মেয়ের কাছে বাবার চিঠি

প্রিয় নাদিয়া,

‘কুতাতাতাহ…’!

তোমাকে যখন এই চিঠিটা লিখতে বসেছি, এমন শব্দ করে লিভিং রুমে ছুটে আসছ তুমি। বয়স ১৪ মাস হলো তোমার। ‘বাই’ শব্দটা বেশ ভালোভাবেই বলতে শিখেছ, ঠিক যেন দেবদূতের মতো গলায়। দুটি স্মার্টফোন ইতিমধ্যেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছ: তোমার মায়ের স্যামসাং গ্যালাক্সিকে মাটিতে আছড়িয়ে, আর আমার আইফোনে ইচ্ছেমতো লালা মেখে। এখন আমাদের এমন সব জিনিস নিয়ে ভাবতে হচ্ছে যেন তোমার নাগালে না পড়ে; অথচ আগে ভাবিনি- এগুলোর প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ থাকবে।

খুব দ্রুতই ছুটে বেড়াও তুমি। লাফিয়ে ওঠো আসবাবপত্রের উপর; উঠে তারপর ফেলতে থাকো এটা-সেটা। টিভির রিমোট তোমার কাছেই থাকে! আর জাদুকরের মতো মুহূর্তেই সব কিছু উধাও করে দাও! ফ্রিজের হাতলে আমি হাত রাখলেই, লাফিয়ে এসে এটা-সেটা বের করে ফেলো; আর শুরু করে দাও নিজের প্রিয় চর্চা! একটা একটা জিনিসপত্র বের করে পেছনের দিকে ছুড়ে ফেলতে থাকো।

যখন কোনো রুমে ঢুকে কী-বোর্ড চোখে পড়ে, ইচ্ছেমতো চেপে হিজিবিজি কী সব লিখতে থাকো তুমি। সব কিছুতেই নাক গলাতে হবে তোমাকে, তাই না? যখন কোনো রুমে ঢুকে দেখতে পাও বসে আছে লোকজন, তারা সবাই একই কথা বলে: চঞ্চল তুমি খুব, তুমি খুব হাসিখুশি মেয়ে, তোমার মধ্যে ‘ভাব’ আছে বেশ, কাউকেই ভয় পাও না, আর তুমি ভীষণ সামাজিক। বয়স এখন এক বছরের চেয়ে সামান্য বেশি হলো তোমার। অথচ এরই মধ্যে সবার নজর কেড়ে ফেলেছ তুমি। পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার হাসির অধিকারী যে তুমি! তোমার মুচকি হাসির সঙ্গে তুলনা চলে না কিছুর।

তোমাকে নিয়ে মাঝে মধ্যে ভয় হয় আমার। জানি না ঠিক কী রকম পৃথিবী অপেক্ষা করছে তোমার জন্য! আমার ধারণা, যেকোনো বাবার ক্ষেত্রেই প্রাথমিক স্বভাবটি হলো, নিজের কন্যার নিরাপত্তার প্রশ্নে অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে থাকা। এই আধুনিক পৃথিবীতে তুমি যখন তরুণী হয়ে উঠবে, তখন তোমাকে নিয়ে কি আমার উদ্বিগ্ন থাকা উচিত? বড় হয়ে কোন ধরনের জীবনসঙ্গী নেবে বেছে- সে চিন্তায় কি উচিত মানসিক চাপে থাকা? তোমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও পেশাদার জীবন নিয়ে ভেবে ভেবে কি উচিত আমার নির্ঘুম রাত কাটানো?

তুমি তো এখনও ডে-কেয়ারে ভর্তি করানোর মতোই বড় হওনি; অথচ এখনই, আগ-বাড়িয়ে এতসব চিন্তা করাটা খানিকটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছে আমার। কিন্তু যখনই ভাবি, তখনই কেমন যেন উদাসীন হয়ে যাই; আর নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকি, নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালো থাকবে। নিজের যে কোনো সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার সমাধান বের করে, তারপর সেটিকে পিছু ফেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেও তুমি।

যে কোনো বাধা-বিপত্তি তুমি এমনভাবে পেরিয়ে যেও- যেন সেগুলো কোনো ব্যাপারই নয়। নিজের ভয়-ডরকে চূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দিও তুমি। যে সব মানুষ ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তোমার, তাদেরকে এমনভাবে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিও- যেন কোনোদিন তোমার নাগাল না পায়। যতই কঠিন সময় এসে দাঁড়াক তোমার সামনে, সেগুলোতে মুহূর্তের ভেল্কিতে উধাও করে দিও। আর সবই করে যেও তুমি এই মহোত্তম সুন্দর হাসিমুখে, সশব্দে ফেটে পড়া হাসিতে, অনন্ত শক্তিমত্তা ও উদ্যম নিয়ে।

স্বীকার করছি, খুব একটা আবেগতাড়িত মানুষ আমি নই; তবু তোমার জন্য, আমার মনের ভেতর একটা বিশেষ জায়গা খোদাই হয়ে আছে। আর সেটির পরিধি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। আমি এখন বুঝতে পারি, আমার সকল উদ্বেগের মূলে রয়েছে আমার নিজের অক্ষমতা; তোমার নয়। আমার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি শক্তিমত্তা ও আত্মবিশ্বাসের অধিকারী তুমি। ঠিক বলেছি না? ‘কুতাতাতাহ…’ -বলে জবাব দিলে তুমি! তার মানে, তুমি সত্যিই একমত।

ফুটনোট : তোমার আম্মু খানিকটা ঈর্ষান্বিত; কেননা, তোমার উচ্চারিত দ্বিতীয় শব্দটি হলো- ‘বাবা’; ‘মা’ নয়। এ কথা তুমি তাকে বলে দিও না যেন!

সন্তানকে অসাধারণ চিঠিটি লিখেছেন মিসরের জনপ্রিয় স্যাটেয়ারিস্ট ও কলামিস্ট  বাসেম ইউসেফ। টাইম ম্যাগাজিনে চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে ২০১৩ সালের পৃথিবীর সবচেযে প্রভাবশালী শত ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম বাসেম ইউসেফ।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *