ইলেকট্রনিক সিগারেটের ভেতরে থাকে নিকোটিনের দ্রবণ যা ব্যাটারির মাধ্যমে গরম হয়। এর ফলে ধোঁয়া তৈরি হয়। এটি মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন ই–সিগারেটে আগ্রাসনকে কঠোরভাবে দমন করা উচিৎ। শাস্তিমূলক কর এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানের মধ্যে প্রকাশ্যে এসবের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। ডিজিটাল ভ্যাপিং ব্যবস্থার ব্যাপকতা বা ইলেকট্রনিক সিগারেট গ্রহণের প্রবণতা গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঁচজনে একজন ই–সিগারেট ব্যবহার করে। তবে ইউরোপসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমেরিকার শীর্ষ চিকিৎসক জেরোম অ্যাডামস বলেছেন, উচ্চ–নিকোটিন ডিভাইসগুলির ফাঁদ থেকে লক্ষ লক্ষ কিশোর–কিশোরীকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন– পিতামাতা, শিক্ষক ও ডাক্তারদের একসাথে অবশ্যই কাজ করা উচিত যাতে ভ্যাপিং এর মহামারী মোকাবেলা করে নাবালকদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যায়। ভ্যাপিং তরুণদের স্বাস্থ্য এবং মস্তিষ্কের বিকাশকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
গবেষকরা বলছেন, যারা ই–সিগারেট সেবন করছেন তাঁদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। দি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ই–সিগারেটে আছে জীবাণুনাশক ফরমালডিহাইড,যেটি ক্যানসার তৈরির উপাদান। অথচ ২০০৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ই–সিগারেট এবং অন্যান্য ভ্যাপিং ডিভাইস বিক্রি হচ্ছে এবং এখন ৬.৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ডিভাইসকে সিগারেটের চেয়ে কম ক্ষতিকারক বলে সিগারেটের বিকল্প হিসাবে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়।
যদিও কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে ভ্যাপিংয়ে অভ্যস্ত কিশোররা নিয়মিত সিগারেট খেতেও পছন্দ করে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের কাছে ই–সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু সরকারি জরিপে দেখা গেছে যে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৩.৬ মিলিয়ন তরুণ ই–সিগারেট ব্যবহার করে।
গত বছর হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ই–সিগারেট এর ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের মধ্যে এখন এক পঞ্চমাংশ ভ্যাপিং ডিভাইস ব্যবহার করে। ১৭ এবং ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। জনাব অ্যাডামস জানিয়েছেন, সিলিকন ভ্যালির এক কোম্পানি জুউল ই–সিগারেট বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে, আম এবং শসার মতো স্বাদের সমন্বিত ডিভাইস রয়েছে।
সার্জন জেনারেল জানান, প্রতিটি জুউল কার্টিজে এক প্যাকেট সিগারেটের চেয়ে অনেক বেশি নিকোটিন থাকে। আমরা জানি যে জুউলের মতো এই নতুন পণ্যগুলির কয়েকটি ব্যবহারেই এর প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। আমাদের অত্যন্ত শক্তিশালী এসব পণ্যগুলি থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য এমন আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যা তরুণ নতুন প্রজন্মকে নিকোটিনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বয়ঃসন্ধিকালে নিকোটিনের প্রকটতা বিকাশমান মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে, যার বিকাশ প্রায় ২৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ই–সিগারেটগুলি ভারী ধাতুসহ সম্ভাব্য অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থগুলিকে দেহে প্রবেশ করাতে পারে।
ই–সিগারেটের এরোসোল রয়েছে যেটি ক্ষতিকারক। এটি শরীরে শিরাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে। এবং স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত বা টক্সিক ধাতু ই–সিগারেটের এরোসোলের ভেতর পাওয়া গেছে। যেমন : টিন, নিকেল, ক্যাডিয়াম, লেড ও মারকারি।
গত মাসে জুউল তার সোস্যাল মিডিয়ার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদের নিকট স্বাদযুক্ত কার্টিজ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল। এক বিবৃতিতে কোম্পানিটি বলেছিল, ‘জুউল পণ্যগুলিতে তরুণদের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
সার্জন জেনারেলের সতর্কবার্তাটি তখন আসলো যখন নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো বলেছেন, তিনি আগামী বছর থেকে নিউইয়র্কে ক্যান্নাবিসের বিনোদনমূলক ব্যবহার আইনগতভাবে বৈধ করতে চান। এর মানে আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল শহরটি এমন স্থানগুলির তালিকায় যুক্ত হবে যেখানে ড্রাগ ব্যবহার অনুমতিত। এ পর্যন্ত ১০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি রাজ্য এবং কলাম্বিয়া জেলা বিনোদনমূলক ব্যবহারের জন্য ক্যান্নাবিসগুলিকে বৈধ করেছে।
ই সিগারেটে থাকা ই–লিকুইড অথবা ই–জুস এমন এক ধরনের দ্রবণ যেগুলো তাপ উৎপাদন করে এবং অ্যারোসোলে রূপান্তর হয়। যেটা বাষ্পায়িত হয়ে বুকের ভেতরে প্রবেশ করে। ই–সিগারেট এবং সাধারণ সিগারেট দুই ধরনের সিগারেটেই নিকোটিন ( নেশা জাতীয় দ্রব্য) থাকে। এটি মস্তিস্কের মধ্য স্নায়ুতে উদ্দীপকের কাজ করে। এটি রক্তচাপ, শ্বাসপ্রশাস এবং হৃদস্পন্দন বাড়ায়। একশোরও বেশি স্বাদের ই–সিগারেট রয়েছে। চেরি, চিজ কেক, সিনামোন, টোবাকো ইত্যাদি। এগুলো সব গন্ধযুক্ত খাবারে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ডায়াসেটিল রয়েছে। এটি সাধারণত পপকর্নের মাখনযুক্ত গন্ধ তৈরি করে। এর সাথে ফুসফুসের রোগের একটি যোগসূত্র রয়েছে এবং এটি বেশ ক্ষতিকরও।
প্রোপাইলিন গ্লাইকোল (পিজি) গবেষণাগারে বানানো লিকুইড যা খাদ্য, ওষুধ এবং কসমেটিক বানানোর জন্য নিরাপদ। এটি রক–কনসার্টে কৃত্রিম ধোঁয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি ফুসফুস এবং চোখে বিরক্তির উদ্রেগ করে। এটি ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের জন্য ক্ষতিকর। যেমন : অ্যাজমা ও এমপাইসিমা। গ্লিসারিন গন্ধহীন এবং বর্ণহীন। তরল গ্লিসারিন অনেকটা মিষ্টি স্বাদের হয়। এটি বিভিন্ন পণ্যে পাওয়া যায়। ই–সিগারেটে ধোয়া তৈরির জন্য এক ধরনের ই–লিকুইড বা তরল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ধোয়া শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমন ক্ষতি সত্যিকারের সিগারেটেও হয় না বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালোফোর্নিয়ার অধ্যাপক বেনোউইটজ। ই–সিগারেটে রয়েছে ফরমালডিহাইড ও এসিটালডিহাইড নামের দুটি রাসায়নিক দ্রব্য। এই উপাদান ই–লিকুইডের তাপমাত্রা বাড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত এর ফলে আরো নিকোটিন তৈরি হয়। এ মধ্যে থাকা একরোলিন উত্তপ্ত গ্লিসারিন থেকে গঠিত। এটি ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।ধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
লিথিয়াম ব্যাটারির মাধ্যমে কার্টিজে থাকা নিকোটিন, স্বাদ ও গন্ধমিশ্রিত ই–লিকুইড ও প্রপিলিন গ্লাইকল নামক রাসায়নিক পুড়িয়ে মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে ই–সিগারেট। অনেকে সিগারেট ছাড়তে হাতে তুলে নিয়েছে এই ডিজিটাল ভ্যাপিং ব্যবস্থা। ধূমপানে আসক্তি কমাতে ও সিগারেটের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে তামাকবিহীন ই–সিগারেট তুলনামূলক ভালো সমাধান বলা হলেও গবেষণা বলছে ই–সিগারেটে থাকা কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। ই–সিগারেটে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। ই–সিগারেটেও থাকে ক্ষতিকারক নিকোটিন যা তরল–নিকোটিন সিগারেটের মতোই নেশাগ্রস্ত করে।