সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ক্রমশ মানুষকে অসামাজিক করে তুলছে, আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নিজের কথা বলতে, নিজের মতামত ব্যক্ত করতে আর্থিক ক্ষতিও স্বীকার করছে। সময় জ্ঞান লোপ পাওয়ায় কাজের সময় ঠিকঠাক থাকছে না, কাজের আগ্রহ হারাচ্ছে। অনেকে অসৎ পথেও পরিচালিত হচ্ছে। নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে ঈর্ষাবোধ করছে। সেলফি আর ভিডিও তোলতে ব্যস্তদের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিকমতো পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে।
হরহামেশা সেলফি তোলায় ব্যস্তরা এমন যে কুরবানির রক্তাক্ত পশুর সাথেও সেলফি তুলছে। বিপজ্জনকভাবে সেলফি তোলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে সেলফির দিকে। মানবিক বিপর্যয় কোন ধরনের হলে নিকটাত্মীয় কবর দিতে বা দাফন করতে করতে লাশের সাথে ছবি তোলা যায়। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে রক্ষা না করে তার সঙ্গে ছবি তোলা কী ধরনের অসুস্থতা বা কী ধরনের মানসিক বৈকল্য। যারা ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত সেলফি ও ছবি আপলোড করছেও; তারাও জরুরি কোনো ব্যাপারে ম্যাসেঞ্জারে কিছু পেলেও উত্তর না দেয়া সামাজিকতা হয় কী করে! অথচ সালাম দিলে জবাব দেয়াও ন্যূনতম সৌজন্যতা।
পিঠব্যথা, মাথাব্যথা, স্পন্ডাইলিটিজ বা মেরুদণ্ডে সমস্যা, ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, ইনসমনিয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা ও চোখের সমস্যাসহ বিবিধ শারীরিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ায় দেখা বা দেখানোয় বুঁদ হয়ে থেকে আশু কর্তব্য থেকে বিরত থাকছে। জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণার কারণ জানিয়ে ফেসবুক লাইভে একজনকে আত্মহত্যা করতে দেখেও আরেকজন চেষ্টা করেন না তাকে বাঁচাতে, এগিয়ে এসে থামান না। রাস্তায় রক্তাপ্লুতকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে প্রাণ বাঁচানোর হুঁশ নেই, সবাই ব্যস্ত সেলফি অথবা ভিডিও রেকর্ডিং নিয়ে।
অবসর সময় কাটানো, ঘুরতে যাওয়া ও খেলতে যাওয়ার সময়ও এসব মাধ্যমকে সঙ্গী বানালে প্রিয়জনদের খোঁজ নেওয়ার সময় মিলে না। মিটিংয়ে, সেমিনারে, নিত্যদিনের বন্ধুদের আড্ডায় ও পারিবারিক অনুষ্ঠানেও এসবের ব্যবহার সামাজিকতা রক্ষার চেয়ে অসামাজিক করে তুলে মানুষকে। ভার্চুয়াল কমিউনিটি ও নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময়ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করছেন।
ফেসবুক ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের অসামাজিক করে তুলেছে। ইদানীং অফিস-আদালতসহ অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্টেও মোবাইল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ হোটেলে মানুষ বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে আসবে, গল্প-গুজব করবে, আনন্দের সঙ্গে খাবে-তা না বসে বসে ফেসবুক দেখে, চ্যাট করে, টিকটক দেখে, নইলে গেম খেলে। ফলে এক সময় খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়, খাবারের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়; খেতেও অনেক সময় নেয়, খাওয়ার পরও অনেকেই উঠে না। এক সময় হোটেলগুলো মানুষের কোলাহলে ছিল সরগরম, বিভিন্ন দেয়ালে লেখা থাকত আস্তে কথা বলুন। আর এখন পুরো হোটেলভর্তি মানুষ কিন্তু কোনো কথা নেই, সুনসান নিস্তব্ধতা, সবাই যেন সবার অপরিচিত, সবাই যেন নির্বাক; কারণ বেশিরভাগই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।
ফেসবুকের কারণে বাড়িঘরেও ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সঙ্গেও কথা বলে না। সন্তানের ফেসবুক ব্যবহারের কারণে অনেক মা অসহায় হয়ে পড়েন, যা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। সন্তান ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না, শরীরের প্রতি যত্ন নেয় না। সব সময় খিটখিটে মেজাজ, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে না। ফলে অনেক সময় আত্মীয়স্বজনের কাছে লজ্জায় পড়তে হয়। ফেসবুক আমাদের সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আত্মকেন্দ্রিক মানুষে পরিণত করেছে।
ফেসবুকে বন্ধুর তালিকায় শত শত বন্ধুর নাম থাকলেও প্রকৃত বন্ধুর মতো বিপদে এরা কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না। লাইক আর কমেন্ট দিয়েই এদের দায়িত্ব শেষ। সরাসরি সাক্ষাতের কোনো বিকল্প নেই, কখনো তৈরিও হবে না। বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর হওয়া ঠিক নয়। স্মার্টফোনের অনেক ব্যবহারকারীর কারো সঙ্গে কথা বলার সময় পূর্ণ মনোযোগ থাকে না, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, মানসিক নানারকম পরিবর্তন ঘটে। ভাই-বোন, মা-বাবা, সঙ্গী, সন্তানের কাছ থেকেও একা করে ফেলে।
অযথা সময় নষ্ট করা, সময়জ্ঞান না থাকা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, একধরনের অস্থিরতায় ভোগার মতো সমস্যা বাড়ায়। অফলাইনে থাকলে হতাশা কাজ করছে এবং নিজেকে অসুস্থ মনে করছে। বাস্তব জীবনে যথেষ্ট সময় ব্যয় না করায় দাম্পত্যজীবনে অসুখী হচ্ছে, বিয়ে বিচ্ছেদের কথাও ভাবছে। নেটওয়ার্কের কারণে ভার্চুয়াল জগত ধীরে ধীরে নেট বনাম ব্যক্তিজীবনে পরিণত হওয়ায় মানুষ সমাজে একা হয়ে যাচ্ছে।