আনিসুর রহমান এরশাদ
সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ইদানীং এমন মানুষদের আচরণজ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে যারা সমাজে মর্যাদাজনক অবস্থানে রয়েছেন । কিছু ঘটনা ভাইরাল হলেও এগুলোর মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। যার আচরণজ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায় তার আচরণ হবে অনেকের জন্যই বিব্রতকর।
অসুন্দর ও অভব্যকে কেউ দমন করতে চাইলে আগে তাকে সভ্য-ভদ্র হতে হবে। অশোভন আচরণ, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, খারাপ আচরণ, অসভ্য আচরণ, বর্বর আচরণ, অযৌক্তিক আচরণ, উদ্ভট আচরণ, আপত্তিজনক আচরণ, অমানবিক আচরণ, অসংযত আচরণ, অশ্লীল-অশালীন আচরণ, বৈষম্য়মূলক আচরণ, অন্যায় আচরণ, ভীতিকর আচরণ, হঠকারী আচরণ, প্রতিহিংসামূলক আচরণ, সহিংস আচরণ, নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ, একগুঁয়ে আচরণ, বিকৃত আচরণ, নির্বোধ আচরণ, অস্বাভাবিক আচরণ, বিরক্তিকর আচরণ, রূঢ় আচরণ, অপেশাদার আচরণ, বেপরোয়া আচরণ কিংবা অভব্য আচরণ কখনও গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
কাণ্ডজ্ঞান মানে প্রাথমিক জ্ঞান নয়, ব্যবহারিক জ্ঞান, পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক আচরণ করার জ্ঞান। যা বোধ, অভিজ্ঞতা ও সচেতনতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আর আত্মপরাজয়মূলক এবং অসংলগ্ন আচরণকে মানসিক ব্যাধি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কাণ্ডজ্ঞানের অভাব এমন ধরণের এক ব্যাধি যা শরীরকে আক্রান্ত না করলেও সামাজিক আচরণে সুস্থতা বিঘ্নিত করে। তাইতো শান্তিপ্রিয় ও সচেতন মানুষ চায়- আদর্শ আচরণ, স্বাভাবিক আচরণ, বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ, ভালো আচরণ, সামাজিক আচরণ, নিয়ন্ত্রিত আচরণ, সংযত আচরণ, মানবিক আচরণ, শোভন আচরণ, সংযত, উত্তম আচরণ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, সৌহার্দপূর্ণ আচরণ, সহজ আচরণ, স্বাস্থ্যকর আচরণ, দৃপ্ত-সাহসী আচরণ, নিরপেক্ষ- পক্ষপাতমুক্ত আচরণ, দায়িত্বশীল আচরণ, উপযুক্ত-যথাযথ আচরণ, পেশাদার আচরণ ও সঠিক আচরণ।
অযৌক্তিক কটাক্ষ-কটূক্তিকারী গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়। অশালীন মন্তব্য করে নিন্দা কুড়ায়। তীর্যক বাক্যে, পাগলাটে আচরণে মনোবিকারগ্রস্ত বা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। উদ্ভট চিন্তা, ভগ্নমনস্কতা, সামঞ্জস্যহীন আচরণ এবং অতি আবেগ প্রবণতা ও বু্দ্ধিমত্তার অবনতিই মনোবিকার! দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ, অযৌক্তিক ব্যবহার, আক্রমণাত্মক মেজাজ ও আগ্রাসী মনোভাব নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যকে এক বিন্দু ছাড় না দেয়ায় সমালোচিত হতে হয়। ভালো ক্যারিয়ার বা সার্টিফিকেটধারী হওয়ার চেয়ে ভালো মানুষ হতে পারা বেশি কঠিন! পাবলিক স্পেসে অপ্রীতিকর আচরণ করে অনেক নন্দিতরাই নিন্দিত হয়েছেন।
অনুমতি ছাড়া সেলফি তোলা, হঠাৎ কাউকে জড়িয়ে ধরা, অশালীন ইঙ্গিত করা, কুপ্রস্তাব দেয়া, অশোভনভাবে অচেনা মানুষেরর গায়ে হাত দেয়া অস্বস্তিকর আচরণ। কাউকে হেনস্থা করা, চিৎকার-চেঁচামেচি, তর্কাতর্কি, বকাঝকা, গালিগালাজ- সবই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ। পাগলাটে আচরণ, বিতর্কিত বক্তব্য দান, শিষ্টাচার ভঙ্গ করা অরুচিকর আচরণ। অনেক সমাজে জনসম্মুখে চুমু খাওয়ার বিষয়টিকে অশালীন ও উদ্ভট আচরণ হিসেবে দেখা হয়। আসলে মনুষ্যত্ববোধ হারালে স্কুল শিশুদের পিঠকে সেতু বানিয়ে জুতা পায়ে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন জনপ্রতিনিধি, জনসম্মুখে প্রধান শিক্ষককে কানে ধরিয়ে ওঠবসই করাতেও পারেন।
একজনের অপকর্ম অন্যদের ব্যথিত করে, লজ্জিতও করে। স্কুলের বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে হাজার মানুষের সামনে মঞ্চে বসে আরমসে ধুমপান করা অভদ্রতা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সভাপতির নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়া অসচেতনতা। আসলে যে যত বড় ব্যক্তিত্বই হোক না কেন পাবলিক প্লেসে যথাযথ আচরণ করতে না পারলে তা হাস্যরস সৃষ্টি করে, লজ্জাস্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে, বিড়ম্বনা ও বিরক্তি উদ্রেক করে। অসভ্য আচরণের প্রতিবাদ বা শাস্তি না হলে সামাজিক অনেক ধরনের সমস্যা বাড়ে। একজন সভ্য মানুষ অন্যকে গালি দেন না, কখনো অশ্লীল কথা বলেন না, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন না।
অসভ্য-অভদ্র মন্দ মানুষ যখন রেগে যায় তখন সে ভুলে যায় ভদ্রতা-সভ্যতা এবং তার পাশবিক রূপ বেরিয়ে আসে। সে তখন গালি দেয়, ব্যক্তিকে আক্রমণ করে, যুক্তিহীন ও পাশবিক আচরণ করে। হাসি-তামাশা ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালিগালাজ করা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় কিংবা আলোচিত-সমালোচিত হবার প্রত্যাশায়- মন যা চায়, তাই করা অনুচিত। কারণ সাময়িক আনন্দ বা তৃপ্তি দীর্ঘ সময়ের জন্য বেদনার কারণও হতে পারে।
অনেকসময় অফলাইনের সভ্য মানুষটিই অনলাইনে এসে অসভ্য-অভদ্র-বর্বর-অশোভনীয় আচরণ করছে। মতের অমিল হলে গালাগাল করছে, অযৌক্তিক ও অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করছে, অশ্লীল ছবি বা ভিডিওর লিঙ্ক শেয়ার করছে, মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে, কারো ছবি বা লেখাকে এডিট করে হেয় করার কাজে ব্যবহার করছে, প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র না দিয়ে অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে, অঝথা যাচাই বাছাই না করে লাইক-শেয়ার দিচ্ছে, সময় অপচয় করছে, অধিক প্রশ্ন করছে ও বেশি কথা বলছে, নিজেকে বড় ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরছে, না বুঝে হইচই করছে, নোংরা অডিও-ভিডিও শুনছে-দেখছে ও চর্চা করছে, অল্প জেনে যাচাই না করেই বিশ্বাস করছে।
আসলে প্রয়োজন মার্জিত আচরণজ্ঞান। পরিবার থেকেই শিশুকে আচরণজ্ঞান শেখাতে হবে। মানব আচরণ হবে সচেতন আচরণ। হবে না- স্বৈরাচারীর মতো আচরণ, ভৃত্যের মতো আচরণ, জঙ্গিদের মতো আচরণ, ডাকাত সর্দারের মতো আচরণ, মূর্খের মতো আচরণ, পশুর মতো আচরণ, বেড়ালের মতো আচরণ, দানবের মতো আচরণ কিংবা শত্রুর মতো আচরণ। লোক দেখানো আচরণ, আক্রমণাত্মক আচরণ, শৃংখলা বর্হিভূত আচরণ, আজব-রহস্যময় আচরণ, অশান্তিপূর্ণ আচরণ- সবই আচরণ বিধি লংঘন। ব্যক্তিগত আচরণ হবে সুন্দর, দাপ্তরিক আচরণ হবে আন্তরিকতাপূর্ণ, সাংগঠনিক আচরণ হবে যুক্তিপূর্ণ, দায়িত্ব পালনে থাকবে সেবার মানসিকতা ও পেশাদার আচরণ।
আক্রমণাত্মক আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সম্মান বয়স দেখে নয় আচরণ দেখে করা উচিত! অসৌজন্যমূলক আচরণ কখনোই কাম্য নয়। তারকাসুলভ আচরণ ভুলে সাধারণের মধ্যে মিশতে হবে সাধারণভাবেই। বড়দের আচরণ যেমন শিশু সুলভ আচরণ হওয়া কাম্য নয়, কোনো পেশাজীবীরই যাচ্ছেতাই আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ভুল আচরণ হয়ে গেলে তিরস্কার-নিন্দাই জুটবে, সেক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়াটাই শুভবুদ্ধির পরিচয়।