কার্যকরী পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কমলার রসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম। ফলটি একসঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান দেয়। নিয়মিত কমলা খেতে পারলে অনেকরকম অসুখ থেকে দূরে থাকতে পারবেন। কমলায় প্রচুর ভিটামিন এ, ফ্ল্যাভনয়েড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও ডায়েটারি ফাইবার থাকে। একজন মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন হয়, তার প্রায় পুরোটাই একটি কমলালেবুতে পাওয়া যায়।
উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণ
শত পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ কমলাতে আছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি এবং হেসপিরিডিন যা উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে থাকা ফ্ল্যাভনোয়েড শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। হৃদযন্ত্র ভালো রেখে শরীরে রক্ত চলাচল নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে কমলা।
ক্যানসার প্রতিরোধ
ত্বক, মুখের ভেতর, স্তন, ফুসফুস, পাকস্থলী ও কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে কমলা। এ ফলটিতে থাকা লিমোনেন উপাদান ক্যানসার প্রতিরোধে খুবই উপযোগী।
ক্যান্সারের জীবাণু ধ্বংস করে
কমলায় প্রচুর পরিমাণ ভিটামিনের পাশাপাশি রয়েছে আলফা ও বেটা ক্যারোটিনের মতো ফ্ল্যাভনয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কমলায় উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণ হচ্ছে ফ্ল্যাভনয়েড যা ফুসফুস এবং ক্যাভিটি ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর। তাই ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে প্রতিদিন ১ টি কমলা খাওয়া উচিত।
হার্ট সুস্থ রাখে
কমলাতে রয়েছে ভিটামিন সি, কোলিন, পটাশিয়াম, ডায়েটারি ফাইবার যা অ্যাথমিয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় অনেকটাই। কমলায় আছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান যা হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে। পটাশিয়াম এবং ক্যালশিয়ামের মতো খনিজ উপাদানগুলো শরীরে সোডিয়ামের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন ঠিক রাখতে সাহায্য করে। কমলার চর্বিহীন আঁশ, সোডিয়াম মুক্ত এবং কোলেস্টেরল মুক্ত উপাদানগুলো হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখে।
সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা
প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি থাকায় নানা ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কমলা।
কিডনির জন্য উপকারী
যাদের কিডনিতে পাথরের সমস্যা রয়েছে তারা খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন এ ফলটি। চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে খেলে সমস্যার সমাধান হবে অনেকটাই।
ওজন কমায়
ডায়াবেটিস, মস্তিষ্ক গঠন, ওজন কমাতে সাহায্য করে কমলা। কমলায় রয়েছে প্রচুর আঁশজাতীয় উপাদান, যা ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে। কমলা ‘ক্যালরি ফ্রি’ ফল হিসেবে পরিচিত, আর এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। তাই কমলার পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের বাড়তি মেদ কমাতে সাহায্য করে। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক পুষ্টি যেমন থিয়ামাইন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি সিক্স, ম্যাগনেশিয়াম এবং কপার রয়েছে কমলায়।
দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি করে
চোখের দৃষ্টি শক্তি ঠিক রাখতে দরকার প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ। আমরা সবাই জানি ভিটামিন এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। কমলায় বেশ ভালো পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে। এই ভিটামিন শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।
ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়
কমলার ভিটামিন ত্বক নমীয়, কোমল এবং সুন্দর করতে সাহায্য করে। প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কমলা ব্যবহার করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্বকও দ্রুত বুড়িয়ে যেতে শুরু করে। ভিটামিন সি ছাড়াও কমলায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমূহ ত্বককে সতেজ ও সজীব রাখতে সাহায্য করে। বার্ধক্যেও ত্বককে অনেকটাই মসৃণ রাখে, সহজে বলিরেখা পড়ে না। কারণ, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও ভিটামিস সি ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখে বহু বছর। এটি ত্বকের ব্রণ সমস্যা দূর করে ও ত্বকের কালো দাগ সারায়। কমলা রস করে খাওয়ার চেয়ে কোয়া খাওয়াই শরীরের পক্ষে ভাল।
তারুণ্য ধরে রাখে
কমলায় রয়েছে নারিজেনিনের মতো বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান যা উন্নত মানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিইনফ্লামাটর। এছাড়া রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরের অক্সিজেনের অণু স্থিতিশীল করতে এবং ফ্রি রাডিক্যালস নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে। এই নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতার কারণে ত্বক পরিষ্কার হয় এবং বয়সের ছাপ সহজে পড়ে না। তাছাড়া ত্বক ভিতর থেকে উজ্জ্বল করতেও সাহায্য করে কমলা। তাই একটু বেশি বয়সি মহিলাদের জন্য কমলা খুবই উপকারী।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
কমলা প্রতিদিনের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করে। একই সঙ্গে এ ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় উপাদান। এ পুষ্টি উপাদানসমূহ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ছোটবড় নানা ব্যাধি ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। মুখে ভিটামিন সি এর অভাবে যে ঘাঁ হয় সেটার ঔষুধ হিসেবে কমলা অনেক ভাল কাজ করে। এটি ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কমলাতে উপস্থিত বিটা ক্যারোটিন সেল ড্যামেজ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এতে উপস্থিত ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাঁড়ের গঠনে সাহায্য করে।
প্রদাহ সারাতে কার্যকর
রক্তে থাকা ক্ষতিকর ও প্রোদাহজনক মৌল থেকে রক্ষা করে ভিটামিন সি। সিট্রাসজাতীয় ফলে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। আর কমলা হচ্ছে ভিটামিন সি’র অন্যতম উৎস। কমলার রয়েছে ভিটামিন সি যা যেকোনো ক্ষতস্থান দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে এবং ফ্লু ও ঠান্ডা প্রতিরোধে কাজ করে।
রুচি তৈরি
কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমে ভারসাম্য বজায় রাখতে ভীষণ সহায়ক কমলালেবু। কমলা খেলে খিদে বাড়ে, খাওয়ার রুচি তৈরি হয়। শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও কমলার জুড়ি মেলা ভার। এটি হজম শক্তি বাড়ায় ও সর্দিকাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তশূন্যতা সারাতে ভূমিকা রাখে।
ওষুধ শোষণ
শরীরে ওষুধ গ্রহণে সাহায্য করে কমলা। এই ফলের রস ওষুধের বায়োকেমিক্যাল ও সাইকলজিকাল প্রভাব শরীরে গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।
শর্করা নিয়ন্ত্রণ
কমলার খোসায় চিনির পরিমাণ নেই বললেই চলে, তাই এটা রক্তে শর্করার মাত্রায় প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিস ও মেটাবলিক সিন্ড্রম রোগীদের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রেণ রাখতে হয়। তাই কমলার পুষ্টিগুণ ডায়াবেটিকদের জন্য উপকারী।
খিদে দূরে রাখে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইডেনে মোট ১৮০০০ নারীকে নিয়ে করা দীর্ঘমেয়াদী এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, যারা নিয়মিত কমলা খেয়েছেন, তাদের প্রায় কারোই অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা নেই, অর্থাৎ তাঁরা অতিরিক্ত মোটা হননি। দিনে মাত্র তিনটি কমলা শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পূরণ করতে পারে।
আঁশসহ খাওয়া
শুধু জুস নয়, আঁশসহ খান কমলার জুস খাওয়াটা বেশ সহজ হলেও কিন্তু স্লিম হওয়া বা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে কিন্তু খোসা ছাড়িয়ে কমলা খাওয়ার এফেক্ট অনেক বেশি। ২০০ গ্রাম কমলায় আঁশ বা ফাইবার ২০০ গ্রাম জুসের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। তাই সম্ভব হলে জুসের চেয়ে কমলা খোসা ছাড়িয়ে খাওয়াই শ্রেয়। এতে কমলার স্বাদও লেগে থাকে মুখে অনেকক্ষণ।
ভেতরের সাদা অংশ
কমলার খোসা অতটা পরিস্কার করে ছাড়াবেন না। কারণ, খোসার নীচের সাদা অংশেই থাকে প্রচুর পরিমাণে পেকটিন, যা অন্ত্রের বিষাক্ত জীবাণু বাইরে বের হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা দমন
কমলায় থাকা প্রাকৃতিক, মিষ্টি কিন্তু চকলেট বা অন্যান্য মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছাকে দমন করে। কাজেই এতেও অনেকটা ক্যালোরি কম খাওয়া হয়।
কখন খাবেন
দুপুরে খাওয়ার ১৫ মিনিট আগে কমলা খাবেন। এতে আসল খাবার থেকে কম করে হলেও ৩০০ গ্রাম ক্যালোরি কম খাওয়া হবে। খাওয়ার আগে যারা নাকের মাধ্যমে কমলা বা লেবুর সুগন্ধ নিয়েছেন, তারা খাওয়ার আগে মেন্যু থেকে হালকা ধরণের খাবারই বেশি পছন্দ করেছেন।
একই নিয়মে, অর্থাৎ ক্যান্টিনে যাওয়ার ঠিক পনেরো মিনিট আগেই কমলা খেয়ে নেবেন। সম্ভব হলে ক্যান্টিনের চর্বিযুক্ত খাবারের পরিবর্তে সেদ্ধআলু ও ব্রোকলির সাথে খানিকটা মাখন মিশিয়ে নিন। এতে পেট এবং মন দু’টোই ভরবে।
সারাদিন পান করার জন্য প্রতি গ্লাস পানিতেই খানিকটা কমলার রস মিশিয়ে নেবেন। এতে যেমন পানির স্বাদ বাড়বে, তেমনি ওজনও কমবে।
খোসা ও বিচিও উপকারি
কমলার কোয়া ও খোসা দুটোই পুষ্টিতে ভরপুর। ত্বকের সতেজতা বৃদ্ধিতে অথবা চুলের যত্নেও কমলার খোসা ব্যবহার করা যায়। কমলার খোসা রূপচর্চায় অত্যন্ত উপকারী। স্কিনে ব্ল্যাকহেডস দূর করতে সহায়ক পাঁকা কমলার খোসা। তাছাড়া কমলার খোসা একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে দাঁতের হলদে ভাব দূর করে। তাই কমলার তাজা খোসা বেঁটে টুথপেস্টের মতো ব্যবহার করা যায়। সিদ্ধ কমলারও রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ।
সতর্কতা
যাদের হাই পটাশিয়াম যুক্ত খাবারের ওপর নিষেধ আছে তাদের অবশ্যই পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে কমলা খাওয়া উচিত। এ ফলটি বেশি খেলে পেটে ব্যথা, ডায়েরিবা বা বদহজম হতে পারে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, জি নিউজ, রয়টার্স ও ডিডাব্লিউ