মধ্যবিত্ত সন্তানদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা স্বপ্ন না বাস্তব?

ডা. মো. সাজেদুর রহমান শাওন

ডা. মো. সাজেদুর রহমান শাওন

আমাদের দেশের অনেকের মাঝেই এই চিন্তাটা রয়েছে যে দেশের বাইরে পড়াশুনাটা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যদি দেশের বাইরে পড়তে চান বা স্বপ্ন দেখেন তাহলে তাদের বলা হয় অনেকটা বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাঁড়ানোর মতো।

এই চিন্তাটার সাথে আমি সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। আমি সুইডেনে ও ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছি এবং এখন অস্ট্রেলিয়াতে আছি। আমি দেখেছি- বাংলাদেশ থেকে যারা পড়তে আসেন তাদের ৮০ ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাপরও আমি বলবো- মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে আসার যে আনুপাতিক হার অনেক কম।

এর পেছনের কারণ হিসেবে অধিকাংশ মানুষই বলে থাকবেন- মধ্যবিত্ত পরিবারে ঐ পরিমাণ আর্থিক সামর্থ্য বা সক্ষমতা নেই। এর বাইরেও আরো অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে- যেসব কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা দেশের বাইরে পড়তে আসতে অতটা চায় না।

টেমেপ্লেট বা ছাঁচের সমস্যা

আপনি দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারে ঘুরে আসলে দেখবেন তাদের পর্দার কালার একরকম, ফার্নিচার একরকম। এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়েও একটি টেমপ্লেট তৈরি করে ফেলেছেন। এবং সবগুলো পরিবারই সেই টেমপ্লেট ফলো করে। সেই টেমপ্লেটটা হলো- ছেলে-মেয়েরা ভালোভাবে পড়াশুনা করবে, পড়াশোনা করে তারা মেডিকেলে পড়বে বা বুয়েটে পড়বে বা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে এবং সেখান থেকে তারা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে একজন সরকারী কর্মকর্তা হবে। এই টেমপ্লেটে কোনো প্রবলেম নেই। বরং যাদের যে টেমপ্লেটটা পছন্দ তাদের সেইটাই ফলো করা উচিত। কিন্তু এটা সব পরিবারের সব ছেলে মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আপনি কয়টা পরিবারকে দেখেছেন- যেখানে ছেলে-মেয়েরা চিন্তা করে বড় হয়ে ইউকেতে পড়াশুনা করবে, ইউএসএতে পড়াশুনা করবে, হার্ভাডে পড়াশুনা করবে, অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করবে। কয়জনকে দেখেছেন? কেউ সেটা চিন্তাও করে না। ভুলেও যদি কেউ সেটা চিন্তা করে থাকে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়- খবরদার এটা চিন্তা করা যাবে না। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কখনোই এই চিন্তা করে না যে আমি বড় হয়ে ঐ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাব, অমুক দেশে পড়তে যাব। তাদের পরিবার তাদেরকে যে চিন্তাটা ধরিয়ে দিয়েছে সেই টেমপ্লেটটাই তারা ফলো করতে থাকে।

ইনফরমেশন গ্যাপ

আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করতাম আমার যে বন্ধুরা রাজশাহীতে বা খুলনায় পড়াশুনা করতো তারা বলতো- তোরা ঢাকায় যারা পড়াশুনা করছিদ তাদের আউটলুক বা চিন্তা-ভাবনা অনেক ব্রড। কারণ তোদের কাছে সেই ইনফরমেশন আছে। তোরা অনেক কিছু জানতে পারিস। কিন্তু আমরা যেহেতু মফস্বল শহরে থাকি, এই মফস্বল শহর থেকে অনেক কিছুই জানা সম্ভব না, অনেক কিছুই সংগ্রহ করা সম্ভব না। এটা ২০০৫,২০০৬, ২০০৭, ২০০৮ সালের কাহিনী! এর মধ্যে কিন্তু অনেক সময় পেড়িয়েছে, অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। এখন ইনফরমেশনের গ্যাপ আগের মতো আর নেই। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাবার কারণে এখন সব ইনফরমেশন আপনি আপনার হাতের নাগালে পাচ্ছেন।

কেউ যদি গাইবান্ধাতে বসেও যদি চায়- হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে কিভাবে অ্যাপ্লিকেশন করতে হয় সেটা সম্পর্কে জানব। আপনি সেটা জানতে পারছেন। তাছাড়া সোস্যাল মিডিয়াতে এমন অনেকগুলো গ্রুপ ক্রিয়েট হয়েছে যেখানে মানুষজন একজন আরেকজনকে সাহায্য করে। আপনি সেসব গ্রুপের মেম্বার হতে পারেন এবং সেখান থেকে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন। আগে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকের মফস্বল এরিয়াতে থাকার কারণে ইনফরমেশনের যে গ্যাপটা ছিল, সেই সমস্যাটা এখন কিন্তু নেই। তাদের সেই সমস্যাটা কমে এসেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের যে সমস্যাটা এখনো প্রবলভাবে রয়ে গেছে তা হচ্ছে আগ্রহ না থাকা। আগ্রহ থাকলেই কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।

সময়ের সমস্যা

দেশের বাইরে পড়াশুনার চেষ্টা করা কালে আবেদন করার প্রক্রিয়া রয়েছে। অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করার ব্যাপার রয়েছে। আইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হয় অথবা জিআরই দিতে হয় এবং আবেদন করতে হয়। আবেদনের পর অপেক্ষা করতে হয়। স্কলারশীপের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় পেড়িয়ে যেতে পারে। আর এই সময়টাই কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরকে দেয়া হয় না।

বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিতে দীর্ঘায়িত সময় তিনবছর অতিবাহিতও করলেও কেউ কোনো কথা বলবে না। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় প্রস্তুতির জন্য একটি বছর সময় চাইলে বা পড়াশুনার জন্য সুযোগ চাইলে তখন রাজি হবে না। তখন বলতে থাকবে- তোমাকে পরিবারের হাল ধরতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাকরিতে ঢুকো। এই হাল ধরতে গিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলে-মেয়েরাই স্বপ্ন বা পরিকল্পনাকে বিসর্জন দেয়।

টাকার সমস্যা

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সেই পরিমাণ আর্থিক সামর্থ্য থাকে না যেটা দিয়ে তারা দেশের বাইরে পড়তে যাবে। আমি এর সাথে একমত পোষণ করি না। আমি নিজে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমার ওয়াইফ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মেয়ে। আমরা দু’জনই দেশের বাইরে মাস্টার্স করেছি। আমি পিএইচডি শেষ করেছি। আমার ওয়াইফ এখন পিএইচডি করছেন। আমাদের পরিবার দেশের ভেতরে পড়াশুনা করার জন্য অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেছেন কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি দেশের বাইরে মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য তারা আমাদের পেছনে একটা টাকাও খরচ করেনি।

বাইরে পড়তে হলে অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন এই কথাটা তারাই বলে যারা জানে না যে আসলে দেশের বাইরে পড়ার জন্য অনেক স্কলারশীপ রয়েছে। স্কলারশীপ না পেলে রিসার্স অ্যাসিস্টেনশীপ করার সুযোগ রয়েছে। টিচার্স অ্যাসিস্টেনশীপ করে টাকা-পয়সা ইনকাম করার সুযোগ রয়েছে। আমি অনেককে দেখেছি তারা পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে নিজেদের হাত খরচ চালিয়েছেন এবং পড়াশুনার খরচও বহন করেছেন। ফলে দেশের বাইরে সন্তানকে পড়তে পাঠানোর জন্য ব্যাংকের কাড়িকাড়ি টাকা থাকতে হবে- এটা একদম সত্য নয়।

তবে হ্যাঁ ইনিশিয়াল কিছু খরচ রয়েছে। আপনি যেটাই করতে চান ইনিশিয়াল কিছু ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে।আপনাকে আইএলটিএস পরীক্ষার জন্য কিছু ফি দিতে হবে, জিআরই পরীক্ষা দেয়ার জন্য কিছু ফি দিতে হবে, অ্যাপ্লিকেশন ফি দেয়ার জন্য ক্রেডিট কার্ডে কিছু পে করতে হবে- এইগুলোতে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অনেক নার্ভাস হয়ে যায়, ভয় পেয়ে যায়। আমি কোথা থেকে ক্রেডিট কার্ড যোগাড় করবো, কোথা থেকে এই বিল দেব, কোথা থেকে এই টাকা দেব!

দেখুন টাকার অংকে এইগুলো কিন্তু খুব বেশি নয়। আপনি যদি এই সিদ্ধান্ত নেন যে আমি দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য আগামী এক বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করবো, ৫০ হাজার টাকা খরচ করবো।সেটা কিন্তু আজকের বাজারে খুব বেশি টাকা নয় কিন্তু! এটা যদি আপনি আপনার পরিবার থেকে নিতে পারেন অথবা নিজে টিউশনী করেও যদি ইনকাম করতে পারেন; তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ের টাকার সমস্যাটা দূর হয়ে যায়।

মাইন্ডসেট প্রবলেম

মধ্যবিত্ত পরিবারের টেমপ্লেটের মধ্যে থাকতে থাকেতে নিজেদের মেন্টালিটি বা মাইন্ড সেটেও একটা সমস্যা দেখা দেয়। পরিবর্তন চলে আসে! একটা সময় প্যারেন্টস থেকে এক্সটার্নাল প্রেসার আর থাকে না; ইন্টার্নালি নিয়ে ফেলে। আমি এমন অনেককে বলতে শুনেছি- দেশের বাইরে তারাই যায় যারা দেশে ভালো কিছু করতে পারে না।

আপনি হয়তো ভেবে থাকবেন- এটা মুরুব্বিরা বলছে! না আমার সমসাময়িক বা আমার চেয়ে জুনিয়র অনেক ছেলে-মেয়েদেরকেও আমি এটা বলতে শুনেছি। পারিবারিক টেমপ্লেটে থাকতে থাকতে বিদেশে যাওয়ার প্রতি বা বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রতি তাদের একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। একটা সময় এটা তাদের মাইন্ডসেটে ঢুকে গিয়েছে, তারা নিজেরাও আত্মস্থ করে নিয়েছেন।

ফেল করার ভয়

ব্যর্থ হবার ভয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বেশি কাজ করে। আমি যদি চেষ্টা করে খারাপ করি তাহলে লোকে কী বলবে! আমার বাবা-মা কী বলবে! আমার আত্মীয় স্বজন কী বলবে! অন্যরা কী বলবে- এই মানসিকতার কারণেও মানুষজন ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। অনেকে বলে থাকে- আমি অনেক বড় স্বপ্ন দেখি; কিন্তু পরিবারের চাপে, বাবা-মার প্রেসারে আমি সেটা করতে পারছি না।

সেটা অনেক ক্ষেত্রে সত্য! তারপরও গভীরভাবে চিন্তা করে দেখবেন- আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য কী শতভাগ চেষ্টা করেছেন? আপনার পরিকল্পনা কী শতভাগ সঠিক ছিল? আপনি কী আরেকটু চেষ্টা করতে পারতেন না? এই টেমপ্লেটের ভেতরে থাকতে থাকতে আপনার  নিজের মধ্যেই কী এক ধরণের কমফোর্ট জোন তৈরি হয়ে যায়নি? আপনি বলছেন আপনার হাত-পা শিকলে বাধা, এজন্য আপনি বের হতে পারছেন না। কিন্তু এটাও ভেবে দেখেন- আপনি আসলে কতটুকু প্রেসার দিয়েছেন, যেই প্রেসারে শিকল ছিঁড়ে যেত! আপনিও আপনার স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে আরো কয়েকধাপ এগিয়ে যেতেন।

এই বিষয়গুলো আমার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে আপনাকে বলা অসম্ভব! এটা ইন্টারনাল রিয়ালাইজেশনের ব্যাপার! প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজস্ব অবস্থানের ভিত্তিতে নিজেকে প্রশ্ন করতে পারে, আমার কি আসলে মাইন্ড সেটের একটা প্রবলেম রয়েছে। এসব সমস্যার কোনোটাই একেবারে খোদাই করে লেখা না যে, রিমুভ করা যাবে না। প্রত্যেকটা প্রবলেমকেই আসলে সলভ করা সম্ভব। প্রত্যেকটা প্রবলেম মোকাবেলায়ই প্ল্যান করা সম্ভব।

তাই আপনার যদি আসলেই বাইরে যাবার ইচ্ছা থাকে সেটার জন্য প্ল্যান করুন। সেই প্ল্যান মাফিক কাজ করুন। আর সবশেষে বলবো, পরিবারের কাছে কিছুটা সময় ধার চেয়ে নিন। কারণ বিদেশে যাওয়া প্রস্তুতির ব্যাপার, সবশেষে যাওয়ার ব্যাপার। প্ল্যানিং ও বাস্তবতার মাঝখানে সময়ের একটি গ্যাপ রয়েছে। এই সময়টা পরিবার থেকে চান। বলেন- দেখুন আমি কাজ করছি, পড়াশোনা করছি, এই এই প্রসেসে এগুচ্ছি। আর এটা আমার স্বপ্ন। আমাকে এই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য কিছুটা সময় দিন। আশা করি আপনার পরিবার সেটা বুঝবে এবং আপনাকে সেই সময়টা দিবে। সঠিকভাবে চেষ্টা করলে অবশ্যই আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।

লেখক: পিএইচডি (অক্সফোর্ড), এমএসসি (সুইডেন), এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল), এমপিএইচ  এফআরএসপিএইচ পোস্টডক্টোরাল এপিডেমিওলজিস্ট, ইউএনএসডাব্লু সিডনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top