শৈশব কাটুক ভালোবাসায় আর যত্নে

মার্শিয়া খান মিথুন

আমার সন্তান প্রথমদিকে বুকের দুধ খেতে চাইত না। বুকের দুধ খাওয়ানো ধৈর্যের ব্যাপার। হঠাৎ করে একটা উচ্ছল মেয়ের জীবনে একটা সন্তানের জন্ম। বুকের দুধ খাওয়ানো, পটি পরিস্কার করা এগুলো খুবই কষ্টের কাজ ছিল আমার জন্য কারন সে প্রথম সন্তান। চাকরির সুবাদে আমাকে জার্নি করতে হতো কিন্তু গাড়িতে উঠলেই সে কান্না করত। কয়েক মাস বয়স হলে তার কান্নাটা বন্ধ হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ্।

প্রকৃতি থেকে এই পরিবর্তনগুলো হয়েছে, পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যখন সে একটু বড় হল আধো আধো কথা বলা শিখলো। শুধু আমাকে প্রশ্ন করত এটা কি এটা এটা কি এটা। তার কথার উত্তর দিতে দিতে পাগল হয়ে যেতাম। একটা জিনিস একবার বললেই তার মনে থাকতো। এভাবে সে কথা বলা শিখে গেল।
প্রতিটা মুহূর্তে তার খাবারের পরিবর্তন হয়েছে, রুচির পরিবর্তন হয়েছে, এটা খাবে তো ওটা খাবেনা। প্রতিটা মুহূর্তে অসংখ্য পরিবর্তন করতে হয়েছে ওর খাবারের মেন্যুতে। বিভিন্ন খাবার ট্রাই করেছি। যেভাবেই হোক পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করেছি। ঘরের তৈরি খাবার দিয়েছি। পরিমাণে অল্প খাক সমস্যা নেই কিন্তু সে যেন পুষ্টিকর খাবার খায়। ওর ওজন উচ্চতা ভালো আছে তার মানে পরিমাণে কম হলেও ওর জন্য পরিমাণটা ঠিক আছে।
দুই বছর বয়সে সব কথা বলতে পারলেও সে পটির কথা বলত না। যেখানে সেখানে পটি করে দিত। যেটা পরিষ্কার করা আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিল। তাকে বোঝাতে বোঝাতে আমি পাগল প্রায়। পুতুল দিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে একটা সময় সে নিজে থেকে বলা শুরু করলো।
ওর ট্যানট্রামসের সময়টা ছিল সবথেকে ভয়াবহ। প্রচন্ড কান্না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে সে কান্না করত। সে সময় ছিল লকডাউনের সময়। ওর পাপা ছিল গ্রামের বাড়িতে তার মানে পুরোটা আমাকে একা হাতে সামলাতে হয়েছে।
এতো জোরে চিৎকার করত যে কানে তালা লেগে যেত। এটা হলো কেন এটা হল না কেন!! বাসায় শুধু বলতাম ওর তিন বছর পূর্ণ হলেই এগুলো ঠিক হয়ে যাবে আমি একটা লেখায় পড়েছি। বাসায় বলতো সবকিছু কি আর বইয়ের ভাষা দিয়ে হয়? হয় আমি বিশ্বাস করেছি এবং দিন গুনতাম কখন ওর তিন বছর পূর্ণ হবে। আসলেই তিন বছর পূর্ণ হলে সেটা ঠিক হয়ে গেছে।
ও যখন ছোট ছিল নানা ভাই বাসায় আসলে নানা ভাইকে আর ছাড়তে চাইতো না। নানাভাই লুকিয়ে চলে যেত। তা না হলে সে যাওয়ার সময় প্রচন্ড কান্না করত। সেটাও কিন্তু ঠিক হয়ে গেছে। ইদানিং সে তার পাপার খুব ভক্ত হয়েছে (আগেও ছিল) পাপাকে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। মেয়েরা মনে হয় পাপার ভক্ত বেশি হয়।
আমি অফিসে যাওয়ার সময় ওর কান্না। এত যে বুঝিয়েছি মাম্মি ঝটপট ঝটপট অফিস থেকে চলে আসবে। তারপরও সে কান্না করে। জানি সময়ের সাথে সাথে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আছি আমি। সেদিন আমার মেয়েটা প্রচন্ড দুষ্টুমি করছ, প্রচন্ড। আমি শুধু বলেছি এত দুষ্টুমি করছ কেন? আম্মু আমাকে বলে আর কিছুদিন যাক তোকে আর ওর দরকার হবে না। ও বড় হয়ে যাবে। তখন এই দুষ্টুমিগুলোকেই কিন্তু মিস করবি।
সে আমার বুকের মধ্যে ঘুমায়। একটা সময় সেটা হয়তো থাকবে না। সে আলাদা রুমে ঘুমাবে। তার প্রাইভেসি দরকার হবে। এইযে খাবার নিয়ে লেগে থাকা, পড়তে বসানো, দুষ্টুমি করা, গোসল করতেন না চাওয়া, দাঁত ব্রাশ করতে না চাওয়া, এইগুলা কি আজীবন থাকবে? না। একটা সময় সে বড় হয়ে যাবে।
আমার সন্তান শৈশব থেকে কৈশোরে প্রবেশ করবে তারপর যৌবনে। শারীরিকভাবে সে বড় হলেও মা হিসেবে আমি কোনদিনও বড় হতে পারব কিনা জানি না। যে দিনটা চলে যাচ্ছে সেই দিন আর ফিরে আসবেনা। যদি একটু ধৈর্য্য সহকারে এই দিনগুলোকে মোকাবেলা করি তাহলে কিন্তু বড় হলেও আমাদের দুজনের মনে সুখের স্মৃতি হয়ে থাকবে এই সব দিনগুলো।
আমি আমার সন্তানের বন্ধু হতে চাই। সে যেন তার সব কথা আমাকে এসে বলে। তার যৌবনের কথা, সে তার সব কথা আমার সাথে শেয়ার করে। সে যেন ভয় না পায় যে মাম্মির কাছে গেলেই আমাকে বকা দেবে এমনটা যেন না ভাবে। আমি আমার সন্তানকে পিটিয়ে মানুষ করতে চাইনা। খাচ্ছেনা? মার!! দুষ্টুমি করছে? মার!! আমার কথা শুনছে না? মার!! পড়াশুনা করছে না? মার!! আমি এমনটা করি না। বড় হলেও আমার সন্তানের মনে আমাকে নিয়ে যেন সুখের স্মৃতি থাকে সেই চেষ্টাই করি আমি।
মাদেরকে ধৈর্য্যশীল হতে হয়। আশেপাশের পরিবেশ থেকে সন্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব মায়েরই। পরিবারের সাপোর্ট, সন্তানের পিতার সাপোর্ট অবশ্যই দরকার আছে। আমি আমার সন্তানকে বলি না তোমাকে জন্ম দিয়ে আমি উদ্ধার করে দিয়েছি!! বরং আমার সন্তান আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে। আমি নিজের প্রয়োজনে তাকে দুনিয়াতে এনেছি। সে আমাকে মাম্মি বলে ডাকে।
সেদিন আমার মেয়ে গোসলের পর জামা পরা নিয়ে ১ ঘন্টা সময় নষ্ট করলো!! এমনিতে সে গোসল করতে চায় না। আবার শুরু করলে পানি থেকে উঠতে চায় না। বেশ কষ্ট করে পানি থেকে উঠানোর পর মুছতে দিবে না, প্যান্ট পরবে না, জামা পরবে না, জুতা পরবে না। অনেক কষ্টে পরালেও খুলে ফেলবে। খাটের উপর লাফাবে। দৌড় দিবে। এরকম আরো অনেক দুষ্টামি করে জায়গায় সে এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে ফেলল। প্যান্ট না পরলে আব্বুর কাছে আমি অনেক বকা খাই। আব্বু প্যান্ট ছাড়া দেখতেই পারে না তাকে।
খুব রাগ হচ্ছিল, রাগ উঠেছিল। কিন্তু আমি এমন মানুষ নই যে আমার কোনো স্ট্রেস বা রাগ আমি আমার বাচ্চার উপর ঝাড়বো। আচ্ছা ভালো কথা সে এক ঘন্টা সময় নষ্ট করল, এই একঘন্টায় কি এমন কাজ করতাম যেটা আমার সন্তানের থেকেও বেশি ইম্পর্টেন্ট?? দুনিয়া উদ্ধার করে দিতাম?? দুষ্টুমি করছে সেটাই তো স্বাভাবিক তাই না? না করাটাই তো অস্বাভাবিক। একটা সময় সে বড় হয়ে যাবে। ছোট ছোট জিনিস করলে তা খুবই প্রয়োজন। আমি তাকে কি শেখাচ্ছি তার ফল আমি পাচ্ছি।
সেই দিনেরই ঘটনা, আমি গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে খানিকটা পানি পড়ে গেল। সাথে সাথে আমার মেয়ে আমাকে বলল মাম্মি পানি পরে গিয়েছে, কিচ্ছু না মুছে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি খুব অবাক হলাম আমার মেয়ের সাথে আমি ঠিক এমনই ব্যবহার করি। সে কোথাও পরে গেলে বা কোনো সমস্যা হলে বা কিছু একটা ঘটলে সাথে সাথে বলি কিছু না কোনো ব্যাপার না কিছু হয়নি। সেটাই আমার সাথে সে করলো।
পাপা বাসায় ফিরলে কোনো বাচ্চা যদি বলে পাপা মাম্মি আমাকে বকা দিয়েছে। তার পাপা সাথে সাথে যদি তার মাম্মির কাছে জানতে, বকা দিয়েছ কেন?? এমন কাজ করা মোটেও ঠিক না। এতে বাচ্চা তার মা কে সম্মান করবে না। বরং পাপা বাচ্চাকে বলবে তুমি কি করেছ যে মাম্মি বকা দিয়েছে?? কোন ভুল করেছ?? করলে সরি বল। এতে বাচ্চা তার ভুল বুঝতে পারবে। মায়ের ভুল হলে আলাদাভাবে বলতে হবে। বাচ্চার সামনে না।
আমার আব্বু আমাকে বলছিল সে যদি তার পিতার কাছে কোন বিষয়ে নালিশ করতে যেত সে আগে সেটা না শুনে তার কাছে জানতে চাইত তুমি কি এমন কাজ করেছিলে যে সে ওই কাজটি তোমার সাথে করেছে? সেটা আগে বল তা না হলে আমি বুঝবো কিভাবে কার ভুল হয়েছে??
প্যারেন্টিং আসলে কঠিন কিছুনা আবার অনেক কঠিন। প্রতিদিন আমরা খুব সাধারন কিছু ভুল করে থাকি। একটু সচেতন হলেই এই জিনিসগুলো শুধরে নেওয়া যায়, পিতামাতাদের জন্য। ও-ই যে কথায় বলে না আপনার শিশুর ভুল আপনি আগে ধরিয়ে দিন যেন দুনিয়া তার ভুল ধরতে না পারে।
প্রতিটি শিশুর শৈশব কাটুক ভালোবাসায় আর যত্নে সেই কামনায় ,,,

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *