আরিবার দু’চোখ ভরা বিস্ময়! ভোরে সূর্যের আলোটা মুখে পরতেই তাকায়ে দেখল তার বাবা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে চলে গেল। তারপরও জানালার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি সূর্যের আলো দেখে সে নিশ্চিত হলো সকাল হয়েছে। সে আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে বসলো!
আদিফা ঘুম থেকে আগে জাগলেও অলসভাবে এতক্ষণ শুয়ে ছিল! বড় বোনকে বসতে দেখেই তার সব জড়তা ও আলস্য নিমিষেই দূর হয়ে গেল! জানালার গ্লাস ঝাপসা ও ভেজা দেখে বুঝতে পারলো বৃষ্টি হয়েছে। জানালা খুলে গ্লাসে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্পর্শ করতেই শীতল বাতাসের ঝাপটা লেগে তাদের মনটা ভালো হয়ে গেলো।
প্রতিদিনের রুটিন মতো আজও দু’জন বারান্দায় টবের গাছ দেখতে গেলো! মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করল বৃষ্টিস্নাত নানা রঙের ফুল ও সবুজ পাতার সৌন্দর্য । কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি এসে যেগুলোকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। টবে পানি জমা দেখে আম্মুকে জানালে উনি এসে টব একদিকে কাত করে পানি ফেলে দিয়ে গেছেন।
টবের ফুলগুলোর মতো স্রষ্টার সকল সৃষ্টিই সুন্দর। প্রতিটি সৃষ্টি অনেক নিখুঁত। নেই অসঙ্গতি। গাছের পাতার উপর জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চিক চিক করছে। বাইরের আঙ্গিনাটা বৃষ্টির বিন্দুগুলো যেন ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কয়েকটি পাখি কিচিরমিচির শব্দ করছিল। একটি পাখি ডানা মেলে উড়ে চলে গেল দৃষ্টিসীমানা বাইরে হারিয়ে গেল।
আরিবার ইচ্ছে করলো পাখির মত উড়ে যাবার, এমনভাবে যেখানে তার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূর্ণতা পাবে। এতক্ষণে নাস্তা রেডি হয়ে গেছে। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে যাবার ডাক পড়লো। খেতে খেতে আদিফা-আরিবা বাবার সাথে গল্পও করছে। আম্মু নাস্তার যেমন আইটেম বা যে ধরনের মেন্যুই হাজির করেন না কেন, বাবার গল্প ছাড়া তার স্বাদ যেন পরিপূর্ণতা পায় না!
একদিন আরিবা-আদিফা বারান্দায় বসে গল্প করছে। এসব গল্পের কোনো সীমান্ত নেই। অভিনব সব ডায়লগ! কখনো কখনো মনে হয় যেন নাটক! আশেপাশে রং বেরঙের অনেক ফুল। ফুলের উপর কখনো কখনো উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। সবমিলিয়ে আনন্দঘন মুহূর্তগুলো! বাবাকে পেয়েই ছাদে যাবার জোরালো আবদার! ছুটির দিনে বিকেলে এমন আবদার নতুন নয়!
তখন ছাদে বড় বড় অনেকগুলো টব ছিল। টবে গাছ ছিল। গাছের উপর উড়ে উড়ে বসছিল পাখি। পাখির গানও ভেসে আসছিল। একজন খেলার ছলে সুন্দর একটি প্রজাপতিকে মেরে ফেলল। এতে লোনা জলে আরিবার চোখ ভরে গেল। তার প্রজাপতিটির প্রতি খুব মায়া হলো। এই ধরণের একটি ঘটনায় সে যে এতটা কষ্ট পাবে তা অন্যরা কেউ বুঝতে পারেনি।
আরিবা ভাবলো- যার রঙিন ডানা, ক্ষুদ্র জীবন খেলার ছলে নিথর হয়ে যায়, কোথায় যাবে সে? কোন আকাশে কোন ঘাসের দেশে ডানা মেলবে? সে চায় প্রজাপতি স্বাধীনভাবে ডানা মেলে উড়ুক। কেউ যেন তাদের খুন না করে। সব সুন্দর, সকল জীবন আপনাতে উদ্ভাসিত হোক প্রকৃতির নিয়মে। সুন্দর প্রজাপতি সুন্দরের উপমা হয়ে ভাসুক ঘাসে ঘাসে, ফুলে-ফলে, মানুষের মনে দক্ষিণা বাতাসের মৃদুমন্দ সমীরণে।
আরেকদিন ক্লাস শেষে আফরা বান্ধবীর বাসায় গিয়ে একসাথে খেলতে পেরে আরিবার আনন্দের সীমা নেই। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে বেশ ক’দিন হয়েছে। এছাড়াও তাসফিয়ার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। এমন অনেকের সাথেও ভালো পরিচয় হয়েছে, যাদের আগে ভয় পেত! দেখলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত এবং ওর দম বন্ধ হয়ে আসত! প্রথম শ্রেণিতে ওঠে এই বয়সেই সে বুঝতে পেরেছে- আসলে দূর থেকে কাউকে সঠিকভাবে বুঝা দু:সাধ্য।
আরিবা নিজে দাবি করে সে ছবি আঁকতে বেশি ভালোবাসে। তবে আদিফার দাবি তার আপুর কার্টুন দেখা বেশি পছন্দ। তখন আরিবা আরেকটু ছোট। মুরগির দুটি ছানা ছিল তার। খাঁচায় ছটফট করত। আরিবা একদিন দেখে তাদের হ্নদস্পন্দন থেমে গেছে। গভীর অভিমান নিয়ে চলে গেছে। অভিমান যেন পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর, প্রকৃতির নিয়মের উপর। সবচেয়ে বড় অভিমান মানুষের উপর!
এই ঘটনার পর থেকে আরিবার অপরাধী মনে হয়। অনুশোচনা জাগে। এখনো সে ভাবে এবং মনে করে- তার অতিরিক্ত যত্নে মুরগির বাচ্চা দুটি মারা গেছে! বেশি বেশি পানি দেওয়া, বেশি বেশি খাবার দেয়া! আজ গল্পটি লিখতে গিয়েও তাকে ঘটনাটি স্মরণ করালে সে এই বিশ্বাসের কথা জানায়!
দুজনই বলে বেড়ায়, তোমরা কেউ পাখি ধরবে না। কারণ এগুলো মারা গেলে সুন্দর সুন্দর পাখি দেখতে পাবে না। প্রতিদিন ভোরে পাখিদের মধুর গান শুনতে পাবে না। পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙবে না। পাখি আমাদের প্রকৃতির সৌর্ন্দয, আমাদের সম্পদ। পাখি ছাড়া প্রকৃতি এত বৈচিত্র্যময় মনে হবে না। বাবা বললো- তোমরা পাখিকে যেভাবে ভালোবাসে, মানুষ যদি মানুষকে এতটুকুও ভালোবাসতো তবে অমানবিক দৃশ্য দেখতে হতো না।
একদিন আদিফা-আরিবা টাঙ্গাইলে বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। গাড়িতে বসে তার শান্ত, গভীর কালো দু’টি চোখ চলে গেছে সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠের পানে। যেখানে নানা রঙের পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে। বাড়ি পৌঁছতেই দাদা ভাই- দাদু আপুনুকে পেয়ে যে কী আনন্দ! তখন পড়ন্ত বিকেল। বাড়ির ভেতরে এক পাশে গাঁদা ফুলের সমারোহ। ফুলের অনিন্দ্য সুন্দর রুপ আকন্ঠ পান করলো তারা।
আচমকা তাদের পাশ থেকে কে যেন ডেকে উঠল- আরিবা। ফিরে তাকাতেই দেখে চাচাত বোন আতিফা। আরিবা সবসময় নিজের জ্ঞান ঝাড়ে। নিজে ছোট হলেও আতিফা-আদিফা-ছাফিয়ার কথার্বাতাকে ছোট মানুষের খেয়াল ভাবে। আরিবা প্রচুর বই পড়ে। ছবি আঁকে। ওর কাছ থেকে অনেক বিষয় জানা যায়। ফলে সে ভীষণ পছন্দের। সমবয়সীদের গানের আসরে আর বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পের আসরে তার জুড়ি মেলা ভার!
দাদা ভাই বললেন, তোমাদের ভীতরে আছে সৃজনশীলতা। সৃজনশীল মানুষ কখনো হেরে যায় না। কখনো কিছু সময়ের জন্য হয়তো থমকে দাঁড়ায় তবে সব বাধাঁ অতিক্রম করে আবার ঠিকই এগিয়ে চলে। সত্যি তোমাদেরকে পেয়ে আমরা দারুণ আনন্দিত। তোমাদের ক্লাস ছুটি চলছে। ক’দিন বেশ আনন্দেই কাটবে।
পরদিন ভোর ছুঁই ছুঁই ভাব। র্পূবাকাশে সাদা আলোর রেখাপাত। কালো অন্ধকার আকাশটায় একগুচ্ছ জোসনা যেমন করে ফোটে তেমনি মনে হচ্ছে এ সময়। এদিকে দাদু বাড়ি এসে আদিফার দুষ্টুমি বেড়ে গেছে। জোনাকি পোকা তার খুবই পছন্দ! জোনাকি পোকা ধরতে চায়! চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী জোনাকির হঠাৎ জ্বলা হঠাৎ নেভার দৃশ্য তার দারুণ পছন্দের। সারাদিন দুষ্টুমিতে মেতে থাকে। সেও গল্প শুনতে খুবই ভালোবাসে।
বাবা তাকে তালগাছের মধ্যে থাকা বাবুই পাখির বাসা, পাখির কিচির মিচির আওযাজে ঘুম ভাঙার কথা শুনালে সে খুবই মুগ্ধ হয। পুকুরে ফুটে থাকা লাল শাপলার কথা! দুষ্টুমি করে থাপ্পর খেয়ে কারো চোখের জল আর নাকের জল এক হয়ে গাল বেয়ে দুই ঠোঁটের ফাঁক গলে ভেতরে ডুকতে থাকার ঘটনার কথা!
এক বর্ষায় হুজুর দাদাদের বাড়িতে যাত্রা পথে নৌকায় দাদু আপুনুর কোলে বসে নদী থেকে শাপলা তোলেছিল আরিবা। হাসপাতাল দাদুর সাথে বেড়াতে যাবার সময় সেখানে টলমলে জোছনায় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক। মস্ত চাদঁ ঝুলে ছিল মাথার উপর। চিকমিকে আলোর ফুটকি খেলা করছিল পানির ওপর। দু-একটা রাতজাগা পাখি উড়ে যাচ্ছিল ক্লান্ত ডানায়। ঘুরে ফেরার পথে সমস্ত এলাকা ডুবে ছিল গভীর নিথর নিদ্রায়।
আরিবা-আদিফার চোখ জুড়ে খেলা করছিল অনবরত আলোর জগৎ। তারা কখনো এভাবে রাতকে দেখেনি। নদীকে পায়নি কাছে। উদারমুক্ত বাতাসে নি:শ্বাসের সুযোগও ঘটেনি এমন। শহরে জানালা থেকে যতদিন আকাশ দেখেছে, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই এর। এ এক অন্য ভূবন! নদী যে এত প্রাণময় হতে পারে, চঞ্চল আলোর ছলকে মেতে উঠতে পারে ঢেউয়ের শোভা, বাতাস যে হতে পারে এত বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল; প্রথম সেটা হ্নদয় দিয়ে অনুভব করেছিল আরিবা ।
সামনের খোলা প্রান্তর কেবলই হাতছানি দিযে ডাকছিল- আয়, আয়, আয়……। হাওয়ার ঘূর্ণি ও নানা বর্ণের মায়াবি ঝিলিক কে কী আর উপেক্ষা করা যায়! আরিবা চায় সবাই তাকে ভালোবাসুক। চমৎকার আচার ব্যবহারের মাধ্যমে সবার হ্নদয়ই জয় করতে চায় সে। তার স্বপ্ন এক সুন্দর ভবিষ্যতের, এক সুন্দর আগামীর। স্বপ্ন দেখতে সে বড্ড ভালোবাসে। তাইতো আগামী দিনের স্বপ্নগুলো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে ।