অ্যলামনাই এসোসিয়েশনের মাধ্যমে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী–শিক্ষকদের প্রয়োজনে সাহায্য–সহযোগিতা করতে, প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং করতে একসাথে কাজ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাবেকদেরও যে কিছু দায়–দায়িত্ব বা দায়িত্ব–কর্তব্য রয়েছে; তা পালন করতে পারে।
অ্যালামনাই কী?
ল্যাটিন ‘alumnus (অ্যালামনাস)’ শব্দ থেকে ‘alumni’ (অ্যালামনাই) শব্দের উদ্ভব। প্রথমে যার অর্থ ছিল পালকপুত্র, শিক্ষার্থী প্রভৃতি। সেকালে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সাধারণত পালকপুত্র হিসেবে শিক্ষকের গৃহে অবস্থান করে অধ্যয়ন করত। এদের বলা হতো ‘alumni’। অন্যদিকে, অতি ধনী লোকের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিজেই শিক্ষার্থীর বাড়িতে অবস্থান করতেন। বর্তমানে ‘alumni (অ্যালামনাই)’ শব্দটি ‘প্রাক্তন শিক্ষার্থী’ অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
রোমান আইনে প্রথম খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ‘alumnus’ শব্দটি প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন গুরুগৃহে অবস্থান করে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ‘অ্যালামনাই’ বলা হতো । সেকালে শব্দটি কেবল এই অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হতো।
অ্যালামনাইয়ের ইতিহাস
নবম শতকের প্রথম দিকে ‘alumni’ শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ‘প্রাক্তন শিক্ষার্থী’ প্রকাশে ব্যবহৃত হওয়ার সূচনা ঘটে। University of Bologna in Italy-কে কেন্দ্র করে কয়েক জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইউরোপে প্রথম অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বল্প পরিসরে একটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (Alumni Association) প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা নিয়ে আধুনিক অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়।
ষোড়শ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে বর্তমান অর্থ (প্রাক্তন শিক্ষার্থী) প্রকাশে ‘অ্যালামনাই’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। ফলে শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং মর্যাদাকর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান পেয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যালামনাই এসোসিয়েশন কী
অ্যালামনাই (Alumni) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রাক্তন’ এবং এসোসিয়েশন (Association) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সংঘ’। “অ্যালামনাই এসোসিয়েশন” এর সম্পূর্ণ অর্থ হচ্ছে “প্রাক্তন সংঘ”। স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অধ্যয়ন শেষ করা শিক্ষার্থীদেরকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলা হয়।
ঐ প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবং প্রতিষ্ঠানের লিখিত অনুমতিতে গড়ে তোলা হয়, ‘প্রাক্তন সংঘ’। আর এই সংঘ পরিচালনার জন্য থাকে নির্দিষ্ট একটি ‘প্রাক্তন পরিষদ’। এই ‘প্রাক্তন পরিষদ’ তৈরি করা হয় সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মতামতের উপর ভিত্তি করে।
কেন অ্যালামনাই এসোসিয়েশন
যারা যে প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে তাদের নিজ ব্যক্তিগত, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক–শিক্ষিকা, কর্মচারী–কর্মকর্তা এবং সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ার–টেবিল থেকে শুরু করে প্রতিটি দেয়ালে তাদের নানান স্মৃতি জড়ানো থাকে। অধ্যয়ন করা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পরও আমাদের প্রত্যেকের মনে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মায়ামমতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কাজ করে। প্রত্যেকেরই ইচ্ছা করে ফিরে যেতে পুরানো সময়ে, যদিও তা কখনো সম্ভব নয়।
তবে প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ সম্পর্ক বজায় রেখে পুরানো স্মৃতি মনে করে অনুভবে ফিরে যাওয়া যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। সাধারণত প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পর অধিকাংশেরই ক্যাম্পাসে আসা হয় না। এ যোগাযোগ সম্পর্ক নিয়ে যায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে আসা সেই ক্যাম্পাসে।
এ যোগাযোগ সম্পর্ক বজায় রাখার একটি মাত্র উপায় প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন সংঘ এর সাথে নিজেকে যুক্ত করা। প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যই এ ধরনের প্রাক্তন সংঘ তৈরি করা হয়।
অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের উদ্দেশ্য
প্রতিষ্ঠানের সাথে সাবেক শিক্ষার্থীদের সেতুবন্ধনের মাধ্যম অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। যা ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্ক অটুট রাখে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে কাজ করে।
অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজ প্রতিষ্ঠানের সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে সকলের মাঝে সম্পর্ক তৈরি করা। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা, নানান চিন্তা–ভাবনার মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, দেশের নামীদামী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিবর্গকে চেনা, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সকলের মাঝে উপস্থাপন করা এবং বহুবিধ কাজের মাধ্যমে কিছু না কিছু শেখা। এ সবকিছু বাস্তব জীবনকে নানানভাবে প্রভাবিত করে থাকে। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন ও কিছু শিখার থাকে।
অ্যালামনাই নাকি এলামনাই?
অ্যালাম আর এলাম কখনো এক হতে পারে না। রোমান–ইংলিশ শব্দের শুদ্ধ রূপ অ্যালামনাই। ইংরেজি a বর্ণের উচ্চারণ বাংলা এ বর্ণের মতো নয়; অ্যা এর মতো। এলামনাই শব্দটি alumni শব্দের প্রতিবর্ণীকৃত কোনো শব্দ হতে পারে না। alumni শব্দের একমাত্র শুদ্ধ এবং প্রমিত রূপ অ্যালামনাই।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কী করতে পারে?
অরাজনৈতিক, অলাভজনক, স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে সংস্থাটি একটি কার্যালয় তৈরি করতে পারে। অ্যালামনাইদের কল্যাণে ও মাদ্রাসাটির ভাবমুর্তি উন্নত করতে ‘অ্যাসোসিয়েশন’ পরিচালিত হতে পারে। অ্যালামনাইদের মধ্যে একতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন এবং একে– অন্যকে যথাসম্ভব সাহায্য ও সহযোগিতা করতে পারে। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। সাহায্য পাওয়ার যোগ্য শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য একটি পৃথক তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অ্যালামনাইদের জন্য সমাবেশ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশিবির, প্রদর্শনী ও আমোদ ভ্রমণের আয়োজন করতে পারে। লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, কনফারেন্স সেন্টার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, গবেষণাগার, ক্রীড়া ও আপ্যায়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিয়মিত ‘বুলেটিন’, সাময়িকী, পুস্তক মুদ্রণ ও বিভিন্ন প্রকাশনা প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন ও বিনোদনমূলক কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্টস বাস্তবায়নসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে সহযোগিতা করতে পারে। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। অ্যাসোসিয়েশনের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ও কর্মসূচির প্রয়োজনীয় প্রচার, বার্ষিক পুনর্মিলনী, বার্ষিক সাধারণ সভা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্মরণিকা বা পুস্তিকা, গবেষণা ইত্যাদি প্রকাশণার ব্যবস্থা করতে পারে। সমাজসেবামূলক দায়িত্ব পালন করতে পারে। বিভিন্ন জনহিতকর ও মানবিক কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে।
সাবেকদের তথ্য সমৃদ্ধ একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ প্রস্তুত, হালনাগাদ ও সংরক্ষণ করতে পারে। যেখানে মোবাইল নম্বর, ইমেল এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, বাংলা ও ইংরেজি নাম, মাদ্রাসায় কত সালের কোন মাসের কত তারিখ থেকে কত সালের কোন মাসের কত তারিখ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিলেন এসব ব্যক্তিগত বিবরণ থাকতে পারে।
গুণীজনকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করতে পারে। প্রাক্তন সফল শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করতে পারে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সফলদের সম্মাননা প্রদান করতে পারে। মেধাবী, কৃতি ও দরিদ্র ছাত্র–ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করতে পারে। ভালো ফলাফল করায় পুরস্কৃত করতে পারে। সদস্য/ সদস্যাদের মননশীলতা, সৃজনশীলতা এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে পারে।
এর ফলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে বন্ধন, সেটা সবসময় অটুট রাখার সুযোগ তৈরি হয়। সবসময় যোগাযোগ রাখার সুযোগ তৈরি হয়। একসাথে পথচলায় আনন্দ অনেক। পুরনো দিনের গল্প শুনার ও বলার কালচারটাই এমন যে আবেগাপ্লুত করে। এক জায়গায় হওয়ার সুযোগ পেলেই স্মৃতিচারণ হয়, অনেককেই চেনাজানা হয়, নতুনদের সাথে পুরাতনদের যোগাযোগ হয়। জেনারেশনাল চেঞ্জ হলেও সম্পর্কের দৃঢ়তা অটুট থাকে ।
একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করার মাধ্যমে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলা এবং প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলার্থে ভালো কিছু করার অভিপ্রায় লালন করা, সকল অ্যালামনাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন সুদৃঢ় করা, আন্তঃ যোগাযোগ ও পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করা যায়। প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য বৃদ্ধি, শক্তিশালী আন্তঃসম্পর্ক, এবং বন্ধুত্ব বৃদ্ধি করা যায়। নিয়মিত সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি সক্রিয় এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ কাজের সম্পর্ক লালন ও বজায় রাখার চেষ্টা করা যায়।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ইতিবাচক দিক
সাবেকদের জীবনের সংগ্রাম, তাদের স্বপ্ন, তাদের পরিকল্পনা ও তাদের কর্ম সম্পর্কে জানতে পেরে অন্যরা অনুপ্রাণিত, উত্সাহিত ও আনন্দিত হয়। অনেক প্রাক্তনকেই ভালো চিন্তা ও কাজকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই মনোযোগী এবং আলোচনায় খুবই আন্তরিক পাওয়ায় সেবামূলক ও স্বেচ্ছাশ্রমধর্মী কাজে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অন্যদের শুভ বোধ, সহযোগিতার মানসিকতা ও সহমর্মিতা হৃদয়কে আলোকিত করে।
যখন সিনিয়র, জুনিয়র ও বন্ধুরা যোগাযোগকে গুরুত্ব সহকারে নেয় তখন ভালো লাগে এবং আশাবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পায়। সকলের সম্মিলিত চেষ্টা ও আন্তরিক প্রয়াসে অনেক ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব হয়। ভালো ও আনন্দের অনুভূতি তৈরি করার মতো সাবেকদের মধ্যে থাকা অনেক কিছু জানা যায়।
অনেকেরই ভালো চিন্তা থাকে, ভালো কিছু কাজ করার আগ্রহ থাকে; তা কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ ও একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য সহায়ক হয়। একসাথে পথ চলতে যারা ইচ্ছুক, তারা সাধারণত স্বপ্নময়, দূরদর্শী এবং সমাজে অবদান রাখতে আশাবাদী। ফলে নানা যৌথ উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
যেমন দরিদ্র মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা, দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আয়োজন, মিলনমেলা-পিকনিক, সম্মাননা দেয়া, সাহায্য-সহযোগিতা করা, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখা, স্মারণিকা প্রকাশ করাসহ কলাণধর্মী নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয় প্লাটফর্মটির মাধ্যমে।