সন্দেহ, সন্দেহপ্রবণতা ও সন্দেহ বাতিক

আনিসুর রহমান এরশাদ :  সন্দেহপ্রবণতা সম্পর্ক নষ্ট করে, বিশ্বাসে ভিত্তি নড়বড়ে করে ও অবিশ্বাসের দেয়ালকে মজবুত করে। অতিরিক্ত সন্দেহ নেতিবাচক চিন্তা বাড়ায়, উদ্বেগজনক অনুভূতি তৈরি করে, মানসিক যন্ত্রণাকে তীব্রতর করে, কষ্টের নানা কারণের সমাহার ঘটায়।

সন্দেহের কখনো ভিত্তি থাকে, কখনো থাকেও না। তবে সন্দেহ তৈরি হলে তা মানসিকতায় চাপ সৃষ্টি করে, হাতে হাত রেখে চলার আগ্রহে ভাটা ফেলে, সম্পর্ককে অসুন্দর করে, ঐক্যে ফাটল ধরায়, যৌথতায় অনাগ্রহী করে এবং সমন্বয়ে যত্নশীল হতে নিরুৎসাহিত করে।

সন্দেহ বাতিকতা কত যে ভাঙনের সুর বাজায়, কত যে অযৌক্তিক প্রশ্ন জাগায়, ভালোবাসার সুখ-স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে, ভালোবাসার মানুষকে ‌‌‌ঘৃণার মানুষে পরিণত করে।

সন্দেহে মনে জাগে নানা সংশয়, ভেতর কোনো জড়তা কাজ করলেও তা দুর্বলতা ভাবায় বা কিছুটা সময় নিতে চাইলে তা দূরে সরে যাওয়ার আলামত ভাবতে সাহায্য করে।

সন্দেহপ্রবণতায় অযথা দুশ্চিন্তা হয়, সময় নষ্ট হয়, কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বাড়ায়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজে উদাসীন করে, ভালোভাবে বোঝার চেষ্টায় আগ্রহী করে আরও অস্পষ্টতা বাড়ায়, ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তায় বর্তমানটা নষ্ট হয়।

ফোন না করা, ফোন না ধরা, ম্যাসেজ না দেয়া, ম্যাসেজ না দেখা বা ম্যাসেজের জবাব না দেয়ার মানেই অবহেলা করছে বা এড়িয়ে চলতে চাইছে এমনটা নাও হতে পারে। থাকতে পারে ব্যস্ত, নেটওয়ার্কে বা মোবাইল ফোনে কোনো সমস্যাও থাকতে পারে।

সন্দেহ বাতিকরা নিজেকে সম্মান জানান না, নিজেকে দামী ভাবেন না, অন্যকে বেশি গুরুত্ব দেন। এরা অন্যের সামনে খারাপ আচরণ করে, হঠাৎ রাগ করে, অযথা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে!

সন্দেহ বাতিকরা কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন না। যাকে সন্দেহ করছেন তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন না। সুন্দরভাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে যে অনেককিছুই সমাধান করা সম্ভব তা বিশ্বাসও করেন না। নিজের একঘেয়েমি কাটানোর চেষ্টা করেন না।

সন্দেহপ্রবণতা মানসিক শান্তি নষ্ট করে। সম্পর্ককে বোঝায় পরিণত করে। সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। সুখের সংসারে ভাঙ্গনের সুর ওঠে। উদাসীনতা বাড়ায়। নেতিবাচক চিন্তা, নেতিবাচক আবেগ, নেতিবাচক অনুভূতি বাড়ায়। সমস্যা খুঁজে সমাধান বের করায় অনাগ্রহী করে।

সম্পর্কে সন্দেহ বাড়ে- ভালোবাসা প্রকাশ না করলে, মনে নানা সংশয় জাগলে, ভবিষ্যতের জন্য অযথা দুশ্চিন্তা করে বর্তমান সময় নষ্ট করলে, ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা না করলে। খোঁজ খবর না নিলে। অন্যের সামনে খারাপ আচরণ করলে। সারাক্ষণ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে।

সন্দেহ করার প্রবণতা দেখা দিলে অবস্থা এমন হয় যে- কারও সাথে কথা বললেও সন্দেহ হয়, হেসে কথা বললেও সন্দেহ হয়, ফোন চেক করলেও সন্দেহ হয়, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়েও ছাড় না দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে সম্পর্ক একঘেয়ে হয়ে পড়ে। সম্পর্ক পানসে হয়ে যায়। মানসিক শান্তি চলে যায়। সঙ্গীর কোনো কাজে সহযোগিতা করা কমে যায়।

অতিরিক্ত সন্দেহ করার বিষয়টি মানসিক সমস্যা। যারা এই সমস্যায় ভুগেন তারা এটাকে আচরণগত কোনো সমস্যা মনে করতে চান না, মন খুলে কথাও বলেন না, বোঝাপড়া বৃদ্ধিও করেন না। ফলে অন্যের চাহিদা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না, সময়ও দেন না, অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনাও করেন না। অথচ কোনো ব্যাপারে দ্বন্দ্ব থাকলে তা পরিষ্কার করা, যোগাযোগের সমস্যা নিরসন করা মনের ভেতরে সমস্যা দূরীকরণের স্বার্থেই জরুরি।

অকারণে অতিরিক্ত সন্দেহ করার প্রবণতা কাটাতে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে, ঈর্ষা জন্মানো রুখে মানসিকভাবে সবল থাকতে হবে, নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে, অন্যকেও বিশ্বাস করতে হবে, নিজেকে ভালবাসতে হবে, অন্যকেও ভালোবাসতে হবে।

সন্দেহবশত খারাপ কথা বলা যাবে না, মেজাজ ঠিক রেখে ঠান্ডা মাথায় ভেবে ভাষা ব্যবহার করতে হবে। ভয়ে ভয়ে থাকা যাবে না, নিজের ত্রুটি খুঁত বের করে হতাশা বাড়ানো যাবে না, অতীতের পুরোনো খারাপ স্মৃতি টেনে তিক্ততা বাড়ানো যাবে না।

সন্দেহ সুখের অন্তঃরায়। যার ফলে কাঁচের পাত্রের মতো সম্পর্ক ভেঙে খান খান হয়ে যায়। তাই ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর আগে নিজেকে সংযত রেখে কথা বলে মিটিয়ে নিতে হবে! নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে কঠোর ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চাওয়া ঠিক নয়। সন্দেহে পরস্পরের প্রতি আস্থা কমায়, যত্ন কমায়, শ্রদ্ধা হারায়, ভালোবাসা তাড়ায়, দায়বদ্ধতাকে মেরে ফেলে।

সন্দেহ বাতিকতার অস্বাভাবিক অসুস্থতা- সম্মান ও সহমর্মিতাকে বিদায় করে, সহানুভূতিকে অগভীর করে, পারস্পরিক সম্মান কমায়, বন্ধনকে ঢিলে ঢালা করে, দূরত্ব বাড়ায়ে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে, কলহ বাড়ায়, যত্ন কমায়, নির্যাতন বাড়ায়, ছাড় দেয়ার মানসিকতা কমায় এবং ভাঙন বাড়ায়।

সন্দেহ প্রবণতা থেকেই পৃথক ব্যক্তিসত্ত্বা, পৃথক চিন্তা ভাবনা, পৃথক চাওয়া পাওয়াকে উপেক্ষা করে মাত্রাতিরিক্ত অধিকারবোধ খাটাতে চায়। আস্থা অর্জন না করা ও অনিশ্চয়তাবোধ থেকে অতিরিক্ত প্রশ্ন, অতিরিক্ত বিধি নিষেধ, স্বাধীনতায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ আক্ষেপ বাড়ায়।অথচ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শান্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মানবিক আবেগকে জাগ্রত করে গড়ে তুলতে হবে শান্তি সুখের নীড়।

 

 

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *