বাবার শর্তহীন ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না

brother

আনিসুর রহমান এরশাদ

বাবা মানেই আপনজন, বাবা মানেই নির্ভরতা, বাবা মানেই প্রখর রোদে শীতল ছায়া দেয়া উঁচু বটবৃক্ষ, অন্ধকারে পথের দিশা। বাবার বুক পরম নির্ভরতার, যেখানে এক নিমিষেই পৃথিবীর সব ভয় জয় করে নিতে পারে সন্তান। অনেক আদর-একটু শাসন, আশ্রয়-প্রশ্রয় আর মমতায় মাখা বাবা বুকে সস্নেহে আগলে রাখে পরম ধনকে।

তাইতো বলা হয় বাবা মানেই- সব আবদারের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার, নিজে কৃপণতা করে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা, শত শাসন সত্ত্বেও এক নিবিড় ভালোবাসা, আমি তো সাথে আছি ভয় কিসের, শত অভাব-অনটন থাকলেও সন্তানের ওপর তার আঁচ লাগতে না দেওয়া কিংবা সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পরেও হাসিমুখে বাড়ি ফেরা।

হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব বাবাই সন্তানকে এগিয়ে যেতে দেখে সুখী হন, সন্তানের মুখে হাসি দেখে তৃপ্ত হন; সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকারের মাঝেই আনন্দ খুঁজে পান। অনেক কিছুই বদলে যায়, বদলে না বাবার ভালোবাসা। সন্তানদের অগাধ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও স্যালুট বাবাদের প্রতি।

বাবার কোনো তুলনা হয় না

বাবা হচ্ছেন- সন্তানের জনক, অভিভাবক, পুরুষ জন্মদাতা, আব্বা, পিতা। বাবা শব্দের সমার্থক শব্দ- জার্মান ভাষায় ‘ফ্যাট্যা’, ড্যানিশ ভাষায় ‘ফার’, আফ্রিকান ভাষায় ‘ভাদের’, চীনা ভাষায় ‘বা’, ক্রি (কানাডিয়ান) ভাষায় ‘পাপা’, ক্রোয়েশিয়ানরা বলে ‘ওটেক’, ব্রাজিলিয়ান ও পর্তুগিজ ভাষায় ‘পাই’, ডাচ ভাষায় ‘পাপা’ ‘ভাডের’ ও ‘পাপাই’, ইংরেজি ভাষাতে ‘ফাদার’ ‘ড্যাড’ ‘ড্যাডি’ ‘পপ’, ‘পপা’ বা ‘পাপা’, ফিলিপিনো ভাষায় ‘তাতেই’ ‘ইতেই’ ‘তেয়’ ও ‘আমা’, হিব্রু ভাষায় ‘আব্বাহ’, হিন্দি ভাষায় ‘পিতাজি’, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ‘বাপা’ কিংবা ‘আইয়্যাহ’, জাপানিজ ভাষায় ‘ওতোসান’ ‘পাপা’, পূর্ব আফ্রিকায় ‘বাবা’, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় পাপা ও বাবা ‘এদেসাপা’ ইত্যাদি। যে যেভাবেই ডাকুক, বাবা বাবাই; বাবার কোনো তুলনা হয় না। বাবা মানেই মাথার ওপর এক টুকরো ছাদ, মাথার ওপর বিশাল আকাশ।

বাবা পথপ্রদর্শক ও বন্ধুর মতো

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যে শব্দগুলো সবার আগে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তার অন্যতম হচ্ছে বাবা। এ যেন সন্তানের কাছে চিরন্তন আস্থার প্রতীক, পরিচয়ের পতাকা। শিশু যখন বাবা উচ্চারণ করতে শেখে তখন বাবার মন পুলকে ভরে যায়, বাবার হাস্যোজ্জ্বল সেই অনুভূতি অবুঝ শিশুর হৃদয়কেও আন্দোলিত করে। বাবা ছোট্ট একটি শব্দ হলেও এর ব্যাপকতা বিশাল। এ ডাকের মাঝেই লুকিয়ে থাকে কী গভীর ভালোবাসা, নিরাপত্তা, নির্ভরতা।

একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিকবার উচ্চারণ করতে হয় যে শব্দগুলো তার মধ্যে বাবা অন্যতম। যার কারণে এই পৃথিবীর রং, রূপ ও আলোর দর্শন; সেই বাবা শব্দটির সঙ্গেই অপার স্নেহ আর মমতার মিশেলে এক দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকে সন্তান। সন্তানের কাছে বাবা পথপ্রদর্শক ও বন্ধুর মতো। বাবার ভালোবাসা, বাবার স্নেহ, বাবার আদর অতুলনীয়। বাবাই সন্তানকে দেন ভরসা, জীবনে চলার পথে দেন বলিষ্ঠ সাহচর্য, দেন সঠিক পথের দিশা, ভালো কাজে দেন অনুপ্রেরণা, দেন জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সবক।

দায়িত্বশীলতার শৃঙ্খলে বাঁধা বাবা

জন্মের পর থেকেই নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতার শৃঙ্খলে বেঁধে সন্তানের জীবনকে নিরাপদ ও সুন্দর রাখতে চায় বাবা। সন্তানকে স্বনির্ভর ও প্রকৃত মানুষ করার স্বপ্ন-সাধনাই জীবনের প্রধান ব্রত হয়ে দাঁড়ায় বাবার। বাবার আদর-আহ্লাদে হাজারও স্মৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠে সন্তান, বাবার হাত ধরেই ছোটবেলায় দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করে পৃথিবীকে চেনে। সদ্য জন্ম নেয়া সন্তান বুকে নিয়ে বাবার যে সুখ তা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম জিনিস, সবচেয়ে ভালোলাগার জিনিস।

সন্তানের মুখে হাসি দেখলেই একজন বাবা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন সুখী মানুষ। পরম বন্ধু বাবার হাত ধরেই বেঁচে থাকার মানে একটু একটু  করে বুঝতে শেখা। তবে এ পরম বন্ধুত্বের কোথায় যেন ছড়িয়ে আছে খানিক গাম্ভীর্যের মেঘ, কিন্তু ওই মেঘেই ধরা দেয় পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য। বাবার হাতেই অনেকের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়, বিশ্বটাকে প্রথম বাবার চোখেই দেখতে শিখে।

জীবনে বড় অনুপ্রেরণা বাবা

ব্রায়ান লারা বলেছেন, ‘আমি যা, পুরোটাই বাবার অবদান।’

শচীন টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন বাবা।’

মাশরাফির বাবা বলেছেন, ‘বাবা হওয়াটাই গর্বের বিষয়, সফল সন্তানের বাবা হওয়া তো আরও গর্বের।’

অভিনেতা অপূর্ব বলেছেন, ‘বাবা সব সময় একসঙ্গে থাকতে ভালোবাসেন। আমিও ঠিক তাই পছন্দ করি।’

অভিনেত্রী ও সাংসদ  নুসরাত জাহান বলেন, ‘বাবা তুমি আমায় মনুষ্যত্ব শিখিয়েছো। মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছো। সবসময় তোমার শেখানো নীতি ও আদর্শ মেনেই চলব। সব মেয়েই যেন এমন বাবা পান।’

ববিতা বলেন, ‘আব্বা আমার জীবনের আদর্শ। আব্বা আমাদেরকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা বলতেন। আমার জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্র আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। এই যে আমি এত পরিপাটি থাকি, গুছিয়ে থাকার চেষ্টা করি, এটা আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া।’

তারিন জাহান বলেন, ‘বাবার সততাকে আদর্শ মেনে নিয়ে পথ চলার চেষ্টা করি।’

সাদিকা পারভিন পপি বলেন, ‘আব্বুর কারণেই সাহস পেয়েছি।’

প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বলেন, ‘বাবার অভাব পৃথিবীর কোনো কিছুই পূরণ করতে পারবে না।’

গঞ্জালো হিগুয়াইন বলেন, ‘পিতৃত্বের স্বাদ পাবার মুহূর্তটা বলে বোঝানোর মতো নয়। সবকিছুই তখন অর্থহীন হয়ে যাবে।’  লিওনেল মেসি৩৯ বলেন, ‘সন্তানরা জীবনের পথে নতুন করে আমাকে চলতে শিখিয়েছে।’

বারাক ওবামা বলেন, ‘আমি আমার জীবনে যা কিছু করেছি, এর মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত মালিয়া ও সাশার বাবা হিসেবে। তোমরা চৌকস, তোমরা সুন্দর, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তোমরা দয়ালু, বিচক্ষণ ও অনুভূতিপ্রবণ।’

বিপদে-আপদে পাশে থাকেন বাবা

বাবা সন্তানকে শিশুকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সাহায্য করেন, সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে আত্মত্যাগ করেন, সুস্থ ও সবল রাখতে যত্ন করেন, সম্মানিত ও দক্ষ-যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়তে খরচ করেন, বিপদে-আপদে পাশে থেকে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করেন, প্রেমময় মনোযোগে যুক্ত রাখেন, সন্তানের মঙ্গলে পেরেশান থাকেন, আবেগগত চাহিদাগুলো পূরণে আন্তরিক থাকেন, সহমর্মী হন ও অনুভূতি বুঝতে আন্তরিক থাকেন। বাবা আছেন তো, সন্তান চিন্তাহীন-ভাবনাহীন।

বাবা থাকলে যত চিন্তা সব বাবা নিয়ে নেন, কোনো ভয়ই কাজ করে না। ভীষণ বড় বড় অপরাধ ক্ষমা করে কাছে টেনে নেন বারবার। সন্তানের দুঃসময়ে বাবা ডেকে নিয়ে বুকে চেপে রাখেন, চেষ্টা করেন সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেয়ার। হাজার কষ্ট সয়ে তিলে তিলে সন্তানকে বড় করেন একজন বাবা। সন্তানকে সন্তানের মতো মেনে নিয়েই ভালোবাসেন। বাবাই শিখান- সৌন্দর্য নয়, গুণই মানুষের পরিচয়। অনেক মেয়েরই ছোটবেলা, মাঝারি বেলার নায়ক বাবা। ছোটবেলা থেকে সবচেয়ে সুন্দর উপহারগুলো পাওয়া যায় বাবার কাছ থেকে। অনেকেই জীবনের প্রতি মুহূর্তে বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করে যান।

কষ্ট হাসিমুখে স্বীকার করেন বাবা

ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত সকলের কাছেই বাবা অসাধারণ। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সকলেরই প্রথম চাওয়া আর পাওয়া। একজন আদর্শ বাবা তার সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল না হয়ে পারে না। বাবা সারাটা জীবন সংসারে চরম কষ্ট হাসিমুখে স্বীকার করে যান, সব মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে। সবকটা বিপদে বুকে আগলে রাখেন নির্ভীক নাবিকের মতো। চাঁদনী রাতে বাবা কোলে নিয়ে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনান। কখনো রাক্ষস আর ডাইনীর গল্প শুনান।

প্রত্যেকটা বাবার কাছেই নিজের মেয়েটা যেন রাজকন্যা, আর ছেলে রাজপুত্র। সে সুন্দর হোক বা কালো কুৎসিত হোক। সন্তান যখন নতুন কোন ড্রেস পরে বাবার সামনে এসে বলে ‘বাবা আমাকে কেমন লাগছে?’ বাবা তখন ঠোঁটের কোণে উজ্জ্বল হাসি এনে বলে,‘আমার মাকে তো আজ সত্যি সত্যি রাজকন্যার মতো লাগছে’। প্রত্যেকটা বাবা তার রাজকন্যা ও রাজপুত্রকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে। তার রাজপুত্র ও রাজকন্যা একদিন অনেক বড় হবে ধুমধাম করে বিয়ে দিবে। একসময় নাতি-নাতনী হবে, বাসার সামনে মাঠে নাতি, নাতনীদের সাথে নিজের চোখ বেঁধে চোর হয়ে কানামাছি খেলবে।

বাবাহীন জীবন ধূসর মরুর ঊষর বুক

আদম (আ.) মানুষের আদি পিতা। খ্রিস্টান সম্প্রদায় গির্জার পুরোহিত মহাশয়কে সচরাচর ‘ফাদার’ বা পিতা হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। পিতার সেবা ও পরিচর্যা সুখকর, জগতে সুখদায়ক। পিতাই স্বর্গ, পিতাই ধর্ম এবং পিতাই পরম তপস্যা, পিতা প্রীত হলে সকল দেবতা প্রীত হন’ শাস্ত্রের এ বাণী থেকে উপলব্ধি করা যায় বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ও দায়িত্ব কতটুকু।

গ্রিক কবি হোমার  আরও বাড়িয়ে বলেছেন- ‘সেই জ্ঞানী সন্তান, যে তার বাবাকে জানে।’

বাবাহীন জীবন ধূসর মরুর ঊষর বুক, শ্বাপদ সংকুল বনে দুরু দুরু হৃৎকম্পন; ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়ার দুঃসাহসিক চেষ্টার নাম। বাবার আদর্শ, সততা ও  নৈতিকতা সন্তানকেও প্রভাবিত করে।

বাবাকে নিয়ে মার্ক টুয়েনের অনুভূতি হচ্ছে-‘আমি যখন বছরের বালক তখন মনে হতো আমার বাবা কিচ্ছু জানে না, এই পুরনোকালের মানুষটার সাথে থাকা অসহ্যকর। কিন্তু আমি যখন একুশে পা দিলাম তখন উপলব্ধি করলাম এই লোকটা কতটা জানে।’

২০ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর কথা মনে করে রোনালদো আক্ষেপ করে বলেন, ‘তখন আমার অর্থ-বিত্ত কিছুই ছিল না, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন। আজ আমার সব আছে, কিন্তু পাশে বাবা যে নেই।

দায়িত্বশীল স্নেহময় বাবা

সাহিত্যে, গীত-আনন্দ ও লোককথা-শিল্পকর্মে বাবা স্থান করে নিয়েছেন এক দায়িত্বশীল স্নেহময় পুরুষ হিসেবে। বাবাকে নিয়ে নানা কাব্য তো আছেই, আছে অসংখ্য গান। ‘মন্দ হোক আর ভালো হোক বাবা আমার বাবা, পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কেবা;’ ‘কাটে না সময় যখন আয় খুকু আয়;’ ‘বাবা আমার মাথার মুকুট চোখের মণি মা, তাদের ছাড়া এই পৃথিবী ভাবতে পারি না’- আরো কত কি।

‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে, বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না; মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়’ এই গানের সুর যখন কানে এসে লাগে এমন কোনো সন্তান নেই যার বাবার কথা এবং এমন কোনো বাবা নেই যার সন্তানের কথা মনে না পড়ে। মনে হয় অতীতের গহব্বর থেকে কথাগুলো মধুরতম সুর হয়ে হৃদয়ে পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, আর ভিনদেশী কবি পাপাকংগোসসহ অনেকে।

একজনও খারাপ বাবা নেই

বাবাকে নিয়ে কিছু গল্প রয়েছে এমন যে: ‘বাবাদের শার্টগুলো বেশিরভাগ সময় মায়েদের শাড়ি থেকে দামি হয় না, বাবাদের ওয়ারড্রব ভর্তি শার্ট-প্যান্ট থাকে না। বাবাদের জুতা চলে বছরের পর বছর, মোবাইলটা একেবারে নষ্ট না হলে বদলান না, ঘড়িটা বৃদ্ধ হয়, তবুও হাতেই থাকে। একা খেতে হলে সবচেয়ে সস্তা হোটেল খোঁজেন, একা কোথাও গেলে বাসে চড়েন। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সঞ্চয় করেন। অথচ স্ত্রী-সন্তানকে সাধ্যের সব চেয়ে দামি জিনিসগুলো কিনে দেন।

বাবারা একান্ত বাধ্য না হলে কখনো না বলেন না। নিজের জন্য সবচেয়ে কৃপণ বাবাটা তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য সবচেয়ে বেশি বেহিসাবি। বেশিরভাগ বাবাই ভালোবাসি শব্দটা বলতে জানেন না, করতে জানেন। তারা আজীবন তাদের ভাগের বিলাসিতার ভাগ দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবেসে যান। পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ পুরুষ আছেন, অসংখ্য খারাপ জন্মদাতাও আছেন। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই।’৪৪ একজন সন্তানের কাছে বাবা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ। ব্যক্তি জীবনে মানুষ খারাপ হতে পারে, নিকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু সন্তানের কাছে সব বাবাই ভালো।

সন্তানকে আগলে রাখেন বাবা

বাবা শুধু একজন মানুষ নন, স্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ। বাবা নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো বয়সী সন্তানের হৃদয়ে শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার এক অনুভব জাগে। বাবা কতভাবে অবদান রেখে যান সন্তানের জন্য, যার চুলচেরা হিসাব করে কেউ বের করতে পারবেন না।

বাবার কাঁধটা কি অন্য সবার চেয়ে বেশি চওড়া? তা না হলে কি করে সমাজ সংসারের এত দায়ভার অবলীলায় বয়ে বেড়ান বাবা। বাবার পা কি অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত চলে? নইলে এতটা পথ এত অল্প সময়ে কি করে এত শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা। আর বাবার ছায়া? সেটাও শেষ বিকেলের বটগাছের ছায়ার চেয়েও বড়। বড় যদি না হবে তবে জীবনের এত উত্তাপ থেকে কি করে সন্তানকে সামলে রাখেন বাবা আর বাবার চোখ? সেটাও কি দেখতে পায় কল্পনার অতীত কোনো দূরত্ব। তা না হলে কি করে সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায় শঙ্কিত হন বাবা।

বাবার সন্তুষ্টিতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি

প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের উচিত হচ্ছে- বাবার সাথে এবং বাবার স্বজন-নিকটাত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করা। নিজেদের পিছনে যে অনেকে প্রেমপূর্ণ-কর্মব্যস্তময়-যত্নশীল সময় ব্যয় করেছে তার জন্য  কৃতজ্ঞতা পোষণ করা, অন্যদের স্নেহ-ভালোবাসাময় অবদানকে উপলব্ধি করা এবং স্বীকার করা, নিজের পক্ষ থেকে অন্যদেরকে মূল্যবান গণ্য করে আন্তরিক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া এবং যত্ন নেওয়া।

বাবাকে ভালোবাসার অর্থ- তিনি দূরে থাকলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা, উৎসাহজনক কথা লিখে ফ্যাক্স-ইমেইল-চিঠি পাঠানো, টেলিফোনে বা মোবাইলে কল করে দরদপূর্ণ ভাষায় কথা বলা, সাক্ষাৎ করে আনন্দকে বাড়ানো, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্য উপহার পাঠানো, বস্তুগত চাহিদাগুলো জুগিয়ে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করা, অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ না করা, অকৃতজ্ঞ না হওয়া, বাবাকে ভুল না বুঝা। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।

সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বাবা

বাবা নিয়ে সব সন্তানের অনুভূতিটা সমান হয় না। আবার সব বাবাও পারেন না সন্তানের প্রতি তাদের আবেগকে একইভাবে প্রকাশ করতে। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বাবা সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করে যান এবং সন্তানের জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করেন। বাবা যাদের বন্ধু তারা নিজের সব ভাবনাকে বাবার হাতে সঁপে দিয়ে হাল্কা হতে পারেন, বাবার নির্ভরতার ছায়ায় থেকে তার চোখে দেখা সুন্দর ভবিষ্যৎটাকে নিজের করে নিতে পারেন। অন্যদিকে বাবা যাদের কাছে দূরতম গ্রহের বাসিন্দা, তারা শত অর্জনের মাঝেও নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হন অমোঘ এক প্রাপ্তি থেকে।

বাবার সঙ্গে সন্তানের যে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তাতে দুজনেরই কিছু না কিছু করার ব্যাপার রয়েছে। বাবা হয়ত সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সে ক্ষেত্রে ভালোবাসার বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সন্তানকেই। আবার সন্তান যখন মনের মাঝে ঘরবসতি গড়ে দিনে দিনে নিভৃতচারী হয়ে উঠছে তখন তার ভাবনাগুলো ভাগাভাগি করতে সামনে এগোতে হবে বাবাকে।

সন্তান যত বড়ই হোক না কেন তার অভিমান আর অবহেলার পরিমাণ যত বিশালই হোক বাবার স্নেহ সব সময় তার জন্য এক পরম আশ্রয়। বেঁচে থাকার আনন্দে, কষ্টের তীব্রতায়, কঠিন সমস্যায় বাবাই হয়ে ওঠেন বিপদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা সহায়। অন্যদিকে সন্তানকেও ভাবতে হবে বাবার কথা। তার আবেগ অনুভূতি আর পরিণত বয়সের চাওয়া পাওয়াগুলোর দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে।

জীবনের কারিগর বাবা

আমরা শিশুকালে হামাগুড়ি থেকে প্রথম উঠে দাঁড়াই যে হাত ধরে তা বাবার হাত। হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শিখি বাবার হাত ধরে। প্রথম যে কথা বলি তা বাবার ভাষায় কথা বলি। এভাবে সব শুরুই হয় বাবাকে দিয়ে। বাবা হয়ে ওঠে একজন সন্তানের আদর্শ মানুষ। জীবনের কারিগর বাবার অবদান অপরিসীম । বাবার উপদেশ বা আদেশ পথ চলার পাথেয়।

বাবাকে কেউ ডাকে আব্বা, কেউ আব্বু আবার কেউ ড্যাড বা ড্যাডি। যে নামেই ডাকি না কেন, বিশ্বজুড়ে এ ডাকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সব সন্তানের নিঃস্বার্থ আবেগ, ভালোবাসা। বাবা একটু চোখের আড়াল হলেই সন্তানের মনে হয় পৃথিবীর কী যেন হারিয়ে ফেলেছি, অস্থির লাগে, উৎকণ্ঠা জাগে মনে। বাবার কাছে সন্তানই সব; আদর, ভালোবাসা, মায়া-মমতায় জড়িয়ে রাখেন আষ্টেপৃষ্ঠে।

সন্তানের জন্য বাবার কত উৎকণ্ঠা,অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা। বাবার সঙ্গে সন্তানের রক্তের বন্ধন, মায়ার বন্ধন। সন্তানও বাবাকে ভালোবাসে পরম শ্রদ্ধায়, তুলে রাখে হৃদয়ের মণিকোঠায়। যারা বাবার কাছ থেকে দূরে থাকে, তারাও বিভিন্নভাবে চিঠিতে-ফোনে বাবাকে কাছে রাখে। যাদের বাবা নেই, তারাও স্মৃতি গেঁথে রাখে সব সময়।

বাবার অবদান অসাধারণ

অনেক আদর-একটু শাসন, আশ্রয়-প্রশ্রয় আর মমতায় মাখা বাবা বুকে সস্নেহে আগলে রাখে পরম ধনকে। বাবাই সন্তানকে দেন ভরসা, জীবনে চলার পথে দেন বলিষ্ঠ সাহচর্য, দেন সঠিক পথের দিশা, ভালো কাজে দেন অনুপ্রেরণা, দেন জীবনে এগিয়ে যাওয়ার সবক। বাবার আদর্শ, বাবার সততা, বাবার নৈতিকতা সন্তানকেও প্রভাবিত করে।

বাবাই শিখান- সৌন্দর্য নয়, গুণই মানুষের পরিচয়। অনেকেই জীবনের প্রতি মুহূর্তে বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করেন। ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত সকলের কাছেই বাবা অসাধারণ। ফলে যেসব বাবার সন্তান স্বনির্ভর ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে, কৃতিত্ব ও মেধার  স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে; তাদের বাবা তাদের প্রতি যত্নশীল ছিল নিঃসন্দেহে। বাবা যদি সন্তানের প্রতি আরো বেশি দায়িত্বপরায়ণ হন এবং সন্তান যদি বাবার অবদানকে যথাযথভাবে অনুধাবন করেন তবে ভালোবাসাপূর্ণ হবে পরিবার।

সুখে থাকুন বাবাকে নিয়ে

পিতার সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। আমরা যেন ভুলে না যাই বাবার  স্নেহের মাঝে বেড়ে ওঠা আমাদের শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো। যাদের বাবা বেঁচে আছে বাবাকে সম্মান করুন আপনার জীবন পরির্বতন হয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে পুরাতন স্মৃতিচারণ করুন। দেখবেন তার পুরাতন স্মৃতি কিন্তু আপনাকে ঘিরেই। এতে আপনারও ভালো লাগবে।

বাবাকে নিয়মিত পকেট মানি দিন। দান-খয়রাত করতে চাইলে সহযোগিতা করুন। সময় পেলে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যান। বিশেষ করে তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে, পুরাতন আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিন। পারিবারিক কোনো বিষয়ে তার পরামর্শ গ্রহণ করুন। তাকে বোঝান যে আপনি এখনো বাবাকে ছাড়া কিছু করেন না।

যাদের বাবা নেই-তারা বাবার জন্য আশীর্বাদ করুন, প্রার্থনা করুন। প্রত্যাশা করি পৃথিবীর সব সন্তানই সুখে থাকুক বাবাকে নিয়ে। শেষ বয়সে কোনো বাবাকে যেন অসহায়ের মত জীবনযাপন করতে না হয়। যে বাবার জন্য আমরা পৃথিবীর আলো দেখেছি সেই বাবাকে যেন কেউ কষ্ট না দেয়।

পিতৃত্ব কষ্টের হলেও আনন্দের

বাবা হলেন মাঝির মতো। মাঝি যেমন উত্তাল তরঙ্গেও শক্ত হাতে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন, বাবা তেমন করেই পরিবারকে শত প্রতিকূলতা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। বাবার ঘামে শ্রমেই পরিবারের চাকার গতিময়তা বজায় থাকে।  ২০১১ সালের আগস্টে মাত্র ১৯ বছর বয়সে শিশুর বাবা হবার পর নেইমার বলেন, ‘প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, পরে খুশি হলাম। এটা একটা নতুন দায়িত্ব এবং এখন আমি উপভোগ করছি।’

বাবাকে স্মরণ

আরিবার সাথে খেলতে গিয়ে আমার সাথে ছোটবেলায় বাবার খেলার কথা ভাবি! আরিবা যখন গলা জড়ায়ে বলে- বাবা তোমারে কত ভালোবাসি! জ্বরে আক্রান্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কল্পনা করি অসুস্থ আমার শিরদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে রাত্রি জেগে কী ভাবতেন বাবা? মনে পড়ে বাবার বুকে স্নেহের ঢেউ হয়ে আসতাম আমিও। দাদার মৃত্যুর পর নিজের ছোট তিন ভাই, দুই বোন ও মায়ের সংসারের হাল খুব ছোটবেলাতেই ধরেছিলেন আমার আব্বা।

ক্লাসের মেধাবী ছাত্র হয়েও চতুর্থ শ্রেণিতেই বন্ধ হয়েছিল শিক্ষাজীবন। খেলায় আনন্দে মেতে থাকার বয়সেই গরু ও লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করতে হয়েছে। জীবন কী তা বুঝার আগেই সংসারের গুরু দায়িত্ব মাথায় নিয়ে জীবিকার জন্য কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতে আদাবাড়িতে এবং ঢাকার কারওয়ান বাজারে সামান্য মাইনেতে মুদি দোকানে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছেন।

মা ও ভাই-বোনের মুখে আহার তুলে দেয়ার মানবিক চেতনাবোধ ও আন্তরিক সহমর্মিতার কারণে আনন্দহীনভাবে কেটেছে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য। বিয়ের পর পাথরঘাটা-কামালিয়া চালা-চাকদহ-রাজবাড়ি-নাকশালা-করটিয়ায় এক হাট থেকে আরেক হাটে কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। পায়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। রাতে ডাকাতের কবলে পড়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজেছেন, ঝরেছে ঘাম, ভেজা কাপড় শুকিয়েছে শরীরেই।

বছরের পর বছর সন্তানদের পড়ালেখা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে  প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাটিয়েছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। সদা কর্মব্যস্ত ও পরিশ্রমী মানুষটি সারা দিন রোদে পুড়া খাঁটুনির পরও দুই ছেলে ও এক মেয়েকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বাবার এত ত্যাগ স্বীকার আমাকে আবেগাপ্লুত ও অনুপ্রাণিত করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top