কামরুন নাহার। শুধু একটি নাম নয়, নামের চেয়েও বেশি কিছু। আলোকিত মানুষ গড়ার এই কারিগর কর্মে ছিলেন ব্যতিক্রমী। খুবই প্রাণবন্ত ও মজার মানুষ। কয়েকদিন আগে অসুস্থ হওয়ার পরেও ফেসবুকে লিখেছিল, ‘বেড়াইতে আইসি। ভাব্লাম অক্সিজেন খাইয়া যাই। আমার অরোলা হইসে।’
তিনি চিন্তায় ছিলেন অগ্রগামী। অনেকেরই প্রিয় শিক্ষিকা। ছিলেন যেন একটি বটবৃক্ষ! শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। অনেকের কামরুন নাহার ম্যাডাম। অনেকের রুমা আপা। ডেইলি অবজারভার এর স্পোর্টস এডিটর সাংবাদিক মশিউর রহমানের সহধর্মিণী।
গত ৩ আগস্ট (মঙ্গলবার) তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হলে ৪ আগস্ট তাকে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) ইমপালস হাসপাতালে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (৯ আগস্ট) সকাল ছয়টায় ৪০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন ম্যাম। নিশ্চিত গন্তব্যে। অনিবার্য কবরে! মাটির ঘরে! রেখে গেলেন- কত স্মৃতি! কত খুনসুটি! কত ভালোবাসা! কত গল্প! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হাসপাতাল থেকে লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আল মারজাজুল ইসলামীতে তাঁকে গোসল করানো হয়। তারপর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে নিয়ে তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
তিনি সাংবাদিকতার শিক্ষিকা ছিলেন। শিক্ষার্থীদেরও বন্ধু ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কল্যাণকামী ছিলেন। ক্লাসরুমের বাইরেও ছিলেন আন্তরিক। প্রাণখোলা মানুষ। কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ব্যক্তিগত খোঁজখবরও নিতেন। পরিবারের খোঁজখবরও নিতেন। ক্লান্তিহীন, পরিশ্রমী জ্ঞানসাধক! এত অমায়িক ব্যবহার কম মানুষেরই থাকে! শিক্ষার্থীদের শুভ পাগলামিতেও সমর্থন করতেন।
শিক্ষকতাকে তিনি চাকরি হিসেবে নেননি। ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। আর একসাথে আড্ডা হবে না। কথা হবে না। দেখা হবে না। একসাথে চা খাওয়া হবে না। অভিভাবকের মতো পড়তে বলবেন না। ভাবতে বলবেন না। আদর-শাসনের মিশ্রণে ক্লাস করা হবে না। তবে মনে থাকবেন। স্মৃতিতে থাকবেন। ছবিতে থাকবেন।
এমন কিছু মানুষ থাকেন, যারা নিজেকে উজাড় করে অন্যকে মানসিক সাপোর্ট দেন। অন্যের চলার পথটা মসৃণ করেন। কামরুন নাহার ম্যাম তেমনই একজন মানুষ ছিলেন। অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ছিলেন, প্রাণশক্তিতে ভরপুর প্রাণ ছিলেন। । ভোজনরসিক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছিলেন।
তিনি ২০১৭ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। শিক্ষা জীবন শেষে বাংলাদেশ অবজারভারে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। তিনি পিআইবি’র গণমাধ্যম সাময়িকী নিরীক্ষাসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও জার্নালে লেখালেখি করতেন।
ম্যাম বলতেন, শিক্ষক তো সবাই-ই, আমি না হয় বন্ধুও হলাম। তিনি শিক্ষার্থীদের সেই স্পেসটা দিতেন। তাইতো শিক্ষার্থীরা তার বাসায় দল বেঁধে যেত, তিনি রান্না-বান্না করে খাওয়াতেন। ছিলেন অত্যন্ত আপনজন । একজন শিক্ষিকারও উর্ধ্বে ছিলেন বলেই শিক্ষার্থীর জন্মদিনের ট্রিটেও তিনি অংশ নিতেন। খুব সহজেই আবদার করা যেত, তিনিও তা রাখতেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের ভীষণ ভালোবাসতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে গুরুগম্ভীর দেয়াল তুলে রাখাটাকে তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না।
ড্যাফোডিলে উনার সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছে শুনেছি- ম্যাডাম শিক্ষার্থীদের নিজের লাঞ্চের ভাগ দিতেন। কাউকে অভুক্ত পেলে খাবার কিনেও খাওয়াতেন। এমনও হয়েছে নিজের লাঞ্চ কোনো শিক্ষার্থীকে খাইয়ে নিজে না খেয়েই ক্লাস নিয়েছেন। শিক্ষার্থী সময়মতো টিউশন ফি দিতে না পারায় নিজের বেতন থেকে সেই টিউশন ফি পরিশোধ করেছেন। শাতাধিক শিক্ষার্থী তাকে মা বলেও ডাকতো। শিক্ষার্থীদের কেউ অসুস্থ হলে কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেও ম্যাম কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো মানসিক সাপোর্ট দিয়ে পাশে থাকতেন। শিক্ষার্থীদের জন্মদিন পালন করতেন, কখনো নিজেই আয়োজনও করে ফেলতেন।
আহারে জীবন! আহারে স্বপ্ন! আহারে পৃথিবী! অদ্ভুত মানবজীবন! করোনাভাইরাসে এলোমেলো করে দিচ্ছে কত পরিকল্পনা। ম্যাডামের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করছি। পিআইবিতে মাস্টার্সে সরাসরি শিক্ষার্থী ছিলাম। দোয়া চাচ্ছি- আল্লাহ যাতে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত নসীব করেন। আমীন! ছুম্মা আমীন!
আনিসুর রহমান
সাংবাদিক ও লেখক
০৯-০৮-২০২১ ইং