শিশুকে কী খাওয়াবেন? কেন খাওয়াবেন?

ডাঃ লুনা পারভীন

খাবার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, লেবু চিপে তিতা বানিয়ে ফেলার পরও, ইনবক্সে মায়েরা নক করেই যাচ্ছেন, অধিকাংশই কি খাওয়াবে, কী খেলে বাচ্চার শরীর মোটা হবে, বেশি খাওয়ানোর উপায় কী…..এই একটাই চিন্তা নিয়ে । আবার কিছু করছেন, অভিযোগ। তারা নয়, বরং, শশুরবাড়ির চাপে, পাড়াপ্রতিবেশীর খোঁটায় শিশুকে উল্টাপাল্টা খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা । আসুন আপনাদের কিছু দৃশ্যপট দেখাই, আপনারা বুঝতে পারবেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল?

দৃশ্যপট এক

একজন এলেন হসপিটালে বাচ্চার পা বাঁকা, রিকেটস কিনা জানতে । দেখলাম সব রিপোর্ট নরমাল, ওজন বেশী। ওজন বেশীর জন্য পায়ের উপর প্রেশার পরছে, বয়স মাত্র ১৯ মাস, ওজন ১৬ কেজি । কেন ওজন বেশী? পাঁচবার ফিডার ভর্তি করে ফর্মূলা দুধ খাওয়ান সাথে বাড়তি খাবার। ফিডার বন্ধ করতে বলায় অবাক হলেন। তাহলে বাচ্চা খাবে কি? ওজনের জন্য বাচচার পা বাঁকা হয়ে গেলেও খাওয়াতে হবে বেশী?

দৃশ্যপট দুই

আরেক বাচ্চার মা এলো সেদিন বাচ্চাকে জোর করে সারাদিন বাটিভর্তি খিচুড়ি খাওয়ান জোড় করে, গাজর মিষ্টি কুমড়া মিশিয়ে। গায়ের রং হলুদ হয়ে গেছে গাজর খেতে খেতে, খেয়ে যখন আর নিতে পারে না, জোর করার জন্য খাওয়া শেষে বমি করে ফেলে প্রতিবার। বমির জন্য এসেছেন চিকিৎসা নিতে। ঠেসে খাইয়ে বমি করানোর কি প্রয়োজন?

দৃশ্যপট তিন

তিন বছরে উনিশ কেজি ওজনের বাচ্চা, হাঁটাহাটি করছে আর ঘামছে। ঘাম গায়ে বসে ঠান্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তবুও মায়ের আফসোস, বাচ্চাকে কিছুই খায় না! শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তাও খাওয়ানো বন্ধ নেই।

দৃশ্যপট চার

১৩ মাসের বাচ্চার মা পারলে পুরা ফার্মেসীর সব ঔষধ গুলিয়ে খাওয়াবে, কেন বাচ্চার আগের মত মাসে ১ কেজি করে ওজন বাড়ছে না?প্রতিমাসে যদি ওজন ১ কেজি করে বাড়ে তাহলে ৩৬ মাসের ( ৩ বছর) বাচ্চার ৩৬ কেজি ওজন হলে তাকে কেমন লাগবে চিন্তা করুন একবার, ৫বছরে (৬০ মাস) ৬০ কেজি হলে ?

দৃশ্যপট পাঁচ

বাচ্চা হালকাপাতলা বলে ঘরের মুরুব্বি থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশী এমনকি কোন অনুষ্ঠানে গেলে অপরিচিতরাও অাফসোস করে, বাচ্চাকে কিছু খাওয়ান না? শ্বশুরবাড়ির লোকজন সারাদিন গঞ্জনা দেয়। প্রায়ই তারা তার ৭ মাসের বাচ্চাকে আম, কাঁঠাল, বাইরের খাবার, সুজি, সাগু ফিডারে ব্লেন্ড করে খাইয়ে দেয় মোটা হওয়ার জন্য। ফলে বাচ্চার দুদিন পর পর আমাশয় হয়, হসপিটালে এ নিয়ে তিনবার ভর্তি হয়েছে তাও তারা এসব খাওয়ানো বন্ধ করেনি।

দৃশ্যপট ছয়

কেন হাবিজাবি খাওয়ান জিজ্ঞেস করায় এক মা হেসে বললো, একটুই তো খাওয়াই, সারাদিনে একবার বা একদুই চামচ। কথা হচ্ছে বিষ তো বিষই। এক চামচ আর এক বালতি হলেই কি? জীবন তো আর রবীন্দ্র সংগীতের মত নয়, ” আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান……! ” এটা আপনার বাচ্চার জীবন যার পুরো ভবিষ্যত সামনে পরে আছে।
এখন বলুন, কার কার মনে হচ্ছে উপরের মা বা তার পরিবার ঠিক কাজই করছে? করে থাকলে বলুন কেন? আর না করে থাকলে বলুন, আপনার সাথে কি এরকম হয়না, হলে আপনি কি করেন ?

স্বাস্থ্য বলতে আমরা কেন মোটা হওয়াটাই বুঝি? খাওয়া নিয়ে আমরা এত অবশেসড্ কেন? খাবার নিয়ে এত চিন্তা, এত পরিশ্রম না করে যদি চরিত্র গঠন বা সৎ স্বভাব তৈরী নিয়ে সময় ব্যয় করতাম তাহলে কি আমাদের সমাজে এত অবক্ষয় দেখা দিত? ভেবে জানাবেন।

খাদ্য কি?

খাদ্যের সংজ্ঞা হলো, ‘বেঁচে থাকা ও সুস্থ থাকার জন্য আমরা যা খাই তাই খাদ্য।’ এখন বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু খাবার লাগে? এটা যার যার চাহিদা। কেউ দুই প্লেট বিরিয়ানি, পাঁচটা রোস্ট খেয়েও বলে পেট ভরলো না, কি আর খেলাম। আবার কেউ দু লোকমা খেয়েই বলে, আর পারছিনা, পেট ঢোল হয়ে গেছে।
খাবার খাবেন পেট ভরে, যতটুকু খেলে আপনার হজম হবে। জানতে হবে কখন থামতে হবে। কিছু মাকে দেখা যায় বাচ্চা বেশি খেয়ে বমি করে দিচ্ছে তার আগে খাওয়ানো থামছে না। এমনটা কি ঠিক?

কি খাওয়াবেন?

খাদ্যের ছয়টি পুষ্টিগুণ আছে। শর্করা, আমিষ, স্নেহ( ফ্যাট), ভিটামিন, খনিজলবন, পানি।

শর্করা

ভাত, রুটি, আলু, চিনি এসবে পাওয়া যায়। কাজেই এগুলো খাওয়াতে পারলে সুজি, চালের গুড়া, সাগু, সেরেলাক খাওয়ানোর দরকার আছে কি?

আমিষ

মাছ, মাংশ, ডিমের সাদা অংশ, দুধ, ডাল। শুধু গরু বা মুরগীর মাংস খাওয়ালেই হবে না, দুধ, ডিম, ডালও খাওয়াতে হবে। কারন ওতে ভিটামিন, মিনারেলসও আছে।

স্নেহ /ফ্যাট

পেটে গ্যাসের সমস্যা বা আমাশয় না থাকলে, বাচ্চাদের একটু করে তেল, ঘি, বাদাম দুধের সর, ডিমের কুসুম খাওয়ানোর দরকার আছে। তাই বলে, চিজ, মাখন, ঘি, গরুর চর্বি, বড় মাছের তেল বেশি খাওয়ানোর দরকার নেই।

ভিটামিন ও খনিজ লবণ

রঙিন শাকসবজি, ডিমের কুসুম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ, কলিজা, ফলমূল চাহিদা পূরনে সক্ষম কিন্তু তা যেন, ফরমালিন ও কীটনাশক মুক্ত হয় সে খেয়াল রাখতে হবে। পানিঃ

বাচ্চাকে প্রচুর পানি খাওয়াতে হবে। বয়স ও ওজন অনুসারে এক থেকে দুতিন লিটার পান করাতে হবে। তবে গরমে, বেশী ঘামলে, জ্বর বা বমি-পাতলাপায়খানায় এক থেকে দেড় লিটার পানি বেশি খাওয়ানোর দরকার আছে।

কেন আপনার বাচ্চা মোটা?

১. বংশগত কিনা? বাচ্চা তার বাবা মা, আত্মীয় স্বজনদের উচ্চতা ও ওজন পেয়ে থাকে। এরসাথে খাবারের কোন সম্পর্ক নাই।

২. বাচ্চার খাবারটা সময়মতো দিচ্ছেন কিনা? একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চাকে খাবার দিলে অভ্যাস হয়ে যায় ঐ সময়টায় খিদে অনুভব করার। কিন্তু যদি, একেকদিন একেক সময় দেন, তাহলে তার শরীরে খিদে তৈরীর কোন সময় পায় না।

৩. চাহিদা বুঝতে হবে। একটা বাচ্চার এক চামচ খেয়েই পেট ভরে যায়। সে হয়তো অল্প করে বারে বারে খাওয়ায় অভ্যস্ত। আবার আরেক বাচ্চা সারাদিনে মাত্র দুইতিন খায়, কিন্তু ভালো খায়। বেশী খাবার দিয়ে বমি করিয়ে কি লাভ? বাচ্চা পরে বমির ভয়ে খেতে চায় না বা ভয় পায়।

৪.বাচ্চা বেশী চঞ্চল কিনা? যে বাচ্চা সারাক্ষণ ছুটোছুটি করছে তার খাবার হজম হচ্ছে দ্রুত, ক্যালরি বার্ন হচ্ছে, ঘাম দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। কাজেই মোটা হওয়ার কোন সুযোগ নাই।

৫. সঠিক খাবার দিচ্ছেন কিনা? যা খাওয়াচ্ছেন, ব্লেন্ড করে দিচ্ছেন, পেটে থাকছে না, বাচ্চা চিবানো শিখছে না, দাঁত গজাতে দেরী হচ্ছে। শুধু শর্করা জাতীয় খাবার দিলে শরীর বাড়ছে কিন্তু পুষ্টি হচ্ছে না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে না, বুদ্ধি তৈরী হচ্ছে না।

৬. কিছু জন্মগত ত্রুটি বা হরমোনের সমস্যা থাকে, কিছু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বাচ্চার ওজন এমনিতেই বেশী হয়। এর সাথে খাবারের কোন সম্পর্ক নাই।

৭, সারাক্ষণ ট্যাব, টিভি, মোবাইল নিয়ে বসে আছে যে বাচ্চা, স্কুলের হোমওয়ার্ক, টিচারের কাছে সারাদিন পড়ছে এসবই তাকে করতে হচ্ছে বসে বসে। নড়াচড়া কম, ক্যালরি তেমন খরচ হচ্ছে না। ফলে ওজন বেড়ে যাচ্ছে।

৮. সারাক্ষণ বাইরের খাবার, চিপস, চকলেট, মিষ্টি, ফাস্ট ফুড, বিরিয়ানি এসব খেলে শরীরে মেদ জমবেই। ফলে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, হাড় নরম হয়ে যাওয়া, বদহজম, পাতলা পায়খানা, পরবর্তীতে এ্যাজমা, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক জাতীয় রোগের ঝুকি বেড়ে যাচ্ছে।

শিশুর স্থুলতা দূর করার উপায়

১. বংশগত হলেও খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রচুর পানি ও শাকসবজি বেশী করে খাওয়াতে হবে। বাইরের খাবার বন্ধ করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী সুষম খাদ্য দিতে হবে। জানতে হবে কখন থামতে হবে!

২.শারীরিক পরিশ্রম হয় বা ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বাড়াতে হবে। সারাক্ষণ বসে থাকবে না। হাঁটতে হবে বসার ফাঁকে ফাঁকে। এছাড়া সাঁতার, খেলাধূলা যেমন, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, সাইক্লিং এসব করতে হবে। বাগান করাতে প্রচুর ক্যালরি খরচ হয়।

৩. অযথা ঔষধ খাওয়াবেন না। ভেজাল খাবার থেকে সাবধান হবেন।

শেষের আগে

এত কথার পরও যারা বলবেন, ডাক্তাররা তো এমন বলেই, ভয় দেখানোর জন্য। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন,
বাচ্চাকে কেন মোটা বানাতে চান?

১.দেখতে ভালো লাগে তাই?
২আপনি কি নিজেকে মোটা বা আপনার জীবনসঙ্গীকে মোটা দেখতে চান?
৩.আপনি কি চান মোটা হওয়ার জন্য আপনার বাচ্চার চলাচলে, নড়াচড়ায় কষ্ট হোক, শ্বাসকষ্ট হোক?

৪.আপনার বাচ্চা স্কুলে বুলিংয়ের স্বীকার হোক?সবাই তাকে মোটু, পেটকু, বাচ্চা হাতি, খাসি বলে ব্যঙ্গ করুক?
৫.মোটা বানানোর জন্য যে খাবারগুলো খাওয়াচ্ছেন, তাতে পর্যাপ্ত ভেজাল থাকার জন্য বাচ্চা পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট, প্রেশার, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়ুক তাই কি চান?

৬.কখনও চিন্তা করেছেন, বাচ্চার স্বাস্থ্যের দিকে না তাকিয়ে যদি সুস্থতার দিকে নজর দিতেন, বুদ্ধি ও স্বভাব উন্নয়নের দিকে নজর দিতেন তাহলে সমাজে এত অপরাধ, এত দুর্নীতি, এত রোগবালাই বাড়তো না।

পরিশেষে

পরিশেষে বলবো,
‘ স্বাস্থ্য যদি সুস্থ রয়
শিশু একদিন বিশ্ব করবে জয়। ’

লেখক: আবাসিক মেডিকেল অফিসার, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *