করোনায় নতুন ব্যবসা, নতুন বিকল্প, নতুন সম্ভাবনা

করোনা কেড়ে নিচ্ছে অনেক কিছু। সঙ্গে সন্ধানও দিচ্ছে বেঁচে থাকার নতুন বিকল্পের। অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, বদলে দিচ্ছে। ফলে কারও জন্যে যখন চেনা-জানা পথে আয়রোজগারের পথ সীমিত হয়ে সর্বনাশ হচ্ছে, তো তখন কারও নতুন নতুন উদ্যোগ-আইডিয়ায়-উপায়ে ব্যাপক লাভের মুখ দেখা। বিশ্বব্যাপী বহু শিল্পোদ্যোগীর সামনেই নয়া ব্যবসার বিরাট সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলে দিয়েছে করোনা। করোনা শিখিয়েছে নতুন ব্যবসা, তৈরি হয়েছে নতুন ব্যবসার পরিসর। করোনার সময়ে মানুষের জীবনে যে অভাব ও চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা থেকেও তৈরি হয়েছে নতুন উদ্যোগ। যেসব উদ্যোক্তারা  ভেবে বের করতে পারছে পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো সঠিক উদ্যোগ তারাই প্রবেশ করছে বিশাল উপার্জনের খাতে । ব্যবসায় যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানো ও ব্যবসা বাড়িয়ে ব্যবসার ক্ষতি পোষানোর চেষ্টায় সফল হচ্ছেন অনেকেই। করোনায় নতুন ব্যবসা, নতুন বিকল্প, নতুন সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছেই।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন
এক করোনায় বদলেছে অনেক কিছু

এক করোনায় বদলেছে  অনেক কিছু

করোনা পেশার জগতে ঘটিয়েছে যুগান্তকারী পরিবর্তন, ওলটপালট হয়ে গেছে ব্যবসার জগত।  পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখে  নিশ্চিন্তে থাকার উপায়ও বের করেছে অনেকেই। তৈরি হয়েছে নতুন পণ্য ও পেশা। অনেকে পুরনো পেশাকে সামান্য বদলে নিয়ে সময়োপযোগী করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া পেজনির্ভর উদ্যোগের মাধ্যমে কেউ শুরু করেছেন নতুন জীবন। আবার কেউ কেউ স্থবির ব্যবসাকেও দিয়েছে গতি। মানুষ যখন কোনো সমস্যায় থাকে তখন তার সমাধান খোঁজা শুরু করে। এটাই সুযোগ ব্যবসা শুরু করার। তাই ব্যবসা উদ্যোগ তৈরি করতে হলে আগে একটা সমস্যা খুঁজে বের করতে। সে হিসেবে মহামারি-মন্দা এসব হচ্ছে নতুন উদ্যোগ খুঁজে বের করার একটি সময়।  যখন স্বাভাবিক ব্যবসা লাটে উঠে তখনই নতুন ব্যবসা শুরুর ভালো সময়।

পিসির  কাজ

করোনা পরিস্থিতির কারণে ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি ডেস্কটপ, ল্যাপটপের বিক্রি বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছর বাজারে পিসির চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে মোট পিসি বাজারে আসার হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। গত বছর ২৯ কোটি ৭০ লাখ ইউনিট পিসি বাজারে এসেছে। এক দশকের মধ্যে গত বছর পিসির বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরে ৩০ কোটি ২০ লাখ ইউনিট পিসি বিক্রি হয়েছে। বাড়ি থেকে পড়াশোনা ও কাজের কারণে পিসির বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময় গেমিং পিস ও মনিটর বিক্রিও বেড়েছে। পিসি বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজার বড় করার সুযোগও তৈরি হয়েছে।

ভিডিও কলিং-মিটিং

বেড়েছে ভিডিও কলিং বা ভিডিও মিটিং এর চাহিদা। স্কুলের ক্লাস থেকে শুরু করে অফিসের মিটিং পর্যন্ত যাবতীয় কাজ চলে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে। অন্যান্য ভিডিও কলিং অ্যাপের থেকে এগিয়ে যায় জুম অ্যাপ। রাতারাতি বাড়তে থাকে অ্যাপটির ফ্রি ডাউনলোডের সংখ্যা। এমনকি হু হু করে বেড়ে যায় পেইড সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যাও। জুম অ্যাপ তাদের শেয়ারের দামের উর্ধ্বগতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে হয়ে ওঠে বছরের অন্যতম সেরা বিনিয়োগ উৎস।

মাস্কের ব্যবহার

মানুষের জীবনে মাস্কের ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। মানুষ মাস্ক পরা শুরু করার ফলে এর বিক্রি যায় বেড়ে। যেসব দোকানে কখনোই মাস্ক পণ্য হিসেবে রাখা হত না সেসব দোকান তো বটেই, এমনকি ওষুধের দোকান, সুপার শপ এমনকি রাস্তার হকাররা এখন মাস্ক বিক্রি করেছে।আগে সার্জিকাল মাস্ক শুধুমাত্র মেডিকেলে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে থাকতো। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে যখন এর চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায় তখন চাহিদার যোগান দিতে তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়।গলির মোড়ের দর্জি কাপড়ের মাস্ক বানানোয় ব্যস্ত।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার মাখা

কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ যেটা হাতে মাখলে হাত জীবাণুমুক্ত হয় এই ধারণাটা হয়ত সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছিল না।করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে বার বার হাত ধুতে হবে এই স্বাস্থ্য বিধি মানতে মানুষ সাবান দিয়ে যেমন হাত ধুয়েছে তেমনি এই তরল পদার্থ বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার এখন মানুষের হ্যান্ডব্যাগে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মত স্থান করে নিয়েছে।বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ মুখে তো বটেই অনেকে নিজের ব্যাগেই রাখছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের একটি ছোট বোতল।

পিপিই পরিধান

স্বাস্থ্য বিধি মানার জন্য ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য সেবা-দান কর্মীদের এই পিপিই বা বা পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার এখন বাধ্যতামূলক। করোনাভাইরাসের জীবাণু যাতে করে কোনভাবেই শরীরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য এই বিশেষ ধরণের পোশাক পরার দরকার হয়। দৈনন্দিন কাজের সূত্রে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি যাদের হতে হচ্ছে, যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা গার্ড, বা বড় বড় দোকানে ক্রেতাদের মুখোমুখি হচ্ছেন যেসব সেলস্ কর্মীরা, তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পিপিই পরছেন।

গ্লাভস ও সুরক্ষা সামগ্রী

গ্লাভসের চাহিদা বেড়েছে বিপুল। তার জোগান দিতে গড়ে উঠেছে নতুন নানা ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোগ। প্রোটেকটিভ ফেস শিল্ড, মেডিক্যাল প্রোটেকটিভ গগল্স, মেডিক্যাল প্রোটেকটিভ সু কভার ব্যবসা রমরমা! টেস্টিং কিট আর ভেন্টিলেটর রফতানি-আমদানি চলছেই।

তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র রাখা

এতদিন জ্বর হলে তবেই বাসায় রাখা ছোট থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপতে অভ্যস্ত ছিল মানুষ।এছাড়া হাসপাতালে থার্মোমিটার ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এখন বাড়ির বাইরে বের হয়ে যেখানেই যাবেন সেখানেই প্রবেশ মুখে দাঁড়াতে হবে আপনার তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রের সামনে।বড় আ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, দোকান, মার্কেট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন পিপিই পরে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র হাতে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।পালস অক্সিমিটার, হৃৎস্পন্দন ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র। ছোট এই যন্ত্রটি ব্যবহার করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।

সঞ্চয় করা

করোনাকালে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। ব্যয় বাড়লেও মানুষ আগের চেয়ে সঞ্চয় করছে বেশি। ব্যাংক আমানতে সুদ কমে গেলেও মানুষ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংককেই পছন্দের তালিকায় প্রথমে রাখছে। টাকা রাখার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র। এছাড়া শেয়ার বাজারেও মানুষ এখন বিনিয়োগ শুরু করেছে। করোনায় খরচও কমেছে অনেকের, বিলাসিতা করার সুযোগ ছিল না। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার চিন্তায় মানুষ টাকা জমানোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। অনেকেরই বাহুল্য খরচ কমেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং তথা ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ চালু হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েছে।

অনলাইনে ক্ষুদ্র ব্যবসা করা

অনলাইনে পণ্য কেনার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের একটি অংশ অনলাইনের ওপর ভরসা রাখছে, ক্রয়াদেশ বা অর্ডার  বাড়ছে। অনেকেই কম খরচে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে অনলাইনকে ভালো উপায় হিসেবে দেখছে। এতে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচের মতো বিষয়গুলো নেই। করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার এখন অনলাইন। নতুন উদ্যোক্তারাও ব্যবসা শুরুর জন্য অনলাইনকে খুবই সুবিধাজনক মনে করছে। ক্রেতা-গ্রহিতার আগ্রহ তৈরিতে ওয়েবসাইট বানানো হচ্ছে এবং কনটেন্টগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্য বা সেবার ব্যাপারে প্রচারণা বেড়েছে, ক্রেতার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। ব্লগ লেখা হচ্ছে বা ই–মেইলে নিউজলেটার পাঠানো হচ্ছে।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্স উদ্যোগ

বছরটিতে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে ব্যাপক। ই-কমার্সের মাধ্যমে নিত্যপণ্য বিক্রি ব্যাপক হারে বেড়েছে। মানুষের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ফলে করোনাকালেও সুদিন দেখছেন ই-কমার্স উদ্যোক্তারা। ই–কমার্সে যুক্ত হয়েছেন অনেক নারী উদ্যোক্তাও। করোনাকালে যে অভ্যাস ও আস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা এ খাতকে এগিয়ে নেবে। ফলে, বাজারের আকার অনেকটাই বাড়বে। মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। ই-কমার্স খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগও এসেছে। সব মিলিয়ে খাতটি বড় হয়েছে। ক্রেতা বেড়েছে।

ওয়েবসাইট তৈরি

বর্তমানে ইন্টারনেট যেন মানুষের অলিখিত মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। ব্যবসার জন্য প্রচুর ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনায়াসেই পণ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কেনাকাটা করার প্রক্রিয়াও সব ধরনের মানুষের বোধগম্য হচ্ছে। সমস্যায় পড়লে ক্রেতা সাহায্য পেতে যোগাযোগও করতে পারছে।

ক্রেতা টানতে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার

সার্চ ইঞ্জিন যেমন গুগল, ইয়াহু, বিং এদের কিছু নিজস্ব নীতি মেনে নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ওয়েবসাইট বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। প্রতি ক্লিকের দাম পরিশোধের বিজ্ঞাপন দিলে সার্চ ইঞ্জিন এমনিই ক্রেতাকে ওয়েবসাইটে টেনে নিয়ে আসছে। কিছু বিশেষ শব্দ বা কি ওয়ার্ড ব্যবহার করা ক্রেতাকে ডাকা হচ্ছে। পণ্যের সঙ্গে সুসম্পর্কিত সবকিছুকে কি ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ক্রেতা টানা যাচ্ছে।

মেইলের ব্যবহার

ই–মেইলের শক্তি ব্যবহার করে ওয়েবসাইটের দর্শকে ক্রেতা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। সাবস্ক্রাইবারদের ই–মেইল নেয়া হচ্ছে। অফারও দেওয়া হচ্ছে। যখনই নতুন কিছু ওয়েবসাইটে আসছে, ক্রেতাকে একটা ই–মেইল পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পণ্য বিক্রির পর একটা ই–মেইল দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা জানতে চাওয় হচ্ছে। সমস্যা বুঝে তা সমাধানের চেষ্টা করায় ব্যবসায় সফল হওয়া সহজ হয়ে যাচ্ছে।

অনলাইন ক্লাস

বহু তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার নয়া আকর্ষণীয় ব্যবসা ক্ষেত্র হিসাবে উঠে এসেছে স্কুলের ভার্চুয়াল ক্লাসরুম ও লার্নিং অ্যাক্টিভিটি।স্কুল কলেজ বন্ধ হলেও ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতেই চলছে জ্ঞান চর্চা-পড়াশুনা। গুগল মিট, জুম এবং এমএস টিমস্-এর প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস চালানোর পরিষেবাও দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। লাইভ ভিডিয়োর মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ানোর পাশাপাশি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে স্ট্রিমিং নির্ভর অনলাইন ইন্ট্যারঅ্যাকশনও করতে পারছে, হোম-ওয়ার্ক দিতে পারবেন। ভর্তি থেকে পরীক্ষা এমনকী ডিজিটাল লাইব্রেরির সুবিধাও অনলাইনেই দেয়া হচ্ছে। এডুটেক স্টার্ট-আপগুলো সংস্থাগুলি খুব ভালো ব্যবসা করছে। অনলাইন ই-লার্নিং শিল্প ক্ষেত্র দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। অনলাইন কোলাবরেশন-এর বড় ক্ষেত্র স্কুলের অনলাইন পড়াশোনা। অনেকে বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য প্রযুক্তি সলিউসন দিচ্ছে, অনলাইন পড়ানোর সফ্টওয়্যার ও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে।

পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্তকরণ ব্যবসা

করোনাভাইরাসের কল্যাণে জোয়ার এসেছে পরিচ্ছন্নতা এবং জীবাণুমুক্তকরণ সংক্রান্ত ব্যবসায়। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে নিয়োগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রশিক্ষিত কর্মী। কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করছেন অনেকে। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে অনেক ক্লিনিং সলিউশন প্রতিষ্ঠান।

পণ্য পরিবহণ পরিষেবা

কর্মী নিয়োগের জোয়ার এসেছে বিভিন্ন অনলাইন বিপণন সংস্থাগুলিতেও। দোকান-বাজারের ভিড় এড়াতে চাইছেন অনেকে। ফলে ডেলিভারি কর্মীর প্রয়োজনীয়তা-চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট এবং অনলাইন স্টোরের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সামলানোর কর্মীর চাহিদা। শুধু বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, ছোট অনেক সংস্থাও এই পণ্য পরিবহণ পরিষেবার কাজে জড়িত হয়েছে। ই-কমার্স খাতে পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ডেলিভারি সেবাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।

টেলিমেডিসিন পরিষেবা

ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডাক্তার-রোগী যোগাযোগের পথে। হাসপাতাল-নার্সিংহোম-চেম্বারমুখো হতে চাইছেন না অনেকে। ফলে নির্ভরতা বাড়ছে টেলিমেডিসিন পরিষেবার উপর। বিশ্বজুড়ে টেলিমেডিসিন পরিষেবা বেড়েছে কয়েক গুণ। উপকৃত হচ্ছে ওই ব্যবসায় জড়িত সংস্থাগুলি।

সাইকেল ও মোটরবাইক ব্যবসা

করোনা আবহ আমূল বদলে দিয়েছে পরিবহণের মাধ্যম। গণপরিবহণ এড়াতে অনেকে বেছে নিচ্ছেন সাইকেল এবং মোটরবাইক। যে কারণে সাইকেল-মোটরবাইক উৎপাদনকারী সংস্থা এবং ব্যবসায়ীরা তার সুফল পাচ্ছেন।

রেফ্রিজারেটরের বেঁচা-বিক্রি

অনেকে বাড়িতে বেশি খাবার মজুত রাখতে চাইছেন। বাড়ছে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা। রেফ্রিজারেটরের বেঁচা-বিক্রি বাড়ছে।

অনলাইন বিনোদন অ্যাপ

ঘরে বসে সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখার অভ্যেস তৈরি হয়েছে। ফলে অনলাইন মুভি স্ট্রিমিংয়ের ব্যবসা এখন জমজমাট। শিক্ষামূলক আর বিনোদন সংক্রান্ত অ্যাপগুলির চাহিদা কমেনি। ইন্টারনেট গেমস এবং পাজ্ল-এর জনপ্রিয়তা বাড়ায় বেড়েছে ব্যবসা।

বই পড়ার অভ্যেস

করোনা-পরবর্তী কালে মানুষের বই পড়ার অভ্যেস বেড়ে গিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়। বই লেখা হচ্ছে, বই ছাপানো হচ্ছে, অনলাইনে অর্ডার হচ্ছে এবং ডেলিভ্যারি ম্যান বা  কুরিয়ারের ,মাধ্যমে পাঠানোও হচ্ছে।

জিম

ঝোঁক এসেছে শরীরচর্চার। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি লাভবান হয়েছে।

 স্বাস্থ্য সচেতনতা

করোনার কারণে মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে। সুস্থ জীবনযাপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন জীবনযাপন করে। হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, শহরের অলিগলি আগের চেয়ে বেশি পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা হয়। মানুষ এই পরিবর্তিত অভ্যাসগুলোতে সহায়ক পণ্য-সেবা অনেকদিন ভালো চলবে। মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন পণ্য বাজারে আসছে।

পরিবেশবান্ধব সেবা-পণ্য

করোনার কারণে পৃথিবীটা আরো বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে কার্বন নিঃসরণ সাত ভাগ কমেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন রেকর্ড৷ মানুষের যাতায়াত, বিমানযাত্রা, পর্যটন ইত্যাদি বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বেশ কয়েকবছর ধরেই কথা হচ্ছে। কিন্তু অনেক উদ্যোগ নিয়েও যথেষ্ট ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। করোনার কারণে কিছুটা হলেও সেটা সম্ভব হয়েছে। সব খারাপেরই কিছু ভালো দিকও থাকে। করোনার কারণে মানুষের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এর কারণে প্রকৃতি ও জীবজগতের উপকার হয়েছে। এই সচেতনতা বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণে পরিবেশবান্ধব সেবা-পণ্য বাড়াবে।

প্রযুক্তিনির্ভরতা

ভবিষ্যতে কারখানার মালিকগণ উত্পাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তিনির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এখরও মানুষের নিত্য জীবনযাত্রায় ভার্চুয়াল নির্ভরতা প্রবল হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি, ব্যাংক তাদের কর্মীদের করেনার কারণে হোম অফিসে পাঠিয়েছে। বিশ্বকে সংযুক্ত রাখতে অসাধারণ অবদান রেখেছে প্রযুক্তি। ভবিষ্যতে এআই প্রযুক্তি বাড়বে।

পরিবর্তনে সময়োপযুগী পণ্য-সেবা

সামাজিক আচার-আচরণ ও রীতি-নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরাসরি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন মিটিং-মিছিলের পরিবর্তে অনলাইনে মিটিং-মিছিল হতে পারে। বিয়ের অনুষ্ঠান, বউভাত, জন্মদিন ইত্যাদি পালন করার পদ্ধতি ও রীতি পরিবর্তন হতে পারে। সামাজিকভাবে আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়ানোর কালচারও অনেকটাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলির মতো সামাজিক প্রথাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সাইড বিজনেস

দীর্ঘসময় কাজ না থাকা, বেতন কর্তন, খরচ কমাতে ছাঁটাই, বেতন কমানোর প্রবণতা দেখে চাকরির পাশাপাশি অনেকে খুলছেন সাইড ব্যবসা। যেকোনও সময় চাকরি চলে গেলেও টিকে থাকতে এই ব্যবসা কাজে লাগবে। আগেভাগে শুরু করলে বিপদে মানসিক চাপটা কম থাকবে। চাকরিতে অনিশ্চয়তার কারণে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও পোশাকের ব্যবসায় বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছেন অনেকে। ঘরে বসে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে খাবার ও পোশাকের অর্ডার বাড়ছে। বাসায় বানানো খাবার বিক্রির উদ্যোগ নিতেই বেশি দেখা যাচ্ছে।ব্যয়ের চেয়ে আয় কমে যাওয়ায় বাজার থেকে রান্না পর্যন্ত সবই নিজেরা করে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছেও দিচ্ছেন অনেকে। মূল পেশার পাশাপাশি  ‘সাইড বিজনেস’ এখন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে।

মেসের ব্যবসা

খরচ কমাতে অনেকেই পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে নিজে ব্যাচেলর জীবনযাপন শুরু করেছেন। এই সুযোগে অনেকে মেসের জন্য অ্যাডভান্স দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে ব্যাচেলর ভাড়া দিচ্ছেন, স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাবারেরও ব্যবস্থা করছেন এবং এসব থেকে লাভ করছেন।

সাসটেইনিবিলিটি রক্ষার্থে পদক্ষেপ

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সাসটেইনিবিলিটি রক্ষার্থে নিকট ভবিষ্যতে উন্নয়নে অংশ নিবে।এই মহামারি একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে পৃথিবীকে সুন্দর করার, পরিচ্ছন্ন ভাবে। দেখিয়ে দিয়েছে – আমরা এককভাবে কেউ-ই নিরাপদ নই যদি না সবাই নিরাপদ হই।করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি মানবিক হবে। এগিয়ে আসবে মানুষের আরো কাছাকাছি।”

সৃজনশীল উদ্যোগ

অনলাইনে বেড়েছে সৃজনশীল নানা উদ্যোগ। প্রসেসড ভেজিটেবল বা প্যাকেটজাত কাটা সবজি, ঘি, বাদাম, লোকজ শিল্পকলার ধারায় তৈরি শৌখিন পণ্য, ভেষজ উপাদান, ফরমায়েশি গয়না, মসলা ও ঔষধি উদ্ভিদের গুঁড়া, গামছার মাস্ক থেকে শুরু করে আমসহ নানা ফলের চাহিদা অনলাইনে বেড়েছে এই করোনাকালে। কেউ তৈরি করছেন হাতে বানানো রুটি, কেউ আনছেন ছাদবাগানের জন্য সারযুক্ত মাটি কোনো পেজে বিক্রি হচ্ছে । ব্লকপ্রিন্টের পোশাক নিয়ে খুলেছেন ফেসবুক পেজ ।

কুরিয়ার

অনলাইনের প্রসারে বেড়েছে পণ্য পৌঁছানোর ভৌত বাজারও। নতুন কুরিয়ার কোম্পানি তৈরি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোরও কাজ বাড়ছে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের পণ্য সরবরাহে সহায়তা করে এমন  ই–কুরিয়ার এর নতুন উদ্যোক্তা যুক্ত হয়েছেএবং ডেলিভারি—দুই–ই বেড়েছে। মানুষের অনলাইনে অভ্যস্ততা বাড়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। আগে যার ক্রেতা ছিল এলাকা ভিত্তিক, এখন দেশজুড়েই তার ক্রেতা। ভিডিও করে পণ্য দেখিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে পণ্য বিক্রি করেন, কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন, বিকাশে পেমেন্ট নেন।

লাভবান  ব্যবসা

উবার মানুষের জীবনযাপন সহজ করেছে তা–ই নয়, চলাচলের খরচও কমিয়ে এনেছে অনেকটাই। শুধু যাতায়াত নয়, খাবার পরিবহনসহ অনেক ধরনের সেবাই দিয়ে থাকে তারা। হোয়াটসঅ্যাপ ফোনের নেটওয়ার্ককে মোটেই ব্যবহার করে না, ফলে খরচও হয় না এবং তা সহজেই জনপ্রিয়তা পায়। ইনস্টাগ্রামে যোগাযোগ করছে ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে। পিন্টারেস্ট অ্যাপটি যেন ডিজিটাল স্ক্র্যাপবুক।

নতুন নতুন স্টার্টআপ

দ্রুতগতির ফোর-জি ইন্টারনেট সুবিধা স্টার্টআপগুলোকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। করোনাকাল তাঁদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ চালু রয়েছে। করোনাকালে নতুন এসব স্টার্টআপ নতুন পথ দেখাচ্ছে। করোনাকালে ইন্টারঅ্যাকটিভ কেয়ারসের ই-লার্নিং, টেলিমেডিসিন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন অনেক মানুষ। এর বাইরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে অনলাইনে। ইন্টারনেট সুবিধার কারণে সহজে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে পেরেছে মানুষ।

অনলাইন প্রশিক্ষণ

চালু হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন প্রশিক্ষণ। সেখানে বর্তমানে কাজে লাগছে জুম, গুগল মিট, মাইক্রোসফট টিমস, স্কাইপে, হ্যাংআউটস ইত্যাদি সফটওয়্যার। ডিজিটাল মার্কেটিং, ভাষা শিক্ষার মতো বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে।

কো-ওয়ার্কিং স্পেস

করোনা পরবর্তী সময়ে বা এখনই নতুন নতুন বিজনেস মডেল আসবে যা হয়তো আরও কয়েক বছর পরে আসতো। একটি সাজানো গোছানো বিশাল অফিসে নিজের অফিস গড়ে তোলাকে বলা হচ্ছে কো-ওয়ার্কিং স্পেস। ঢাকায় একাধিক কো-ওয়ার্কিং স্পেস গড়ে উঠেছে।

স্মার্টফোন বিক্রি

করোনা মহামারীর বছরে সবচেয়ে বড় নির্ভরতা ও প্রয়োজন হয়ে পড়ে তথ্যপ্রযুক্তি। এ সময় দেশের মানুষের অনলাইন নির্ভরতা বাড়ার কারণে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ায় স্মার্টফোন বিক্রিও বেড়েছে। দেশে স্মার্টফোন বিক্রির এ হার আগের প্রান্তিকের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

এনডিটিভি,আনন্দবাজার, বিবিসি, ডয়চে ভেলে

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *