেন, ”স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অনেক মিল রয়েছে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, বাংলাদেশের মানুষকেও একসময় এরকম সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটি দূরের দেশ হওয়ার সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে আপনারা যে সমর্থন দিয়েছেন, সেজন্য আপনাদের প্রতি আমি তাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।”

ম্যান্ডেলা ছিলেন অনন্য

ম্যান্ডেলা এমন এক ব্যক্তি, যিনি দেশমাতৃকার জন্য জীবনের ২৭টি বছর অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন, বর্ণবাদী সরকারের নানা প্রলোভন সত্ত্বেও যিনি নীতি ও আদর্শে অবিচল থেকেছেন, ক্ষমতার মোহ যাকে বিন্দুমাত্র প্রলুব্ধ করতে পারেনি

নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু

ম্যান্ডেলার দেহে ২০০১ সালে প্রস্টেট ক্যান্সার সহ আরো রোগ ধরা পড়ে। তাঁর সম্মানে ২০০৯ সালে ১৮ জুলাই কে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা ইন্টারন্যাশনাল ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি এবং মানবাধিকারে প্রচুর অবদান রাখায় এই সম্মান।

নেলসন ম্যান্ডেলা  ফুসফুসের সংক্রমণে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ভক্তকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এ কিংবদন্তী। এ সময় তার বয়স ছিল ৯৫।

তথ্যসূত্র

আনন্দবাজার

বিবিসি বাংলা

যুগান্তর

প্রথম আলো

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *