উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনচর্চায় বিলাস-অনাচারের মতো নেতিবাচকতা যেমন আছে, তেমনি ত্যাগ-সেবা-পরোপকারও আছে। কিছু মানুষ আছেন যারা বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান, প্রতারণা করেন না, অনৈতিক কাজ করেন না, অবৈধ পথে যান না, বেআইনি কিছু করেন না, সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা করেন না, লোভের কাছে পরাভূত হন না।
ইতিবাচক মানসিকতার লোকজনের ভালোবাসার কাছে ঘৃণা পরাভূত হয়, উদারতার কাছে লোভ পরাস্ত হয়, সহিষ্ণুতার কাছে হিংসা পরাজিত হয়, সুরের কাছে অসুর পদানত হয়, মানবতার কাছে স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হয়, সুন্দরের আয়োজনে অসুন্দর পরাজিত হয়।
এরা এমন যে- হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়েও বলেন- আলহামদুল্লিাহ ভালো আছি! মৃত্যুর আগের দিনও বলেন- চিন্তা করো না, আগের চেয়ে অবস্থা উন্নতির দিকে! অর্থাৎ এদের শরীরের চেয়েও মন অধিকতর শক্তিশালী, শরীর কাবু হলেও এদের মন কাবু হয় না। মানসিক শক্তি ও দৃঢ়তা অত্যন্ত বেশি। কোনো আফসোস নেই, হতাশা নেই, পেরেশানি নেই!
একজনের ইতিবাচকতা আরেকজনের মানসেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা মানবিকবোধে উচ্চকিত থাকেন, নিজে যন্ত্রণা ভোগ করেও অন্যের কষ্ট লাঘব করেন, নিজেতো বিবাদে জড়ানই না বরং অন্যের বিবাদের মীমাংসা করেন। বিভেদ আর ভেদাভেদে কষ্ট অনুভব করেন।
তারা চান কেউ প্রতারণা না করুন, কেউ লোভে পড়ে পাপ না করুক, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার না চলুক, বিচারবহির্ভূত অন্যায় হত্যাকাণ্ড না ঘটুক। তারা ভোগ-বিলাসিতা ও আনন্দ-ফুর্তিকে জীবনের শেষ কথা মনে করেন না।
এমন মানুষও আছেন যিনি বিনা মাইনেতে সমাজের মানুষের কল্যাণ কাজে এতটা ব্যস্ত থাকেন যার কারণে ঠিক সময় খাবারের সুযোগও করে ওঠতে পারেন না। এই যে ব্যস্ততা, পরের জন্য ভাবনা, সারাক্ষণ ছুটাছুটি- এর পেছনে অর্থ-বিত্তের জন্য কোনো চাওয়া নেই, ক্ষমতার কোনো মোহ নেই! এদের কারণেই- শত বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে থাকে সমাজ! ধ্বংসস্তুপের আড়ালে দাঁড়িয়েও দেখা যায় আশার আলো!
এদের জীবনযাপনে নানান টানাপোড়েন থাকলেও অন্যদের জন্য এরা রহমদিল হিসেবে হাজির হন। থাকে না স্বার্থপরতা। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন। অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচিত হন, হরহামেশাই অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করেন। মানুষের প্রয়োজনে নিজে দৌঁড়ে যান বলেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা অনুভব করেন।
এরা তথাকথিত ভদ্রলোক নন! ফলে পদ-পদবীহীন মানুষের কাছাকাছি গেলেও তাদের জাত যায় না। ঘর্মাক্ত ও ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত মানুষকে জড়িয়ে ধরলেও তাদের মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যায় না। লাভ লোকসানের হিসাব কষে তারা জীবনযাপন করেন না। জটিল চিন্তাভাবনা নেই বলে সরল-সহজ ভাবে চলেন। তাদের খ্যাতি হারানোর আশঙ্কা নেই, ক্ষমতা হারানোর ভয় নেই; ফলে সবার নাগালের মধ্যেই তাদের পাওয়া যায়।
কিছু মানুষ আছেন যাদের ওপর পুরো সমাজটা দাঁড়িয়ে থাকে; অথচ তাদের নিজেদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অন্যরা যখন শূন্যতাবোধ করে তখন তারা পূর্ণতা নিয়ে হাজির হন! পরের জন্য কাজ করায় এমন আনন্দবোধে করেন যে নিজেকে নিয়ে ভাববার প্রবণতাই দেখা যায় না! দেশ-মাটি-মানুষ-আদর্শকে পাত্তা দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেন! তবে এরা খুব কমই আলোচনায় আসে, মিডিয়ায় আসে, প্রচার-প্রচারণায় আসে; পর্দার আড়ালেই থেকে যান।
কিছু মানুষ আছেন যারা নিরবে কাজ করে যান! স্বীকৃতি-প্রশংসার ধার ধারেন না। সংকট দেখলেই উত্তোরণে ঝাপিয়ে পড়েন, ভ্রান্তি দূরীকরণে অস্থিরতা দেখান, সমস্যার সমাধানে সাহসী উদ্যোগ নেন, সমস্যার সমাধান ভাবনায় মশগুল হন, অন্যের মনের আকুতি-মিনতিও অনুভব করেন, উত্তেজনার মধ্যেও শান্তভাবে সামনে অগ্রসর হন, শুরু করছেনতো সমাপ্তির পথ খুঁজতেই থাকেন, উদ্দেশ্য পূরণের কাজে লেগেই থাকেন।
যাদের প্রতিহিংসা নেই, হারানোর ভয় নেই, অন্ধকারের হাতছানি নেই; তারা আলোর পথে হাসিমুখে চলেন। আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য শ্রম-মেধা নিয়োজিত করেন। আলোকিত সমাজ গড়ায় সময় দেন। জীবনবোধের উজ্জ্বলতায় এরা এগিয়ে। এদের অলসতা নেই, কাজে বিরক্তি নেই, পরিশ্রমে ভীতি নেই। হয়তো পরিপাটি পোশাক নেই, নাদুস নুদুস চেহারা নেই, পারফিউমের সুগন্ধী নেই; তবে সুন্দর মন আছে, অদেখাকেও দেখার মতো চোখ আছে, অজানাকেও জানার মতো আগ্রহ আছে!
যাদের ইতিবাচক মানসিকতা আছে- তাদের বিচার ক্ষমতা আছে, সুবুদ্ধি আছে, সুবিবেচনা করার শক্তি আছে। কাজের প্রতি মমত্ববোধ আছে, দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা আছে, সাময়িক সুখের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি না করার মতো সচেতনতা আছে, ভবিষ্যত নিয়ে ভেবে বর্তমানকে দুর্ভাবনায় না কাটানোর মতো বুদ্ধি আছে , সাধ্যের অতিরিক্ত সাধ নেই, সুখের চিন্তা করে দুঃখকে ডেকে আনার মতো মূর্খতা নেই, মুনাফার লোভে শরীর-মন-আত্মার ক্ষতি করার মতো লোভ নেই।