উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ বাকি প্রাণীদের থেকে আলাদা৷ তবে মস্তিষ্ককে ব্যবহারের ভিন্নতার কারণে কেউ হয় ফেরশতা তুল্য আর কেউ হয় শয়তান তুল্য। আকারে মানুষ হলেই সে মানুষ হয় না, মানুষকে চেষ্টা-সাধনা করে মানুষ হতে হয়!
যেসব মানুষ পাশবিকতা লালন করে, পশুর মতো আচরণ করে তারা মানুষও না, পশুও না; পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীব! কিছু মানুষ সারা জীবন বিনিময় ছাড়াই দিয়ে যায়, আর কিছু মানুষ সারা জীবন বিনিময় ছাড়াই নিয়ে যায়।
আবার এমন কিছু মানুষ আছে যারা শুধু নামেই মানুষ নয়, কাজেও মানুষ। এমন মানুষ যে শুধু অতীতে ছিল, বর্তমানে মোটেই নেই এমনটি নয়! যদি প্রকৃত মানুষ একেবারে নাই থাকতো তাহলে তো কিয়ামতই হয়ে যেত! আমাদের আশপাশে-চারপাশেও এমন অনেকে রয়েছে খুব গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা আসল মানুষ, খাঁটি মানুষ!
দৃশ্যপট : ১
বাসায় আমন্ত্রিত মেহমানরা। তাদের মধ্যে আছে সাতজন শ্রমিক। কেউ কেউ ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত হলেও তাদের চোখ-মুখে আনন্দের ঝিলিক। ইতোপূর্বে তারা আরো অনেকের বাসা পাল্টানোর কাজেই কায়িকশ্রম দিয়েছেন। কিন্তু কখনো পারিশ্রমিকের বাইরে এমনভাবে আমন্ত্রিত বা নিমন্ত্রিত হননি।
দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে। নীচে ভিক্ষুকের কাতর কণ্ঠ ভেসে এলো। দু’তালার বারান্দা থেকে ডাকলেন তাকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে আসলেন তিনি। বাসায় পৌঁছলে ভিক্ষুককেও অন্যদের মতোই সমাদর করা হলো। তিনি খুবই তৃপ্তি সহকারে খেলেন। সবার সাথে মর্যাদা ও সম্মানের সমতা তাকে অবাক করলো।
ভিক্ষুকও মন- প্রাণ খুলে আন্তরিক যত্ন-আত্তির জন্য দোয়া করলেন। সবার সাথে কথা-বার্তা বললেন। কোনো শ্রমিক বা ভিক্ষুক যদি সমাজের সম্মানজনক আরো পেশার মানুষজনের সাথে একই মাত্রার আতিথেয়তা লাভ করেন, তাহলে তারা দারুণভাবে অভিভূত হন; তাদের মধ্যে দেখা যায় মুগ্ধতা।
দৃশ্যপট : ২
অফিস শিফট হয়েছে! নতুন অফিসে এলেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তি! দেখলেন পিয়ন অফিস গোছানো ও পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত! সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি হয়েও তিনি ঝাড়ু হাতে নিলেন। ইউরোপের দু’টি দেশে পড়াশোনা করে আসা ব্যারিস্টারের এই মানসিকতা অন্যদেরকেও চমৎকৃত করলো!
দৃশ্যপট : ৩
মানিব্যাগে সবসময় চকচকে নতুন ১০ টাকা ও ২০ টাকার নোট রাখেন। গাড়িতে রাখেন ১০ টাকা ও ২০ টাকার নোটের বান্ডিল। এর পেছনের কারণ- কোনো ভিক্ষুককেই তিনি খালি হাতে ফেরাতে রাজি নন, আর ছেঁড়াফাটা টাকা দান করাও তার পছন্দ নয়। সেজন্যই এই ব্যবস্থা!
দৃশ্যপট : ৪
মানিকনগর থেকে গন্তব্য মিরপুর। মিরপুর ১০ এ একজন অপেক্ষা করছে। দ্রুত যেতে হবে। সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাড়ার চেষ্টা হলো। অতিরিক্ত ভাড়া দিতে আপত্তি নেই যাত্রীর। তবে অটোরিকশার চালকরা কমন একটি কথা বলছে, পুলিশ ধরলে বলতে হবে মিটারে এসেছি।
মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া ইচ্ছেমত আদায় করলেও যেতে যাত্রী রাজি, তবে মিটারে না গিয়ে মিটারে এসেছি বলতে রাজি নয়। অর্থাৎ কোনোভাবেই কৌশলেও মিথ্যা বলবেন না তিনি। প্রায় ৭/৮টি সিএনজি একই শর্ত দিলে রিকশায় মতিঝিল গেলেন; তারপর বাসে মিরপুর!
দৃশ্যপট : ৫
প্রতি সপ্তাহে বাবা-মাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে যান। ঢাকায় অনেক দায়িত্ব, ব্যবসায়িক ব্যস্ততা ও নিজ পরিবারকে সময়দান তাকে বাবা-মাকে নিয়মিত দেখতে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে না।
বাবা-মায়ের খেদমত করা, সেবা-যত্ন করা, সদ্ব্যবহার করা ও অধিকার পূরণ করায় নিবেদিতপ্রাণ এক সন্তান। বাবা-মাকে খুশি করা, সুখী করা ও সুস্থ রাখতে সন্তানের এমন পেরেশানি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দরতম দৃশ্য!
দৃশ্যপট : ৬
ছিলেন সরকারের সচিব। সফল উদ্যোক্তা। রহমদিল ও সচেতন মানুষ। পরিবারের কথা সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চান। যেকোনো সমস্যা হলেই তার কাছে চলে যাওয়া যায়।
ব্যক্তিজীবন সাধারণ গরীব মানুষের মতো। খুবই সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। সাধারণ খাবার খান। ব্যবহার অমায়িক। বড় পদে থাকার পরও রুম খোলা থাকে এবং লোকজন অবাধে যাতায়াত করে। কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই সোজা ঢুকে যাওয়া যায়।
বৈধ স্বার্থও উপেক্ষা করেন। ইমেইল এড্রেস নেন এবং নিজের লেখাগুলো পাঠান। বই উপহার দেন। অনেক লেখা ফটোকপি করে বিলান। কাজকে ফেলে রাখেন না। যখনকার কাজ তখনই করে ফেলার তাগিদ তীব্র। সময়ানুবর্তীতা খুব বেশি।
অন্যদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বুনে দেন। বারুদ জ্বালিয়ে দেন। বাসায় অতিথি আপ্যায়নে চানাচুর-মুড়িও দেন। ভালো আইটেমে আপ্যায়ন করানোর অসামর্থ্যে দুঃখও প্রকাশ করেন। সিঁড়ি ও লিফট পর্যন্ত মেহমানকে এগিয়েও দেন।
দৃশ্যপট : ৭
ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নিজে কাজ করতে ভালোবাসেন, অন্যকেও কাজ করতে উৎসাহিত করেন। নিজে কাজপাগল থেকে অন্যকে কর্মঠ হতে শিখান। সহজ-সরলভাবে নিজের জীবনের ঘটনা বর্ণনা করেন। উত্তম পরামর্শ দেন, কথার মাধ্যমে ভেতরের শক্তিকে নাড়ায়ে দেন।
পজেটিভ বলেন ও শুনেন। বলেন- জীবন মানে কাজ, কাজ আর কাজ। আপনি কাজ ভালোবাসলে লোক আপনাকে স্যালুট করবে আর কাজে ফাঁকি দিলে অন্যকে স্যালুট করতে করতেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
দেখা হলে সুযোগ পেলেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে খোঁজখবর নেন। যেকোনো মিটিংয়ে যথাসময়ে হাজির হন। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। কিভাবে বাথরুমে বসেও সময়কে অবহেলা না করে পড়া যায়, জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে দুটো ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করা যায়- তা বলেন।
তার কাছে সব রকমের বেদনার কথা বলা যায় এবং তিনি মন দিয়ে শুনেন। তিনি অফিসে রুমের দরজা কখনো বন্ধ করেন না। কারণ দরজা খোলা রাখলে যে কেউ আসতে পারে।
বাড়ি না করে প্রতিষ্ঠান করলে বেশি সওয়াব বলে বিশ্বাস করেন। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েন; কাউকে উপযুক্ত মনে করলে তাকে নিজ থেকে প্রস্তাব দিয়ে নিয়ে আসেন। অপরিচিত হলেও সহযোগিতা করেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্ধ্বে মনে করেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। সময়ের কাজ সময়ে করেন। নিরবে কাজ করতে পছন্দ করেন। নিজেকে ফোকাস করেন না। নেতিবাচকতার চর্চা করেন না।
কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা, একসাথে অনেক কাজ করার যোগ্যতা অর্জনের কথা বলেন। নির্মোহ নির্লোভ জীবন যাপন করেন।
ঘরে কোনো টেলিভিশন নেই। নেই কোনো রেফ্রিজারেটর! ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও খুবই সাদাসিধে। পোশাকও খুবই কম দামি। নিজের সামান্য ভুলও স্বীকার করতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
দৃশ্যপট : ৮
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শিক্ষার্থীদের আপনি সম্বোধন করেন। বহু বছর পর সাক্ষাতেও নাম ধরে ডাকেন। শিক্ষার্থীর প্রয়োজন যার কাছে সবার আগে। নিজের লেখা বই উপহার দেন। লিখতে ও চিন্তা করতে উৎসাহিত করেন। চিন্তা-ভাবনার নতুন খোড়াক যোগান। ক্লাসে পড়ানোর বাইরেও লেখালেখি, গবেষণা, বক্তৃতায় নিয়োজিত থাকেন।
চমৎকার তার বলার ক্ষমতা। কথার মধ্য দিয়ে চিন্তার নতুন নতুন দিগন্তে নিয়ে যান। ‘চিন্তার বন্ধ্যাত্ব’ ও ‘মানসিক দাসত্ব’ তৈরির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। নিজের ভিতরকার উৎসাহটাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করার অদ্ভূত ক্ষমতার কারণে তিনি খুবই ব্যতিক্রম। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে চিন্তার জগতের গভীরতম স্থানে নিয়ে যেতে পারেন।
ইমেইলের জবাব দিতে দেরী হলে শিক্ষার্থীর কাছেও দুঃখ প্রকাশ করার মতো তিনি উদার। শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে সুপারিশ পত্র লিখে প্রিন্ট করে স্বাক্ষর দিয়ে ইনভেলাপে ভরে শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর মতো বড় হৃদয়ের অধিকারী। একদম ছকবাঁধা গতানুগতিক চিন্তা তার অপছন্দ।