তখন মনের রাজ্য ছিল খুব ছোট। এক গ্রামীণ জনপদ ছিল আমার জগৎ। প্রিয় দাদির পদযাত্রায় সঙ্গী হতে পারলে ধন্য হতাম। হানারচালা থেকে মূল্যপাড়া। মনে হতো কতদূর বহুদূর। আঁকাবাকা মেঠোপথ। দু’ধারে ফসলের ক্ষেত। জুম্মাপাড়া হয়েও বেশ দূরত্ব। বর্ষায় কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে সাবধানে পা ফেলতে সতর্ক করতেন দাদি। একসময় পৌঁছতাম গন্তব্যে। মৌলভী ভাইদের বাড়িতে! অর্থাৎ মাওলানা আবু রায়হান কাজী আবদুল মান্নান আনসারীর বাড়িতে।
অবাক বিস্ময়ে একজন কর্মব্যস্ত ও কর্মপাগল মানুষকে দেখতাম। কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। কত জায়গায় যে বাইসাইকেলে-মটরসাইকেলে ছুটে বেড়িয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। খুব আদর করতেন। স্নেহমাখা উপদেশ দিতেন। শিক্ষণীয় গল্প বলতেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। দোয়া করতেন যাতে মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। ভালোভাবে লেখাপড়া করতে বলতেন। আমাকে নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন।
একটু যখন বড় হয়েছি শুক্রবারে জুমআর নামাজ পড়তে দড়ানীপাড়া জামে মসজিদে যেতাম। ভাই মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। উপস্থাপনা ছিল প্রাণবন্ত। ওয়াজ-নসিহত বয়ান করতেন। শুনতাম, কিছু বুঝতাম, কিছু বোধগম্য হতো না। তবে কিছু মসজিদমুখী মানুষ দেখতাম। ইসলামি সংস্কৃতির সৌন্দর্য দেখতাম। আলোকিত সমাজ গঠনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা দেখতাম। আল্লাহর ঘর! কতই না সুন্দর! তুলনাহীন সৌন্দর্য! সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে মসজিদ! যেখানে কিয়ামত পর্যন্ত হবে আযান-ইকামত এবং চলবে নামায! মুসলমানদের সোনালী যুগে পুরো সমাজব্যবস্থা ছিলো মসজিদ কেন্দ্রিক। মুসলমানের তালীম, তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র ছিলো মসজিদ। দ্বীনী কাজ, সাধারণ কাজ সবকিছুর জন্য মসজিদে আসতে হতো।
তিনি শুধু মসজিদের ইমাম ও খতিবই ছিলেন না। ভাত গ্রাম হাইস্কুল, মিরিকপুর হাইস্কুল এবং পাথরঘাটা হাইস্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। খাল-নদী-মেঠোপথ দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পেরাতেন! ছিলেন বিয়ে নিবন্ধনকারী কাজী। যেন ক্লান্তিহীন এক দুরন্ত পথিকের অবিরাম ছুটে চলা। একদিকে ছিলেন মাদরাসা থেকে কামিল পাস, অন্যদিকে জেনারেল শিক্ষিতও। জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার গাজেশ্বরী গ্রামের দড়ানীপাড়ায়। কাঞ্চনপুর এলাহিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে দাখিল এবং মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে আলিম-ফাজিল-কামিল পাস করেছিলেন। এছাড়া জেনারেল শিক্ষায় ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট ও বি.এ পাসও করেছিলেন।
বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তিনি ওয়ায়েজিন হিসেবে থাকতেন। ইসলামের কথা বলতেন। কুরআন-হাদীসের কথা বলতেন। নবী-রাসূলদের কথা বলতেন। আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতেন। মৌলভী কাকার সাথে এমন মাহফিলে কত গিয়েছি। তিনি ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার উপকারী কর্মগুণেই তিনি বেঁচে থাকবেন। মানুষ মনে রাখবে।
আসলে বাংলাদেশের সমাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি টেকসই। এখানে তিনলাখেরও বেশি মসজিদ আছে। মসজিদের সাথে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খতিব যুক্ত। এতিমখানা-কাওমী-হাফেজী, আলিয়া, নূরানী-মক্তবসহ নানাধরনের মাদরাসা আছে ৫০ হাজার। আর এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন প্রায় ২০ লাখ সৎ, আস্থাবান ও বিশ্বস্ত মানুষ। ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড খুব বেশি বেশি দরকার।
দক্ষ ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে সুন্দর সমাজের একটি সম্পর্ক আছে। কবরস্থান মানে যে কেউ শুধু মরলে সেখানে কবর দেয়া হবে এর বাইরে পরিকল্পিতভাবে সেখানে লাগানো গাছ বিক্রি করে আয় করে সমাজের কল্যাণে ব্যয় করা যাবে না এমন নয়। মসজিদভিত্তিক পাঠাগার, মক্তব, কর্জে হাসানা ফান্ড, কমিউনিটি সেন্টার থাকবে; একেকটি মডেল সমাজ হবে । মানুষের মাঝে সৎ কাজ করার প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হবে।
একটি ব্যাপার দুঃখজনক যে, ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশেও ইমাম, খতিব ও মুয়াজ্জিনের সম্মানজনক সম্মানী দেয়া হয় না। অথচ একজন ইমাম মানে ঐ সমাজের নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, ধনী দরিদ্র, চাকরিজীবী ব্যবসায়ি, শ্রমিক মালিক তথা আবাল বৃদ্ধ বণিতার সর্বজন শ্রদ্ধেয় সম্মানিত ধর্মীয় নেতা। ইমাম মানে নেতা অর্থাৎ যিনি মসজিদের ইমাম তিনি সমাজেরও নেতা। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের দক্ষতার উন্নয়ন করা, উৎপাদনশীল কাজে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সময়ের অনিবার্য দাবি। দুনিয়াবি জ্ঞানের জন্য যদি স্কুল-কলেজে ফুলটাইম লোকের দরকার হয় তবে নৈতিক জ্ঞানের জন্য অবশ্যই ফুলটাইম ও যোগ্য লোক দরকার। তাই খরচ করতে হবে।
মসজিদকে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবাধ জাগরণের কেন্দ্র বানানো যেতে পারে। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণের মাধ্যমে সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্বারী, হাফেজ, ওয়ায়েজিন, খতিব, মুন্সি-মৌলভী-মাওলানা, মুহাদ্দিস-ফকীহ-হুজুরগণ সবাই মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ ঐ ধর্মের মানুষের ভালোবাসার প্রতীক। তারা যদি পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, জীবে দয়া করেন, বৃক্ষরোপন করেন, মুসুল্লীদের সহযোগীতা নিয়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান তবে তার প্রভাব অন্যদের উপরও পরবে। ইমাম ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকে সামাজিক নেতৃত্ব হয়ে ওঠতে পারেন যদি তিনি মসজিদে চুপচাপ বসে না থেকে মুসল্লিদের খোঁজ খবর নেন, দু:খীর পাশে দাঁড়ান, নিজে উদ্যোগী হয়ে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান করেন। এটা ঠিক যদি ধর্মীয় নেতৃত্বকে সবসময় পেটের চিন্তাই করতে হয়, সম্মানজনক জীবন জীবিকার নিশ্চয়তা না পান- তাহলে তারা সামাজিক কাজ করবেন কিভাবে!
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ধর্মচর্চা ও ইবাদত বন্দেগীর কাজেই ব্যবহারিত হবে না এগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারিত হতে পারে। বিশ্বাস অন্তরে, অন্তরটা দেহে আর দেহটা জগতে। তাই জগত ভালো না হলে ভালো দেহ কিংবা ভালো মন পাওয়া যাবে না। সাধারণত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানাদিতে নারীর অংশগ্রহণ কখনো সীমিত, কখনো নিয়ন্ত্রিত, কখনো নিষিদ্ধ। নারী ধর্মীয় আলোচনা শুনার সুযোগের সীমাবদ্ধতায় বহুবিধ অজ্ঞতা নিয়ে জীবন কাটায়। যখন নারী সফরে থাকেন কিংবা কোনো কাজে বাসার বাইরে বের হন তখন নামাজ পড়ার সুন্দর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকে বলেন নারী শুধু ঘরেই থাকবে বাইরে কোনো কর্মক্ষেত্রে যাবে না, বাজারে যাবে না, মসজিদেও যাবে না তাহলে তার উত্তম সামাজিকীকরণ কী করে হবে?
পুরুষ নামাজে শুদ্ধ তেলাওয়াত শুনে শুনে তেলাওয়াত শুদ্ধ করে নিবে, খুতবা শুনে ধর্মীয় জ্ঞান বাড়াবে, মসজিদে যেয়ে যথাসময়ে নামাজ পড়ে নেবে কিন্তু নারী এসব কিছুই কেন করতে পারবে না? সে মাসলা মাসায়েলের বয়ান শুনবে না, বাসার বাইরে থাকলে সময়মত স্রষ্টার বন্দেগী করার সুযোগ পাবে না। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন যেহেতু নারীকে বাইরে বের হতেই হচ্ছে সেহেতু মসজিদে নারীর আলাদা নামাজ পড়ার ব্যবস্থা, অজু করার ব্যবস্থা থাকবে না কেন? সমাজ যদি নারীকে সিনেমা দেখতে সিনেমা হলে যাওয়া থেকে শুরু করে পার্কে, মার্কেটে যেতে সুযোগ দেয় তবে কেন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মসজিদে নামাজ পড়তে পারবে না।
ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা যদি অযত্নে অবহেলায় থাকে তবে ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাবে যা বাস্তবেই দেখা যাচ্ছে। মিডিয়ায় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের খাটো করে দেখালে এবং সমাজেও তারা অবহেলিত হলে সাধারণ মানুষ ধর্ম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের যথাযথ মর্যাদা দেবে না। এই অবহেলিতদের বিশেষ সেবা প্রদান করে তাদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমাজের মানুষদের সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে। এতে পরিবার, সমাজ, দেশ তথা মানবজাতি উপকৃত হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। ধর্মীয় ব্যক্তিদের সহায়ক কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার। মসজিদ ভিত্তিক পাঠাগার তৈরি হতে পারে, শিক্ষার প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। বৃক্ষরোপনকে সামাজিক আন্দোলনে রুপদান করা যেতে পারে। যৌতুক, ইভটিজিং, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। সমাজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ ও উদ্বুদ্ধকরণ হতে পারে। রক্তদান কর্মসূচি পরিচালিত হতে পারে। সামাজিক, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চায় জনগণকে অভ্যস্ত করা যেতে পারে। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উপকার করা যেতে পারে। সমাজের মানুষদের সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়লে পরিবার, সমাজ, দেশ তথা মানবজাতি উপকৃত হবে। কয়েকটি নির্দিষ্ট কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ধর্মের সামগ্রিক চেতনা, মানুষের কল্যাণ- সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার।
সে যাই হোক। আজ আর নয়।
আল্লাহ মৌলভী ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমীন।