আনিসুর রহমান এরশাদ
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও দাসত্বের মানসিকতা বদলায়নি। মোসাহেবি-চাটুকারিতা দাসত্বের আধুনিক-নবসংস্করণ। কেউ প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার আশায়, কেউ অধিকার পাবার লোভে, কেউ লাভের মোহে ক্ষমতাবানদের প্রশংসা করে যাচ্ছে। চাটুকারিতা অসুস্থ সংস্কৃতি! দাসের মানসিকতা থাকলে চাটুকার হওয়া যায়, তেল দেয়া যায়, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেয়া যায়।
দাসত্বের সংস্কৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা অসহায়, মূল্যবোধসম্পন্নরা অধিকারবঞ্চিত, যোগ্যরা পরাজিত ও অযোগ্যরা বিজয়ী। দাসত্বের সংস্কৃতিতে দেশের সর্বনাশ হয়, সমাজের বারোটা বাজে, প্রকৃত কর্মীদের মূল্যায়ন নেই, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষদের ঠাঁই নেই। দাসত্বের সংস্কৃতিতে চাপাবাজদের জয়জয়কার, আত্মমর্যাদাহীনদের উল্লাস, করুণাশ্রিত জীবনে সুখীদের আনন্দ। স্বাধীন দৃঢ়চেতা মর্যাদায় দাঁড়ানোর চেয়ে গোলামিতেই দারুণ তৃপ্তি!
মোসাহেবি চরিত্র সমঅধিকার চায় না, আদর্শে অটল থাকতে চায় না, শপথ রাখতে চায় না। এদের ভাবনা মুষ্টিমেয়র অধিকার নিয়ে, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে, ধর্মের ব্যবহার নিয়ে, রাজনীতির সুবিধা নিয়ে ও অর্থবিত্ত লাভের স্বার্থ নিয়ে। এদের মাথাব্যথা নেই- বৈষম্য কমানো নিয়ে, অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে, প্রাপ্য পাওনা দেয়া নিয়ে, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে, নি:স্বার্থ সেবা নিয়ে।
দাসত্বের সংস্কৃতি চর্চাকারীরা কখনো অন্যের মর্যাদার ব্যাপারে যত্নশীল নন, তবে ক্ষমতাধরদের নৈকট্য লাভে খুব যত্নশীল। নিজে পেলেই তারা তৃপ্ত, অন্যে বঞ্চিত হলো নাকি অধিকার হারালো তা নিয়ে চিন্তিত নন। দুর্বলের সমালোচনায় এরা মুখর, সবলের প্রশংসায় গদগদ, নিজের সমালোচনায় বড্ড বেজার। পুরো জাতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও তাদের আপত্তি থাকে না, শুধু নিজ ব্যক্তি-পরিবার-দল বাঁচলেই হলো।
অনেক মিথ্যাবাদী ভুল করেও তা সঠিক প্রমাণ করতে পারে। ভাবটা এমন তাদের কথাই শেষ কথা, কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর সাথে তাদের দহরম-মহরম। দাসত্বের মানসিকতা সম্পন্নরা ব্যর্থতা স্বীকার করে না, যে কোনো যুক্তিতে নিজের দম্ভকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এরা অন্যকে নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে পারে, তবে নিজের অর্থবিত্ত-ক্ষমতা-মালিকানা-সিন্ডিকেটের ব্যাপারে উদার হয়।
দাসত্বের সংস্কৃতিতে যে যাকে প্রভু-নেতা-বস মানছে, তার চাওয়া-পাওয়া-ভালোলাগা-পছন্দ-সিদ্ধান্তই সব। আমজনতা বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে কি-না, অযোগ্যতার কারণে বৃহত্তর ক্ষতি হচ্ছে কি-না এসব ভাবনার বালাই নেই। এসব দালাল-ডানহাত-একনিষ্ঠ সমর্থকরাই জনগণের মাঝখানে দূরত্বের দেয়াল তৈরি করে, নতজানু চিন্তা-চেতনা-কর্মের দ্বারা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করে। অন্ধভক্ত-দলকানা-দলদাসরা প্রতিষ্ঠানকে ভঙ্গুর করলেও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু।
অসুস্থ থাবার কবলে প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা হয় অসহায়, প্রকৃত কর্মীরা থাকে ঝুঁকিতে; অথচ দুর্বৃত্তদের সহায়তায় লুটপাটকারীরা থাকে নিরাপদে, ঋণখেলাপীরা থাকে আনন্দে-আরামে, পাচারকারীরা থাকে নির্ভয়ে। অর্থের দাসদের কাছে টাকা বিদেশে পাচার করা শক্তির বহিঃপ্রকাশ, মানি লন্ডারিং নিরাপত্তার গ্যারান্টি আর ব্যাংকের টাকা লুট করা ক্ষমতা চর্চা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের পথে বসানো বুদ্ধির খেলা।
চাটুকাররা জানেন অপরাধ করলেও তাদের বিচার হবে না, বিচার হলেও শাস্তি হবে না, হরিলুট করলেও পাকড়াও হবে না, দুর্নীতি করলেও তিরস্কৃত হবে না। ক্ষমতাশালী নেতা-নেত্রীর পৃষ্ঠপোষকতা ও ভয়াবহ সিন্ডিকেটের সাথে গভীর সম্পর্ক থাকায় শত সতর্ক ও হুমকিতেও তারা বেপরোয়া। সুসম্পর্ক-যোগাযোগের শক্তিতেই এদের দাপট, এরাই দায়িত্ব পায়, সুযোগ পায়। পাওয়া সুযোগ হারানোর ভয়ে ভীতরা যা পারে তা কামায়ে নেয়। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সুশাসন নিশ্চিত করে না, সংবিধানেও মনোযোগ দেয় না।
এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম নেই, নারীর সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নেই, কর্মচারী হয়েও মালিকের আচরণ করতে লজ্জা নেই। গণমানুষের আবেগ-অনুভূতি আমলই দেন না, জবাবদিহি করেন না, পুরো দাপুটের সাথে জীবনযাপন করেন। নিজেদের ক্ষমতা ও ভাগ্যবদলে তৎপরতা ছাড়া তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। দাসত্বের মানসিকতায় ব্যক্তিগত লাভ-লোভে এক করুণ পরিস্থিতি! যারা আদর্শ নিয়ে লড়ছেন, তারাও সুবিধাবাদীদের নানা বন্দনা করছেন। সততা চর্চাকারীরাই খলনায়ক, দায়িত্বশীলরাই অসমাদৃত, প্রকৃত কর্মীরাই উপেক্ষিত!
দাসত্বের সংস্কৃতিতে মানবকল্যাণ, আদর্শ, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা শুধু মুখে আছে কাজে নেই। ক্ষমতার নাগাল পেলেই যাদের গাড়িবাড়ি টাকা হয়ে যায়, তারা বিত্তশালী হলেও চিত্তশালী হন না। দাসত্বের মানসিকতায় বেড়ে ওঠাদের লোভের আগুনে সমাজ পুড়ে। এদের শক্তির উৎস ক্ষমতাবানদের পায়ে পড়ে-ধরে সালাম করায়। যেখানে স্বার্থ-লাভ-লোভ সেখানেই তারা, ক্ষমতা হারালেই পথ ভুলে যায়।
আধুনিক দাসত্বে নেই ক্রীতদাস, নেই মানুষ বেঁচা-কেনা। তবে আছে নিজেদের আত্মসম্মান এবং মর্যাদা রক্ষা না করার মানসিকতা। দাসত্বের মানসিকতা ছাড়তে না পারায় দৃশ্যত স্বাধীন হলেও কার্যত এরা দাসের যিন্দেগী যাপন করেন। দাসত্বের বেড়াজাল ছিন্ন করে মুক্ত জীবনের স্বাদ নিতে তারা বেরিয়ে আসতে পারেন না।
আগে দাসের মালিকরা ভিকটিমের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করতো। এখনকার অনেক মালিকও শ্রমিকদের মানুষই মনে করেন না! কর্মচারীদের সাথে মিথ্যাচার করেন, নির্দয়-নির্মম ব্যবহার করেন, মায়া-মমতাহীন সিদ্ধান্ত নেন এবং বিশ্বাসের মূল্য দেন না। এরা আক্রমণ করতে পছন্দ করেন, আক্রান্ত হতে পারেন তা মানতে চান না। নিজেরা সম্মান পেতে চান, কিন্তু অন্যের সম্মান নষ্ট করতে দ্বিধা করেন না।
এরা স্বার্থের জন্য ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দেন। একজন আরেকজনকে আক্রমণ করেন। আল্লাহই যে বিচারের মালিক তা বেমালুম ভুলে যান। এরা ভ্রমণ-বিনোদন-বিলাসিতায় যে উদারভাবে ব্যয় করেন, গরিবের ন্যায্য পাওনা মেটাতে ততই গড়িমসি করেন। এরা ধর্মের নামে বাণিজ্য করেন, সেবার নামে বাণিজ্য করেন, দম্ভ ভরে সমাজে চলেন।
মূল্যবোধহীন ও আদর্শহীনদের উল্লাসমঞ্চ অন্যের আত্মত্যাগ চায় আর নিজে আত্মত্যাগ করাকে বোকামি মনে করে। ক্ষমতা যদি শপথ রক্ষা না করে পথে হাঁটে, রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, বিচারকই যদি দুর্নীতিবাজ হয়, স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীরাই যদি দাসত্বের মানসিকতার হয়, সেবকরা যদি অসৎ হয়, অপরাধী যদি আইনের চেয়ে বড় হয়ে যান; তাহলে জনগণের দুর্দশার শেষ থাকে না।
একমাত্র আল্লাহর দাস হওয়া সম্মানের, দাসত্বের মহিমা এখানেই। তাছাড়া সব দাসত্ব দাসত্বই। মানুষ হয়ে মানুষের দাসত্ব অসম্মানের। সেই দাসত্ব হোক যৌন দাসত্ব, শিশু দাসত্ব, শ্রম দাসত্ব, মজুরি দাসত্ব, পুঁজির দাসত্ব, মানসিক দাসত্ব। জোরপূর্বক শ্রম, বাধ্যতামূলক শ্রম, শোষণমূলক শ্রম, অত্যাচার, বিনামজুরিতে কাজ করানো, স্বল্পমজুরিতে কাজ করানো, ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করা, আগাম শ্রম কিনে অপছন্দনীয় কাজে শিশুদের নিয়োগ, জোরপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তি, ছেলে-মেয়ে উভয়েরই অঙ্গ পাচার, যৌন শোষণ ইত্যাদি দাসত্বেরই নামান্তর।
আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত দাসত্ব প্রথা থেকে রক্ষা পায় না শিশুরাও। বিভিন্ন বাড়িতে মেয়ে শিশুকে দিয়ে সারা দিনব্যাপী ঘরের সব কাজ করা হয়। গৃহস্থালি দাসত্বের শিকার শিশু স্কুলে যাওয়ার অনুমতি পায় না। কাজের মেয়ে বলে পরিবারের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে পারে না এবং একসঙ্গে বসে টিভিও দেখতে পারে না। হোটেলে কাজ করে এমন কম বয়সী শ্রমজীবী শিশুদের গায়ে হাত তোলা হয়। ঘরের মেয়ে বা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে এমন মেয়েরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে এ জাতীয় কাজে নিযুক্ত হন।
অনেকেই অল্পবয়সী কর্মীদের হাতে বেতন বা মজুরি দেন না। তাদের মজুরি সরাসরি এজেন্ট বা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে দেয়া হয়। ফলে প্রতিদিন কাজের সময় তাদের ছিন্নভিন্ন, নোংরা পোশাক পরতে দেখা যায়। একজন অল্প বয়সী মেয়ের অক্লান্তভাবে রান্না করা, সবকিছু পরিষ্কার করা, জামা কাপড় ধুয়ে দেয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। অথচ তাদের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। তাদের নেই কোনো কণ্ঠস্বর। তারা ভয়াবহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, ধর্ষণ করা হয়, অনাহারে রাখা হয়, মারধর করা হয়। অথচ ঘরোয়া দাসত্বের শিকার মেয়েগুলো ন্যায্য পারিশ্রমিক পায় না, যা মজুরি দেয়া হয় তাও অন্যদের হাতে দেয়া হয়।
আধুনিক সময়ের দাসত্ব আছে বিশ্বব্যাপী। দাসত্বের শিকার মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। কিছু মানুষ দাসত্বের ফাঁদে পড়ে। কিছু মানুষ নিরুপায় হয়ে দাসত্ব করে জীবনযাপন করে। আধুনিক সময়ের দাসত্বের সমস্যাগুলো ভয়াবহ। যেখানে নির্যাতন চলে সেখানে আর মুক্ত-স্বাধীন জীবনের স্বাদ কোথায়! পারিবারিক দাসত্ব তখনই শেষ হবে যখন হৃদয়ের অস্থিমজ্জাগত দাসত্বের ভাব দূর হবে।
কত রকম দাসত্বই না লুকিয়ে রয়েছে সমাজে। কারখানা থেকে শুরু করে, ঘরের দরজার আড়ালেও দাসত্ব বিদ্যমান। দাসত্ব না থাকলে কী আর ডাস্টবিনে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকে গৃহপরিচারিকা আদুরী। এমন বর্বরতা! একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে এতটা নিচু মনে করে, দুর্বল মনে করে! তাদের কিছুতেই কারো কিছু এসে যায় না, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। এমন নির্মম রূপ প্রাচীনকালের নিকৃষ্টতম দাসত্বের মতোই। যেন মালিকের কিনে ফেলা বস্তু! এদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন জাগে না।
যারা ঠিকমতো খাবার পায় না, পানি পায় না! চরম দুর্দশা ও অবহেলার পরও মানুষের জীবন হয় কী! যারা অসুস্থ্ হলে চিকিৎসা করাতে পারে না, ময়লায় জায়গায় বসবাস ও নোংরা কাপড় পরিধানের কারণে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে তারা দাস নয়তো কী! কিছু মানুষের পশুর মতো মানসিকতার কারণে এমন পরিস্থিতি অত্যন্ত লজ্জাজনক।
দিনমজুর বা রিকসাচালক বলে তাদের জীবনের কী কোনো মূল্য নেই! হোক কৃষক, হোক শ্রমিক- তারাও পৃথিবী দেখে, বুঝতে চেষ্টা করে, ব্যথা পায়, বিশ্বাস করে এবং নিজের জীবনটাকে ভালোবাসে। তাদের মনেও অনেক ইচ্ছা জাগে। অন্যের সম্পত্তি হয়ে বেঁচে থাকা, ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ছাড়া বেঁচে থাকা, প্রতিনিয়ত নিষ্ঠুরতা সহ্য করে বেঁচে থাকার জীবন মানুষের জীবন হতে পারে না!
আশ্রয়হীন মানুষের প্রতি কম মানুষই আগ্রহ দেখান। ভিক্ষুককে অবজ্ঞা-অবহেলায় বাঁচতে হয়। মানুষের যে উচ্চ মর্যাদা তা তাদের নেই। অসহায়ত্ব পুঁজি করে মুনাফা লুটা, মানুষকে ব্যবসা বা উপার্জনের শুধুই একটি মাধ্যম বানানো নৈতিকতা-মানবিকতা পরিপন্থী। যিনি ফুটপাথে বা পার্কে ঘুমান তারও জীবনমানের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারলে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে না।
দাসত্বের মানসিকতা নিয়ে দায়িত্বশীল হওয়া যায় না, নেতৃত্ব দেয়া যায় না। দাসত্বের মানসিকতা থেকে শেখ মুজিব তৈরি হয় না, শেরেবাংলা তৈরি হয় না, মাওলানা ভাসানী তৈরি হয় না, মাহাথির তৈরি হয় না, এরদোগান তৈরি হয় না। মেরুদণ্ডহীন নেতা আসলে প্রকৃত কোনো নেতা নয়। কেউ চাকরির দাস, যেন কারো কেনা গোলাম! যে অন্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, দাসত্ব শৃঙ্খল ভাঙার আনন্দ সে পায় না।
সৃষ্টির দাসত্ব করে সৃষ্টি বড় হতে পারে না। তবে স্রষ্টার দাসত্ব করে সৃষ্টি বড় হতে পারে। সেক্ষেত্রে সৃষ্টির তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র-মতবাদ অনুকরণ-অনুসরণের মতো সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠতে হয়। মানুষ যখন মানুষের কাছে নিজের বুদ্ধি-বিবেককে সমর্পণ করে তখন সে হেরে যায়, কখনো কখনো ঠকে যায়। সীমাবদ্ধতা-সংকীর্ণতা কখনো অসীমের সান্নিধ্যের সমকক্ষ ফল বয়ে আনতে পারে না। যখন পরনির্ভরশীলতা বেশি থাকে তখন নতুন নতুন আইডিয়া আসে না, আইডিয়ার উন্নয়ন হয় না।
দাসের মানসিকতা আত্মবিশ্বাসকে হুমকির মুখে ফেলে, আত্মগঠনকে ব্যাহত করে, মুক্তচিন্তা-বুদ্ধিকে অসুস্থ করে ফেলে। সৃষ্টি কখনো স্রষ্টার পরিকল্পনার বাইরে যেতে পারে না, সৃষ্টি কখনো স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। মানুষ অনেক কিছুই করে কিন্তু সে মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না, বার্ধক্য থেকে দূরে থাকতে পারে না। দুর্বল মানুষই যার শক্তি-সামর্থ্য-ক্ষমতার উৎস আর মহাপরাক্রমশালী সর্বশক্তিমান যার প্রেরণা-আস্থা-শক্তির উৎস দু’জন সমান হতে পারে না।
কোনো মানুষ কতটুকু ভালোবাসা ও সম্মান পাবার যোগ্য তা বিবেচিত হবে মানুষটির ব্যবহারিক জীবনের ওপর ভিত্তি করে। আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার সাথেও মর্যাদা যুক্ত; তবে এগুলোতো অদৃশ্যমান-গোপনীয়। যারা মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখেন, দরিদ্রের দুষ্টচক্রে বন্দি করে রাখেন; আর যারা স্রষ্টার কথা বলে নিজের ভালোলাগা-পছন্দকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন কেউই সঠিক কর্তব্যটি পালন করছেন না।
সত্যিকারের ভালোবাসা চিত্তের সমৃদ্ধি আনে, মানসিক-দৈহিক নির্যাতন বয়ে আনে না। তবে টাকার দাস যখন টাকার জন্য মানুষকে ব্যবহার করেন তখন ব্যবহারিত মানুষগুলোর দাসত্ব যেন শেষ হবার নয়! নিদারুণ অভাবে নিরুপায় মানুষ যে শুধু দাসত্বের শিকল পরে এমন নয়; মগজ ধোলাইয়ের ফলে বিভ্রান্ত মানুষও হাসিমুখে দাসত্বের জীবন-যাপন করতে রাজি হয়ে যায়।
সত্যিকারের মানবতাবাদী কখনো বর্ণবাদী হয় না। অথচ মানবধর্মের কথা মুখে বললেও কাজে অনেকে বর্ণবাদী, দাসত্ব জিইয়ে রাখতে চান, নিজেদের জাতি-দেশ-ধর্ম-ভাষার শ্রেষ্টত্ববাদী মনোভাব পোষণ করেন এবং ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষী হন! গণতন্ত্র মুখে বলে অনেকে স্বৈরতন্ত্র চালায়, মানবতাবাদের উদারতার কথা বলেও অনেকে ধ্বংসযঙ্ঘ চালায়। মূলত বলার সাথে কাজের কোনো মিল নেই। তথাকথিত এনলাইটেনমেন্ট ইউরোপ ছাড়া বাকী বিশ্বকে দাসত্বই দিয়েছে। সারা পৃথিবীর বিবাদে-যুদ্ধে-সংঘাতে সেই দাসত্বের কালো হাত স্পষ্ট! যতসব বাজে ও বস্তাপঁচা মতবাদ!
সভ্যতায় যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি সময়ের ব্যবধানে তাদের অবস্থানও অপাংক্তেয়তুল্য হয়ে যায়। আর যাদের সভ্যতা বিনির্মাণের চেয়ে সভ্যতা ধ্বংসেই অবদান বেশি তারা কিভাবে বিশ্বমানবতাকে মুক্তি দিবে! দাসমনোবৃত্তির কারণে সভ্যতার সেবাদাসেরা আছে তবে তারা নায়কোচিত ইমেজ তৈরি করতে চেয়েও ভিলেনই হয়ে পরে। কখনো বেখেয়ালে মুখোশ খুলে গেলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে এবং তাদের আবেদন হারায়।
সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে যেসব মানুষের অবস্থান সমাজের সবচেয়ে নীচুস্তরে তাদের মানবিক কোনো মূল্য নেই, যা আছে তার সবটাই বাজারমূল্য। এই বাজারমূল্য নির্ধারিত হয় উচুস্তরের মানুষদের স্বার্থে-কল্যাণে কতটুকু ভুমিকা তারা রাখতে পারে তার ওপর। শিক্ষা-দক্ষতা-পেশীবহুল-কর্মক্ষম হওয়ার ওপর দাম একটু কম-বেশি হয়। সুদের ব্যবসায়ীর কাছে সুদগ্রহীতার প্রতি সহানুভূতির কিছু নেই। সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোর-সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন দাসত্বের বাইরে কিছু নয়।
যেসব মানুষ দাস তারা অধিকার হারালেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে না। হোক তা ভোটের অধিকার কিংবা ভাতের অধিকার। আর যেসব মানুষ মুক্ত তারা পরিস্থিতির কারণে নিরব-নিশ্চুপ থাকলেও সুযোগের চেষ্টা করে, স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে দাসত্ব অস্তিত্বের সহায়ক হওয়ায় উত্তম বিবেচিত হতে পারে, তবে মনিব ছাড়া জীবনধারণ তার পক্ষে অসম্ভব।
যে নিজেকে অপেক্ষাকৃত নীচুজাত বলে মেনে নিয়ে উঁচুজাতের সন্তোষ অর্জনেই নিজের জীবনের সার্থকতা মনে করে তারা দাসত্ব করবে এটাই স্বাভাবিক। তোষামোদ-খোশামোদ করতে করতে কিছু মানুষের মনোভাব এমন হয়ে যায় যে, তাদের মাঝে জোর করে দাসত্বকে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়োজনই হয় না, তারা মনের অজান্তেই দাসের মতো হয়ে যায়।
দাসত্বের সুবিধাভোগী ও লালন পালনকারীরা কখনো কখনো দাসত্বের সাথে বর্ণবাদ জড়ায়, কখনো কখনো জেন্ডার বৈষম্য তীব্র করে, কখনো কখনো আইনকে সামনে আনে, কখনো কখনো বিভিন্ন ব্রান্ডকে হাজির করে। এসবের ফলে কখনো সামাজিক-সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠতে না পেরে, কখনো আধুনিক-সভ্য হয়ে ওঠতে না পেরে, কখনো প্রযুক্তিবান্ধব-স্মার্ট হয়ে ওঠতে না পেরে- তারা দাসত্বকেই চূড়ান্ত পরিণতি বা শিরোধার্য বলে মেনে নেয়।
কখনো বুদ্ধিতে পিছিয়ে, কখনো শিক্ষায় পিছিয়ে, কখনো সম্পদে পিছিয়ে, কখনো প্রগতিশীলতায় পিছিয়ে পরে স্বেচ্ছায়ও দাসত্বে মনের সুখ খুঁজে নিতে দেখা যায়। তারা প্রশ্নই করে না কেন অন্যের মতো হতে হবে কিংবা আমাকে বিচার করার অধিকার তারা কোথায় পেল?