নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা

আনিসুর রহমান এরশাদ

 কবি কাজী নজরুল  ইসলাম ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে  মানবমঙ্গলের গান গেয়ে গেছেন।  তিনি নিপীড়িত সাধারণ মানুষের প্রগতি চেয়েছেন, পিছিয়ে পড়াদের জাগাতে চেয়েছেন, চেয়েছেন ইংরেজ শাসকদের হটিয়ে দিয়ে উপমহাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ঝান্ডাকে উড্ডীন করতে। তিনি ছিলেন সকল সংগ্রামে, তিনি ছিলেন সকল সংগ্রামীর অন্তরে, তিনি প্রতিনিধি অত্যাচারিতের এবং দুর্বলের, তিনি গেয়েছেন মানুষের জয়গান, তার প্রাণে ছিল তারুন্যের উল্লাস। নজরুলের জন্ম তার দু:খ দারিদ্রে, অনাথ এতিম অবস্থায়। সেই শিশু কাল থেকেই তাকে ঘিরে ধরেছে দারিদ্রের অভিশাপ। দুবেলার দু মুঠো অন্ন জোগাড় করেছেন নিজের অর্জনে, যখন তার থাকার কথা খেলার মাঠে, শিশুদের পাঠশালায় স্লেট চক হাতে। তাই সব সময়ই দেখা যেত তার কাব্যে পরাজিতের জন্য, দূর্বলের জন্য, সর্বোপরি মানুষের জন্য সুতীব্র ভালবাসার কথা।

নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের কণ্ঠস্বর। তার কবিতা গানে কিংবা যে কোন লেখায় প্রকাশ পেল সাম্যের কথা, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন এক সমাজের কথা। কবি নজরুল শ্যামা সঙ্গীত, হরিনাম, কীর্তন রচনা করেছেন তাই তিনি হয়েছেন কাফের, হিন্দুত্ববাদী -আবার গজল ইসলামী সঙ্গীত রচনা করেছেন, আরবী ফারসী সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছেন, কবিতা গানে বা সাহিত্য কর্মে ফারসী আরবী হরদম ব্যবহারে সিদ্ধ ছিলেন তাই গোঁড়াপন্থীদের কাছে ছিলেন সাম্প্রদায়িক। অথচ কবি সে যুগে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেছেন যিনি কিনা একজন হিন্দু ছিলেন।ফলে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, নজরুল অসাম্প্রদায়িক ছিলেন; মানবতাবাদী চেতনাই ছিল তার অন্তরজাত প্রেরণার উৎস।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি

প্রাথমিক কথা

নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ করেছেন – “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’’ নজরুল চেয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদমুক্ত সম্প্রীতি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই তিনি সম্প্রদায়গত বিভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তিনি যে সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে অসাম্প্রাদায়িক কবিতা লিখেছেন তা মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। তিনি কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের হয়ে মুক্তিযোদ্ধ করেন নি।

পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তি ছিল তার স্বপ্ন। মানব হিতৈষণাই তার চেতনার মূল প্রেরণা, মৌল শক্তি! নজরুল ছাড়া মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক কবি শুধু বাঙলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিরল। নজরুল ছিলেন প্রগতিশীল মানবতাবাদী কবি এবং মানুষের কবি। মানবতাবাদী ও মানুষের কবি বলেই তিনি আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিলেন। সত্য-সুন্দর-কল্যানের পূজারী নজরুল সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানুষের মুক্তি চেয়েছেন, সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের প্রাণান্তকর সংগ্রাম, সাম্য ও মুক্তির বাণী আজ বর্তমান প্রেক্ষাপটেও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।  

অসাম্প্রদায়িক বলতে কি বুঝায়?

অসাম্প্রদায়িক মানে যিনি সাম্প্রদায়িক নন। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তি বিশেষে এক্ষেত্রে গৌণ, মূখ্য হলো সম্প্রদায়। অসাম্প্রদায়িক মানে, বিশেষ কোনো দল বা ধর্ম-সম্প্রদায় সম্পর্কে নিরপেক্ষ, সর্বজনীন; দলাদলি করার ভাব নাই এমন, উদার।

নজরুলের সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

১৯২৭ সালে অধ্যক্ষ ইবরাহিম খাঁ- কে লেখা চিঠিতে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা লক্ষ করা যায়। “হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিচ্ছু হবে না, এ আমিও জানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র-সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে।” তাই তিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়েই এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করবার প্রয়াস চালিয়েছেন।

শব্দ ব্যবহারে অসাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল সৃষ্টি

“বিদ্রোহী’’ কবিতায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে আহরিত শব্দ, উপমা, রূপক ও বাকভঙ্গি অনায়াসে মিশে গেছে। একই নিঃশ্বাসে কবি তাই উচ্চারণ করেন-

‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,

আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ,

আমি বজ্র, আশি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,

আমি ইস্রাফিলে সিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,

আমি পিণাকপানির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,

আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড।

অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই কাব্যে হিন্দুয়ানি মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। যেমন-

‘ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,

রথ টেনে আন, আনরে ত্যজিয়া,

পূজা দেরে তোরা, দে কোরবান।

শত্র“র গোরে গালাগালি কর, আবার হিন্দু-মুসলমান।

বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’

এখানে কাজিয়া, রথ, ত্যজিয়া, পূজা, কোরবান, গোরে, শঙ্খ ও আজান শব্দগুলি হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক, নজরুল শব্দ ব্যবহারে এভাবেই তাঁর কাব্যে একটি অসাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা

নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে যে অসাম্প্রদায়িক চিত্র পাওয়া যায়-তা অন্যত্র দুর্লভ। যেমন-

‘গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু- বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

অথবা,

‘গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান,

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম-জাতি

সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।’

‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার চিত্র উঠে এসেছে অবলীলায়। যেমন-

‘মাভৈ! মাভৈ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,

সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান- গোরস্তান!

ছিল যারা চির-মরণ-আহত,

উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা জাগ্রত,

‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ।

জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।

মরে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,

বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ মরণে নাহি লাজ।’

‘পথের দিশা’ কবিতায়ও নজরুলের ক্ষোভ ও দ্রোহ অস্পষ্ট নয়। যেমন-

‘চারিদিকে এই গুণ্ডা এবং বদমায়েসির আখড়া দিয়ে

রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই পারবি আপণ প্রাণ বাঁচিয়ে?

…….                 ………               ………

ভগবান আজ ভূত হ’ল যে প’ড়ে দশ-চক্র ফেরে,

যবন এবং কাফের মিলে হায় বেচারায় ফিরছে তেড়ে।

বাঁচাতে তায় আসছে কি রে নতুন যুগের মানুষ কেহ?

ধূলায় মলিন, রিক্তা ভরণ, সিক্ত আঁখি, রক্তদেহ?

মসজিদ আর মন্দির ঐ শয়তানের মন্ত্রণাগার,

রে অগ্রদূত, ভাঙতে এবার আসছে কি জাঠ কালাপাহাড়?

জানিস যদি, খবর শোনা বন্ধু খাঁচায় ঘেরাটোপে,

উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির পিঠেদ, দাঁড়ির ঝোপে।’

‘যা শত্রু পরে পরে’ কবিতায় ও হিন্দু-মুসলিম কলহের চিত্র সামান্য নয়। যেমন-

‘ঘর সামলে নে এই বেলা, তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন!

আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!

ধর্ম-কলহ রাখ দুদিন।

নখ ও দন্ত থাকুক বাঁচিয়া

গণ্ডুষ ফের করিবি কাঁচিয়া,

আসিবে না ফিরে এই সুদিন!

বদনা গাড়তে কেন ঠোকাঠুকি, কাছা- কোঁচা টেনে শক্তি ক্ষীণ,

সিংহ যখন পঙ্কলীন।’

বস্তুত এ-সব কবিতা থেকে সহজেই একজন অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে নজরুলকে চিহ্নিত করা যায়।

গদ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

‘হিন্দু-মুসলমান’ এবং ‘মন্দির ও মসজিদ’ শীর্ষক গদ্যে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সুপরিস্ফুট। ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন, ‘‘মারো শালা যবনদের’’। ‘মারো শালা কাফেরদের।’’-আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। প্রথম কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘ প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম-তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে-“বাবা গো, মাগো মাতৃ পরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।’…

একই প্রবন্ধের অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেন, ‘এক স্থানে দেখিলাম, ঊনপঞ্চাশ জন ভদ্র-অভদ্র হিন্দু মিলিয়া একজন শীর্ণকায় মুসলমান মজুরকে নির্মমভাবে প্রহার করিতেছে, আর এক স্থানে দেখিলাম, প্রায় ঐ সংখ্যক মুসলমান মিলিয়া একজন দুর্বল হিন্দুকে পশুর মত মারিতেছে।’ এরপরই নজরুল মন্তব্য করেন-‘দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল মানুষ। ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জঙ্গী বর্বরেরা শুকরকে খোঁচাইয়া মারে। উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শুকরের চেয়েও কুৎসিত। হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ।’

নজরুল আরো মন্তব্য করেন, ‘ দেখিলাম, আল্লার মজসিদ আল্লা আসিয়া রক্ষা করিলেন না, মা-কালীর মন্দির কালী আসিয়া আগলাইলেন না। মন্দিরের চূড়া ভাঙ্গিল মসজিদের গম্বুজ টুটিল। আল্লার এবং কালীর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। আকাশ হইতে বজ্রপাত হইল না হিন্দুদের মাথার উপর। এই গোলমালের মধ্যে কতকগুলি হিন্দু ছেলে আসিয়া গোঁফ দাড়ি কামানো দাঙ্গায় হত খায়রু মিয়াকে হিন্দু মনে করিয়া ‘বল হরি হরিবোল’ বলিয়া শ্মশানে পুড়াইতে লইয়া গেল এবং কতকগুলি মুসলমান ছেলে গুলী খাইয়া দাড়িওয়ালা সদানন্দ বাবুকে মুসলমান ভাবিয়া, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়িতে পড়িতে কবর দিতে নিয়া গেল। মন্দির ও মসজিদ চিড় খাইয়া উঠিল, মনে হইল যেন উহারা পরস্পরের দিকে চাহিয়া হাসিতেছে।’

‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি বলেন-‘হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব, দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব, তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি! আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে সেটাও ভাই পণ্ডিত মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।”

অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানদের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমি মানুষের জন্য এসেছি-আলোর মত, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তরা বলেন, কৃষ্ণ হিন্দুর, মুহম্মদের ভক্তরা বলেন, মুহম্মদ মুসলমানদের, খ্রীষ্ট শিষ্যেরা বলেন, খ্রীষ্ট ক্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ মুহম্মদ খ্রীষ্ট হয়ে উঠলে জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তি নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষ, কিন্তু গরু ছাগল নিয়ে করে।

তিনি দেশের তরুণ সমাজকে উদার মানবতায় উচ্চাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বের উর্দ্ধে ওঠার আহ্বান জানান। গদ্যেও নজরুল তাঁর বক্তব্যকে একটা অসাম্প্রদায়িক কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। এখানেই অসাম্প্রদায়িক গদ্যকার হিসেবে নজরুলের স্বকীয়তা।

উপন্যাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসের নজরুলের ধর্ম নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর মতে হিন্দু-মুসলিম- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই অভিন্ন এক মানব ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে আছে। ধর্মের বাহ্যিক রূপটা একটা খোলস মাত্র। ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্যকে ভুরে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান বাহ্যিক আচার-আচরণকে অহেতুক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

সব ধর্মের ভিত্তি চিরন্তন সত্যের পর- যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনো রয়েছে এবং অনন্তে থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ঐখানেই। ধর্মের আদত সত্যটাকে না ধরে এরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান।

নজরুল ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনাকাঙ্খী। তাঁর মতে এই উভয় সম্প্রদায়ের মিলনের পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে হিন্দুদের ছোঁয়াছুঁয়ির বাছ-বিচার। ‘এ আমি জোর করে বলতে পারি, এই ছোঁয়াছুঁয়ির উপসর্গটা যদি কেউ হিন্দু সমাজ থেকে উঠিয়ে দিতে পারেন, তা হলেই হিন্দু-মুসলমানদের একদিন মিলন হয়ে যাবে। এইটাই সবচেয়ে মারাত্মক ব্যবধানের সৃষ্টি করে রেখেছে, কিন্তু বড় আশ্চর্যের বিষয় যে, হিন্দু-মুসলমান মিলনাকাক্সক্ষী বড় বড় রথীরাও এইটা ধরতে পারেননি। তাঁরা অন্য নানান দিক দিয়ে এই মিলনের চেষ্টা করতে গিয়ে শুধু পণ্ডশ্রম করে মরছেন।

সংগীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভাবনার মধ্য দিয়ে স্বদেশচেতনার পরিচয় দিয়েছেন নজরুল। যেমন-

‘ মোরা এক বৃন্তে  দুটি কুসুম

হিন্দু-মুসলমান

মুসলিম তার নয়নমণি,

হিন্দু তাহার প্রাণ।

নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক গান (কল্পতরু সেনগুপ্ত’ ১৯৯২; ১৬৫), গানের উৎস এবং চরণ-ই প্রমাণ দেয়।

‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’’-ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন!

কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।

তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক এক সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে এ গানটি পরিবেশন করেন। এভাবে নজরুল তাঁর এই ধারার গানগুলিকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম সবাইকে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন-

১. জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছ জুয়া

২. দুর্গম গিরি কান্তার মরু

৩. পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর/বিধির বিধান সত্য হোক

৪. ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়

৫.ভারতের দুই নয়ন-তারা হিন্দু-মুসলমান-ইত্যাদি।

নজরুল ইসলামের কাছে সব মানুষ যেমন পবিত্র ছিল, তেমনি সব ধর্মও ছিল সমান শ্রদ্ধেয়। কোনো ধর্মকে তিনি এতটুকু খাটো করে দেখেননি। সব মানুষই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সকল মানুষের মিলিত শক্তিই ছিল তাঁর কাম্য। তাই গানে, সংগীতে প্রকাশ পেয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা।

সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূরীকরণে নজরুলের প্রয়াস

সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূরীকরণে নজরুল অব্যাহত প্রয়াস চালিয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখালেখি ছাড়াও নানান তৎপরতার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। যেমন-

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী ইশতেহারে সই

 ১৯২৬ সালের এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে-তিনবার, কলকাতায় রক্তাক্ত দাঙ্গা বাঁধে। বেদনাহত নজরুল এবং তাঁর বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদ সে সময় বাংলায় ও উর্দুতে দাঙ্গা বিরোধী ইশতেহার প্রকাশ করেন। নজরুল তাতে সই করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে আলোচনা

‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?… যে প্রশ্ন করছিলাম   এই যে ভেতরের ন্যাজ, এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর ও দাড়ি-স্থানই বুঝি এর আদি জন্মভূমি।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম

নজরুলের জীবন ও চিন্তা সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী কেবল নয়, যিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন ধর্মীয় শাসন  ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ঐক্যের প্রচেষ্টা

সাম্প্রদায়িক বিরোধের সময় তিনি জাতির সামনে প্রশ্ন রাখেন গানের কলি-‘আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ’। দেশের ভয়ানক পরিস্থিতিতে তিনি লেখেন-

যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির-চূড়া,

সে লাঠি কালি প্রভাতে করিবে শত্রু-দুর্গগুড়া।

প্রভাতে হবে না ভায়ে-ভায়ে রণ,

চিনিবে শত্রু, চিনিবে স্বজন।

করুক কলহ- জেগেছে তো তবু-বিজয়- কেতন উড়া!

ল্যাজে যদি তোর লেগেছে আগুন, স্বর্ণলঙ্কা পুড়া!

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি

অসাম্প্রদায়িক চেতনার কোনো স্থপতি যদি এদেশে জন্মে থাকেন তিনি হলেন নজরুল। নজরুল লিখেছিলেন, ‘আমি স্রষ্টাকে দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধুলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।’ নজরুল সাম্প্রদায়িক হলে ‘মানুষ’ না বলে একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্যই বলতে পারতেন। সুতরাং নজরুল অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিবাদী মুসলমান বলেই নিজেকে চিহ্নিত করে গেছেন।

কৈশোরই নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ভিত্তি

 ‘‘রাণীগঞ্জে নজরুলের আরও একজন বন্ধু জুটেছিলেন। তার নাম ছিল শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ। নজরুল ইসলাম মুসলমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় হিন্দু-ব্রাহ্মণ, আর শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ খ্রীস্টান। তিনবন্ধু একসঙ্গে  বেড়াতেন। নজরুল ইসলাম যে রেলওয়ে গার্ডের বাড়িতে চাকরি করেছিল তার শ্রীমতি হিরণপ্রভা ঘোষ ছিলেন শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষের দিদি।’’

হিন্দু-মুসলিম মিলনাকাঙ্খী নজরুল

মানবধর্মের পূর্ণ বিকাশের প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমানের মিলনাকাঙ্খী ছিলেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা অটুট ছিল। অধ্যাপক আহমদ শরীফের ভাষায়, ‘সাহিত্যক্ষেত্রে তাই তাঁর অসাম্প্রদায়িক মৈত্রীকামী চেতনা সক্রিয় ছিল গোড়া থেকেই। নজরুল ইসলাম সারাজীবন প্রায় সতর্কভাবেই চেতনায় চিন্তায় কথায় ও আচরণে এ অসাম্প্রদায়িকতা বজায় রেখেছিলেন।’ নজরুল নিজেও দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছেন এভাবে,  ‘আমি হিন্দু-মুসলমানদের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী, তাই তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দুদের দেবীর নাম নিই।’

অসাম্প্রদয়িক মানসিকতাই নজরুল চেতনার মূল উৎস

মানবতার কবি হতেই তাকে সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ, গ্লানি ও ভয়ঙ্কর চেহারাকে নিশ্চিহ্ন করার কাজটুকু শুরু করতে হয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে তিনি এক মিশনারী

তিনি অনুভব করেছেন, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আলাদা আলাদা ধর্মীয় সংস্কৃতি পরিহার করে একটি ঐক্যবদ্ধ মিশ্র সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল তাঁর অন্তরজাত প্রেরণার উৎস।

সাম্প্রদায়িকতার বিরোধীতায় নজরুল; মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি

নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল অংশ জুড়ে আছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’-এ মর্মবাণী। তিনি বিশ্বাস করতেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিশ্চান হোক-নিপীড়িত মানবতার একটাই পরিচয়, তারা শোষিত বঞ্চিত মানুষ।

কোনো বিশেষ সম্প্রদায় নয়, চেয়েছেন মানবতার জাগরণ

হিন্দু-মুসলিম যাই হোক না কেন মানবতার উদ্ভোধনই নজরুলের বিশেষ লক্ষ। তাঁর মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাঁর উজ্জীবনী-শক্তি, তাঁর চেতনার রঙের বৈচিত্র, তাঁর মানবিক প্রেম এবং তাঁর উদার আন্তর্জাতিকতা।

দিয়েছেন উদারনীতিক মানসিকতার সুস্পষ্ট পরিচয়

‘সাম্যবাদী’ ‘সর্বহারা’ ও ফণি মনসা’র মতো কাব্যগ্রন্থে তাঁর আন্তর্জাতিক ও উদারনীতিক সাহসিকতার পরিচয় সুস্পষ্ট।

মানবধর্মই আত্মস্ফুরণের অন্তরলৌকিক চেতনার উৎস

কাজী নজরুল ইসলাম একমাত্র কবি যিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল নিপীড়িত বাঙালির কবি। তাঁর জাগরণের আহ্বানে বিশ্বের সকল বঞ্চিত, শোষিত মানুষের জাগরণের আহ্বান। তিনি জানেন পৃথিবীর সকল সম্পদে সকলের সম অধিকার।

মানবতাবাদী মানুষরূপে উপস্থাপন

নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ। তিনি অনুভব করেন মানবধর্মকে, মানুষকে, মানবীয় চেতনাকে, তাই ‘সাম্য’ তাঁর কাছে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।

প্রবহমান জীবন সত্যের অনুসরণ; মানবাত্মায় বিধৃত

মানব আত্মার অবমাননা কাজী নজরুল সহ্য করতে পারেননি। তাই বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে কবিতা, গানে, প্রবন্ধে, উপন্যাসে, গল্পে, নাটক ও সাংবাদিকতায়।

মানবপ্রেম; মাতৃভূমিকে মা রূপে রূপায়ন

নজরুল মানবপ্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমকে মিশিয়েছেন, মাতৃভূমিকে মা’রূপে রূপায়ন করেছেন।

‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!

‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।

নজরুল মানস ও চিন্তা- চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতা

‘ধর্ম’ সম্পর্কে নজরুল লিখেছেন-‘মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোন্খানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনীয় ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।’

ব্যক্তিজীবনে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ চিন্তার উর্দ্ধে অবস্থান

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ কবি নিজে এবং তার দ্বিতীয় বিবাহ। প্রমীলা তাঁর স্ত্রী সরার জীবনের সঙ্গী কিন্তু উভয়েই যার যার ধর্ম বজায় রেখেছিলেন। কাউকেই ধর্ম পরিবর্তন করতে হয়নি। সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম কাজী কৃষ্ণ মোহাম্মদ (শৈশবে মৃত), দ্বিতীয় সন্তান কাজী অরিন্দম খালেদ ( বাল্য মৃত), তারপর কাজী সব্যসাচী, সর্বশেষ কাজী অনিরুদ্ধ। সে যুগে এ ধরনের বাংলা নাম রাখার চিন্তা নজরুলের মতো উদারচেতা ব্যক্তিই করতে পারেন।

প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল আলোকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা

নজরুলের অন্তর- প্রেরণার উৎস ‘মানুষ’। এই মানুষকে খুঁজতেই তিনি সম্প্রদায়গত বিভেদ, বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা করেন। শৈশবের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষে কাজ করেছেন সারাজীবন।

ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মশোষণের ব্যাপারে নজরুল

নজরুল নির্বিকার দ্বিধীহীন এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে ঘোষণা করেন-

“কাটা উঠেছি ধর্ম-আফিস নেশা

ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা

ভাঙ্গি মন্দির, ভাঙ্গি মসজিদ

ভাঙ্গিয়া গির্জন গাহি সঙ্গীত

এক মানবের একই রক্তে মেশা

কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”

অসাম্প্রদায়িক নজরুলের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

নজরুল হিন্দু-মুসলমানের গালাগালিকে গলাগলিতে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ ঘোষ এর বক্তব্যটি স্মরণযোগ্য-“সাম্যবাদী চিন্তা তার মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে-হিন্দু মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতনা না হয়ে তার চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই প্রান্ত।”

দুই ধর্মের সৌন্দর্যকে এক করে দেখেছেন নজরুল। তিনি যেমনি বিপুল পরিমাণ কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন তেমনি লিখেছেন হামদ-নাত, গজল, ইসলামি সঙ্গীত। তিনি যেমন লিখেন-

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে

যেন উষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে।

তিনি আবার লিখেন-

আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়

দেখে যা আলোর নাচন

মায়ের রূপ দেখে বুক পেতে শিব

যার হাতে মরণ বাঁচন।

নজরুল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যে লড়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, সমৃদ্ধ দেশ, উন্নত জাতি তথা শান্তিময় পৃথিবী  গড়ায় নজরুলের চেতনাকে সবার মাঝে ছড়ায়ে দিতে হবে। এ জন্য দেশের মাটি, মানুষ তথা বিশ্বমানবতার প্রয়োজনে বৃদ্ধি করতে হবে নজরুল চর্চা। জাতীয় পর্যায়ে নজরুল চর্চার অর্থই হল আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিকে শক্ত করে তোলা। নজরুল আমাদের আত্মপ্রতিরোধ শক্তি। তাই নজরুলকে উচ্চকিত করার অর্থ আমাদের দেশকে, আমাদেরকে উচ্চকিত করে তোলা।

বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং নজরুল এক ও অবিভাজ্য। এর চেয়ে সত্য আর কিছু হয় না। জাতীয় পরিমণ্ডলে আমাদের জীবন, সমাজ, সংসার, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সাহিত্য, মঞ্চ,  মিলনায়তন, মিডিয়া, ক্লাসরুম সবকিছুকে নজরুলময় করতে হবে। তাঁকে রাখতে হবে সর্বসময় দৃশ্যমান এবং প্রাণপণ করে। অসাম্প্রদায়িকতার অভিশাপমুক্ত দেশ বা বিশ্ব গড়তে নজরুলের চেতনার বিকাশের বিকল্প নেই।

শেষ কথা

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বতোভাবে সংস্কারমুক্ত উদার মানবতাবাদী এবং ধর্মবোধে কল্যাণকামী কবি। এদেশের মানুষের ধর্মবোধে আঘাত দিয়া নহে বরং ধর্মের নামে অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সরব এবং সাহসী ছিলেন। তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়, বিশ্বাসের ক্ষুদ্রতা বা সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিজেকে হারাইয়া দেন নাই। ব্যক্তিজীবনেও তিনি গোঁড়ামি ও তথাকথিত সংস্কারের হাতে বন্দী হন নাই, কোনো রুদ্ধ কথা বিবেচনার মধ্যে নিজের মুক্ত ও উদার ভাবনাকে বন্ধকও দেন নাই।

অসাম্প্রদায়িক, সাম্য ও মানবতাবাদী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, আমাদের জাতিসত্তার প্রধান রূপকার, আমাদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার কবি, মানুষ এবং মানবতার কবি, বাংলা সাহিত্যে আমাদের সর্বোচ্চ মিনার। বেঁচে থাকার জন্য বাতাস, পানি এবং খাদ্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি জাতি হিসেবেও আমাদের জন্য নজরুল। এবং তা কোনো বিচারেই এরই প্রাসঙ্গিকতা মনে রেখে আমাদের এখন দরকার অবিরল, অবিরাম, অবিশ্রাম এবং অবিশ্রান্ত নজরুল চর্চার।

বাংলাদেশের মানুষের মনে, মননে, শরীরে, আত্মায়, চেতনায়, সংগ্রামে, সংস্কৃতিকে, আচরণে, বিশ্বাসে, স্বপ্নে, জাগরণে, প্রতিদিনের যাপিত জীবনের চারদিকে নজরুল আছেন, নজরুল থাকবেন। আমাদের সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, ধর্ম বিনাশী যে চক্র অষ্ট-প্রহর সর্প দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়-ফুঁক করে এগুলোকে শেকড়সুদ্ধ নাড়াতে হলেও দরকার নজরুলের। তাই নজরুলকে উচ্চকিত করে তুলতে হবে।

তথ্য নির্দেশ

১) ড. আলী হোসেন চৌধুরী, ‘অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি নজরুলের অন্তর প্রেরণার উৎস’, নজরুল: বিবিধ প্রসঙ্গ, মনন প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ২০০৯

২) মাহবুব হাসান, নজরুলের রাজনৈতিক চিন্তা- চেতনা, ‘তৃতীয় অধ্যায়-অসাম্প্রদায়িকতা: নজরুল ইন্সটিটিউট, জুন ১৯৯৭

৩) তিতাশ চৌধুরী, নজরুলের নানা দিক, ‘অসাম্প্রদায়িক নজরুল: এক; মুক্তধারা, ৬ষ্ঠ ঢাকা বইমেলা, ডিসেম্বর ১৯৯৯

৪) বিশ্বজিৎ ঘোষ, ‘নজরুল মানস: প্রসঙ্গ অসাম্প্রদায়িকতা’, জাতীয় পর্যায়ে বৎসর ব্যাপী নজরুল জন্মশত বার্ষিকী উদ্বোধন স্মারক গ্রন্থ, নজরুল ইন্সটিটিউট, জুন ১৯৯৯

৫) বদরুদ্দীন উমর, সাম্প্রদায়িকতা, পৃ.১২

৬) সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, একবিংশতিতম মুদ্রণ মে ১৯৯৭, পৃ.৫৩

৭) কাজী নজরুল ইসলাম, ‘বিদ্রোহী’ অগ্নিবীণা, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩

৮) কাজী নজরুল ইসলাম, ‘যা শত্রু পরে পরে’ ফণিমনসা

৯) ‘সাম্যবাদী: ‘সর্বহারা’, ‘সঞ্চিতা’, পৃ.৭৫

১০) ‘মানুষ’, ঐ, পৃ.৭৭

১১) কাজী নজরুল ইসলাম, ‘সঞ্চিতা’ ফণিমনসা ‘পথের দিশা’ (ঢাকা: ৯ম সংস্করণ, মাওলা ব্রাদার্স ১৯৯৮ সাল), পৃ.৮৭

১২) ঐ, ‘ফণিমনসা’ ‘সঞ্চিতা’, পৃ.২০,১২৩

১৩)  ঐ, ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘রচনাবলী: ১’, পৃ.৭০৭,৭০৫

১৪) ঐ, ‘বাঁধনরা’, ‘নজরুল রচনাবলী’, প্রথম খণ্ড, আবদুল কাদির সম্পাদিত, পৃ.৫৯৩,.৫৬৪-৫৬৫

১৫) ‘নজরুল গীতি অখণ্ড’, পৃ.৪৬৫

১৬) কাণ্ডারী হুঁশিয়ার, ‘নজরুল রচনাবলী’ ২য় খণ্ড, পৃ.৩৭

১৭) রশিদুন নবী ‘নজরুল-সঙ্গীতে দেশাত্মবোধ’ নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা, মার্চ ২০০৬, পৃ.১৫০

১৮)  দেবকুমার ঘোষ, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ ‘কবি নজরুল ও সঞ্চিতা’ সম্পাদনা: দেবকুমার ঘোষ, শিলালিপি, কলকাতা, আগস্ট ১৯৯৩, পৃ.১১১

১৯) কাজী নজরুল ইসলাম, ‘নজরুল রচনাবলী-১: বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২৫ মে, ১৯৯৩, পৃ.৮৮৩

২০) কল্পতরু সেনগুপ্ত, ‘জনগণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, জানুয়ারি ১৯৯২

২১) শফি চাকলাদার, ‘নজরুল ইসলামী চেতনার রূপকার’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলা: নানা প্রসঙ্গ, বাতায়ন প্রকাশন, ঢাকা, মে ২০০৩, পৃ.১৮৬-১৮৭

২২) মুজফফর আহমদ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ স্মৃতিকথা: মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ.৩১

২৩) অধ্যাপক আহমদ শরীফ, একালে নজরুল, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯০, পৃ.১৮

২৪) ইব্রাহিম খাঁকে নজরুলের লিখিত চিঠি, সওগাত, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত, কলিকাতা, পৌষ ১৩৩৪, পৃ.৫৮০

২৫) আবু জোবায়ের, ‘নজরুল ইসলামের মানবিকতা ও আধুনিকতা’ মুহাম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত, নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা, বিশেষ সংখ্যা, এপ্রিল ২০০১, পৃ.৬২৪

২৬) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ‘নজরুল চেতনা’, নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৯৬, পৃ.৩৩

২৭) ড. আলী হোসেন চৌধুরী, ‘নজরুল: বিবিধ প্রসঙ্গ’ অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি নজরুলের অন্তর- প্রেরণার উৎস’, মনন প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ২০০৯, পৃ.৩৪

২৮) ‘সর্বহারা’, ‘সঞ্চিতা’ ৯ম সংস্করণ, ডি.এম.লাইব্রেরী, পৃ.৬৫

২৯) আমার পথ, রুদ্র-মঙ্গল, নজরুল রচনাবলী, ১ম খণ্ড, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৬

৩০) বিংশ শতাব্দী নজরুল রচনাবলী ২, ১৯৯৩, পৃ.৭০

৩১) ‘জুলফিকার’ নজরুল রচনাবলী ২, ১৯৯৩, পৃ.২৩২

৩২) ‘বনগীতি’, দ্বিতীয় সংস্করণ, নলেজ হোম, ১৩৬৯, পৃ.৬৮

৩৩) মমতাজ উদ্দীন আহমদ, শতবর্ষে নজরুল সম্ভাষণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ১৪০৫-১৪০৬

৩৪) আবদুল হাই শিকদার, ‘বাংলাদেশে নজরুল, নজরুলের বাংলাদেশ’, ঝিঙেফুল; ঢাকা, মার্চ ২০০৩

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *