অপরূপ সৌন্দর্যের সিকিম : রূপ-লাবণ্যে ভরপুর গ্যাংটক

মোজাম্মেল হক : ছবির মতো সাজানো গোছানো সিকিম। আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ। উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যটির পাহাড়-পর্বতের সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তিব্বত, ভুটান আর নেপাল বেষ্টিত সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। সুন্দর সাজানো রাস্তা। ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে সিকিমে বাংলাদেশিদের প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। তখন থেকে বাংলার ভ্রমণ পিপাসুরা গ্যাংটকে ভ্রমণ শুরু করছে।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

সিকিম ভ্রমণের আমন্ত্রণ

আমি প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসি। আমার ডিএসএলআর ক্যামেরায় প্রকৃতির ছবি বেশি তোলা হয়। তবে ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার কারণে খেলার মাঠের ছবিও সুন্দর করে তুলি। আমি টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের একজন সাধারণ সদস্য। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলাসহ বর্তমান কমিটির সদস্যদের উদ্যোগে জুলাই মাসে পরিবারবর্গ নিয়ে এই সিকিম ভ্রমণের সিন্ধান্ত নেয়া হয়। আমি সাধারণ সদস্য হওয়ায় পরিবারবর্গ নিয়ে সিকিম ভ্রমণের আমন্ত্রণ পাই।

সিকিম ভ্রমণের প্রস্তুতি

সিকিমের গ্যাংটক ভ্রমণ স্থলপথে একটু কঠিন। বাস জার্নিতে অভ্যন্থ থাকতে হয়। অনেকটা ভেবে-চিন্তে জুনিয়র সাংবাদিক মাসুদ আব্দুল্লাহ সহযোগিতায় আমার এবং আমার ছেলে শিমরোজ হাসান শিহাদের পার্সপোর্ট ২৫ দিনেই রেডি করে ফেলি। এক্ষেত্রে মাসুদ আব্দুল্লাহর চিন্তা-পরামর্শ ও সাংবাদিক ইফতেখারুল অনুপমের প্রেরণা-উৎসাহ  গ্যাংটক ভ্রমণে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সদস্যদের সময় সাপেক্ষে ১৮ নভেম্বর যাত্রার তারিখ ঠিক হয়। আমাদের এই ভ্রমণে প্যাকেজ ট্যুর নিয়ে এজ ট্রাভেল গ্রুপের সুজন দত্ত টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে এসে ৬ দিনের ট্যুর প্লানের বিস্তারিত বলেন। ১৮ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় শ্যামলী পরিবহনে করে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সম্মুখ থেকে যাত্রা শুরু হবে। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ সহ প্রায় ৪০জন সদস্য পরিবার বর্গ নিয়ে ভ্রমণে যাবে।

এবার সবার ভারতের ভিসা লাগানোর পালা। আমি ১৭ অক্টোবর ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করে ২৮ অক্টোবর ৬ মাসের একাধিকবার ভিসা পাই। যাত্রার দিনক্ষণ এসে পড়লে অনেকে ভিসা না পাওয়া কিংবা ব্যস্ততার কারণে সময় বের করতে না পারায় ২৯ জন সদস্য যাবে সিদ্ধান্ত হয়।

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব থেকে যাত্রা শুরু

১৮ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের পাশ থেকে এসি বাস শ্যামলী পরিবহনে যাত্রা শুরু করি। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদ বিভিন্ন সমস্যার কারনে না যেতে পারায় সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলার নেতৃত্বে যাত্রা শুরুর পূর্বে প্রেসক্লাব চত্বরে ফটোসেশান হয়।

৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ুয়া ১১ বছর বয়সী আমার ছেলে শিমরোজ হাসান শিহাদকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসি। সারারাত ভ্রমণ শেষে আমরা পরিবারবর্গ ও ব্যাচেলর মিলে ২৯জন সদস্যের একটি গ্রুপ ১৯ নভেম্বর শনিবার সকালে লালমনির হাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর পৌঁছলাম।

ফ্রেশ হয়ে বুড়িমারীর প্রখ্যাত বুড়ির দোকানে নাস্তা সেরে নির্দিষ্ট সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতের চ্যাংড়াবান্দা থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভিসা জটিলতায় তরুণ সাংবাদিক সুমন খান না গেলে আমরা ২৮ জন হই। চ্যাড়াবান্দা থেকে বাংলা টাকা এক্সচেঞ্জ করে রুপি করে নিলাম। বর্তমানে বাংলা টাকায় রেট কম থাকায় ৭৪.৫০ রুপি পেলাম।

মাঝে মাঝে যাত্রাবিরতিতে স্বস্তি

দুই ঘন্টা জার্নি শেষে আমার ছেলে শিহাদসহ ২৮ জন দুপুর সাড়ে বারোটায় পৌঁছালাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজায় আমরা ফ্রেশ হয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম। লাঞ্চ শেষে ৫টি রিজার্ভ প্রাইভেট ট্র্যান্সপোর্ট গাড়ীতে দুপুর ২টায় চড়ে বসলাম। যে গাড়িতে আমি ও শিহাদ বসলাম সেই গাড়িতে চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক মুসলিম উদ্দিনসহ তার পরিবার ছিল।

আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের সমস্ত খরচ টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব বহন করছেন। যে কারণে কত টাকা গাড়ি ভাড়া কিংবা হোটেল খরচ কত তা আমি জানাতে পারবো না। যাহোক শিলিগুড়ি থেকে গাংটকের উদ্দেশ্যে এবার যাত্রা শুরু হলো। ছোট্র শিলিগুড়ি শহর, ক্যান্টনমেন্ট, সেভক এরিয়া পাড়ি দিয়ে গাড়ি চলছে তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষা সড়ক ধরে।

অপরূপ সৌন্দর্যে জুড়ালো প্রাণ

ছেলে শিহাদ গাড়িতে চড়লেই গাড়ির ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে যায়। যথারীতি শিহাদ আমার পাশে কাধ রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। তিস্তার নীলচে পানির সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নদীর মতই এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটছে। পিচঢালা মসৃণ সড়ক, খানা খন্দক খুবই কম। আশেপাশের দৃশ্য বদলাচ্ছিল একটু পরপরই। কখনো পাহাড়ের সারির পাশ দিয়ে ছুটছি, সাথে ঘন গাছপালা। আবার কখনো পাহাড়গুলো দূরে সরে যাচ্ছিল, সামনে চলে আসছিল গাছের সারি।

এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি আমাদের সিকিম ভ্রমণের জন্য দেশ থেকে দশ কপি ছবি ও সর্বশেষ ভিসাসহ পাসপোর্টের কপি সাথে নিয়ে রেখেছি। কারণ সিকিমের যেকোনো জায়গায় ভ্রমণের জন্য বিদেশি পযটকদের ইনার লাইন পারমিট ও রেষ্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট নিতে হলে ছবি ও পাসর্পোটের কপি প্রয়োজন হয়। সিকিম থেকে ফেরার সময়ও আবার রাংপোতে অবহিত করতে হয়। সিকিমে প্রবেশের সময় ও ফেরার সময় পাসর্পোটে সিল দেয়া হয়।

শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যেতে প্রায় ৫ ঘন্টার মত সময় লাগে। আকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ও তিস্তা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রাংপো চেকপোস্ট পৌছে গেলাম সন্ধ্যায় সময়। রাংপো চেকপোস্ট যাওয়ার পূর্বে রাস্তায় মুসলিম মামা পথের পাশে কমলা বিক্রেতার নিকট থেকে সরেস মিষ্টি কমলা কিনে খাওয়ান। চেকপোস্টে পারমিট নিতে ২০ মিনিটেই কাজ শেষে আমরা ছুটলাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে।

আনন্দদায়ক ভ্রমণ গন্তব্য গ্যাংটক

গ্যাংটকে প্রবেশ করতেই আমরা দেখলাম বিশাল এক ঐতিহ্যবাহী ফটক। রাতের আলোতে যেটুক দেখলাম, তাতে খুবই সুন্দর লাগলো। রংবেরঙের নকশাকাটা কারুকার্য, যা সিকিমের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। এখান থেকে পারমিট না নিলে গ্যাংটকের কোনো হোটলে থাকা যাবে না। আমাদের এজ ট্রাভেল গ্রুপের সুজন দত্ত এই সব কাজগুলো সমাধান করেছেন।

সিকিমের অতীত থেকে বর্তমান

আমরা ভারতের সিকিম ভ্রমণে যাচ্ছি তাহলে সিকিম সর্ম্পকে কিছু জানা দরকার। সিকিম (নেপালী নাম সিক্কিম) পূর্বে যা দ্রেমোশং নামে পরিচিত ছিল এবং সিকিমি ১৮০০ সাল পর্যন্ত সরকারী নাম, পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের একটি বংশানুক্রমিক রাজতন্দ্র ছিল। ১৬৪২ থেকে ১৬মে ১৯৭৫ পর্যন্ত রাজ্যটি টিকে ছিল। রাজ্যটি তিব্বতীয় বৌদ্ধ নামগিয়াল রাজবংশের চোগিয়াল দ্বারা শাসিত হতো।

১৬৪২ থেকে তিব্বতের আশ্রিত রাজ্য ছিল, ১৭৭৬ থেকে ১৭৯২ পর্যন্ত নেপালীদের আধিপত্য ছিল, ১৮১৬ থেকে ১৮৯০ সাল ব্রিটিশদের উপস্থিতি ছিল, ১৮৬১ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আশ্রিত রাজ্য ছিল। ব্রিটিশরা চলে গেলে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সিকিম স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত রাষ্ট্র।

এরপর ১৯৭৫ সাল থেকে ভারতের প্রদেশ। সিকিম এখন ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলের একটি রাজ্য এবং উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। আয়তনের ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ। এর উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনরে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, পূর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং দক্ষিণে ভারতের অপর একটি রাজ পশ্চিমবঙ্গ।

সিকিমের প্রথম চোগিয়াল হন ফুন্টসোগ নামগিয়াল। সর্বশেস চোগিয়াল ছিলেন পালভেন থন্দুপ নামগিয়াল। লেন্দুপ দর্জি হলেন সিকিমের প্রভাবসালী নেতা। তিনি ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিকিমকে ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত করার জন্য আবেদন করলে ভারতীয়দের উস্কানির ফলে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে সিকিমে নেপালী হিন্দুদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগের কারনে চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ।

ভারতীয় সেনাবাহিনী এই সুযোগ নিয়ে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক দখল করে। ৪টি জেলা নিয়ে সিকিমের জনসংখ্যা ৬১০,৫৭৭ জন, আয়তন ৭০৯৬ বর্গ কিলোমিটার, ভাষা- নেপালী,হিন্দু, লিম্বু, সিকিমি,শেরপা, ঠুলুং, তিব্বতী ও ইংরেজী। ৫টি ঋতুতে বিভিক্ত সিকিমের ঋতু হলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, বর্ষা ও শীত কাল। সিকিমের বাসিন্দারা দ্ইু প্রকার জলবায়ু অনুভব করে।

রাজ্যের উত্তর অংশে তুন্দ্রা জলবায়ু এবং অন্য দিকে রাজ্যের দক্ষিণে উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু লক্ষ্য করা যায়। তুন্দ্রা জলবায়ুর উপস্থিতির কারণে এই রাজ্যের উত্তর অংশ বছরের প্রায় ৪ মাস বরফাবৃত থাকে, এইসময় এখানে রাত্রের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীর নীচে নেমে যায়। পর্যটকরা তখন এখানে আসতে পারে না। এখানে ভুটিয়া, লেপচা, কিরাটি এবং গোর্খাদের মতো জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে।

হিমালয়ের কোলে অবস্থিত গ্যাংটক

সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের আধাঁর। ট্যাক্সি গাড়িগুলো গ্যাংটক শহরে যাচ্ছে। আশপাশের সুউচ্চ পাহাড়ী বসতির বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলে উঠেছে, মনে হচ্ছে আকাশে সারি সারি তারা জ্বলছে, সে এক অসাধারণ অনূভূতি যা প্রকাশ করা যাবে না। আমার ছেলের এগুলো দেখে খুবই ভালো লাগলো।

প্রায় সোয়া এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা গ্যাংটক পৌঁছে যাই। ঘড়ির কাটাঁয় তখন ৮টা বাজে । কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ৮টা বাজলেও বাংলাদেশের ঘড়ির সময় থেকে আধা ঘন্টা পিছিয়ে দিলে সাড়ে ৭টা হবে। অর্থাৎ আমরা সাড়ে সাতটায় এমজি মার্গের নিকটে টাইবেট রোডে প্রিন্স হোটেলে উঠলাম।

৫৪১০ ফুট উচ্চতায় চনমনে মন

গ্যাংটক শহর সমুদ্রপুষ্ট থেকে ৫৪১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। শীত প্রধান দেশে গ্যাংটকের তাপমাত্রা তখন ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রাত সাড়ে আটটায় প্রিন্স হোটেলের তৃতীয় তলায় ভারী খাবার খেয়ে ২০২ কক্ষে আমার ছেলে শিহাদকে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। এ সময় হোটেলের বয় সুদেব, উজ্জল সেত্রী ও সহকারী ট্যুর গাইড রাজিন তালুকদারের সাথে পরিচয় হলো।

পরদিন ২০ নভেম্বর রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দোতলা বারান্দায় দাঁড়ায়ে বাইরে তাকাতেই পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠা গ্যাংটক শহরের দৃশ্য দেখতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি। ছোটবেলায় বই পড়ে মনের মাঝে ছবি এঁকেছি, যা এখন বাস্তব!

চোখের সামনে হিমালয়ের চূড়ার অংশ বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্গা অপরুপ রুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা বরফে আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্গা থেকে আলোর রশ্মি বিকরন করছে যা সত্যি দেখার মতো। মনের মাঝে ইচ্ছে ছিল পঞ্চগড়ের সীমান্তে গিয়ে দূর থেকে কাঞ্চনজঙ্গা দেখবো, যা এখন বাস্তব, শুধু বাস্তব নয়, এখন যা অতি নিকটে থেকে দেখা যাচ্ছে এটাই বড় সত্যি।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশা পূরণ

কাঞ্চনজঙ্গা দেখা আশা শুরুতেই পূরণ হলো। আমার ছেলে শিহাদকে ঘুম থেকে ডেকে দেখালাম কাঞ্চনজঙ্গা। দেখালাম গ্যাংটকের পাহাড়ে সারিবদ্ধভাবে বাসস্থানের জন্য ছোট বড় অনেক ইমারত নির্মান করা হয়েছে। যা দেখার মতো। বিশেষ করে পাহাড়ের ঢালুতে মাটি কেটে কেটে সুন্দর সুন্দর আঁকাবাঁকা প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।

চরকির মতো ঘুরে ঘুরে অন্য পাহাড়ে

পাহাড় ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো পাহাড়ের উপর নিচে চলে গেছে অন্য পাহাড়ে। ইনোভা ট্যক্সি গাড়িতে বসে প্রথম দেখায় ভয় লাগবে, এই বুঝি গাড়ি বিশাল ঘাদে চলে গেল! কিন্তু না, নেপালী চালকরা অত্যন্ত দক্ষ হাতে সিকিমের এই আঁকাবাঁকা পাহাড়ের পথে গাড়ি চালায় যা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। তারা ইনোভা ট্যাক্সি গাড়ি নিয়ে চরকির মতো ঘুরে ঘুরে অন্য পাহাড়ে চলে যায।

এখানকার গাড়িগুলো আকারে ছোট। বড় ধরনের গাড়ি সিকিমে চলে না। এখানকার গাড়িগুলোর নাম ইনোভা গাড়ি। গাড়িতে ৪টি আসন থেকে সর্বোচ্চ ৭টি আসন থাকে। আমাদের গাইড রাজিনের ডাকে ছেলেকে নিয়ে তৃতীয় তলায় একত্রে সকালের নাস্তা করার চলে এলাম। নাস্তার টেবিলে ৪ জন করে বসা যায়।

আমি শিহাদকে নিয়ে স্নেহাশিস সাংবাদিক কাউছার ও নোমানের পাশে বসলাম। এখানকার লোকজন আলু খেতে খুব ভালোবাসে। এর প্রমাণ আলু ভর্তা, আলু ভাজি, আলুর তরকারি, আলুর চপ চমৎকার সুস্বাদু। সাথে মসুর ডাল সব সময় আছে। নাস্তার পর চা চক্রে টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলা উনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতারে আলোকে আমাদেরকে পরামর্শ দিলেন।

পাহাড় থেকে  গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা র পানি

প্রথম দিন গ্যাংটক শহরের আশেপাশের সৌন্দর্য অবলোকন। সকাল ৯টায় ২৮ জন ৫টি গাড়িতে বিভক্ত হয়ে বেড়ানোর জন্য বেরুলাম। আমাদের বাপবেটার সঙ্গী হলো একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক কাজী রিপন ও তার ছেলে রাহাত। শুরুতেই ইনোভা গাড়িতে চলে এলাম ঝর্না স্পট ব্রেকিং ওয়াটার ফলস। অনেক উঁচু থেকে পাহাড় বেয়ে ঝর্নার পানি পড়ছে যা সত্যি দেখার মতো।

আমরা ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঝর্না স্পটে কিছু সময় নিজেদের ক্যামেরাবন্দী করলাম। এরপর কাঞ্চনজঙ্গাকে অতি নিকটে দেখার জন্য তাশি ভিউ পয়েন্টে চলে এলাম। এখানে অনেক লোকের ভীড় ঠেলে ভিউ পয়েন্টের দোকানে গিয়ে ২০ রুপি টিকিট কেটে দোকানের সর্বোচ্চ উচ্চতায় গিয়ে ভিডিওর পাশাপাশি ছবি তুললাম।

এরপর সেখান বের হয়ে আমরা ৪ জন বৌদ্ধদের রানাকা মন্দিরে উঠলাম। বৌদ্ধরা এখানে প্রার্থনায় ব্যস্ত। দেখলাম প্রায় ১০০ জন বৌদ্ধরা একত্রে প্রার্থনা করছে। আমরা এই সুন্দর জায়গা থেকে ছবি তুলে এরপর চলে এলাম ৮০০০ হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড় হনুমান টকে। এখানকার আশেপাশের পাহাড়গুলো অনেক উচু।

পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উপরে উঠা

যদিও সিকিম মানেই উঁচু পাহাড়। যা পর্বতের সমান উচ্চতা। পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যত উপরে উঠার আনন্দই অন্যরকম। এখানে আমরা ২৮ জন মিলে গ্রুপ ছবি তুললাম। পথে রাংরাং ব্রীজ, নাগা ফলস, মেয়ং ফলস, সেভেন সিষ্টার ফলস, তুং ব্রীজ, চুংথাং ভিউ পয়েন্ট ও তিস্তা নদীতে চুংথাং হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট পাহাড়ী টানেল সড়কসহ ঘুরে প্রিন্স হোটেলের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

সন্ধ্যার সময় প্রিন্স হোটেল থেকে পাহাড়ের ঢালু পথে বেয়ে সাংবাদিক রিপন ভাইয়ের সাথে আমি ছেলেকে সঙ্গী করে যুগধারার সম্পাদক হাবিব সরকারকে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এমজি মার্গ র্মাকেটে পৌছালাম। এমজি মার্গের সম্মুখে মাহাত্মা গান্ধীর স্ট্যাচুর সাথে ছবি তুলে রাখলাম। সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমি ও হাবিব সরকার ভারতের এয়ারটেল সিম ক্রয় করলাম।

উঁচু পথে সুন্দর রাস্তা

মোবাইল সিম বিক্রেতা নেপালী মেয়ে পুনম হিন্দীতে ভাষায় কথা বুঝতে অসুবিধা হলেও ছেলে শিহাদের কিছু হিন্দী জানা থাকায় সহজে সিম ক্রয় করে মোবাইল সেটে লাগিয়ে নিলাম। কাশ্মরী শাল নাকি বিখ্যাত, তাই বাড়ীর সবার জন্য কিছু শাল কিনলাম। এখন হোটেলে ফেরার পালা। প্রিন্স হোটেলে ফেরা মানেই পাহাড় বেয়ে উঠা।

ধীরে ধীরে শিহাদ ও হাবিব সরকারকে নিয়ে উঁচু পথের পাকা সুন্দর রাস্তা হেঁটে হেঁটে প্রিন্স হোটলে পৌছালাম। রাতের খাবারের সময় সঙ্গী টেবিলে সঙ্গী হিসাবে পেলাম সিনিয়র সাংবাদিক কাজী জাকেরুল মওলা, মীর্জা শাকিল, মুসলিম উদ্দিন মামাকে। আলোচনার পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলে রাত ১১টায় ঘুমুতে গেলাম। ঘুমুতে যাওয়ার পূর্বে দোতলার দরজা খুলে বারান্দায় থেকে রাতের কাঞ্চনজঙ্গার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

রূপকথার লাচুং এশিয়ার সুইজারল্যান্ড

২১ নভেম্বর সোমবার শীতের দেশ গ্রাম্য চীনের বোর্ডার এলাকা লাচুংয়ে যাত্রা। উত্তর সিকিমের ছোট ভুটিয়া গ্রাম হলো লাচুং। লাচুংকে ইয়ামথাং ভালী, জিরো বা কাটাও যাবার প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে। লাচুং যেতে রাস্তা বেশ সুন্দর।

গ্যাংটক থেকে লাচুং যাবার পথে কাবি, ফোদনং, মংগন, সিংঘিক, চংথাং হয়ে পৌছে গেলাম লাচুং চু- নদীর পাশেই অবস্থিত এ পাহাড়ি গ্রামে। পথে পড়ে বহু উঁচু থেকে পড়া উজ্জল ঝর্ণা, মনোরম উপত্যকা আর ছিমছাম ধানখেতে মোড়া ছোট ছোট গ্রামগুলি।

৯৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাচুং গ্রামে বিভিন্ন মানের বহু হোটেল আছে। তবে নদীর কাছাকাছি মাঝারি মানের কাঠের হোটেলগুলোতে থাকতে পারলে বেশ নস্টালজিক মনে হবে। সেখানকার খাওয়া দাওয়াটাও একদম ঘরোয়া পরিবেশ। কাছ থেকে ভেসে আসার লাচুং এর গর্জন সারারাত আপনার সঙ্গী হবে। এই নদীর ব্রিজের কাছে জিপ লাইনিং করার ব্যবস্থা আছে।

লাচুংয়ে যাত্রা পথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ছন্নছাড়া গরু। প্রচন্ড ঠান্ডায় গরুগলি রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। লাচুংয়ে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস অত্যধিক বরফের জন্য পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ থাকে। জুলাই থেকে আগস্ট রাস্তা প্রায়ই ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে এই সফর অনিশ্চিত হলেও বছরের বাকি সময় দিবি উপভোগ করা যায়।

অসাধারণ সৌন্দর্যের সবুজ উপত্যকা

এপ্রিল-মে মাসে ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’ ইয়ামথাং উপত্যকা ভরে থাকে বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রনে, সঙ্গে প্রিমুলা ও অন্য নানান প্রজাতির ফুলও শোভা বাড়ায় সেই অসাধারণ সৌন্দর্যে। বছরের বাকী সময় চোখ জুড়ানো সবুজ উপত্যকা। আমরা যখন লাচুংয়ে আসলাম তখন প্রচন্ড শীত। তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

আমরা সন্ধ্যা ৭.১৫ মিনিটে লাচুংয়ে উপস্থিত হয়ে পাকেজ ট্যুরের দেওয়া তাশি ইয়াং সিং হোটেলে উঠি। প্রচন্ড ঠান্ডায় কিছু সময় আলোচনায় সময় কাটিয়ে নিজেদের পছন্দমতো রান্না করা খাবার থেয়ে মোটা কম্বলের ভিতর ঢুকে যাই। আরেকটি কথা বলে যাই, লাচুংয়ে প্রবেশ করতে সেনাবাহিনীর পারমিট নিতে হয়। যা আমরা যাত্রা নিয়েছি।

২২ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ছয়টায় জিরো পয়েন্টে বরফ এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। বরফের উপর দিয়ে হাঁটার জন্য গাম বুট ভাড়া নিলাম আমরা সবাই। ২টি করে পাউরুটি পিস ও ১টি ডিম খেয়ে জিরো ডিগ্রীতে বরফ দেখার উদ্দেশ্যে বের হলাম। নর্থ সিকিমের চীন সীমান্তঘেষা ইয়ামসাথং থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার জিরো পয়েন্ট, যেখানে চীনের সীমান্ত জড়িত।

অক্সিজেন স্বল্পতায় অসুস্থতা

ইয়ামথাং ভ্যালী থেকে জিরো পয়েন্টের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। রাস্তার দুপাশের বরফে ঢাকা পর্বত। ইয়ামথাং থেকে পৌছাতে হয় ১৬৫০০ ফুট উচ্চতার জিরো পয়েন্টে। জিরো পয়েন্ট এরিয়ায় প্রচন্ড শীতের কারনে বৃক্ষের অস্তিত্ব কম। আমরা যে দিন জিরো পয়েন্টে অবন্থান করলাম তখন তাপমাত্রা ৩ ড্রিগী সেলসিয়াস। প্রচন্ড শীত ও ভূপৃষ্ট থেকে ১৬৫০০ উচ্চতার কারনে পর্যাপ্ত অক্সিজেন স্বল্পতা আছে। যে কারনে আমিসহ কয়েকজন একটু অসুস্থ হয়ে পড়লাম।

এখানে ধীরে ধীরে পথ চলতে হয়, একটু জোরের সাথে চলতে গেলেই অক্সিজেন সংকট পেয়ে বসে। আমার ছেলে শিহাদ নরম বরফে পা দিয়ে দাঁড়ালে নরম বরফ ভেঙ্গে গাম বুট ভেদ করে ঠান্ডা পানি ঢুকে যায়। সাথে সাথে শিহাদকে নিয়ে পাশেই কফি শপের দোকানে গিয়ে আগুনে তাপ দিলে ওর জিন্সের প্যান্ট শুকিয়ে যায়। জিরো পয়েন্টের সাথে চীনের সীমান্ত জড়িয়ে আছে।

চীনের সীমান্ত ঘেঁষা জিরোপয়েন্টে

জিরো পয়েন্টে সবাই স্বাচ্ছন্দে চলতে পারে না। তারপরও সাংবাদিক কাজী রিপন, তার ছেলে রাহাত, প্রেসক্লাবের সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলার পরিবার, মীর্জা শাকিলের পরিবার,মুসলিম উদ্দিনের পরিবার, ব্যাচেলর কাউছার, নোমান ও নওশাদ রানা সানভীকে জিরো পয়েন্টে বরফে তৎপর দেখা যায়।

শিহাদকে গাড়ির ভিতর বসিয়ে কিছু ছবি তোলার পর সবাই ইয়ামথাং ভ্যালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। আরেকটি কথা বলে রাখি তিস্তা নদীর উৎপত্তিস্থল এই স্থানটি। , পাহাড়ী ছোট ছড়ার মধ্যে দিয়ে বরফগলা পানি প্রবাহিত হয়ে তিস্তা নদীর জন্ম দিয়েছে।

রূপ-লাবণ্যে ভরপুর ইয়ামথাং ভ্যালী

এশিয়ার স্ইুজারল্যান্ড ইয়ামথাং ভ্যালী। লাচুং থেকে পাহাড়ী সর্পিল পিচঢালা পথে ইয়ামথাং ভ্যালীর দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। ই উপত্যকা শীতকালে পুরোপুরি ঢেকে যায় শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে, তখন তার অন্য রুপ দেখা যায়। বাকী সময় সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া এই উপত্যকা, আর নীল তিস্তা নদীর বয়ে চলা মুগ্ধ করে ভ্রমণপিপাসুকে।

ইয়ামথাং ভ্যালী জুড়ে পর্যটকদের জন্য বিশ্রাম নেয়ার জন্য স্থায়ীভাবে বেশ কিছু আসন পেতে রাখা হয়েছে। পথের ধারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি পাইন গাছ, নাম না জানা পাহাড়ী ফুল, যাত্রা পথের প্রতি বাঁকে সুউচ্চ পাহাড়গুলো একটাই ইঙ্গিত দেয় সৃষ্টিকর্তাই শ্রেষ্ঠ শিল্পী। প্রায় সাড়ে আটহাজার ফুট উঁচু শহরের উপর তনি চার হাজার ফুট উচ্চতার একেকটি পর্বত দাঁড়িয়ে আছে নিরহংকারী হয়ে।

কোনোটির চূড়ায় বরফের আচ্ছাদন, আবার কোনোটির গায়ে সবুজের প্রলেপ, কোনোটি আবার ন্যাড়া হয়ে একটু গোমড়ামুখো। কোনো পাহাড় সূর্যকে আড়াল করতে ব্যস্ত, কোনোটি আবার সূর্যের আলোর প্রতিফলন আর প্রতিসরণের সূত্র মেনে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।

সাঙ্গু লেকে পাহাড়-মেঘের মিতালী

২৩ নভেম্বর বুধবার সাঙ্গু লেক যাত্রা। যথারীতি সকালে সবাই হালকা নাস্তা খেয়ে সাঙ্গু লেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সিকিমের এলাকার জনপ্রিয় সুমো গাড়ি তৈরী। আমি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলার গাড়ীতে শিহাদকে নিয়ে উঠে বসলাম। গাড়িতে ছিল ওনার স্ত্রী কাজী শামিমা। এছাড়া তরুণ সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও মাসুদ আব্দুল্লাহ।

সাঙ্গু লেক যাওয়ার পথে চেকপোস্টে আমাদের পারমিট চেক হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদের রাস্তার পাশে বড় পর্বত সমান পাহাড় আর অন্য পাশে বিশাল খাদ দেখতেই পাই। সাঙ্গু লেকের রাস্তাটা লাচুংয়ের রাস্তা চেয়ে অনেক প্রশস্ত। সাঙ্গু লেগের উচ্চতা ১৪০০০ হাজার ফুট।

আমরা ৮ হাজার ফুট উঠার পরই পাহাড়ের পাদদেশে থাকা মেঘগুলো আমাদের মাঝে মিশে যায়। তখন খুব ভালো লাগে।  তখন যাত্রা বিরতি দিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা দোকান থেকে কফি পান করি।

পাহাড়ের মাঝে মেঘের ছবি

ক্যামেরায় পাহাড়ের মাঝে মেঘের ছবি তুলে রাখি। তারপর আবার যাত্রায় সাঙ্গু লেকে চলে আসি। প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীর জমে আসে, আমরা কফি পান করি। লেকের দু’পাড়ে ঘোরাঘুরি করলাম ছবি তুললাম।

পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য মন্দিরের পাশে অনেকগুলো পোষা চমরী গরু (ইয়াক) রেখেছে স্থানীয়রা, পর্যটকরা এগুলোতে চড়ে ছবি তোলে। আমরা আকর্ষনীয় কাবল কারে করে ১৪০০০ হাজার ফুট উচ্চতায় চলে আসলাম।

ক্যামেরাবন্দী সৌন্দর্যময় দৃশ্য

সৃষ্টিকর্তার অপার্থিব সুন্দর নিদর্শন। যতটুকু সৌন্দর্য দেখতে পাই তা মুখের ভাষায় পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব না। আমরা পর্বত সমান পাহাড়ের অনেক উঁচু পাহাড়ে অবস্থান করছি। আমাদের নিচের পাহাড়গুলোতে মেঘগুলো খেলা করছে। নীলমেঘে ছেয়ে গেছে পুরো আকাশ। আমরা ক্যামেরায় এই সৌন্দর্যময় অবস্থানকে ক্যামেরায় বন্দী করি।

সিকিম এসেছিলাম এই সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেখতে। যা দেখার দেখলাম, এবার বাড়ী ফেরার পালা। সাঙ্গু লেগ থেকে এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিটে গ্যাংটকে ফিরে আসলাম। বিকেলে গ্যাংটকের একদরের বাজার বাজরা র্মাকেটে চলে আসলাম। বাজরা র্মাকেটে কেনাকাটা শেষে গাড়ী নিয়ে সরাসরি এমজি(মাহাত্বা গান্ধী) মার্গে কিছু সময় অবস্থান করলাম এবং সন্ধ্যা হতে প্রিন্স হোটেলে ফিরে আসলাম।

স্বপ্নের রাজ্য শিলিগুড়িতে কেনাকাটা

২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার এবার ঘরে ফেরার পালা। যথারীতি সকালে নাস্তা খেয়ে নিজ নিজ ব্যাগপত্র গুছিয়ে সবাই ইনোভা গাড়িতে চড়ে বসি। এবার গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি যাত্রা, সময় সাপেক্ষে শিলিগুড়ি বিধান মার্কেটে কেনাকাটা করা। আমি আমার ছেলে শিহাদের জন্য একটি কাশ্ম্রী উইলো ব্যাট কিনবো।

ফেরার পথে পুরাতন একটি ইনোভা গাড়িতে যাত্রী সঙ্গী হিসাবে পেলাম সাংবাদিক কাজী রিপন ও তার ছেলে রাহাত, তরুণ দায়িত্ববান সাংবাদিক কাউছার আহমেদ ও আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং দৈনিক যুগধারা পত্রিকার সম্পাদক হাবীব সরকারকে।

গ্যাংটক আসার সময় তখন সন্ধ্যার রুপ দেখেছি, এবার ফেরার পথে দিনের বেলায় গ্যাংটকের সৌন্দর্য দেখছি। পাহাড়ে পাহাড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। তবে রাস্তাগুলো প্রশস্ত এবং পিচঢালা উন্নতমানের রাস্তা। আমরা রাস্তার দু’পাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সিকিম চেকপোস্টে এসে পড়লাম।

দুর্গম কঠিন ভ্রমণ শেষে ফেরার পালা

সিকিম চেকপোস্ট এবার আমাদের ফেরার পারমিট দিয়ে দিলো। একত্রে ৫টি গাড়ি এগিয়ে চলছে। আমাদের গাড়িটি পথে একটু দেরীর কারণে শিলিগুড়ি শহরে প্রবেশের মুহুর্তে রেললাইন এরিয়ায় ঘন্টাখানেক দেরী হয়। যা শিলিগুড়ি পৌছানোর পর বিধান মার্কেটে র্মাকেট করতে সময় কম হয়ে যায়। তারপরও আমাদের গাড়ী শিলিগুড়ি পৌছালে আমি শিমরোজ হাসান শিহাদকে নিয়ে বিধান মার্কেটে ক্রিকেট ব্যাট কিনতে চলে যাই। সঙ্গী হিসাবে যথারীত কাউছার, নোমান, হাবীব।

বিধান মার্কেটে দ্রুত কিছু কেনাকাটা করে শ্যামলী পরিবহন স্ট্যান্ডে এসে পড়ি। পাশেই হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজায় দুপুরের লাঞ্চ করি। দুপুর দুইটায় শিলিগুড়ি থেকে চ্যাংড়াবান্দা বর্ডারের দিকে যাত্রা করি। শিলিগুড়ি হয়ে জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি হয়ে চ্যাংড়াবান্দা পৌছাই। চ্যাংড়াবান্দায় বাংলাদেশে ফেরার জন্য এমিগ্রেশন পর্বের কাজ শেষ করে বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশী স্থলবন্দর বুড়িমারী এসে পড়ি সন্ধ্যায় তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় পৌনে ৭টা।

বুড়িমারীর সেই হোটলে রাতের খাওয়া খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসি। রাত ৮ টায় টাঙ্গাইল শহরের উদ্দেশ্যে গাড়ী যাত্রা শুরু করে। লম্বা জার্নি, ক্লান্ত সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গাড়ীর চালক কিন্তু সুন্দর ভাবে ভোর ছয়টায় টাঙ্গাইল শহরে পুরাতন বাসস্টান্ডে গাড়ি দাঁড় করায়। যে যার মতো ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রিক্স্রা কিংবা অটোতে চড়ে নিজ বাড়ির দিকে যাত্রা।

সাহচর্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব আয়োজিত সিকিম ভ্রমণে সঙ্গী যাত্রী হিসাবে যাদের সাহচর্য পেলাম তাঁরা হলেন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাকেরুল মওলাসহ তার পরিবার, দ্যা ডেইলী স্টারের জেলা প্রতিনিধি মীর্জা শাকিল ও চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি মুসলিম উদ্দিনের পরিবাব, একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি কাজী রিপন ও তার ছেলে রাহাত, কালের স্বর পত্রিকার সহ-সম্পাদক সাইদুর রহমানের পরিবার, দৈনিক বাংলাদেশ বুলেটিন পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি মাসুদ আব্দুল্লাহর পরিবার, দৈনিক বিজনেস বাংলাদেশ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ও দৈনিক মজলুমের কন্ঠ পত্রিকার কাউছার আহমেদ, ঢাকা ট্রিবিউনের আব্দুল্লাহ আল নোমান, দৈনিক সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি নওশাদ রানা সানভী।

 টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা

টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সৈজন্যে আমরা এক পরিবার হয়ে গ্যাংটকের মতো দুর্গম কঠিন ভ্রমন শেষ করলাম সুন্দর ও সুচারুভাবে। আমার জীবনে এই ভ্রমন ছিল অসম্ভবকে জয় করার সামিল। লম্বা জার্নিতে প্রথমে কিছুটা ভীত হলেও পরবর্তীতে ভয়টা কেটে যায়। সিকিম ভ্রমণ আমার জীবনে অনেক বড় উপহার। আমার ছেলে শিহাদের ছোট্ট জীবনে এটা শিক্ষনীয় সম্পদ। যা ভ্রমণবিজ্ঞানে জ্ঞান বৃদ্ধি করবে। আমি আবারো ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের প্রতি। টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব সাঙ্গু লেকের সৌন্দর্যের মতো দীর্ঘসময় চলমান থাকুক।

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক মোজাম্মেল হক, সদস্য- টাঙ্গাইল প্রেসক্লাব, অর্থ সম্পাদক- ঐকতান ৯১, আজীবন সদস্য- টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার- দৈনিক টাঙ্গাইল সময়,অর্থ সম্পাদক- নিরাপদ সড়ক চাই টাঙ্গাইল।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *