ব্যায়াম করা নিয়ে যে অভিযোগ প্রায়ই অনেকে করে থাকেন তা হলো- সময় কোথায় ব্যায়াম করার মতো? একটি সমীক্ষায় মহিলারা বলছিলেন, ঘাম ঝরিয়ে শরীরচর্চা করার মতো সময় তারা পাচ্ছেন না। কাজকর্ম রয়েছে, শিশুদের দেখাশোনা আছে, স্কুলে আনা-নেয়া, স্কুলের জন্য শিশুদের তৈরি করা, রান্নাবান্না, বাজার করা, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করা, সময় কোথায় ব্যায়ামের? জিমনেশিয়ামে যাবো? অলীক স্বপ্ন বটে। লিখেছেন অধ্যাপক ডা: শুভাগত চৌধুরী
কতটুকু সময় ব্যায়ামের জন্য ব্যয় করলে যথেষ্ট হবে? সুঠাম, ক্ষীণ, সবল দেহও থাকা চাই। বিজ্ঞানীরা এসব প্রশ্নের সম্মুখীন। ব্যায়াম করুন- এ রকম একটি ব্যবস্থাপত্র ডাক্তাররা দিলেন, কিন্তু এর মাত্রা কী হবে?
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন- এসব সংস্থা জনগণকে ‘সঠিক পরিমাণে ব্যায়াম’ করার পরামর্শ দিয়েছে। অনেক বিবেচনার পর সার্জন জেনারেলস অফিস পরামর্শ দিলো- আমাদের সপ্তাহের প্রতিদিন আধঘণ্টা করে মাঝারি মাপের ব্যায়াম (যেমনÑ হাঁটা, বাগান পরিচর্যা করা) করতে হবে। দিনের কর্মসূচির সাথে খাপ খায় এমন সময় বের করে ১০ মিনিট করে দিনে তিনবার ব্যায়াম করা যাবে মোট ৩০ মিনিট।
এই ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছিল ছয় বছর আগে, কিন্তু এখন বলা হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম থেকে ফলাফল পেতে হলে যেমন- আরো শক্তি, আরো এনার্জি ও ক্ষীণ দেহ পেতে হলে আরো ব্যায়াম করতে হবে।
কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সারসাইজ ফিজিওলজিস্ট জোসেফই জেনেলি বলেন, হালকা-মাঝারি ব্যায়াম সামান্য করে অনেক ফল পাবো এমন কথা বলা যাবে না জনগণকে। বছর চারেক আগে আমেরিকার রিসার্চ ফিজিওলজিস্টদের সবচেয়ে বড় দল একত্রে বসে ব্যায়ামের মাত্রা ঠিক করল। আমেরিকান কলেজ অব স্পোর্টস মেডিসিন দিলো পরামর্শ :
দ্রুত অ্যারোবিক ব্যায়াম : যেমন- হাঁটা, জগিং বা সাইকিলিং ২০-৬০ মিনিট, সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ দিন।
ভারোত্তোলন : ৮ থেকে ১০টি ব্যায়ামের একটি সেট, সপ্তাহে ২-৩ দিন।
স্ট্রেচিং : সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন।
সহজ পরিকল্পনা : সবল, সুঠাম থাকতে হলে অন্তত একটু ব্যায়াম করতেই হবে। ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, বাগান করা, হেঁটে চলাচল করা, সপ্তাহে পাঁচ থেকে সাত দিন। ওজন হ্রাস করতে হলে প্রতিদিন আরো ১৫ মিনিট ব্যায়াম যোগ করুন।
কিন্তু সমস্যা থেকে গেল যারা মনে করেন দিনে আধঘণ্টা ব্যায়াম করার জন্য সময় বের করা কঠিন, এরা এক ঘণ্টা ব্যায়ামের কথা শুনলে আঁতকে ওঠারই কথা। তারা বলছেন, আরো বাস্তবসম্মত শরীরচর্চা প্লান করতে, যাতে ফলাফলও পাওয়া যায়।
আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব স্পোর্টস মেডিসিন ছাড় দিয়েছে। আরো বাস্তববাদী পরামর্শ তারা দিচ্ছে। দু’টো পছন্দ রয়েছে, একটা বেছে নিন। যদি ক্ষীণ দেহ ও সুঠাম দেহ চান তাহলে ব্যায়াম করতে হবে দীর্ঘ সময় এবং কঠোর ব্যায়াম বেছে নিন।
সহজ পরিকল্পনা
ব্যায়াম করে ঘাম ঝরাতে চান না বা বেশি চাপ দিতে চান না শরীরে?
সময় একটু বেশি লাগবে।
মাঝারি ব্যায়াম ৩০ মিনিট দৈনিক দ্রুত হাঁটা, শরীরের নিয়ন্ত্রক মেশিন সচল, সবল ও সতেজ রাখতে হলে তা দরকার।
১০০ জন নারী-পুরুষ দুই বছর দৈনিক ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার পর ডালাসের সুপার ইনস্টিটিউট ফর অ্যারোবিক রিসার্চের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, এদের অ্যারোবিক ক্ষমতা (অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড কত কার্যকরভাবে পেশিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে এর পরিমাপ), দেহের মেদের পরিমাণ এবং রক্তচাপ সব কিছুরই বেশ উন্নতি হয়েছে।
অন্যান্য গবেষক দেখেছেন, মাঝারি ব্যায়াম রক্তের চর্বিমান কমায় ও ইনসুলিন রেসপন্স শাণিত হয়। এই প্রতিক্রিয়াটি ব্যায়ামের দ্বারা এত প্রভাবিত হয় যে, বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘মেটাবলিক ফিটনেস’।
শরীরে তেমন লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেলেও আগামী দিনে রোগ অসুখ হওয়ার প্রবণতা অবশ্য কমে যাবে।
তবে খবর একটা আছে। যেসব নারী দেহে সুগঠিত পেশি চান বা অ্যারোবিক ব্যায়ামের বড় সুফল চান বা কয়েক পাউন্ড ওজন হ্রাস করতে চান, এ রকম ব্যায়াম যা বললামÑ সে রকম করলে কিন্তু হবে না।
জোসেফই ডোনেলি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। ওজন হ্রাসের কথা যদি বলি।
কুপার ইনস্টিটিউটে যাদের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছিল, ছয় মাস পর এদের ওজন কিছুটা কমল বটে কিন্তু দুই বছর পর ওজন আবার ফিরে এলো। ডোনেলি বলেন, ডায়েটিং ছাড়া ৪৫ মিনিট মাঝারি ব্যায়ামের জন্য হ্রাস কমই হয়। ওজন হ্রাস করা যদি মূল লক্ষ্য হয় তাহলে দিনে ৯০ মিনিট ব্যায়াম হয়তো লাগে।
যদি আপনি একজন বিগিনার হন, শুয়ে-বসে থাকা লোক, ব্যায়াম শুরু করেছেন, শরীরের ওজন তেমন কমানোর প্রয়োজন নেই, কেবল শরীর সবল-সতেজ রাখতে চান তাহলে ৩০ মিনিট হাঁটুন এতেই হবে। কিন্তু যেসব নারী ব্যায়াম করছেন, আরো নাটকীয় ফলাফল চান, সে ক্ষেত্রে ব্যায়াম হবে আরো কঠোর ও সময়সাপেক্ষ।
দ্রুত সিদ্ধির পরিকল্পনা
সময়ও বাঁচাতে চান এবং কোমরের মেদ কমাতে চান দুই ইঞ্চি। আরো কঠোর ব্যায়াম চাই। নিউ ইয়র্কের এডেলফি ইউনিভার্সিটির এক্সারসাইজ ফিজিওলজিস্ট বব ওটো বলেন, কত সময় ব্যায়াম করলেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত কত কঠোর ব্যায়াম করলেন।
ব্যায়াম যত কঠোর হয় তাহলে প্রতিদিন করার প্রয়োজন নেই, একে কম সময় করলেও চলে। এডেলফি ইউনিভার্সিটির বব ওটো একটি পথ বাতলেছেন। তিনি ৩৮ জন স্বেচ্ছাসেবী লোককে তিন দলে ভাগ করলেন। একটি দল কিছুই করল না। দ্বিতীয় দল ট্রেড মিলে হাঁটল দিনে ২০ মিনিট, সপ্তাহে চার দিন। তৃতীয় দল সে রকম ট্রেড মিল ব্যায়ামই করল তবে এবার শরীরের ওপরের অংশেরও ব্যায়াম করল তারা। তবে ব্যায়াম করল দিনে মাত্র চার মিনিট, সপ্তাহে চার দিন।
কাজ হলো। এরা তাদের সর্বোচ্চ হৃদস্পন্দন হারের ৭০ শতাংশকে অতিক্রম করল (এটি হলো মাঝারি ও ভারী ব্যায়ামের মধ্যে বিভাজন রেখা)।
এদের অ্যারোবিক ক্ষমতা ‘চার মিনিট’ ও ‘২০ মিনিট’ দুই দলই বাড়ল ১০ শতাংশ। যারা কিছু করেনি সে দলে কোনো পরিবর্তন হলো না।
ওটো বলেন, যারা খুব কর্মব্যস্ত এদের জন্য এটি হলো স্বস্তির খবর। তারা ভাবেন, ২৫-৩০ মিনিট অনেক বেশি। এদের জন্য চার মিনিট ব্যায়াম অনেক স্বস্তির সংবাদ। আর হিতকর ফল যদি একই হয় তাহলে বেশি সময় ব্যায়াম করা কেন?
তবে ওটোর এ গবেষণা তার সহকর্মীদের মধ্যে এত প্রশংসিত হলো না।
রোড দ্বীপের প্রভিডেন্সে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সারসাইজ ফিজিওলজিস্ট জন জেকিসিক বলেন, শুয়ে-বসে থাকা মানুষ যদি ছয় সপ্তাহ কিছু না কিছু করেন ফল তারা পাবেন। সে জন্য কিছু না করার চেয়ে চার মিনিট হাঁটা অবশ্য ভালো। তবে এটি ২০ মিনিট হাঁটার সমতুল্য হবে কেন?
২০ মিনিট ব্যায়াম, চার মিনিটের ব্যায়ামের মতো আবেদন না আনতে পারে তবে ৩০ মিনিট ব্যায়ামের চেয়ে তো ভালো। আমেরিকান স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন নীতিমালার মধ্যে এটি লুকিয়ে আছে। যে নারী ব্যায়াম করেন কঠোর-সর্বোচ্চ হৃদঘাত হারের ৭৫-৮৫ শতাংশ (সর্বোচ্চ হৃদঘাত হার বের করতে হলে ২২৬ থেকে নিজের বয়স বিয়োগ করলে ফল পাওয়া যাবে) ২০ মিনিট, সপ্তাহে তিন দিন এতে সুফল আসবে।
বিবেচনা করুন : একজন মহিলা যার ওজন ১৩০ পাউন্ড, তিনি ৪৫ মিনিট হেঁটে যে পরিমাণ ক্যালোরি পোড়াবেন, ২০ মিনিট কঠোর ব্যায়ামের একই পরিমাণ ক্যালোরি পুড়বে তার। হিতকর ফল হলো কেবল ক্যালরি দ্রুত পোড়ার জন্য।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা আটজন মহিলাকে তুলনা করলেন যারা স্টেশনারি বাইসাইকেল ট্রেনিং করছিলেন বেশি ও কম তীব্রতায়। মহিলারা প্রতিটি রুটিনে ব্যয় করলেন ৫০০ ক্যালরি অর্থাৎ তাদের শরীর প্রতিটি সেশনে একই রকম শরীরচর্চা করল। তা হলেও হাই-ইনটেনসিটি বা জোর ব্যায়ামের ফলাফলে দৈহিক পরিবর্তন হলো দীর্ঘমেয়াদি। কঠোর ব্যায়ামের ৩ ঘণ্টা পর দেখা গেল নারীদের শরীর শর্করা ও মেদ ব্যবহার করতে লাগল আরো দ্রুত কম তীব্র ব্যায়ামের লোকদের তুলনায়।
এই সরে যাওয়াটা ঘটল পেশিতে, যেখানে ট্রেনিংয়ের ফলে শরীরে এনার্জির ভাণ্ডার জমা রাখে যে জাইমগুলো সেগুলোসহ মেদও হয় উদ্দীপ্ত।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিরেক্টর, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা।