তার সাধ্য ছিল সীমিত! তবে মনটা ছিল আকাশের মতোই বিশাল !
সেবাদানের মানসিকতা ছিল! পরের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
খুবই মানবিক ও জাগ্রত বিবেক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
ডাকতাম কখনো মামা, কখনো ‘দামান্দে’ বলে!
এখন আর তিনি নেই! তবে হৃদয়ে আছেন। স্মৃতিতে আছেন।
মনে পড়ছে কিভাবে গ্রামাঞ্চলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত মানুষের সেবা দিয়েছেন। রাতেও রোগীদের ফোন পেলে বাড়িতেও ছুটে গিয়েও চিকিৎসা দিয়েছেন। অনেক সাধারণ রোগীরা আধুনিক চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বা না নিয়েও তার শরণাপন্ন হয়ে সেবা নিয়েছে। মানুষের সেবা দিতে এমন ব্যাকুলতা বিরল । তিনি খুবই আশাবাদী মানুষ ছিলেন। বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ জনপদের মানুষের আস্থা-ভরসার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি কর্মপাগল ছিলেন, তবে কখনো ব্যস্ততা দেখাননি। পায়ে হেঁটে অনেক দূর থেকেও বহুরোগী আসতো। রোগীর অবস্থা বুঝে কোনো হাসপাতালে বা কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া উত্তম মনে করলে সেই পরামর্শ দিতেন বা রেফার করতেন। কবিরাজ হিসেবে নির্ধারিত কোনো ফি ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ি যে যা দিতো তাই রাখতেন। টাকা না থাকলে ফ্রি ঔষধপত্রও দিতেন। মানুষের পাশে থাকা এবং মানবিকতার বিচারই ছিল তার কাছে সর্বাগ্রে।
কখনো গভীর রাতে টর্চ লাইট ও লাঠি হাতে হাজির হয়ে গেছেন। দুর্যোগকালীন মুহুর্তে বাদলা দিনে ঝড়-বৃষ্টির সময়ও ছাতা মাথায় আধা ভেজা হয়েও মানুষের সেবায় ছুটে এসেছেন। অন্যের প্রয়োজনে নিজে কষ্ট স্বীকারের এমন দরদী মনই তাকে করেছে অনন্য। বলতেন- মৃত্যু তো একদিন হবেই ভয় পেয়ে লাভ কি? তিনি ছিলেন একজন মানুষ কিন্তু বহু কাজে পারদর্শী।
বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী খোঁজা থেকে শুরু করে ঘর তৈরীর মিস্ত্রী, জমি-জমার হিসাব-নিকাশ-নকশা-খতিয়ান-দলিল-পর্চা বুঝা, নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ মীমাংসা, গ্রামীণবিচার-সালিশে সরব উপস্থিতি ছিল। অর্থাৎ একের ভিতরে অনেক গুণ-দক্ষতার সমাহার।
তিনি অন্যের আবদারকে গুরুত্ব দিতেন, অন্যের মতামতের মূল্য দিতেন, হৃদয়গ্রাহী ভাষায় গল্প করতেন, মনোযোগ দিয়ে অপরের কথা শুনতেন, কেউ কোনো প্রয়োজনে আসলে ফিরিয়ে দিতেন না; নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। আমার দেখা- একজন ভালো মনের মানুষ, সাদা-মনের মানুষ। নিজের চাহিদা নিয়ে পেরেশান ছিলেন না। লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে জীবন চালাননি।
আধুনিক শিক্ষিতরা ‘গ্রাম ডাক্তার’ ‘গ্রাম্য ডাক্তার’ ‘হাতুড়ে ডাক্তার’ ‘হাফ-ডাক্তার’ ‘রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার’ কিংবা ‘গ্রামীণ চিকিৎসক’ ‘পল্লী চিকিৎসক’ যাই বলেন, গ্রামগঞ্জে অসুখ-বিসুখে এরাই ছিলেন একসময় ভরসা। বাগাড়ম্বর-সর্বস্ব আলোচনায় না গিয়ে বলা যায়- তাদের অনেকের ডিগ্রি ছিল না তবে আন্তরিকতা ছিল, অভিজ্ঞতা ছিল; স্বীকৃতি ছিল না, তবে মানুষের ভেতরে আশা জাগাতে পারতেন, চিকিৎসা করাতে গিয়ে গরিবকে সর্বস্বান্ত হতে হতো না। মানুষের বাড়তি আস্থা ছিল।
লোকচিকিৎসায় যে সনাতনী ওষুধ চর্চা করা হতো তাতে গাছ-গাছড়ার ব্যবহার ছিল, প্রাণীজ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দ্রব্য দিয়ে চিকিৎসা চলতো; ফলে এখনকার অ্যান্টিবায়টিকের অপব্যবহারের মতো মারাত্মক ক্ষতি হতো না! এটা ঠিক যারা অদক্ষ ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান নেই তারা অধিকাংশ সময়ে রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হয় কিংবা ভুল চিকিৎসা প্রদান করে। প্রায় সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দিতে গিয়ে, সব রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীকে বড় ধরনের বিপদে ফেলে এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হয়।
তবে এজন্য ঢালাওভাবে গ্রাম এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে এদের ভূমিকাকে খাঁটো করে দেখার সুযোগ নেই। গ্রামীণ সমাজে তাদের কদর ও সম্মান আছে। অল্প টাকায় সন্তুষ্ট হয়ে ভালো চিকিৎসা দেন। গ্রামীন মানুষকে মহৎ সেবা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসেন। মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব পালন করে মানুষের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয়ও হয়ে থাকেন। মানুষের কাছে থাকেন, বিপদের সময় পাশে দাঁড়ান। তাদের সঠিক ভূমিকার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। সহজ-সরল সেবাদানকারী মানুষগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করি।
সম্মান ও সালাম জানাই।
আল্লাহ রওশন মামাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন! আমীন!