আল্লাহর দেয়া শাশ্বত জীবন-বিধানের সার্থক রূপায়ন রাসূল সা.। তিনি ছিলেন মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি সর্বকালের সেরা রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, দক্ষ প্রশাসক ও ন্যায় বিচারক। তিনি শুধু নামাজ-রোজা বিয়ে-শাদীর জন্যই আদর্শ নন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যও ওয়াশিংটন, ল্যাস্কি, লক, হিউম, জেফারসান এর চেয়ে সেরা আদর্শ। অর্থনীতির জন্য পাগলাটে ও বাস্তব জীবন বিচ্ছিন্ন কার্ল মার্কস এবং নির্বিচার বৈভব বিলাসী ও নির্বিবেক নারী নিপীড়ক মাও সেতুং এর চেয়ে অনেক উত্তম আদর্শ। তিনি বুদ্ধ, যীশুখ্রিষ্ট বা মহাবীরের চেয়েও অগ্রসর ধর্ম প্রচারক।
এতো এতো আদর্শের মধ্যে সর্বোত্তম মহানবী সা.। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম, অসাধারণ ও অনন্য মহামানব। গ্রীকদের আদর্শ প্লেটো-এরিস্টটল। বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন আত্মসংযমে অক্ষম ও রিরংসু। স্ত্রীর কাছে অতিশয় নগণ্য ও উপেক্ষার যোগ্য আব্রাহাম লিংকন মার্কিনীদের আদর্শ। সাম্যবাদীদের আদর্শ নরহত্যায় সেরা নিষ্ঠুর লেনিন। কবিদের আদর্শ গ্যেটে-রবীন্দ্রনাথ-শেক্সপীয়ার। ক্লিওপেট্রার মোহিনী শরবর্ষণে ধরাশায়ী রোমানদের আদর্শ আত্মজয়ে অক্ষম বীর জুলিয়াস সিজার। কূটনৈতিক আদর্শ মিথ্যাচারে বিশ্ব ওস্তাদ চার্চিল। রাসূলই সা. একমাত্র ত্রুটিমুক্ত ব্যক্তিত্ব যার জীবনে বিতর্কিত বা প্রশ্নবিদ্ধ কিছু নেই।
মহাত্মা গান্ধী মৃত্যুপথযাত্রী জননীকে ফেলে অন্য কক্ষে সস্ত্রীক নিশিযাপনের তুচ্ছ আরামটুকু পরিহার করতে পারেননি। আইনস্টাইনের ছিল দায়িত্বহীনতা, আপন খেয়ালের হাতে স্বেচ্ছাসমর্পিত। গ্যেটে ছিলেন পদ-লিপ্সু ও রাজশক্তি কেন্দ্রের নিকটবর্তী থাকায় চেষ্টারত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুবই প্রচারব্যগ্র ও প্রজাপীড়ক। কলম্বাস ছিলেন মিথ্যাবাদী ও লোভী। কনফুসিয়াস ছিলেন চীনা সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বুদ্ধদেবের জীবনের রূঢ়তা থেকে পলায়নপরতা ছিল। সন্ত পল ছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে চতুর। এমনভাবে রাসূল সা. ছাড়া কেউই আসলে শতভাগ নিখুঁত নয়। তাইতো আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাসূল সা. এর আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।
নিবন্ধের শিরোনাম বিশ্লেষণ
আধুনিক
‘আধুনিক’ শব্দটি তুমুল উচ্চারিত, বহুল ব্যবহৃত, সমাদৃত, বেশ কদর। আধুনিক কথাতো সমধারার পথিকের। আধুনিক কাজতো যুগান্তরের যাত্রীর। আধুনিক চিন্তাচেতনা চলমান সময়ে আধুনিক। আধুনিক কৌশল মানেই সমসাময়িক সেরা কৌশল। আধুনিক কর্মসূচি মানেই সমকালে মানানসই। আধুনিক কর্মপদ্ধতি আগের চেয়ে পরের মানুষের। আধুনিক উপস্থাপনা মানে সময়ের সাথে সামঞ্জস্যের প্রবণতা।
আধুনিক হবার গল্প মানে, অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা। গতকালের তুলনায় আজ আধুনিক। আজকের চেয়ে আগামীকাল আরো আধুনিক। সময় থেকেও এগিয়ে যাবার গল্পকে বলে অতি আধুনিক। কিছুটা জৌলুশময় হলে বলে অত্যাধুনিক। এই আধুনিক, অতি আধুনিক ও অত্যাধুনিক ছাপিয়ে মহা আধুনিক বা সেরা আধুনিক। আধুনিকতায় ‘আমাদের’ হয়ে গেছে- ‘আমার’, ‘আমরা’ হয়ে গেছে ‘আমি’।
আধুনিক মানুষ- ধারণ করে আধুনিকতার উত্তাপ, মাখতে জানে আধুনিকতার রঙ, আরোহণ করে আধুনিকতার উচ্চগ্রাম, মিশে যান আধুনিক স্রোতের। আধুনিক শব্দটি উদ্যম ছড়িয়ে জাগ্রত করে মানুষের ভেতর জগৎ। জীবনযাপন পদ্ধতি আধুনিক। আধুনিক জীবন মানেই- গতির জীবন, ক্রমাগত ছোটার জীবন, নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে ওঠার জীবন, কঠিন প্রতিযোগিতার জীবন, চ্যালেঞ্জের জীবন, ব্যস্ততার জীবন।
আধুনিক বিশ্ব
আধুনিক বিশ্বের নিয়ামক, মূল ভিত্তি ও সহায় প্রযুক্তি। আধুনিক বিশ্ব মানুষকে বিশ্বগ্রাম দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সংয়ংক্রিয় যন্ত্র এসেছে। রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। যোগাযোগের দ্রুততা দিয়েছে। কম্পিউটারের মেমোরি দিয়েছে। চাঁদে, মঙ্গল গ্রহে ও মহাকাশে বেড়েছে মানুষের বিচরণ। দূরের পথকে কাছে এনেছে। পলকে খবর পৌঁছাচ্ছে। নিজের অঙ্গভঙ্গি মুহূর্তে প্রদর্শনের সুযোগ দিয়েছে। সমগ্রতাকে এনেছে হাতের মুঠোয়। একটি ক্ষুদ্র জানালায় বিশ্ব দেখার আয়োজন করে দিয়েছে।
সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির জয়জয়কার। প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে আধুনিক জীবনযাপন ভাবাই যায় না। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সবচেয়ে বড় বিস্ময়। নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। শিল্প-বাণিজ্যনির্ভর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে। শিল্প-উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি-প্রসার-বিস্তার ঘটেছে। পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ হয়েছে।
সমাজে উদার ও যুক্তিশীল চেতনার জন্ম হয়েছে। স্বাধীন জীবনে আকৃষ্টরা যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেছে। কৃষিক্ষেত্রে উন্নত যন্ত্রপাতি ও কৃত্রিম সার প্রয়োগে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। উদ্ভব হয়েছে- মুক্ত ও স্বাধীন কৃষক সমাজের, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, দালাল বা সুবিধাভোগী শ্রেণির, পুঁজিপতি মালিক শ্রেণীর, মুনাফাখোর বুর্জোয়া শ্রেণীর এবং দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণীর। নতুন নতুন শহরের-নগর হয়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হয়েছে। সকলের সমান অধিকারের ভাবনা দেখা গিয়েছে।
আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ
আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- ভোগের তাণ্ডব ও বিলাসিতা বৃদ্ধি। লোভের গতির উন্মত্ততা। একাকিত্বের শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা ও হতাশা। ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাওয়া। সত্যকে বর্জন, সত্যকে হত্যা এবং মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরা। সন্ত্রাস, চরমপন্থা, দুর্নীতি ও অপচয় বৃদ্ধি। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা। অশ্লীলতা-নগ্নতা, পর্নোগ্রাফি, সমকামিতা, বিয়েতে অনাগ্রহ, লিভ টুগেদার, সন্তান নিতে অনিচ্ছা- বৃদ্ধি পাওয়া।
সর্বগ্রাসী সুদভিত্তিক অর্থনীতি। বিদেশে অর্থপাচার, কালো টাকার দৌরাত্ব। মেধা পাচার বৃদ্ধি। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন। ভুয়া সংবাদ বা গুজব ছড়ানো। বৈষম্য বৃদ্ধি। গণতন্ত্র হত্যা আর একনায়কতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র বৃদ্ধি। বিচার বহির্ভূত হত্যা। বিরোধীদের দমন-পীড়ন। বেকারত্ব বৃদ্ধি। দারিদ্রতা বৃদ্ধি। শরণার্থী সমস্যা বৃদ্ধি। অশান্তি-যুদ্ধ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ। মহামারি ও পরিবেশগত বিপর্যয়। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। জ্বালানি তেল সংকট।জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে না পারা।
রাসুল সা. এর পরিচয়
রাসুলের সা. জীবন বিশাল ও বিস্তৃত ব্যাপার। সুপ্রভাতের ফুটন্ত এ আলো ৫৭১ ঈসায়ী সালে মক্কার বনি হাশেমের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা- আব্দুল্লাহ, মাতা- আমিনা, দাদা- আব্দুল মুত্তালিব। অসাধারণ মানুষটির ভালোবাসার উদ্যান ছিল চির সুবজ ও সতেজ। তার হৃদয় ছিল অকৃত্রিম ভালবাসায় ভরপুর; যে অন্তহীন ভালোবাসা অনেক উচুঁ স্তরের, যার সজীবতা কখনো কমেনি।
যার ওষ্টে মৃদু হাসির রেখা দেখা যেত। ছিল- সকল সৌন্দর্যের কেন্দ্রভূমি, দরদ মাখা হৃদয়ের মমত্ববোধ। আলোতে উন্মুক্ত আয়না থেকে প্রতিফলিত উজ্জ্বল আভার মতো। যার মনে ধারণকৃত আলোয় আলোকিত করেছিল জীবনকে, জগতকে। সত্যের সাথে শক্তির সমন্বয় তথা বীরত্ব ও পৌরুষব্যঞ্জক দৃঢ়তার ক্ষেত্রে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। অনন্য অসাধারণ তিনি ছিলেন সকল প্রশংসার অধিকারী, সকল শোভা ও সমৃদ্ধির প্রতিনিধি, স্রষ্টার সকল সৃষ্টির প্রধান, পরিচ্ছন্নতার অনাবিল প্রকাশ।
রাসুলের সা. শারীরিক সৌন্দর্য, মানসিক পূর্ণতা, প্রশংসনীয় চরিত্র, চমৎকার ব্যক্তিত্ব, পরিশীলিত অভ্যাস ও কর্ম তৎপরতা দেখেই তাকে মন উজার করে ভালোবাসার ইচ্ছা জাগতো। তাঁর জীবন, কর্ম ও চরিত্রের যে অতলান্তিক গভীরতা, যেন নক্ষত্রচুম্বী মহিমা। পরিবেশ, পরিস্থিতি, পটভূমিকা, প্রাসঙ্গিক লক্ষণসমূহ ও পরিণতি ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি ছিলেন অতুলনীয় মেধার অধিকারী। তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা ছিল নির্ভূল, তাঁর বিবেকের জাগ্রতাবস্থা ছিল গভীর তাৎপর্যমন্ডিত। যিনি সর্বপ্রকার ত্রুটি ও ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্ত এক সর্বগুণান্বিত, ধারণাতীত সর্বোত্তম সুন্দর মানুষ, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ও উদ্যমী, সর্বোৎকৃষ্ট অন্তরের অধিকারী। তার কথা ও কাজে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য ছিল।
রাসূল সা. এর আদর্শ
রাসূল সা. ছিলেন সর্বশ্রেষ্ট রাষ্ট্রনায়ক। ইসলামি রাজনীতি ও আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে তাঁর যুগান্তকারি পদক্ষেপ বিধর্মিরাও স্বাগত জানিয়েছিল। তাঁর আদর্শ হচ্ছে শান্তি-শৃঙ্খলা-পারস্পরিক সম্প্রীতি-সহানুভূতির পক্ষে। যা পাপ-নির্যাতনমূলক কাজ থেকে বিরত থেকে সৎ-ভালো কাজে সহযোগিতার নির্দেশ দেয়। যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু উত্তম- তাই শিখিয়েছেন তিনি।
মসজিদে ইমামতি, দোয়া-দরুদ ও ওয়াজ নসীহতের মধ্যে তাঁর কর্মসূচি সীমাবদ্ধ নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনও ছিল তাঁর সুন্নত। তাঁর প্রচারিত আদর্শের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য এতটা আকর্ষণীয় যা শতাব্দীর পর শতাব্দী অসুন্দর-অকল্যাণে-অপরাধপ্রবণতা মূলোৎপাটন-প্রতিরোধ করে বিশ্বব্যাপী শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে। জ্ঞান-গবেষণায়, আমলে-আখলাকে, প্রত্যেক সেক্টর পরিচালনা-ব্যস্থাপনায়, সর্বস্তরের নেতৃত্বে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ চর্চার কথা বলে।
রাসূল (সা.) এর আদর্শের অনুসারীরা শান্তিকামী-সুস্থ-সুন্দর-সহজ-সরল ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর আদর্শ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-ক্ষমা-দয়া-মায়া-মমতা-সহনশীলতা-সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। মানুষে মানুষে হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্য স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি-সমৃদ্ধির পৃথিবী গড়ার তাকিদ দেয় এবং মানবতার কথা বলে। যেকোনো সন্ত্রাসী-অশ্লীল-ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড অনৈসলামিক ও অনৈতিক মনে করে।
আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জসমূহ
আধুনিক বিশ্ব নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সব সেক্টরে অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবলে মানবসভ্যতা বিপন্ন। সমকামিতাকে আইন করে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আধুনিক দাসত্বের ফাঁদ দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছে। চরমপন্থা ও উগ্রপন্থা দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও রাজনৈতিক গোলামি দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার, অশ্লীলতা ও অমানবিকতা। সামাজিক সমস্যা ও পরিবেশগত সমস্যা বাড়ছে। মাদকাসক্তি, লিভ টুগেদার ও পর্নোগ্রাফি মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ
আল্লাহ সন্ত্রাসকে ‘ফিতনা’ ও ‘ফ্যাসাদ’ দ্বারা বুঝিয়েছেন। সন্ত্রাস অর্থ- অতিশয় ত্রাস, মহাশঙ্কা, ভয়ের পরিবেশ। কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হলো সন্ত্রাস। আর সন্ত্রাসবাদ সমাজ-রাষ্ট্রবিধ্বংসী দুষ্টক্ষত; যা বহুল আলোচিত, নিন্দিত ও ধিকৃত বিষয়। সন্ত্রাসের কোনো দেশ নেই, কোনো সীমানা নেই।
সন্ত্রাস শব্দটির উদ্ভব ফ্রান্সে ১৭৮৯-১৭৯৯ সালে; ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয় ১৭৯৮ সালে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে পৃথিবীর জঘন্যতম সন্ত্রাস কার্যক্রমের সূচনা হয়। ১৯৮০-র দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগান মুজাহিদদেরকে আর্থিক সহায়তা দেয়, সমর্থন করে। আর ইসরাইলকে সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিপীড়নে সাহায্য করে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ‘জিহাদ লিটারেসি’ প্রজেক্টে জিহাদি বইয়ের উৎপাদন ও বিতরণে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে। ইউরোপোলের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে সন্ত্রাসীদের ৯৯.৬ শতাংশই অমুসলিম।
১৯৮০-২০০৩ পর্যন্ত ৩১৫টি আত্মঘাতি হামলার মধ্যে ৭৬টি তামিল টাইগারদের কাজ। ১৯৭০-২০১৩ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত ২৪০০টি সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে মুসলমানরা জড়িত ৬০টিতে, ইহুদীরা জড়িত ১১৮টিতে। ইউরোপে ২০১৫ সালে সংঘটিত ২১১টি সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্যে মাত্র ১৭টির জন্য দায়ী মুসলিমরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ও খ্রিস্টান চরমপন্থীরা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে আইন পাস করা হয় এবং এ পরপরই শুরু হয় বিশ্বের সর্বত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
বিশ্বের মোট সন্ত্রাসী ঘটনার ৫ শতাংশের জন্যও মুসলমানরা দায়ী নয়। ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সংঘটিত সব সন্ত্রাসী আক্রমণের মাত্র ৬ শতাংশের জন্য দায়ী মুসলমানরা। বাকি ৯৪ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল অন্যরা (ল্যাতিনরা ৪২ শতাংশ, চরম বামপন্থীরা ২৪ শতাংশ, চরমপন্থী ইহুদীরা ৭ শতাংশ, কমিউনিষ্টরা ৫ শতাংশ, অন্য গ্রুপগুলো ১৬ শতাংশ)। আর ইউরোপে মুসলিম সন্ত্রাসী এক শতাংশেরও কম। তারপরও দেশে দেশে সাধারণ মানুষের ওপর বন্দুকধারীদের ভয়াবহ হামলা প্রমাণ করে কোনো দেশই সন্ত্রাসী হামলা থেকে নিরাপদ নয়।
দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ
দুর্নীতির ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণ এবং সৎ ও ভদ্র শ্রেণী। দেশের ও দশের প্রকৃত শত্রু দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অবৈধ উপার্জন করে। দুর্নীতির কারণে অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়। দুর্নীতি সমাজের জন্য মহামারী ও অভিশাপতুল্য। দুর্নীতির ফলে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমাজকল্যাণ দারুণভাবে ব্যাহত হয়, অনেকে অধিকার বঞ্চিত হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করে এবং সমাজে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন বিপন্ন হয়।
দুর্নীতির কারণে- সমাজ তার গতি হারায়। পারস্পরিক দ্বন্ধ সংঘাত বাড়ে। সুখ শান্তি নষ্ট হয়। সবকিছুকে গ্রাস করে অনাকাঙ্ক্ষিত স্থবিরতা। জনজীবনকে পর্যদুস্ত করে। চরম হতাশা ও নৈরাজ্য তৈরি করে। অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি হয়। আর্থসামাজিক উন্নতি রোধ করে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ছাত্ররাজনীতি এখন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের আঁতুড় ঘর। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
দুর্নীতির কারণে- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। সম্পদের সুষম বন্টন হ্রাস পায়। সামাজিক বৈষম্য বাড়ে। মানব উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হয়। অপরাধ প্রবণতা বাড়ে। সামাজিক নৈরাজ্য, বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় দেখা দেয়। মানুষ শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্নীতির দুঃসহ প্রভাব পড়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে।
সমকামিতা ও সমকামী
সমকাম আধুনিক বিশ্বের বড় ফিতনা। জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ। সব সৃষ্টিরই আছে জৈবিক চাহিদা, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। তাদের বংশ রক্ষা ও বিস্তারের জন্য এর বিকল্পও নেই। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। আল্লাহ তায়ালা নারী-পুরুষ সৃষ্টি করে একে অপরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ দিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের মাধ্যমে জৈবিক চাহিদা বৈধভাবে পূরণের ব্যবস্থার অন্যতম কারণ পৃথিবীতে মানবসভ্যতা টিকে থাকা।
নারী ব্যতীত বংশবিস্তার অসম্ভব, তেমনি পুরুষ ব্যতীতও অসম্ভব। লূতের আ. সম্প্রদায় ছিল আল্লাহর সৃষ্টির উদ্দেশ্যের বিপরীত। স্ত্রীদের রেখে পুরুষে পুরুষে জৈবিক চাহিদা মেটাতো। কওমে লুতকে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায় বলেছে কুরআন। আল্লাহ জাতিটিকে ধ্বংস করেন। যেই হোমোসেক্সুয়ালিটির শাস্তির চিহ্ন এখনো পৃথিবী বয়ে বেড়াচ্ছে; সেই অপরাধকে দেশে দেশে এখন যৌন স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নামে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে, সমলিঙ্গের বিবাহের আইন চালু করা হচ্ছে।
আধুনিক দাসত্বের ফাঁদ
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের শিকার। যারা বাধ্যতামূলক শ্রম অথবা জোরপূর্বক বিয়ের ফাঁদে শিকলবন্দি। বিশ্বের প্রতি দেড়শ মানুষের মধ্যে একজন এমন পরিস্থিতির শিকার। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বজুড়ে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত ছিলেন। ২ কোটি ২২ লাখ মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে একসঙ্গে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছেন; যাদেরকে কাজে বাধ্য করা হচ্ছে।
২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিশ্বে বাধ্যতামূলক শ্রম ও জোরপূর্বক বিয়ের ফাঁদে পড়া মানুষের সংখ্যা ১ কোটি বেড়েছে। এদের দিয়ে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে জোরজবরদস্তি কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার প্রতি পাঁচজনের একজনই শিশু। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার অর্ধেক শিশু।
চরমপন্থা ও উগ্রপন্থা
চরমপন্থী আন্দোলনগুলো অপরপক্ষকে ছাড় দেয়ার বিরোধী, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত এবং দাবি অর্জনে সহিংসতাকে সমর্থন করে। নিজ দলের ভিন্নমতের প্রতিও অসহিষ্ণু, বিরোধীপক্ষকে খারাপ বা দুর্বৃত্ত হিসেবে তুলে ধরে। আত্মবিধ্বংসী আত্মঘৃণা প্রতিশোধের অনুভূতির দিকে এবং মানবতাবোধকে ধ্বংস করার দিকে পরিচালিত করে। নির্যাতনভোগ, নিরাপত্তাহীনতা, উপহাস, অপমানবোধ, ক্ষতি ও ক্রোধের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার অবদমিত তীব্র অনুভূতির আবেগপূর্ণ বহিঃনিঃসরণ ব্যক্তি-দলকে সংঘাতে জড়ানোর কৌশলের দিকে পরিচালিত করে। ক্ষমতা নিয়ে খেলা করে। অসহনশীলতা দেখা দেয়।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেআইনিভাবে নিরপরাধ বা অযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-হত্যায় লিপ্ত ব্যক্তিরা ‘চরমপন্থী’। নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাচার, অন্যায়ভাবে সম্পদ ও অধিকার হরণ এবং ভূমি দখলের জন্যও চরমপন্থা ব্যবহৃত হয়। চরমপন্থিদের সাধারণত কেন্দ্রপন্থী-মধ্যপন্থিদের বিপরীতে তুলনা করা হয়। চরমপন্থার মতাদর্শ সমাজের মূলধারার আচরণ ও গ্রহণযোগ্য মনোভাব বহির্ভূত। মিথ্যা প্রচারণা, কুসংস্কার-ধর্মান্ধতা-ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, ধর্মীয়-আধুনিক-মানবিক শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব-দরিদ্রতা-হতাশা, ক্ষমতার লোভ তরুণ সমাজকে বক্রপথে-ভুলপথে পরিচালিত করে উগ্রপন্থী বানায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ
মুসলিম বিশ্বে খুব কম লোকই আছে যারা পশ্চিমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা করতে পারে। পাশ্চাত্যকে মোকাবেলা করতে এমন মুসলিম বুদ্ধিজীবী গড়ে উঠা দরকার; যারা আধুনিক বিশ্বের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করতে সক্ষম হবে। যারা আধুনিক বিশ্বকে জানবেন, দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি মোকাবেলার উপায় খুঁজবেন, নতুন নতুন সমস্যা ও জটিলতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখবেন।
একদল শান্ত মুসলিম বুদ্ধিজীবি নীরবে গবেষণা করছেন, নিরলস কাজ করছেন; মানব জীবনে প্রয়োজনীয় আভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ বা আধুনিক বিশ্বে মুসলিমদের পরিচয় তুলে ধরার উপর। এরা নিজ দেশে কট্টরপন্থীদের চাপে থাকেন, পশ্চিমাদের কাছ থেকে প্রাপ্য স্বীকৃতি-সহযোগিতা পায় না, মিডিয়ার কভারেজ পায় না। পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন বাড়াতে হবে।
প্রযুক্তির অপব্যবহার
প্রযুক্তির অকল্যাণে-অপব্যবহারে-অভিশাপে আধুনিক জীবন থেকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিদায় নেয়। ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটে। জীবনধারা নেতিবাচকভাবে বদলে যায়। নব নব প্রযুক্তি ক্ষতিকর কাজে লাগিয়ে জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সাইবার ক্রাইম বাড়ে। মানুষের জীবন ও বসবাসের জগত অনিরাপদ ও আতঙ্কজনক হয়ে উঠে। অমনোযোগীতা বাড়ে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে উদ্যমী-সৃষ্টিশীল চিন্তা-চেতনা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হলেও বেশিরভাগই এ সুবিধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে না। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের প্রতি নেতিবাচক আসক্তিতে জড়াচ্ছে অনৈতিক কার্যকলাপে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ সময় নষ্ট করছে বা ক্লাসে-কর্মক্ষেত্রেও চ্যাট-এসএমএস বিনিময় করছে।
অশ্লীলতার জয়জয়কার
টেলিভিশন, ডিশ এন্টেনা, মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেইসবুক ইত্যাদির অপব্যবহারে উন্মোচিত অশ্লীলতার পর্দায় হারাচ্ছে চরিত্রের শ্লীলতা। অশালীন ও উদ্ভট প্রকৃতির নাটক-সিনেমার দেয়া বিকৃত-উদ্ভট চিন্তাধারা-মানসিকতা জীবন গঠনের অন্তরায় হয়ে অপরাধের প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
অমানবিকতা বৃদ্ধি
নির্মম অত্যাচার ও শোষণে দুর্বল আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। অথচ সিরিয়ায়, লেবাননে, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাসহ দেশে দেশে মুসলমানরা অবর্ণণীয় নির্যাতিত হচ্ছে। তাছাড়া মানব পাচার, মেধা পাচার ও অর্থ পাচার বাড়ছে। সুদভিত্তিক অর্থনীতির জয়জয়কার। নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাড়ছে। সর্বত্র নেশার ছড়াছড়ি।
ব্যক্তিবাদ, বস্তুবাদ আর ভোগবাদ একাকার হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা দেখা যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জ। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে ব্যবহার করে আবেগ নিয়ে খেলছেন এবং সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। পশ্চিমা আগ্রাসনের সাথে ইহুদি আগ্রাসন যুক্ত হয়ে ক্রমশ চ্যালেঞ্জ-জটিলতা বাড়িয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থপরতা, সম্পদ অপচয়, ক্রমবর্ধমান হতাশা, যৌন আচরণে শিথিলতা, পরিবারের বিলুপ্তি ঘটছে।
অপসংস্কৃতির ছোবল
ইসলামী সংস্কৃতিকে স্মার্ট বা আধুনিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। ফলে বর্তমান প্রজন্ম পশ্চিমা সভ্যতাকেই আধুনিক মনে করছে। ইসলামী সংস্কৃতির মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে মূল্যায়নে গভীর জ্ঞানের অভাব রয়ে গেছে। নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি আস্থার অভাবের কারণে হীনমন্যতায় ভোগা বা আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া অশনি সংকেত। ডিস্কোর ছোয়ায় নিজেদের প্রায় ভুলতেই বসছে নবীনেরা।
পশ্চিমা ফ্যাশন অনুকরণ, হলিউড-বলিউডকে দেখে ফ্যাশনেবল হয়ে উঠা অপসংস্কৃতি। লোভনীয় ফাঁদে পড়ে ইসলামী চরিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ইসলামী সংস্কৃতির প্রাণশক্তি ধারণকে ভুলে যাচ্ছে। আধুনিকায়ন হতে হবে পশ্চিমাকরণ ছাড়াই। ভিনদেশি সংস্কৃতি, গান-বাজনাতে অভ্যস্তরা ফেইসবুকের ভাষায় কথা বলছে। সালাম দেওয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করছে হাই-হ্যালো। বিকৃতভাবে ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে চলছে কথোপকথন। গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড সংস্কৃতি বাড়ছে।
অভ্যন্তরীণ গলদ
মুসলিম বিশ্বে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বে সৌদি আরবের সাথে ইরানের উত্তেজনা রয়েছে। ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র মিশরের কায়রোর আল-আজহারে শেখানো আদর্শ-ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বিভিন্ন মাযহাবপন্থীদের অমিল রয়েছে। মুসলমানের সাথে মুসলমানের শত্রুতা, মুসলিম দেশের সাথে মুসলিম দেশের দ্বন্দ্ব বহুবিধ সমস্যার কারণ।
আয় ও সম্পদের বণ্টনে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা সুস্পষ্ট। ইজতিহাদের নবজাগরণ নেই। রয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে সংঘাত। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কেন্দ্রের ক্ষমতার স্থানান্তর হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে পবিত্রভূমির দাবীর পক্ষে-বিপক্ষে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম কমিউনিটি বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। রক্ষণশীল কেন্দ্রসমূহ অধিকতর শক্তিশালী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও উদার মুসলিমদের চাপের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
সামাজিক সমস্যা
সামাজিক বন্ধন ঢিলেঢালা হচ্ছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ ভুলতে বসেছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সর্ম্পকে এবং পরবর্তীতে যা বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে ব্যাংকের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধ। বৈষয়িক বিষয়গুলোকে বড় করে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। এ সমাজ ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে গিয়ে অনেকে হতাশা, হীনমন্যতায় ভুগছে এবং বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে অপরাধের দৈত্যদানব।
জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর
জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর চ্যালেঞ্জিং। ২০৩০ সালে বিশ্বের সংখ্যা ১৯৭০ এর তুলনায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পাবে। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছেছিল। ১৭০ বছরের মধ্যে ২০০০ সালে সে সংখ্যা ৬০০ কোটি অতিক্রম করে। প্রতি ১১ বছরে জনসংখ্যা ১০০ কোটি করে বাড়ছে। ফলে প্রকৃতির উপর চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
পরিবেশগত সমস্যা
পরিবেশ বাঁচানো খুব জরুরি। পরিবেশ বাঁচলে বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে জাতি, বাঁচবে দেশ। প্রকৃতি যদি না বাঁচে মানুষও বাঁচতে পারবে না। পরিবেশ বা মানুষ একটি আরেকটির পরিপূরক। অথচ সতেরো শতকে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে মাত্র ৪০০ বছরে যন্ত্র সভ্যতা প্রকৃতি ও পরিবেশের অসীম ক্ষতি করেছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের বর্তমান ধারা অব্যহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের ১৭৭ শতাংশ ভূমি পানির নিচে চলে যাবে। ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে বায়ুদূষণে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ, মোট মৃত্যুর যা ১৪ শতাংশ। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশীদের আয়ু কমছে গড়ে ১ বছর ১০ মাস। গড় আয়ু কমার এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। ফুসফুসজনিত রোগে মৃত্যুর ৪৯ শতাংশ হয় বায়ুদূষণের কারণে।
তাছাড়া মাটি দূষণ, পানি দূষণ, মহাসাগর দূষণ ও বায়ু দূষণ বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। পাহাড় কাটা, বালি উত্তোলন, নদী ভরাটে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ইটভাটা, পলিথিন, রাসায়নিক ব্যবহার পরিবেশগত শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। বন উজার হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশগত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। শিল্প উৎপাদনের উন্নয়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অস্তিত্বের হুমকি
অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়ছে। দারিদ্র্য সমস্যার কারণে বহু মানুষ নিম্নস্তরের জীবনযাপন করছে। খাদ্য সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ (উন্নয়নশীল দেশগুলির ৫০-৬০%) অপুষ্টিতে ভুগছেন। জ্বালানি সংকট ভয়াবহ উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার বিকল্প ভাবা হচ্ছে। এনার্জি সমস্যা হলে জ্বালানি নির্ভর শিল্পগুলির পরিণতি ভাবনা চাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ যেসব শিল্পের জন্য কাঁচামালের একটি উৎস সেসবের সীমাবদ্ধতা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে।
এই পৃথিবীটাকে কয়েকবার ধ্বংস করার মারণাস্র তৈরি হয়েছে। জীবাণুঅস্ত্রের মজুদ বাড়ছে। পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। পারমাণবিক পরীক্ষা পরিবেশের ক্ষতি করছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির দেশে সামরিক দ্বন্দ্ব আরো লেজেগোবরে অবস্থার তৈরি করেছে। তেজষ্ক্রিয়তা মারাত্মক ক্ষতি করছে। যুদ্ধ মানুষের ব্যাপক ধ্বংস এবং মৃত্যু বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বন্যা, জ্বলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি ও ফসলহানী বাড়ছে। ফলে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে।
মরণব্যাধি মাদক ভয়ঙ্কর
মাদক জীবন থেকে জীবনকে কেড়ে নেয়। জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে। ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়। মাদক এমন মরণব্যাধি, আত্মঘাতীমূলক জীবন প্রবাহ, আত্মহননের অসৎ এবং কুৎসিত পথ; যা দুর্বিষহ করে জীবন, অন্ধকার আনে পরিবারে, ধ্বংস করে পারিবারিক সম্প্রীতি, কুয়াশাচ্ছন্ন করে ভবিষ্যৎ, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করে, মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, নষ্ট করে পারিবারিক শৃঙ্খলা, কলুষিত করে সমাজ, বাড়ায় জ্ঞানবুদ্ধিহীন মানুষ, ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। জীবন ধ্বংস করে মাদকাসক্তি।
মাদকের কারণে দেখা দেয়- পরিবারে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সামাজিক উন্নয়নে বাধাগ্রস্ততা, মানবসম্পদের অপব্যবহার, অপরাধমূলক কাজের ব্যাপকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়। একজনের মাদক গ্রহণ আরেকজনকেও ফেলে দেয় মাদক গ্রহণের ঝুঁকিতে। নেশাগ্রস্ত ও নেশাখোররা ধর্ম মানে না, দেশের আইন মানে না, সুন্দর-সুখী পরিবার গড়ে তোলতে পারে না। মাদক গ্রহণের ভয়ঙ্কর ফাঁদে জড়ালে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। দেহের পাশাপাশি বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত হয়ে যায় মনের স্বাস্থ্য, পুড়ে যায় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক চিত্রে নেমে আসে দুর্যোগ।
লিভ টুগেদার
লিভ টুগেদার ভয়ঙ্কর ক্রাইম, সামাজিক বিকৃতি, ভয়াবহ ব্যাধি। শহরে সমাজে যা হু হু করে বাড়ছে এবং বিপর্যয় নেমে আসছে। পবিত্র সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। বংশধারার স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে বিকৃত দুজন নারী পুরুষ শুধু নয় দুটি পরিবার খুন হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ খুন হচ্ছে। সমাজকেই নিঃশব্দে বিকৃতির অতলে টেনে নিচ্ছে।
বেশিরভাগই শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিভ টুগেদার করেন; এতে কাউকেই দায়িত্ব নিতে হয় না। কেউ কেউ বিয়ের আগে ভালো বোঝাপড়ার জন্য করেন। লিভ টুগেদার করাটা অনেকের শখ, পরকীয়ার ফলও। সমাজে কিছু উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। লিভটুগেদারের পরিণতি হচ্ছে- সমাজচ্যুতি, আত্মহত্যা, অপরাধবোধ, বিচ্ছেদ, প্রতারণা, ধর্ষণ, খুন, আতংক, চরিত্রহীন, জারজ সন্তান ও শিশুদের সমস্যা ইত্যাদি।
পর্নোগ্রাফি
পর্নোগ্রাফির প্রকোপ সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয় বাড়াচ্ছে। পর্নো আসক্ত প্রজন্ম মেধাহীন ও অসুস্থ সমাজ উপহার দিচ্ছে। পর্নোগ্রাফি চর্চার ফলে যৌনসন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে চাইল্ড পর্নোগ্রাফিকে। পর্নোগ্রাফি আক্রমণাত্মক ও অবমাননাকর, ধর্মীয় নীতিমালার লঙ্ঘন, হস্তমৈথুন বাড়ায়। কিশোর-কিশোরীদের বড় অংশ পর্নোগ্রাফির আসক্তির জগতে আটকা পরেছে। অনলাইন পর্নোগ্রাফিতে আসক্তরা বন্ধুদের সাথে বোকামি করে, দুর্ব্যবহার করে, সময়মতো ঘুমাতে বিছানায় যায় না। এসব আচরণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে পড়ালেখার ফলাফলের উপর, সামগ্রিকভাবে সামাজিকতা ও নৈতিকতার ওপর।
পর্নোগ্রাফি আসক্তরা মেয়েদের শারীরিকভাবে উত্যক্ত করছে। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা যৌন সহিংসতা বাড়াচ্ছে। অশ্লীলতার চর্চা বাড়াচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট করছে। কন্যাশিশুরা পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছে। ক্লাসে বসেও শিক্ষার্থীরা পর্নো দেখছে। গোপনে ভিডিও ধারণ করেও পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে। পেশাদারদের মাধ্যমেও নীল ছবি তৈরি হচ্ছে। নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট বাড়ছে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মানুষকে হীন আর অপমানিত করছে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে। পরকীয়া বাড়ছে।
পর্নোগ্রাফির কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে। কার্যক্ষমতা কমছে। ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার দিকটি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও বহুবিধ সঙ্কট তৈরি করছে। পর্নে দেখা আচরণ অনুকরণ করছে। শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। জননতন্ত্রের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে নপুংসক হচ্ছে। মস্তিষ্কের আকারে পরিবর্তন আসছে। দাম্পত্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দর্শক থেকে নিপীড়নকারী হচ্ছে। জীবনের ছন্দপতন ঘটছে। যৌন অনাগ্রহতার দিকে ঝুঁকছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। আচরণের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। হস্তমৈথুনের জন্য পর্নোগ্রাফি উপভোগ করছে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়
ইসলাম চর্চা
এক. জীবনের সকল দিক ও বিভাগে ইসলাম চর্চা করতে হবে। পলিটিক্স মানেই ম্যাকিয়াভেলিক ধোঁকাবাজি নয়। কৌটিল্যের কূটচাল নয়! ইসলামে পলিটিক্স, ইকোনমিক্স কিংবা জার্নালিজম সবই এথিক্সের সাথে জড়িত। আর এথিক্সের ভিত্তি এখানে ধর্ম। মুহাম্মাদের সা. নিয়ে আসা ধর্ম একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান, কোনো থিওরিটিকাল সায়েন্স নয়। সারা দুনিয়া যখন সর্বজনীন জীবনব্যবস্থার মুখাপেক্ষিতা অনুভব করছে, ইসলাম সেখানে পূর্ণাঙ্গ সমাধান।
ইসলাম পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবন-বিধান। আংশিক আদর্শ নিয়ে পূর্ণ সমাজ সংগঠিত হতে পারে না। মহানবীর আদর্শ মানব-প্রকৃতির ওপরে স্থাপিত, পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। আল্লাহর দ্বীন প্রচারের মাধ্যম হলো ওয়াজ-বক্তৃতা, পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশন। এসব মাধ্যমকে অবহেলা করা যাবে না। বিশ্বনবীর সা. জীবনচরিত ও সাহাবিদের জীবন সম্পর্কে জানতে-জানাতে হবে।
জেনেরিক দক্ষতার উন্নয়ন
দুই. জেনেরিক দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। জেনেরিক দক্ষতাকে মূল বা প্রধান বা মূখ্য দক্ষতা, বুনিয়াদী বা মৌলিক দক্ষতা, কিছু করার ক্ষমতা বা সামর্থ্য, সর্বজনীন দক্ষতা, স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতা, নিয়োগযোগ্য দক্ষতা, জরুরি বা অপরিহার্য দক্ষতা, প্রয়োজনীয় দক্ষতা, মৌলিক যোগ্যতা, সাধারণ দক্ষতা বলা যেতে পারে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গুণাবলীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা মূল্যবোধ এবং আত্মপরিচয়ের সাথে যুক্ত।
জেনেরিক স্কিল এমন সাধারণ দক্ষতা যা পেশার প্রযুক্তিগত বা প্রায়োগিক দিকগুলির সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত নয় বা বিশেষ অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত বিশেষায়িত সুনির্দিষ্ট দক্ষতা নয়; যা স্বাতন্ত্র্যতা প্রকাশ করে। পর্যায়ক্রমিক বিকাশ, পরিপক্কতা অর্জন এবং সুপরিণতি লাভের মাধ্যমে জেনেরিক দক্ষতা প্রসারিত হয়। এসবের অনেকগুলোকে বিংশ শতাব্দীর দক্ষতা বলতো, পরবর্তীতে একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা হিসেবে আরো নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে।
সাধারণত প্রয়োজনীয় কিছু জেনেরিক দক্ষতা হলো- সমস্যা সমাধান দক্ষতা, জটিল সমস্যা সমাধান দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, বিশ্ব নাগরিকত্ব দক্ষতা, জীবিকায়ন দক্ষতা, নৈতিক দক্ষতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিং দক্ষতা।
মৌলিক দক্ষতা, তথ্য প্রযুক্তি দক্ষতা, পরিমাপ ও গাণিতিক দক্ষতা, অধ্যয়নের দক্ষতা, তথ্য যাচাই বাছাইয়ের দক্ষতা, সময় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, দলগত কাজের দক্ষতা, নেতৃত্ব দক্ষতা, নমনীয়তা দক্ষতা, স্বতন্ত্র অভিযোজন দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের দক্ষতা, ব্যবহারিক দক্ষতা, স্ব-প্রেরণা দক্ষতা।
পেশাগত দক্ষতা, তথ্য ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, জীবনব্যাপী শেখার দক্ষতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, উদ্যোক্তা দক্ষতা, কার্যকরভাবে পড়ার দক্ষতা, সার্থকভাবে লেখার দক্ষতা, ফলপ্রসূভাবে বিশ্লেষণের দক্ষতা, কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা।
সূক্ষ্ম চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, প্রযুক্তিগত চিন্তা ব্যবস্থাপনা, ইতিবাচক চিন্তার দক্ষতা, ধারণাগত চিন্তা-ভাবনার দক্ষতা, গঠনমূলক সমালোচনার দক্ষতা, যুক্তিবিচারের দক্ষতা, নেগোসিয়েশন দক্ষতা, কৌশলগত পরিকল্পনার দক্ষতা, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা, নৈতিক চিন্তন দক্ষতা।
প্রেরণাদায়ক দক্ষতা, ক্যারিয়ার পরিকল্পনার দক্ষতা, প্রাসঙ্গিকতা বোঝাপড়ার দক্ষতা, আধুনিক ভাষার দক্ষতা, গ্রাহক সেবা দক্ষতা, উদ্ভাবন দক্ষতা, সক্রিয় শেখার দক্ষতা, কর্ম শেখার দক্ষতা, সাংস্কৃতিক দক্ষতা, সামাজিক সচেতনতা দক্ষতা, সামাজিক সম্পর্কের দক্ষতা, সামাজিক প্রভাব দক্ষতা, সামাজিক দায়িত্ব দক্ষতা, বৈশ্বিক সচেতনতা দক্ষতা, কল্পনা দক্ষতা।
মানসিকতা উন্নয়ন দক্ষতা, উত্পাদনশীলতার দক্ষতা, জবাবদিহির দক্ষতা, নাগরিকতা দক্ষতা, উপস্থাপনা দক্ষতা, ঐকান্তিক-উদ্যমশীল দক্ষতা, স্ব-কার্যকারিতা দক্ষতা, স্ব-সমর্থন দক্ষতা, স্ব-সহায়তা দক্ষতা, স্ব-নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা, স্ব-পরিচালনা দক্ষতা, মেটাকগনিশন দক্ষতা, বিবেক দক্ষতা, ন্যায়সঙ্গত আচরণের দক্ষতা, যুক্তি দক্ষতা, ধারণা দক্ষতা, কৌতূহল দক্ষতা, আর্থিক সাক্ষরতা দক্ষতা, বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা দক্ষতা।
কনটেন্ট তৈরির দক্ষতা, জ্ঞান উন্নয়ন দক্ষতা, চিন্তামূলক অনুশীলন দক্ষতা, ব্যবসা দক্ষতা, নাগরিক দক্ষতা, নাগরিক সাক্ষরতা দক্ষতা, নগরীয় কর্মে দক্ষতা, ঝুঁকি নেওয়ার দক্ষতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, ঝুঁকি মূল্যায়ন দক্ষতা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সম্পূর্ণতা দক্ষতা, স্ব-শৃঙ্খলা দক্ষতা ইত্যাদি।
গবেষণা
তিন. গবেষণায় অগ্রসর হতে হবে। সময়ের দাবি পূরণ করে এগিয়ে থাকতে হলে গবেষণা খুব জরুরি। মানুষের সমাজ জীবন ক্রমেই হচ্ছে জটিল, বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক সমস্যা। ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বিজ্ঞান গবেষণা, ফলিত গবেষণা, কৃষি গবেষণা, মৌলিক গবেষণা, শিল্প গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
যখনই যে দেশ গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে তখনই ঐ দেশটি উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছে। মানবজীবনের দৈনন্দিন জীবনের আরাম-আয়েশগুলো বৃদ্ধি করা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা, সৃষ্টির রহস্য উদঘাটন করা, জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার মহান কর্তব্য সাধনে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
গবেষণা যদি না থাকে তবে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। গবেষণার মাধ্যমে নিত্য নতুন উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধানের পথ বের করা যায়, মানুষ পার্থিব জগতে শান্তির দিশা পায়, প্রযুক্তির স্বাদ প্রহণ করে অনেক জটিল কাজকে সহজ করতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে ইসলাম যে কিয়ামত পর্যন্ত সচল ও কল্যাণকর একটি জীবন ব্যবস্থা তা প্রমাণ করা সম্ভব হয়।
নৈতিক চরিত্রের উন্নতি
চার. অর্থবহ জীবনের সন্ধান পেতে হালাল-হারাম বাছ-বিচার করতে হবে। সন্ত্রাস ‘ফিতনা’ ও ‘ফ্যাসাদ’ বন্ধ করতে হবে। ইসলাম ফোবিয়া রুখতে হবে। চরমপন্থা-সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই- প্রমাণ করতে হবে। ‘তাসফিয়াহ’ ও ‘তারবিয়াহ’ তথা কিতাব ও সুন্নাতের আলোকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সর্বস্তরের মুসলমানকে মৌল মানবিক গুণে গুণাণ্বিত হতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলতে যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘনমূলক ‘ইরহাব’ ও ‘ইরআব’ সংঘটনকে ঠেকাতে হবে। নবীন প্রজন্মকে সময় দিতে হবে। সুস্থ সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। অপরাধীদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সম্ভাবনার বিকাশ করতে হবে। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আলেমদের এগিয়ে আসতে হবে। মিডিয়ায় অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। শুধু সমালোচনা না করে উত্তম বিকল্প দিতে হবে। মাজহাব, মতবাদ, বহুদলে বিভক্তি কমায়ে উম্মাহর কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। ইনসাফ ও ভ্রাতৃত্ববোধের চর্চা বাড়াতে হবে। নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন-উন্নতি ঘটাতে হবে।
সমাপণী কথা
আধুনিক বিশ্বের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাসূল সা. এর আদর্শ অনুসরণই একমাত্র উপায়। তাঁর আদর্শের মতো নির্ভুল ও সঠিক আদর্শ দ্বিতীয়টি আর নেই। আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থ আদর্শবাদী গতিশীল নেতৃত্ব এবং আদর্শে উজ্জীবিত কর্মীবাহিনী আধুনিক বিশ্বের সমস্যাগুলোর সমাধান ও বিদ্যমান সঙ্কটগুলো থেকে উত্তরণে সহায়তা করবে। তাঁর আদর্শের বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তৈরি করেছিলেন, ইনসাফভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। যেসব সমাজ তাঁর নীতি অনুসরণ করবে, সেসব সমাজই সমৃদ্ধি লাভ করবে। তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠন করেছিলেন। বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য সবাইকে রাসূল সা. এর সুমহান আদর্শের দিকে ফিরে আসতেই হবে।