ডাঃ লুনা পারভীন
দৃশ্যপট
খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মায়ের কোলে ছটফট করছে বাচ্চাটা। গতকাল সকাল থেকে জ্বর এসেছে। এরপর বিকালবেলা চোখ উল্টে মুখে ফেনা তুলে একবার খিচুনী হয়েছে।
বাবা মা দুজনেই সরকারি চাকুরে তবুও ডাক্তারের কথা পাত্তা দিচ্ছিলেন না। ডাক্তারের অনুরোধ, যেহেতু ১বছর বয়সে প্রথমবার খিচুনী হয়েছে জ্বরের সাথে এবং বাচ্চার কিছু লক্ষ্মণ বিপদজনক, তাই অবজারভেশনের জন্য হলেও একদিন ভর্তি থাকা উচিত তাদের।
অপরদিকে, বাবামা তা মানতে নারাজ।বাচ্চার খিচুনির সময় কাজের লোক ছিল শুধু বাসায়, সে ভুল বলেছে, এটা খিচুনি না। তারা এসেছে শুধু কনফার্ম করতে বাচ্চার ডেঙ্গু আছে কিনা। ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ হলে তারা বাসায় এলে যাবেন। ডাক্তার অযথা ভর্তি আর টেস্ট করিয়ে তাদের হয়রানি করতে চাচ্ছে।
এখন তাহলে কে ঠিক বলুন তো? ডাক্তার অযথা টেস্ট করতে চান নাকি ডেঙ্গু ছাড়াও আরো মারাত্মক রোগ মেনিনজাইটিস হলো কিনা কনফার্ম করতে চান? যে রোগ পরীক্ষা ছাড়া কনফার্ম করা যায় না এবং ডেঙ্গুর চেয়েও মারাত্মক যার ক্ষতিকর দিকগুলো সেই রোগ সত্যিই যদি বাচ্চার হয়ে থাকে তাহলে বাচ্চাটা পরে শেষ মুহূর্তে এনে এরাই বলবেন, রোগ ধরতে না পারায় এবং ঠিকমত চিকিৎসা না করায় বাচ্চা মারা গেছে।
জ্বরের সাথে খিচুনি কখন হয়?
পরিবেশের অস্থিরতার সাথে মানবদেহেও এখন সহ্য ক্ষমতা কমে গেছে হয়তো। ইদানিং বাচ্চাদের জ্বর হলেই খিচুনি হওয়ার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। জ্বর হলে মস্তিষ্কের একটি অংশ সে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে অনেকসময় খিচুনি হতে পারে। বংশগত কারনে বা ইনফেকশন, শরীরে শর্করা ও লবণের তারতম্য হলেও খিচুনি হতে পারে।
জ্বরের সাথে খিচুনি কি কি কারনে হয়?
ফেব্রাইল সিজার ( Febrile seizure)
৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত জ্বর হলে ১ম তিনদিন বিশেষ করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাচ্চার খিচুনি হতে পারে। এই খিচুনি সাধারণত ১মিনিটের কম থেকে ১৫মিনিট পর্যন্ত থাকতে পারে। সারা শরীরে খিচুনী হতে পারে, আবার শুধু চোখে বা হাতপায়েও হতে পারে।
এরকম খিচুনী হলে আতংকিত না হয়ে বাচ্চাকে কাত করে শোয়াবেন, জামাকাপড় ঢিলা করে দিবেন, চেপে ধরবেন না। মুখে লালা বের হলে পরিস্কার করে দিবেন।
খিচুনি কমলে নিকটস্থ হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। ২ বছরের আগে খিচুনি হলে, পরিবারে কারো জ্বরের সাথে খিচুনি হওয়ার ইতিহাস না থাকলে এবং সারাশরীরে না হয়ে, কিছু অংশে ( Partial) খিচুনি হলে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয় বাচ্চার মস্তিষ্কে প্রদাহ বা মেনিনজাইটিস হয়েছে কিনা।
মেনিনজাইটিস
মস্তিষ্কের বহিরাবরণে প্রদাহ বা মেনিনজাইটিস একটি মারাত্মক রোগ। এতে৫০% বাচ্চাদের মৃত্যু হতে পারে এবং বাকি ৫০% এ রোগ পরবর্তী জটিলতা থেকে বিকলাঙ্গ, বধির, অন্ধ, মানসিক বৈকল্য, মৃগীসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে জ্বরের সাথে বমি, খিচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বাচ্চা অতিরিক্ত খিটখিটে, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া শরীর অবশ হয়ে যাওয়াও দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, মাথায় আঘাতজনিত কারনে, ডেঙ্গুতে এমনকি ডায়রিয়ায় লবণ ও শর্করার তারতম্য,হলেও খিচুনি হতে পারে। জ্বরের সাথে বার বার খিচুনি হলে অনেসময় তার মৃগী হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
জ্বরের সাথে খিচুনি হলে কি করবেন?
প্রাথমিক কাজগুলো, কাত করে শোয়ানো, জামাকাপড় ঢিলা করা, মুখের ফেনা থাকলে পরিস্কার করা সহ নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া খুবই জরুরি। বাচ্চার স্পাইরাল ফ্লুইড পরীক্ষা করে ও অন্যান্য পরীক্ষায় বাচ্চার রোগ নির্ণয় করে সেভাবে চিকিৎসা দিতে হয়।
খিচুনি জ্বরের কারণেই হয়েছে জানা গেলে পরবর্তীতে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। ৬ বছর বয়স পর্যন্ত এ বাচ্চার খিচুনি হতে পারে জ্বর হলে। এজন্য সব সময় হাতের কাছে প্যারাসিটামল আর সেডিল ট্যাবলেট রাখবেন। জ্বর এলেই ১ম তিনদিন খিচুনি হওয়ার ভয় থাকে। এজন্য সেডিল ট্যাবলেট প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দিনে তিনবার জ্বরের ১ম ৩ দিন খাওয়াতে হবে যেন খিচুনি আর না হয়।
মেনিনজাইটিস পরীক্ষার দ্বারা প্রমানিত হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ইনজেকট্যাবল।এন্টিবায়োটিক দিতে হয়।
এছাড়াও আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, অনেকেই বাচ্চাদের স্যালাইন আধালিটার পানিতে না গুলে একটু একটু করে নিয়ে চামচে গুলিয়ে সারাক্ষণ খাওয়াতে থাকেন পায়খানা যতবারই করুক। এর ফলে বাচ্চার শরীরে মারাত্মক লবণের তারতম্য থেকে কিডনী বিকল হওয়া, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়, যার ফলাফল বাচ্চার মৃত্যু। কাজেই, স্যালাইন কম খাবে ভেবে যেমন, পানিতে স্যালাইন কম করে গুলানো যাবে না তেমনি শুধুমাত্র পায়খানা পাতলা হলেই যতবার পায়খানা হনে ততবার স্যালাইন খাওয়াবেন, কমও না, বেশীও না।
নবজাতকের খিচুনি একটি মারাত্মক সমস্যা। অবহেলা না করে বা বাতাস লাগছে বলে উল্টোপাল্টা চিকিৎসা না করে, শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাবেন দ্রুত। মনে রাখবেন, ভালো-খারাপ সব পেশাতেই আছে তবে ডাক্তারদের উদ্দেশ্য কখনই আপনার বাচ্চার ক্ষতি করা নয়। শিশুদের চিকিৎসা শিশু ডাক্তারকে দিয়েই করাবেন।
লেখক: শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শ্যামলি