প্রতিযোগী প্রতিযোগিতা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা

বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়। ছোটবেলায় রচনা প্রতিযোগিতায় সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট, বই বা টাকা পুরস্কার গ্রহণের মাধ্যমে লেখালেখির ব্যাপারে যে আগ্রহ-ঝোঁক তৈরি হয় সেই সুন্দর কিছু স্মৃতি ভবিষ্যতেও জ্ঞানার্জন-জ্ঞানাহরণে উদ্বুদ্ধ করে। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে নবীন প্রজন্মের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি করার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা সঠিক পদ্ধতি-পন্থায় হতে হবে!

কখনো প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়া যদি কাউকে অহংকারী করে, আমিত্ববোধকে তীব্র করে; তাহলে তা অনেকসময় ক্ষতিকর বলেও বিবেচিত হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা যাতে দলাদলি-শত্রুতার মনোভাব তৈরির চেয়ে অসাধারণ ধৈর্য, ক্রমাগত উৎকর্ষতা সাধনের প্রাণান্তকর প্রয়াস ও আত্মবিশ্বাস তৈরিতে কাজে লাগে; মন-মানসিকতাকে সেদিকে নিয়ে যেতে অভিভাবকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিযোগিতার ভালো দিক হচ্ছে- সেরা নির্ধারণের মাধ্যমে সেরা হওয়ার যোগ্য হতে অনুপ্রাণিত করা যায়। আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে- প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব তীব্র হওয়া, সহযোগিতার মনোভাব কমে যাওয়া ও একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি। সহযোগিতা প্রদর্শন, সহমর্মিতার চর্চা ও ঐক্যবদ্ধভাবে পথ চলার শিক্ষাটাও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণদেরকে দিতে হবে।

প্রতিযোগিতার উদ্ভবও হবে, বিকাশও হবেই। তবে যেকোনো উপায়ে, যেনতেনভাবে অন্যকে হারিয়ে দেয়া বা ছাড়িয়ে যাওয়ার উদগ্র মানসিকতা তৈরি যাতে না হয়! শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ অপরিহার্য ও প্রধান নিয়ামক হলেও যোগ্য হয়ে সঠিক পথেই যাতে অধিকতর ভালো করার সাধনাটা চলে; বক্রপথে বা অসৎ পথে এগিয়ে যাওয়া আসলে পিছিয়ে যাওয়ারই নামান্তর!

প্রতিযোগিতা ভালো, তবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা খারাপ। প্রতিযোগী মাত্রই প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, আর প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্রই শত্রু নয়! প্রতিযোগিতা থাকলে ভেতর থেকে অধিকতর ভালো করার তাগাদা অনুভব করা যায়! এই তাগাদা হতে হবে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য, নিজেকে যোগ্য-দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য। প্রতিযোগিতায় কেউ টিকে থাকে, কেউ টিকে থাকতে পারে না।

প্রতিযোগিতা হতে হবে আনন্দের সাথে। উচ্চমাত্রায় চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভয়-ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে নয়। শিক্ষকদেরও খেয়াল রাখতে হবে- অকৃতকার্যতা বা বিজয়ী হতে না পারা যাতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। যোগ্যতা নির্ধারণের প্রতিযোগিতা যাতে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে এবং পরাজয়ের দিকে নিয়ে না যায়- সেদিকেও আয়োজকদের সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে!

প্রতিযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো ধরনের চাপ উপলদ্ধি না করে, অন্যান্যদের তুলনায় সেরা হওয়াকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য মনে না করে বা সমাজের জন্য অকল্যাণ বয়ে নিয়ে না আসে। জীবনে জীবন-জগতের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু শেখাটার চেয়ে প্রতিযোগিতাই যাতে মুখ্য বিষয়ে পরিণত না হয়। পরাজিত হওয়ার গ্লানি যাতে এমনভাবে ক্ষতিকর না হয়; যাতে প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়!

ছোটবেলায়ও রচনা প্রতিযোগিতায় লম্বা লম্বা রচনা লিখেছি, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করেছি, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বক্তৃতা করেছি। এসব প্রতিযোগিতা আমার কাছে আনন্দময়ই মনে হতো, অর্থহীন মনে হতো না। প্রতিযোগিতা কখনো অপরকে সহযোগিতার প্রবণতাকে দমিয়ে দেয়নি! শিক্ষক বা অভিভাবকরাও প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিয়ে স্বার্থপর হতে শেখাননি।

আমার ছোটবেলায় প্রতিযোগিতায় সফল হতে না পারলেও প্রতিযোগীকে অপমান করতে, লজ্জা দিতে, অন্যদের সাথে তুলনা করে তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে দেখিনি! পুরস্কার না পেলেও নিন্দা-তিরস্কার করতেন না। বলা হতো- অংশগ্রহণ করাটাই বড় কথা! বলতে বলতেই একদিন ভালো বক্তা হবে, লেখতে লেখতেই একদিন ভালো লেখক হবে! মা-বাবা-চাচা কখনো লজ্জার দুঃখের অপমানের জায়গায় ঠেলে নিয়ে যাননি, জীবনটাকে বিষময় করে তুলেননি।

আত্মোন্নতি ও জীবনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনা চালিত করে প্রতিযোগিতার পথে। প্রতিযোগিতার চালিকাশক্তি বাসনা আর সংগ্রামের চালিকাশক্তি হলো অস্তিত্ব রক্ষা। প্রতিযোগিতা যদি লোভের উদ্রেক ঘটায় তবে তা পাপের পথে চালিত করে; তাই প্রতিযোগিতার চেয়ে কর্মের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার। অন্যকে পেছনে ফেলেই জীবনে এগিয়ে যাবার ধারণা সঠিক নয়!

প্রতিযোগিতা জীবনকে উপলব্ধির সুযোগ করে দেয়, সভ্যতার অভাবনীয় উন্নতি অব্যাহত রাখে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার বাসনা কখনোই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। পারস্পারিক সহাবস্থানের মানবিক নীতিকে অস্বীকার করে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা সূত্রপাত ঘটালে তা কখনোই কল্যাণকর হতে পারে না। আত্মকেন্দ্রিকতা বোধের জন্ম হলে চরিত্রে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে না। প্রতিযোগিতামূলক জীবনচর্চা নিজের প্রতিপক্ষ বাড়ায়, বন্ধু বানায় না। তাই শুধু প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার মনোভাব বেশি কাম্য।

আসলে বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভা অনেক ধরনের। শুধু লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তাটুকু যাচাই করেই বিচার করে ফেলা ঠিক না। অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতার চেয়ে নিজের সাথে প্রতিযোগিতা করাটা বেশি দরকার। এতে প্রতিযোগী সামনেই এগিয়ে যায়, কাউকে হারায় না বা নিজেও হারে না, কেউ মন খারাপ করে না বা নিজেরও মন খারাপ হয় না; পুরস্কার পেলেও বিজয়ী হয় আর না পেলেও বিজয়ী হয়।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক। অসুস্থ প্রতিযোগিতা একটি সামাজিক রোগ। জিপিএ ৫ এর উন্মাদনা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যায় মানসিক প্রশান্তি। যেকোনো উপায়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপথগামী করেছে।

শিক্ষার্থী ভর্তিতেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে! এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে অভিভাবকদের ও শিক্ষকদের মধ্যেও! সুনাগরিক সৃষ্টি করতে হলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ করা প্রয়োজন। শিশুকে উন্নততর শিক্ষাদানের বদলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দেয়া কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। মা-বাবা ও অভিভাবকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে হবে। বর্তমানে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের তারকা হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ধ্বংসাত্মক। ভাইরালের অসুস্থ প্রতিযোগিতা! যেন তেন উপায়ে জনপ্রিয় হতে চাওয়া মেধার সংকট দেখা যাচ্ছে।

রাজনীতিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রাজনীতিকেই কলুষিত করছে। ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার জন্য রাজনীতিবীদদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ। নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। স্বার্থবাদী রাজনীতিতে নেতৃত্ব পেতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছেই। ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গণে চলছে হল দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

বিভিন্ন খাতেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে। ব্যাংক খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। ব্যাংকের শেয়ার গুলো ইনডেক্সকে প্রভাবিত করায় ইনডেক্স নিয়ে বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিও বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী!

মহাসড়ক ও সড়কে বাস চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঘটছে প্রাণহানি, বাধছে যানজট। ওভারটেকিং নামক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কত স্বপ্ন যে সড়কেই বিবর্ণ হচ্ছে! খেলার মাঠেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিত্যাগ করা উচিত!

অসুস্থ মূল্য প্রতিযোগিতাও বড় ধরনের সমস্যা। অবৈধভাবে বিত্তশালী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। বিত্তের পেছনে ছুটতে গিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এতে সমাজ কলুষিত হয়ে পড়ছে।উদগ্র লোভ আর চূড়ান্ত নীতিহীনতা বেড়ে যাচ্ছে! দেশি-বিদেশি কোম্পানির মধ্যেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে!

কোথায় নেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা? ধান মজুতের অসুস্থ প্রতিযোগিতা! টেলিকম বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! এলপিজির বাজার ধরতে বড় অপারেটরদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা! জমি ক্রয়-বিক্রয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! বিনোদনের নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেটে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে!

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! চাকরির বাজারে দক্ষতার চেয়ে সার্টিফিকেটকেই প্রাধান্য দেওয়ার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে! ব্যবসায়ীদের মজুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বাড়ছে দাম! সংবাদকর্মীদের মননে-মগজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! রাজনৈতিক দলে দলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা! ক্ষমতাকেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা!

রমজানে ইফতারির ক্ষেত্রেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়! শিশুর লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মাদের মধ্যেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়! নিজের সম্পদ ও ক্ষমতা দেখানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়! কে কার আগে যেতে পারবে- সবকিছুতেই এই ধরনের অদ্ভূত অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামছে অনেকে!

শিল্পে ও চলচ্চিত্রেও যৌনতার প্রতিযোগিতা চলছে! আসলে আত্মসংযম না থাকলে সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা দিবেই! তাই আত্মসংযম বাড়াতে হবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেশকে শেষ করে দেয়, জাতিকে পঙ্গু বানিয়ে ছাড়ে! স্থানীয় সংস্কৃতির নামে যেসব অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে তা সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে! অসুস্থ প্রতিযোগিতা কখনোই কারো জন্যই দীর্ঘমেয়াদে শুভ নয়, কল্যাণকর নয়।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *