মোরশেদা হক পাপিয়া : সময়টা বৈশাখের মাঝামাঝি। যাচ্ছি পিচঢালা পথের বুক চিড়ে, বাসে। বাস জার্নিটা বরাবরই আমার কাছে কষ্টকর। প্রথমে হন্তদন্ত হয়ে বাস খোঁজা তারপর ধস্তাধস্তি করে পৌঁছানো। এবার শুরুটা একটু অন্যরকম হলো। ভরদুপুরে বাসা থেকে বের হলাম। বাসে চড়লাম ঝামেলা ছাড়াই। আর বেশ আয়েশ করেই বসলাম।
বসেই আমার রসিক সাহেব বললেন, কিগো তোমাকে আজ এত দূরে দূরে লাগছে যে! আমি চোখ পাকিয়ে ওকে শাসন করলাম। ও মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো। আমি বাইরে তাকালাম। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ধানের ক্ষেত। সবুজ আর সবুজ। গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ, হলদে সবুজ, ফিকে সবুজ। জমিন জুড়ে সবুজের মেলা।
দূরে দিগন্ত ছুয়ে সারিবাঁধা গ্রাম। সবুজেরা যেন জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। আর ওই জমাট সবুজের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে। সম্ভবত ওগুলো নতুন টিনের প্রতিফলিত রশ্মি। আমি অভিভূত হয়ে তাকিয়েই রইলাম।
আকাশে ছাইরঙা মেঘ ঝুলছে। ধানের ক্ষেতে আলোছায়ার খেলা। বাতাস বইছে। সবুজেরা চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত। বাতাস বইছে। সবুজেরা উদ্দাম, প্রাণবন্ত। এ সৌন্দর্য চোখ শীতলকারী। অন্তর হরণকারী। আমি দৃষ্টি প্রসারিত করে প্রাণখুলে দিলাম। তারপর বুকে ধুকধুক করা হৃদয় ছুয়ে দেখলাম। দেখি, সবুজে ছেয়ে আছে মনের জমিন।
হাবিব, আবিদ, বোরহান, মুজাহিদ, দিনা, মিনা, অনি। এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। আমার চোখে কি করে যেন সবুজ আর তরুণে মাখামাখি হয়ে গেল। মনে হল ওরা এক, একই। সবুজই তরুণ। তরুণই সবুজ। চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত, উদ্দাম, প্রাণবন্ত, নিষ্পাপ, নির্ভয়। আমি স্মৃতির সেলুলয়েডে চোখ রাখলাম। খুঁজলাম ওদের বয়সী আমাকে। পেলাম, স্রোাতে ভাসছি। চেতনার চোখ অন্ধ। স্রোতে ভেসে যায় খড়কুটোও। এতে কোনো কৃতিত্ব নেই। নেই কোনো অর্জন। শুধু ভেসে যাওয়া, লক্ষ্যহীন।
ওদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। ওই সবুজ ফসলী ক্ষেতের মতন। নিজেকে উজাড় করে পৃথিবীতে শান্তি আনা। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়। আবেগে আপ্লুত। চেতনার চোখ খুলেছে। হৃদয় জেগেছে। কিন্তু হায়! এতদিন যে সবল দেহটি মৃত প্রাণের বামন হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে আজ সে হলদে সবুজ। ক্ষয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ এক বসত মাত্র। সজাগ প্রাণের বাহন হয়ে কি করে সে ছুটবে? মনে হলো এটা অসম্ভব। শুধুই অসম্ভব। কেবল সম্ভব প্রাণের মাঝে প্রাণের প্রবাহ।
হঠাৎ হাতের মুঠো ফোনটা বেজে উঠলো।
: হ্যালো।
: সালামু আলাইকুম।
: ওয়ালাইকুম সালাম। ভালো আছো?
: জ্বি, আপনি?
: আলহামদুলিল্লাহ।
: কোথাও যাচ্ছেন মনে হয়?
: হুম। বাড়ি যাচ্ছি।
: জার্নিতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?
: না বাবা । সবুজ দেখছি। চোখ জুড়ানো সবুজ। আর তোমাদের কথা ভাবছি।
: আমাদের কথা?
: হুম। ওই সবুজের সাথে তোমাদের কত মিল। যেখানেই সবুজ সেখানেই প্রাণের অস্তিত্ব। টগবগে। তাজা। তোমরাও কি তাই নও?
: হতে পারে, জানি না।
: জানতে হবে। নিজেকে চিনতে হবে। তোমরা দশদিগন্ত আলোকিত করবে আর সে আলোয় পুড়ে শুদ্ধ হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
: আমাদেরকে নিয়ে আপনার অনেক স্বপ্ন?
: হ্যা বাবা। পৃথিবীকে ধূসর হতে দিও না। সবুজের আগুন ছড়িয়ে দিও। পারবে না?
: পারবো।
: হ্যালো হ্যালো…
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। আর আমি সবুজেই রয়ে গেলাম।