আনিসুর রহমান এরশাদ
অপরাধ প্রবণতা রোধে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান যদি মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখে, মিথ্যা বলতে শুনে, অশ্লীল আচরণ করতে দেখে তবে তারাও নেতিবাচক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদ, মনোমালিন্য ও ঝগড়া-ঝাটি দীর্ঘমেয়াদে সন্তানদের ক্ষতি ডেকে আনে।
সন্তান যদি কখনো জানে মা-বাবা কারো পরকিয়া সম্পর্ক আছে, সুদ-ঘুষ বা অবৈধ ব্যবসা আছে তবে সে তার যাপিত জীবনের কোনো ব্যাপারে মা-বাবার দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে যায়। কারণ সে ছোট হলেও অপরাধী বড়দের কাছ থেকে নীতি কথা শুনতে কিংবা তাদের দেয়া স্বভাব-আচরণ সংক্রান্ত পরামর্শ মানতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। ছোটবেলায় মা-বাবাকে দাদা-দাদির অযত্ন-অবহেলা করতে দেখেই তরুণ বয়সে নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখের জীবন যাপনের প্রবণতা তৈরি হয়। এভাবেই ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মানস গড়ায় পরিবারের ভূমিকা চিরন্তন।
পরিবারে জ্ঞান-আহরণে নিবেদিত সদস্যের দৈনন্দিন জীবন যেমন অন্যদেরকেও আলোকিত করে, তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অসচেতন সদস্যের আচার-আচরণ-চেতনা নেতিবাচকতার দিকে প্ররোচিত করে। যে দাদা ধূমপান করেন কিংবা মাদক গ্রহণ করেন তারপক্ষে নাতিকে নেশাজাত দ্রব্য থেকে বিরত রাখা সম্ভব না। যখন বাবা ছেলের বিয়েতে ছেলের বউয়ের বাড়ি থেকে যৌতুক আনেন, তখন মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক দিতে না চাওয়াকে মেয়েও ভালোভাবে নেন না। কেউ যদি এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে সে যখন যা চায় তাই পায়, তাহলে তার মানসিকতা এমন হয় যে কেউ প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে হয় আত্মহত্যা করে কিংবা এসিড মেরে বা মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে বা কুপিয়ে আহত করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। পরিবারে বৈষম্য বা বঞ্চনার মধ্যে বেড়ে উঠলে মনের কঠোরতা এমন হয় যে সে যেকোনো নৃশংস কাজ করতে পারে। অর্থাৎ অতি আদর কিংবা অতি শাসন, অতি বিলাসিতা কিংবা অতি দরিদ্র কোনোটিই সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সহায়ক নয়।
অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে বিয়ে বিচ্ছেদ, পরকীয়া, বিয়ে বহির্ভূত সংসার, আত্মহননের মতো উপসর্গ বাড়ে। বড়দের জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা ও মিষ্টি-মধুর ভাষা ছোটদের বুদ্ধি-বিবেক, মন-মানস, চিন্তাশক্তিকে প্রভাবান্বিত করে তার ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিত্ব বিশেষ ধরণের ছাঁচে ঢেলে গঠন করে। বড়দের ইতিবাচক আচরণের প্রভাবে ছোটদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও প্রতিভা সঠিকভাবে বিকশিত হয়, ব্যক্তিসত্তায় যথাযথ পরিবর্তন আসে। আরেকটি ব্যাপার যদি কোনো পরিবারে বড় ধরনের অপরাধী যেমন-চোর, ডাকাত, পকেটমার, ধর্ষক, যৌন ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত, চোরাকারবারী কিংবা খুনী থাকে তবে সেই অপরাধীর অপরাধের খেসারত সামাজিকভাবে অন্যদেরও দিতে হয়; এমনকি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকেও এর দায়ভার বহন করতে হয়। একজনের অপরাধে আরেকজনের তিক্ত অভিজ্ঞতা পরিবারের নিরপরাধী সদস্যের মাঝেও হীনমন্যতা তৈরি করে। বাবা যদি অফিসের জিনিস বাসায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা সংগ্রহের জন্য সন্তানকে টাকা দেন কিংবা সহায়তা করেন, চাকরির জন্য ঘুষের টাকার যোগান দেন; তাহলে সেই সন্তান কখনোই বাবাকে সৎ ভাববে না। একসময় সন্তান বাবাকে তার উপার্জিত অর্থের আমানতদারও ভাববে না। এই যে উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা- এটা পরিবার থেকে না শিখলে পরবর্তীতে শেখা অত সহজ নয়।
সমাজে পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা মর্যাদাকর অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে একজনের পাপের কারণে। যেমন পরিবারের কোনো সদস্য যদি অপহরণের সাথে যুক্ত থাকে তবে অন্যদেরও প্রতিনিয়ত কটুকথা শুনতে হবে। এই যে জঙ্গিরা মারা যাচ্ছে বা জীবিত ধরা পড়ছে এতে তাদের পরিবারের মানহানি ঘটছে। এসব পরিবারের কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে শুরু করে যেকোনো যৌথ উদ্যোগে যুক্ত হতে চিন্তা-ভাবনা করছে সমাজের অন্য মানুষ। ফলে বলা যায় পরিবার যদি মান ইজ্জতের ভয়ে অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তবে দীর্ঘমেয়াদে তা ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। তাই পরিবারের কোনো সদস্য যদি ইভটিজিং থেকে শুরু করে সংগঠিত কোনো অপরাধীচক্রের সাথে জড়িত হয় তবে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করা আর যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসে তাহলে আইনের কাছে সোপর্দ করা উচিৎ। চাচার পকেট থেকে না জানিয়ে অর্থ সরানো, অন্যের গাছের ফল না বলে খাওয়া কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া দামি কোনো জিনিস বাসায় আনা- এসব সংবাদ জেনেও যদি অভিভাবকরা লঘু অপরাধ ভেবে শক্তভাবে শাসন না করেন অথবা না বুঝান; তবে সময়ের ব্যবধানে বড় হয়ে পুকুর চুরি করতেও তার দ্বিধা লাগবে না।
পরিবারের অধিকাংশের চিন্তায়-মননে এবং আদত-অভ্যাসে যদি পূণ্যতা-পবিত্রানুভূতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা পরিলক্ষিত হয় তবে সেই পরিবারে অপরাধের বিস্তার সহজ হয় না। পারিবারিক পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীর প্রভাব, ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ এবং নৈতিক মূল্যমানের আনুকূল্য, দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা ও প্রস্তুতির ওপর অপরাধ প্রবণতা থাকা- না থাকা নির্ভরশীল। মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর মধ্যে নীতিবাদিতা, মানসিক আবেগ এমন কার্যকারণ, যা একজন থেকে আরেকজনের মাঝে সংক্রমিত হয়। মনের ইচ্ছা-বাসনা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের পারস্পরিক সংযোজন ইতিবাচক হলে সেই পরিবার হয় অপরাধবোধ দূরীকরণের শক্তিশালী কেন্দ্র। মুরুব্বিরা যদি কাজের ছেলে-মেয়ে কিংবা পিয়ন-দারোয়ানদের সবসময় তুই-তুকারি করেন কিংবা শারীরিকভাবে আঘাত করেন, আর এই দৃশ্য দেখে ছোটরাও সমবয়সী কাউকে মারতে কিংবা গরিব মানুষকে ঘৃণা করতে শিখবে।
অবৈধ যৌন সম্পর্কে বংশগত পবিত্রতা বিনষ্ট হয়; নোংরামী, পংকিলতা, নগ্নতা, নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা ও পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ, শত্রুতা, নরহত্যা ও রক্তপাত ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। পারিবারিক ও বংশীয় একত্ব ও ঐতিহ্য চূর্ণ হয়ে বংশের ধারা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আত্মীয়তা এবং তার মান-সম্ভ্রম ক্ষুণ্ন ও বিলীন হয়। যে সমাজে ব্যভিচার সমর্থন পায়, তা অনিবার্যভাবে উন্নত মানবীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যমান থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। সেখানে ব্যক্তিদের মধ্যে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবেশ জেগে ওঠে; ফলে সামাজিক উন্নতি ও বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে পবিত্র, সুশৃঙ্খল রাখার জন্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে পূর্ণমাত্রায় আন্তরিক ও সদাতৎপর হতে হবে, যাতে কারো মাঝে নৈতিক-মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি না হয়। এক্ষেত্রে সভ্যতা-ভব্যতা, শালীনতা, সুষ্ঠুতা ও আদব-কায়দা সংরক্ষণ-প্রবণতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। যাতে পরিবারের কাউকে বিব্রত, দিশেহারা, অসহায়, নিরূপায় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে না হয়; নৈরাশ্য ও হতাশা, দুঃখ ও দুশ্চিন্তা, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি না পায়। পরিবারের প্রবীণেরা নবীনের মনের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, নতুন জীবনে প্রেরণা ও শক্তিমত্তা জাগাতে পারে। যা তাদের মনে এনে দেয় গভীর প্রশান্তি, স্থিতি ও চিরসতেজতা।
পরিবারে সুস্থ বিনোদন নিশ্চিত করতে পারলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমবে। সহজাত মনোবৃত্তির কারণেই অপরাধবিষয়ক নাটক ও সিনেমা দেখে খারাপ হয় দর্শকরা। তাই পরিবারের সদস্যদেরকে সুস্থ বিনোদনের প্রতি আগ্রহী করতে হবে। রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগে দুই সন্তান পাবন ও পায়েলকে নিয়ে ২০১০ সালে আত্মহত্যা করে মা রিতা। দেয়ালের লেখাগুলোর মধ্যেই সে বলে যায় ‘ডুবসাঁতার’ নামে একটি ভারতীয় সিনেমা দেখে আত্মহত্যায় আগ্রহী হয় সে (রিতা)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাঈদ ২০১১ সালে কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করে। তার আত্মহত্যার ধরনের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় হলিউডের ‘লাইফ অফ ডেবিড গেল’ সিনেমার। ২০১৪ সালে চাঞ্চল্যকর বাচ্চু হত্যাকান্ডের আসামি ফাহরিনা মিষ্টি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়- ভারতীয় সিনেমায় হত্যা করার ধরন দেখে বাচ্চুকে হত্যার কৌশল শিখেছিল সে। এমনই এক ভারতীয় সিনেমা দেখে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও গৃহিণী মাকে হত্যা করেছিল ঐশী। পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে অনেক মেয়ে। এককথায় অসুস্থ বিনোদন আমাদের পারিবারিক বন্ধন ছিন্নের ব্যবস্থা করছে, সামাজিক চরিত্র বিনষ্টের আয়োজন করছে, জাতীয় সংস্কৃতির আমূল বিকৃতি করছে, রীতি-নীতি ধ্বংসের স্লো-পয়জনিং শুরু করেছে।
পরিবারের সদস্যদের বই পড়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে, পারিবারিক লাইব্রেরী গড়ে তুলতে হবে। বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করলে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্য ও সুন্দরের বার্তা, জাগ্রত হয় মমত্ববোধ, সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির ভাবনা। বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। পরিবারের সদস্যদের অবসর সময়কে কাজে লাগাতে পারলে এবং আলোকিত মন গড়তে পারলে অপরাধমুক্ত মানুষ তৈরি করা সম্ভব হবে। নতুবা ভিনদেশি আচার আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছেদ ও সংস্কৃতিকে সানন্দে বরণ করে নেয়ায় নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটবে। অনাদরে অবহেলায় হারিয়ে যাবে এ দেশের মানুষের নিজস্ব ভাব-ভাষা, দেশীয় সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিনষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শান্তি, বাড়ছে পারিবারিক অপরাধ ও নানা ধরনের বিরোধ। বস্তুবাদিতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, আর নগ্নতার হাজারোপাঠ তুলে না ধরে যদি প্রতিটি পরিবার হয় দেশিয় সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র তবে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে, পারিবারিক শান্তি ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
মাদক প্রতিরোধে শরীর ও সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে, সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একজন মাদকাসক্তের কারণে একটি পরিবার কী অবর্ণনীয় আর্থিক ও সামাজিক সংকটের মুখে পড়ে তার ক্ষতির দিক সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি পরিবার হোক এমন যেখানে থাকবে না অপবিত্রতা ও অশ্লিলতা; বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ছোটদের প্রতি স্নেহ যেখানকার অনন্য বৈশিষ্ট্য হবে। মডার্নিজমের দোহাই দিয়ে জলাঞ্জলি দিবে না লজ্জাবোধ-স্বাতন্ত্রবোধ-আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীনতার চেতনা। আগামী দিনের প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর, সভ্য ও উন্নত এবং সর্বোপরি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যেতে চাইলে এ প্রজন্মের সচেতন যুবসমাজকে পরিবার গঠন ও সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি পরিবার হবে অপরাধীর জন্য সংশোধানাগার এবং অপরাধ প্রবণদের জন্য পরিবর্তনের সেরা কেন্দ্র।