সংগঠক দুর্বল হলে সংগঠন শক্তিশালী হয় না। ব্যক্তিগত যোগ্যতার অভাব তথা ব্যক্তিগত পর্যায়ের অক্ষমতা ও অসহায়তা সামষ্টিক উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেয়। অক্ষমতা আনে ব্যর্থতা আর ব্যর্থ মানুষ পরশ্রীকাতর হয়। আলসেমি ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে চাকরি করা গেলেও মানুষকে পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়া যায় না।
সংগঠক যদি সততা দিয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে পারে তবে সেই সংগঠনের ভিত্তি শক্তিশালী হয়। বক্তৃতা দিয়ে বা লেখালেখি করে মানুষকে উৎসাহিত ও উজ্জিবিত করার চেয়ে সংগঠন নির্মাণ বেশি কঠিন কাজ। আত্মসমালোচনার চেয়ে পরের সমালোচনা আর ইতিবাচকতার চেয়ে নেতিবাচকতার প্রবণতা বেশি থাকায় যৌথ প্রয়াস এগিয়ে নেয়া মোটেই সহজ নয়।
একা একা কাজ করার চেয়ে যত বেশি মানুষের যুক্ততায় কাজ হবে তার পরিমাণগত সীমানা ততবেশি বিস্তৃত হবে। সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণ ও আত্মঘাতী প্রবণতা সমষ্টিগত স্বার্থবুদ্ধির তুলনায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর আত্মসর্বস্বতাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে।
সাধারণত আত্মসার্থের প্রবণতা ও আত্মপরতার সামনে সামষ্টিক কল্যাণ বা সমষ্টিগত সমৃদ্ধি গৌণ হয়ে যায়। এর ফলাফল দাড়ায়- যে যেখানে যাকে কায়দামতো পান তার কাছ থেকে কিছু আদায়ের ধান্ধায় থাকেন। অন্যের দোষ ত্রুটি নিয়ে আলাপচারিতায় নির্বীজ মেরুমজ্জাহীন মানুষগুলো যতটা ক্লান্তিহীন, নিজের উন্নয়ন ও বিকাশের প্রচেষ্টায় ততটাই অবসাদগ্রস্ত। অন্যের ব্যাপারে ক্ষমাহীনতা আর নিজের ব্যাপারে ক্ষমাশীলতা সম্পন্নরা দল গঠনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
অধিকাংশ মানুষই অহমিকা ও অহংকারের কারণে কোনোসময় নিজেকে অন্যের চেয়ে কম ভাবতে পারে না। ফলে দেখা যায় নিজেকে তুলনামূলক বিচারে অনেক উঁচু জায়গার মানুষের চেয়েও বড় মনে করছে, একজন দিনমজুরও প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকেও তার চেয়ে নির্বোধ ভাবছে। ভীরুতা, হীনমন্যতাবোধ ও নিজেকে যথাযথভাবে বিচার করতে পারার অক্ষমতার কারণে বাড়াবাড়ি রকমের এই আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। যে দেশে রিক্সাচালকও মন্ত্রীর কান্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়ে না, সেই দেশে পাবলিক প্লেসে ব্যক্তির চরম অসচেতনতাজনিত বিরক্তিকর ঘটনার ব্যাপকতা হাস্যকর নয়কি। মূলত আত্মপ্রাপ্তির লাগামহীন লিপ্সায় কামান্ধ ও আপোষহীন মনোভাব সম্পন্ন হবার কারণেই নিজেকে অন্য কারো চেয়ে কোনো অংশে ছোট ভাবতে পারে না।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সংগঠন ও বাঙালি নামক বইয়ে লিখেছেন, ‘আমরা মুখে মুখে বলছি ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে রাষ্ট্র বড়। কিন্তু কাজের সময় দেখতে পাচ্ছি রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়।একা বাঙালি দেবতা, কিন্তু একসঙ্গে হলে তারা অমানুষ। বুদ্ধি আমাদের কারো চেয়ে কম নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যে, কর্মিষ্ঠতায়, উদ্যোগে, উদ্যমে আমরা তাদের চাইতে অনেক নিচে। কর্মোদ্যোগের অভাবে আমাদের সব উদ্যম, সপারগতা, বুদ্ধিমত্তা সামাজিক স্বার্থরক্ষার বদলে ব্যবহৃত হতে থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার ছোট্ট কুঠুরিটুকুর জন্য।
ব্যক্তিগত স্বার্থ হাতিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বুদ্ধি যে পরিমাণ টনটনে, সামাজিক স্বার্থের বেলায় তা ঠিক সে পরিমাণেই ভোঁতা। আত্মঘাতী ও নেতিবাচক মানুষটি অন্যের যাবতীয় সাফল্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিজেকে পৃথিবীব্যাপী ব্যর্থতার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে।যে মানুষ কোনো কাজ করে না, যার কোনো সাফল্য নেই, গৌরব নেই, পরনিন্দা না করে নিজের অস্তিত্বকে অন্যের কাছে সপ্রমাণ বা অনুভব করার আর কী উপায় তার?’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আরও লিখেছেন, (ভিনদেশে) দশজন মানুষ যদি একটা সংগঠন তৈরি করে তখন সেখানে থাকে চারটি দল। প্রথম দলে থাকে তিনজন। এরা সুইসাইডার; সংশপ্তক। সংগঠনের আদর্শের জন্য এরা জন্মান্ধের মতো প্রাণ দেয়। পরের দলে থাকে আরও তিনজন। প্রথম তিনজনকে প্রাণ দিতে দেখলে এরাও প্রাণ দিয়ে বসে। যদিও এর পরের দলে থাকে দুজন। এরা মাঝারি ক্ষমতার মানুষ; দ্বিধাগ্রস্ত। সবাই সামনের দিকে যাচ্ছে দেখলে তারাও সামনে যাবার কথা ভাবে। শেষ দলে থাকে দুজন। এরা সমালোচক, ক্রিটিক। এরা কিছু করে না, শুধু বসে বসে লেজ নাড়ে আর কথা কয়: ‘ভালো হত আরও ভালো হলে’।
কিন্তু আমাদের দেশে দলের সংখ্যা থাকে পাঁচটি।এই পঞ্চমটিই আমাদের সংগঠনের মূল আততায়ী। আমাদের জাতিগত অক্ষমতা, অসহায়তা, হীনমন্যতা এবং অমানবিক জীবন-পরিস্থিতির ভেতর থেকে জন্ম নিয়ে, জাতির প্রতিটা উদ্যমকে পেছন থেকে ছুরি মেরে মাটিতে শুইয়ে দেবার জন্যে এরা সবার আড়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
এসব নানান কারণে এদেশে অনেক সংগঠন উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ শুরু করলেও টেকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।
সাইরাস বলেছিলেন-অন্যকে বারবার ক্ষমা কর কিন্তু নিজেকে কখনোই ক্ষমা করিও না। যদিও অনেকেই ঠিক এর উল্টো কাজটা করে অর্থাৎ নিজেকে বারবার ক্ষমা করে কিন্তু অন্যকে একবারের জন্যও ক্ষমা করে না। অন্যের সমালোচনা করতে যেয়ে বা অন্যকে মূল্যায়ন করতে যেয়ে অনেকে ভুলেই যান- সেও একজন মানুষ, তারও আবেগ আছে, বিহ্বলতা আছে, দুঃখ আছে, উচ্ছলতা আছে, হর্ষ আছে, বিক্ষুব্ধতা আছে, চাঞ্চল্যও আছে- সবকিছু মিলিয়েই তিনি মানুষ। অথচ নিজের ক্ষেত্রে বিবেচনা ঠিক উল্টো।
সঠিক পন্থা হচ্ছে- অন্যের কাছে যা প্রত্যাশা করা হয়, নিজেকে অন্যের কাছে সেভাবেই উপস্থাপন করা। তা না করার কারণেই আমাদের দেশে সবচেয়ে সাপ্লাই বেশি পরামর্শের আর সবচেয়ে ডিমান্ড কমও পরামর্শের। প্রয়োজন নেই উৎসাহী সমালোচকের, দরকার উত্তম আত্মসমালোচনাকারীর। না হলে প্রয়োজনেও সংগঠন গড়ে তোলা মোটেই সহজ হবে না।