ডাঃ লুনা পারভীন
হুট করে কথা নেই বার্তা নেই কলেজ পড়ুয়া নায়লার বিয়ে হয়ে গেলো আর বছর ঘুরতে না ঘুরতে প্রেগন্যান্ট …..। নাজুক শরীরে আরেকটা শিশুর ভার নিতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খাওয়াতে কোথায় পরিবারের সহানুভূতি মিলবে তা না আরো খোঁটা শুনতে হয়, ‘আমরা যেন আর মা হই নাই, আমাদের সময় পোয়াতি অবস্থায় ঘরের সব কাজ করে এক মাইল দূর থেকে কলসী করে পানি আনছি আর এরা একটু নড়তে চড়তে হাঁপিয়ে ওঠে!’
অতীত থেকে বর্তমান
আসলেই কি তাই? আগের যুগে কি হয়েছিল তার হিসেব এখন মেলাতে বসলে বলতে হয়, আগের দিনে কলেরা, বসন্ত হলে গাঁয়ের পর গাঁ উজার হয়ে যেত। যক্ষা মানে ছিল আর তার নেই রক্ষা। আর এখন মানুষ ক্যান্সার পর্যন্ত জয় করে ফেলছে। আগের দিনে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পায়ে হেঁটে দুইদিন লাগতো। আর এখন চোখের পলকে দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া যায়। আগের দিনে খাবারে ভেজাল ছিল না, বাতাসে সীসা ছিল না, তাই শারীরিক শক্তি ছিল বেশী আর এখন?
সতর্ক থাকাটা জরুরি
কাজেই, গর্ভবতী মায়ের যত্ন নেয়া, তার শারীরিক পরিচর্যার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা নিয়েও সতর্ক থাকাটা জরুরি। বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মানসিক প্রস্ততি থাকতে হবে। বাচ্চা নিতে হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। যেমন,
সতর্কতা ১
পরিবারে জন্মগত ত্রুটির ইতিহাস বা ভয় থাকলে অবশ্যই বাচ্চা নেয়ার তিনমাস আগে থেকেই ফলিক এসিডের ট্যাবলেট খাওয়া ভালো। তাতে জন্মগত ত্রুটির স্বম্ভাবনা কম হওয়ার থাকে।
সতর্কতা ২
মাকে অবশ্য নিয়মিত চেকআপে নিতে হবে। রক্তে হিমোগ্লোবিন, রক্তের গ্রুপ, ডায়াবেটিস, প্রেসার, প্রস্রাবে ইনফেকশন, রক্তে হেপাটাইটিস বি ও অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগ আছে কিনা জানা জরুরি।
সতর্কতা ৩
বাচ্চার অবস্থা, জন্মগত ত্রুটি, প্রসবের সময় জানার জন্য( EDD) জানার জন্য ১২ সপ্তাহ, ২১-২৩ সপ্তাহ এবং ৩২-৩৪ সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাম করা উচিত।
সতর্কতা ৪
মায়ের পুষ্টি, ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বাচ্চার বৃদ্ধি ও বিকাশে প্রভাব ফেলে। মাকে পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ালে বাচ্চার বৃদ্ধি ও বুদ্ধি বিকাশ ঠিকমত হবে না। বিশ্রাম ও মানসিক শান্তি না থাকলে, মা যদি পারিবারিক অশান্তির মধ্যে থাকে তাহলে বাচ্চার বুদ্ধি ও বিকাশে বাঁধা পায়। শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গ শিশু, হাইপারএক্টিভিটি, অটিজম ও কথা বলাতে সমস্যাসহ বুদ্ধি প্রতিবন্ধিও হতে পারে ভবিষ্যতে শিশু।
সতর্কতা ৫
জন্মের ১ম তিনমাস খুবই নাজুক সময়। এসময কোনভাবেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ এমনকি প্যারাসিটামলও খাওয়া উচিত নয়। এসময় গায়ে জ্বরসহ লাল র্যাশ দেখা দিলে অতি সত্তর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। রুবেলা, সিএমভি, টক্সোপ্লাজমা নামক ভাইরাসের কারনে এসময় বাচ্চার নানাবিধ জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে অনেকসময় গর্ভপাত করতে হতে পারে।
সতর্কতা ৬
রুটিন চেকআপ ও রক্ত পরীক্ষা না করলে শেষ তিন সপ্তাহে এসে হঠাৎ করে প্রেসার বা ডায়াবেটিস বেড়ে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। জরায়ুমুখে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল আটকে রক্তপাত হতে পারে, সময়ের আগেই পানি ভাঙতে পারে, পেটে বাচ্চার নড়াচড়া কমতে পারে। এভাবে প্রসবকালিন নানা জটিলতা দেখা যায় যার জন্য অনেকসময় বাচ্চার মৃত্যু বা আইসিইউ কেয়ার লাগে। টাকা বা দুরত্বের সমস্যা এড়াতে চেয়ে শেষে যমে মানুষে টানাটানি শুরু হয়। মাঝে দোষ হয় ডাক্তারের, কসাই নাহলে ভুল চিকিৎসার দায় কাঁধে চাপিয়ে দেয় লোকে।
সতর্কতা ৭
রক্তের গ্রুপ না দেখার কারনে, যে সকল মা আরএইচ নেগেটিভ তাদের বাচ্চাদের জন্ডিস দেয় যা বেড়ে গেলে ব্রেইন নষ্ট করে প্রতিবন্ধি শিশু হওয়ার আশংকা থাকে। এজন্য ব্লাড গ্রুপ জেনে যদি নেগেটিভ হয় তাহলে সেসব মাকে জন্মের সাথে সাথে এন্টি ডি দিলে পরবর্তীতে আর এমন সমস্যা দেখা দেয় না।
সতর্কতা ৮
ব্লাড প্রেশার ঠিকমত চেকআপে না থাকলে প্রেশার বেড়ে মায়ের খিচুনি হতে পারে যা মা ও বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে না থাকলে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, শরীরে গ্লুকোজ কমে খিচুনি, হার্টে সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভে পানি কমে গেলেও বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ডেলিভারিতে কষ্ট হলে বা কাঁদতে দেরী করলে এসব বাচ্চা পরবর্তীতে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়। এসব ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষায় না থেকে অনেকসময় সময়ের আগেই সিজার করার দরকার পড়ে নাহলে মা ও বাচ্চা উভয়ের জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
সতর্কতা ৯
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের বাচ্চাকে জন্মের সাথে সাথে ভ্যাক্সিন ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেয়া জরুরি ও এক বছর বয়সে আবার পরীক্ষা করে দেখা ভালো। রুবেলা ও সিএমভি ভাইরাসের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ।
সতর্কতা ৯
সবচেয়ে মারাত্মক অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অবহেলিত বিষয় পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস ও বেবী ব্লু সিন্ড্রোম। ঠিকমত বিশ্রাম, ঘুম ও পারিবারিক শাখা না থাকলে বাচ্চা জন্মানোর এক সপ্তাহের মধ্যে মায়ের মধ্যে মানসিক চাপের দরুন অস্থিরতা, বিষন্নতা, বাচ্চার প্রতি বিরক্তি ও অনীহা, আবোল তাবোল আচরণ পরিলক্ষিত হয়। এসময় মা ভয়ংকর মানসিক চাপে বাচ্চাকে মেরেও ফেলতে পারে।
প্রস্তুতি নিতে হবে যেন বাচ্চার পুরো গর্ভকালীন সময়টা নিরাপদ ও ত্রুটিমুক্ত থাকে ও প্রসবের পর বাচ্চার যত্ন ও মায়ের পরিচর্যায় কোন ঘাটতি না দেখা যায়।
সুস্থ মা মানেই সুস্থ শিশু
সুন্দর ভবিষ্যৎ পৃথিবী।
লেখক: শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা।