লোভীর ধ্বংস অনিবার্য

অনিয়ন্ত্রিত ও লাগামহীন লোভ হচ্ছে হৃদয়ের সমস্যা, ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির সুযোগ নেয়ার উদগ্র বাসনা। লোভীর কাজ ও আচরণে অপরের কষ্ট বাড়ে। লোভ হচ্ছে অসুস্থ মন ও অস্বাভাবিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। লোভের ফলে রুচিহীনতা বাড়ে, অসন্তোষ বাড়ে, হৃদয় কদর্যতায় ভরে যায়। লোভী থেকে অতি লোভী হওয়ার ঝুঁকিও মারাত্মক!

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

লোভী মানুষ কেমন হয়?

লোভ-লালসা হলো অর্থসম্পদ, প্রাচুর্য বা ক্ষমতার প্রতি এক ধরনের দুর্বিনীত ক্ষুধা বা আকর্ষণ যা মানুষকে আত্মতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত করে। লোভী মানুষ সারাজীবনের জন্য সন্তুষ্টি থেকে বঞ্চিত থাকে। লোভ-লালসায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি প্রায়ই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। নিজের ভালো-মন্দ, নিজের লাভ বা প্রাপ্তি নিয়েই সারাক্ষণ নিয়োজিত থাকে।

লোভীদের মুখে আমি, আমার ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগের আধিক্য দেখা যায়। অন্যের লাভ-ক্ষতি বা কষ্ট নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামায়। অন্যের সম্মান ইত্যাদির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। অন্যের অনুভূতি এদের হৃদয়কে খুব অল্পই স্পর্শ করতে পারে। নিজের প্রাপ্তিতে যদিও বা তাৎক্ষণিক আনন্দ পায় কিন্তু এই সন্তুষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।

এরা বেশ কৌশলী হয়ে থাকে। অন্যের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে অন্যের কাজের স্বীকৃতি সহজেই নিজের বলে চালিয়ে নিতে পারদর্শী। এ ব্যাপারে লজ্জা-শরমের বালাই একটু কম। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে বা অর্জন করতে এরা যতটুকু তৎপর থাকে পরিণাম নিয়ে ততটুকুই উদাসীন থাকে। নিজের প্রাপ্তিটুকু হাসিল হলেই খুশি। প্রয়োজনে নীতি-নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠিত হয় না।

লোভীদের অর্জনে সমাজ লাভবান হয় না

বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ধরনের লোভ-লালসা মানুষের মনে সক্রিয় থাকে। তার মধ্যে ধন-সম্পদ, সামাজিক প্রতিপত্তি এবং সমীহ আদায় করে নেওয়ার তাগিদ অন্যতম। মানুষকে যত প্রকার নেশা বা আসক্তিতে অভ্যস্ত হতে দেখা যায় তার মধ্যে সম্পদ ও ক্ষমতা বা প্রভাবের প্রতি আসক্তি সবচেয়ে তীব্র। এই নেশায় মানুষ ধৃষ্টতা দেখায়, ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় বা অন্যের প্রয়োজন ও অনুভূতির প্রতি নির্লিপ্ত হওয়ার ঘটনা ঘটায়। লোভীদের অর্জন থেকে শেষাব্দি সমাজ খুব অল্পই লাভবান হয়ে থাকে।

লোভের উৎপত্তি ও ভয়াবহতা

লোভের উৎপত্তির ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখ! ভয়, কৃপণতা ও লোভ একই প্রকারের। আর তাদের মূলে হলো খারাপ ধারণা পোষণ করা।’

ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা ধনি যে লোভের আগুনে বন্দি নয়।’

হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলতেন, হে আদম সন্তানেরা! যদি তুমি দুনিয়ার বস্তু পরিমাণ মতো চাও তাহলে সেটা তোমার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি পরিমাণের চেয়ে বেশি চাও, সমস্ত দুনিয়াও তোমার জন্য যথেষ্ঠ নয়।’

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

লোভের কারণে অন্তর অসুস্থ হয়ে যায়, প্রাণ মরে যায়। পাবার বাসনা যত বেশি হয়, লোভ তত বাড়তে থাকে। যখন কেউ কিছুর ব্যাপারে লোভী হয়ে ওঠে, তখন সে যুক্তিবোধ ও বিবেচনাবোধ হারাতে থাকে। লোভ শক্তিশালী হলে তা পাবার আকুলতা-ব্যাকুলতাও তীব্রতর হতে থাকে। লোভাতুর চোখে লোভনীয় ও চাকচিক্যময় যে কতকিছু! তাইতো বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

লোভ জীবনকে এলোমেলো করে

হজরত ওমর রা. বলেন, ‘লোভ করলে আত্মা দরিদ্র হয়ে যায় বা মন মরে যায়। ইবাদতে স্বাদ পাওয়া যায় না। হজরত মূসা আ. আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহ! প্রকৃত ধনী কে? আল্লাহ বললেন, ‘যে লোভ করে না সেই প্রকৃত ধনী’।

সুনানে তিরমিজির হাদিসে আছে, একটি ছাগল পালে ক্ষুধার্ত নেকড়ে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, ছিন্নভিন্ন করে ফেলে সব ছাগলকে, তেমনি লোভ-লালসা মানুষের সুন্দর জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। ধ্বংস করে দেয়, দুনিয়া ও আখিরাতের সুখময় আরামকে।

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট

যার লোভ যত বেশি তার অভাবও তত বেশি। লোভীর মন কখনোই প্রশান্তি পায় না। ক্ষমতার লোভ ক্ষমতায় নিয়ে যায়, শক্তি বাড়ায়; তবে প্রতারণা করে সম্মান-মর্যাদা দীর্ঘসময় টিকিয়ে রাখা যায় না। সীমাহীন লোভ-লালসা বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে, দুর্নীতির পথে পরিচালিত করে, পাপ-পংকিলতায় ভরিয়ে দেয়। বেশি লোভ করা একদমই ভালো নয়; তাইতো বলা হয়- অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।

লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়

লোভ-লালসার ব্যাধিতে আক্রান্ত অন্তরের মানুষ সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে কাজ করে। লোভ-লালসা থেকে যে বেঁচে থাকতে পারে না সে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়, হারামকে হালাল সাব্যস্ত করে, অর্থ উপার্জনে অবৈধ উপায় অবলম্বন করে, মন অতৃপ্তিতে ভরে যায়, অন্যের বস্তু আত্মসাৎ করার প্রবণতা দেখা দেয়। মনে লোভ বাসা বাঁধলে নিজের অবস্থা সুখী করে না, অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। লোভীর লাভ সে ভোগও করতে পারে না; তাইতো বলে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়।

লোভী মানুষের গল্প

লোভী মানুষের গল্পই এমন যে- লোভী মানুষ বঞ্চিত ও অপমানিত হয়! লোভে পাপ পাপে বিনাশ জানার পরও লোভ তার পিছু ছাড়তে চায় না। সব মানুষের লোভই এতো বেশি না বরং কিছু মানুষের লোভ অনেক বেশি। যাদের লোভ তাদের ধর্ম-কর্ম ভুলায়, জীবনের বিনাশ সাধন করে, সর্বনাশ ডেকে আনে, বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দেয়, অন্ধত্ব ডেকে এনে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নেয়, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার হিতাহিত জ্ঞান লোপ করে, পাপ-পুণ্য বিচারের ক্ষমতা নির্মূল করে, চরম শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়।

লোভের পরিণতি ধ্বংস

রাসুল সা. বলেছেন,  তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো।  কারণ লোভের কারণেই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই ধ্বংস হয়েছে, পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে এবং হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’ (মুসলিম)

লোভের বশে মিথ্যা বলে অন্যের জিনিস হাতাতে গেলে নিজেরটাই খোয়া যেতে পারে। যেহেতু লোভ মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। তাই লোভ না করে আমাদের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত।  অযথা আড়ম্বর কাউকে সুখী করতে পারে না।

লোভ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় বিশৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন

যে লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার নৈতিকতার বিকাশও ঘটে না। লালসা যে দমন করতে ব্যর্থ, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করায়ও সে ব্যর্থ। লোভাতুর ব্যক্তি দুর্নীতিবাজ হয়, পরোপকার করে না বা জনকল্যাণকর কাজ করতে উদ্বুদ্ধও হয় না।

লোভী  চরিত্রহীন

অর্থ-সম্পদের লোভ, মান-সম্মানের লালসা, প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ও পদমর্যাদার চাহিদা, প্রসিদ্ধি ও সুখ্যাতি লাভের প্রবল বাসনা চরিত্রহীন করে। লোভী অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে পারে না, নিজেকে সংশোধন করতে পারে না, অন্যের সম্পদের দিকেও লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়, অবৈধ উপায়ে অর্জন করতে ও সমৃদ্ধ হতে চেষ্টা করে।

লোভ মারাত্মক ক্ষতিকারক

লোভী খ্যাতি-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদের অতিশয় মোহে অনিষ্ট করে বেড়ায়। সম্মান লিপ্সা ও সম্পদের লোভ এতটাই ক্ষতিকারক যে- পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, কলহ-বিবাদ, হানাহানি বেড়ে যায়। অন্যের অধিকার হরণ ও ধনসম্পদ আত্মসাৎপ্রবণতা এমন মন্দ স্বভাব যা অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার।

লোভ নিৎকৃষ্ট স্বভাব

পার্থিব ভোগ-উপভোগের অস্থায়ী উপকরণ যেকোনো উপায়ে কুক্ষিগত করার হীন অপপ্রয়াস নিৎকৃষ্ট স্বভাব। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ধনসম্পদ, মানসম্মান, ক্ষমতা, পদমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ। যে অন্তরে লোভ থাকে সেখান থেকে শান্তি-স্বস্তি-ধৈর্য বিদায় নেয়।

লোভীর কাছে কোনো অপরাধই অপরাধ মনে হয় না

মনের কোণে লালিত লোভ একসময় ভয়ানক রূপ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে ধ্বংসের দুয়ার খুলে দেয়। দুনিয়াতে যেমন লোভ একরাশ মন্দত্বের সূচনা করে, একইভাবে তা দ্বীন-ধর্ম ও পরকালকেও বরবাদ করে দেয়। লোভের সময়ে সে যা কিছুই করে, বিবেকের কাঠগড়ায় আসামীরূপে তাকে দাঁড়াতে হয় না। তখন তার কাছে কোনো অপরাধই অপরাধ মনে হয় না। সেসময় যেমন সে কালো টাকা হাতিয়ে নিতে থমকে দাঁড়ায় না, ঠিক তেমনি প্রয়োজন হলে দ্বীন-ধর্ম উপেক্ষা করতে, এমনকি কখনো ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সম্পদের নেশায়, সচ্ছল জীবন লাভের আশায় আদর্শ-ধর্ম সব ছেড়ে দেয়!

লোভীর জীবন অসুন্দর ও অপবিত্র

লোভের বশবর্তী হয়ে জোরপূর্বক কর্তৃত্ব গ্রহণ, যেন তেন উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ক্ষমতা লাভের জন্য কলহ-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ বিবেকবানের কাজ নয়। লোভ জীবনকে অসুন্দর ও অপবিত্র করে। লোভী জয়ী হতে অন্যায় ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়।

লোভীর ধ্বংস অনিবার্য

নিজের কর্মকাণ্ডের ওপরও অতিশয় লোভীর নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং ভবিষ্যত পরিণাম সম্পর্কেও সে চিন্তা-ভাবনা করে না। ফলে পরিণতিতে সে বিপদগ্রস্ত হয়, ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে, অন্যকে ঠকায়ে সে নিজেই বঞ্চিত হয়। অপকর্মের মূল উৎস লোভ মনুষ্যত্বহীন করে, জীবনযাপনে অসৎ ও ন্যায়নিষ্ঠাহীন করে।

লোভ থেকে অশান্তির জন্ম

অর্থের লোভ বড় ভয়ানক। সম্পত্তির লোভ ধর্মহীন করে। ক্ষমতার লোভ পুণ্যহীন করে। সাম্রাজ্যের লোভ সাধুতা নষ্ট করে। পরস্ত্রীর লোভে পবিত্রতা সমূলেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। প্রভাববিস্তারের লোভ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার-নির্যাতন-ছলনা করতেও দ্বিধাহীন করে। লোভ থেকে হিংসা এবং হিংসা থেকে অশান্তি জন্ম নেয়।

 লোভে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন

অর্থলোভ দেখা যায় রাষ্ট্রপর্যায়েও! ক্ষমতা বিস্তারের লোভে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বৈধভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকেও অনৈতিক উপায়ে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় আসে, বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করে! প্রভাব বিস্তারের জন্য নিরীহ মানুষের প্রাণ সংহার করে এবং দারিদ্র্য জিইয়ে রাখে। পরধন লোভে বিয়ে করা, পরস্ত্রীর লোভে নিন্দনীয় আচরণ করার ঘটনা ইতিহাসে অনেক।

লোভ বিপথগামী করে

লোভীরা ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত নয়, অর্থের লোভের কাছে মাথানত করে। লোভই তাদেরকে বিপথগামী করে ও বৈষম্য বাড়ায়। কখনোই সম্পদ লোভীদের জন্য পর্যাপ্ত হয় না; তাদের যতই থাকুক তারা আরো চায়। অন্যকে বঞ্চিত করে, প্রতারিত করে কিংবা শোষণ করেও লোভী টাকা-পয়সা-সম্পদের পাহাড় গড়ে।

লোভ সব অনিষ্টের মূল

মানুষের লোভের কোনো অন্ত নেই। লোভের তীব্রতায় হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা। লোভই যে সব অনিষ্টের মূল তা যেন ভুলতেই বসেছে মানুষ! লোভ সংবরণের জন্য সাধনা প্রয়োজন। লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকতে ঐশী জ্ঞান ও নেক আমলের বিকল্প নেই।

লোভ স্রষ্টার কাছে অপছন্দনীয়

স্রষ্টার প্রেসক্রিপশন বা ঔষধ দিয়ে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। লোভ বা মোহ স্রষ্টার কাছে অপছন্দনীয় এবং মানবতার জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকারক। লোভের ন্যায় ঘৃণিত ও নিন্দনীয় স্বভাব থেকে নিজে বাঁচা এবং অপরকে বাঁচার পরামর্শ দিলেই সমাজ হবে নির্মল ও পূতপবিত্র।

লোভী অন্যের কর্মফলও নিজে ভোগ করে

যা আছে তাতে যে সন্তুষ্ট হতে পারে না, সে আরো পেলেও সন্তুষ্ট হতে পারবে না । লোভ অন্ধকারের এমন অতল গহ্বরে নিয়ে যায়, যেখানে অবিরাম কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয় অথচ তৃপ্ত হয় না । লোভ করলে লাভ হয় না। অথচ লোভী নিজের সম্পর্কে ভালো বোধ করে। মাল ও মর্যাদার লোভীরা শুধু নিজের কর্মফলই ভোগ করতে চান এমন নয়, অন্যের কর্মফলও নিজে ভোগ করতে চান।

লোভী বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দেয়

সর্বগ্রাসী লোভ মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে, ফলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। লালসা-বাসনার ফলে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। লোভ কখনই জীবনে সত্যিকারের সুফল বয়ে আনতে পারে না। লোভের বশবর্তী হয়ে বিত্তশালী বা সমাজপতিরাও বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ধ্বংসের দিকে পতিত হন। লোভ- লালসার কারাগারে বন্দি হলে সে মানুষ আর প্রকৃত মানুষ থাকে না। লোভী ব্যবসায়ীরা মুনাফা করার জন্য ব্যবসা করে, সেবাদানের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে না।

লোভী মানুষ কখনও সুখী হয় না

সম্পদের লোভ মানুষের প্রবৃত্তি পরায়ণতাকে উসকে দেয়, বিলাসিতার প্রতি অন্তর ধাবিত করে, হালাল আয়ের সীমা অতিক্রম করে, সন্দেহযুক্ত আয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, যুক্তি দিয়ে হারামকে হালাল করে, স্রষ্টা থেকে উদাসীন হয়ে পড়ে। সম্মানের লোভে সমস্ত মাল-সম্পদ লুটিয়ে দেয়, রিয়া ও নিফাক্ব প্রবেশ করে, চরিত্রহীন করে ফেলে। লোভী মানুষ কখনও সুখী হতে পারবে না, তার একের পর এক অভাব-অনটন লেগেই থাকবে।

লোভী অতৃপ্ত ও বঞ্চিত

লোভ-লালসা চরিত্রের দুর্বলতম ও হীনতম বৈশিষ্ট্য; যার সাহায্যে সৃষ্টি হয় অন্যায় ও অবৈধ কাজের বিভিন্ন রাস্তা। লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার বলেই নানাভাবে লোভনীয় সব উপায়ে সাধারণ মানুষকে নিঁখুতভাবে ফাঁদে ফেলতে চায় প্রতারকরা৷

ইমাম বোখারি (রহ.) বলেন, ‘লোভী মানুষ দু’টি উৎকৃষ্ট গুণ হতে বঞ্চিত, ফলশ্রুতিতে সে দু’টি দোষের অধিকারী। এক. সে জীবনে পরিতৃপ্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত, ফলে সে জীবন থেকে প্রশান্তিকে হাতছাড়া করেছে, দুই. লোভী যেহেতু সন্তুষ্টি হতে বঞ্চিত; ফলে সে অপরের বিশ্বাসকে খুইয়েছে।’

লোভ করা ভালো নয়

প্রাচীন গ্রিসে স্বর্ণলোভী রাজা ছিলেন মিডাস। তিনি ধনসম্পদকে যেমন ভালোবাসতেন, তারচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তার কন্যাটিকে। একদিন বনদেবতা সাইলেনাস তার গোলাপ বাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজা তাকে আতিথ্য গ্রহণ করতে বললেন।

সাইলেনাসের বন্ধু ডাইওনিসাস আতিথ্য দেখে রাজাকে বললেন, ‘আপনি পুরস্কার হিসেবে কী চান?’ রাজা বললেন, ‘আমি চাই এমন এক শক্তি, যা দিয়ে সবকিছুকে স্পর্শমাত্রই স্বর্ণে পরিণত করা যায়।’ তাকে সে ক্ষমতা দেয়া হলে রাজা তার ঘরবাড়িসহ সব আসবাবকে স্বর্ণে পরিণত করলেন। তিনি থামলেন না। তার আরও স্বর্ণ চাই।

পাগলের মতো স্পর্শের একপর্যায়ে তার মেয়েকে স্পর্শ করার পর সে স্বর্ণের মূর্তিতে পরিণত হল। রাজা বুঝলেন মেয়ে তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। রাজা চিৎকার করে কাঁদতে থাকলেন আর বললেন, ‘আমার এ ক্ষমতা ফিরিয়ে নাও, আমার স্বর্ণ চাই না, আমার কন্যাকে ফেরত চাই।’ গল্পটির শিক্ষা হচ্ছে- বেশি লোভ ভালো নয়, যার যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

লোভ এক মারাত্মক ব্যাধি

একদা হযরত ঈসা (আ.) সফরে বের হলেন। সঙ্গে আহারের জন্য নিলেন তিনখানা রুটি। একটি লোভী লোক অনুমতি নিয়ে তার সফরসঙ্গী হলো। ক্ষাণিকটা পথ চলার পর ক্ষুধা পেলে তিনি রুটিগুলোর পোটলাটি লোকটির কাছে দিয়ে অজু করতে গেলেন। ফিরে এসে পোটলাটি চাইলেন। খুলে দেখলেন রুটি আছে ২ খানা।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, রুটি তো তিনখানা ছিল, তুমি কি একখানা খেয়েছ? লোকটি বলল, না হুজুর আমি খাইনি। খাবার শেষে তারা আবার পথ চললেন। বনের মধ্যে হরিণ পাল চলতে দেখে হযরত ঈসা (আ.) একটি হরিণ শাবককে ডাকলেন। সেটি এলে তাকে জবেহ করলেন, তার গোশত ভূনা করলেন এবং লোকটিকে নিয়ে খেলেন আর বললেন, হাড় চিবুবে না, জমা করে রাখবে। খাবার শেষে হাড়ে ‘কুম-বি-ইজনিল্লাহ’ বলে ফুঁ দিলেন। হরিণ শাবকটি জিন্দা হয়ে খুশিতে বনে চলে গেল।

ঈসা (আ.) বললেন, যে আল্লাহ উচ্ছিষ্ট হাড়কে আবার জিন্দা হরিণে রূপান্তরিত করলেন। তাঁর কসম- তুমি ঐ রুটিখানা খেয়েছ কি না? লোকটি কসম কেটে বলল, না হুজুর ! আমি তো মাত্র একখানা রুটি খেয়েছি। আরো কিছু পথ অগ্রসর হয়ে একটি খরস্রোতা নদীর পাড়ে পৌঁছলেন এবং পানিতে নেমে লোকটির হাত ধরে পানির উপর দিয়ে অপর পাড়ে গিয়ে বললেন, যে আল্লাহ আমাদের পানির উপর দিয়ে হেঁটে এ পাড়ে নিয়ে এলেন তাঁর কসম দিয়ে বলছি, তুমি কি রুটিখানা খেয়েছ? লোকটি কসম কেটে বলল, না হুজুর! আমি খাইনি।

এরপর চলতে চলতে এক বনভূমিতে পৌঁছলেন এবং লোকটিকে একটি বালুর স্তুপের দিকে ইশারা করে বললেন, ওখান থেকে কিছু বালু নিয়ে এসো। সে বালু নিয়ে এলে ঈসা আ. তা তিনটি ভাগে ভাগ করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ফুঁ দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে বালুগুলো তিনটি স্বর্ণের ইটে পরিণত হলো। হযরত ঈসা (আ.) বললেন, যে যতখানা রুটি খেয়েছে সে ততখানা ইট পাবে। লোকটি এবার বলল, হুজুর মাফ করবেন, আমিই সে রুটিখানা খেয়েছি। আমি খেয়েছি দুইখানা রুটি। সুতরাং আমি পাব দু’খানা ইট। ঈসা (আ.) মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আমার ইটখানাও তোমাকে দিলাম। তিনখানাই তোমার। নিয়ে যাও তবে মনে রেখ লোভ করবে না। লোভের পরিণতি খারাপ! ঈসা (আ.) এই বলে সামনে চললেন।

কিন্তু লোকটি আর তাঁর সাথে গেল না। স্বর্ণের ইট নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। ইত্যবসরে দু’জন ডাকাত এসে তার কাছ থেকে ইট নিয়ে নিতে চেষ্টা করল। ধস্তাধস্তি শুরু হলে ডাকাতরা রণে ভঙ্গ দিয়ে বলল, লড়াইতে কাজ নেই, তিনখানা ইট আমরা তিনজনে একখানা একখানা করে নেব। তবে তুমিও ক্ষুধার্ত আমরাও ক্ষুধার্ত। আমাদের একজন গিয়ে বাজার থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসুক। খেয়ে দেয়ে তারপর যার যার ইট নিয়ে চলে যাই। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডাকাতদের একজন বাজারে গিয়ে খাবার কিনে খেল।

আর কিছু খাবারে বিষ মিশিয়ে নিয়ে চলল, যাতে ঐ খাবার খেয়ে বাকি দু’জন মারা যায় আর তিনখানা ইট সে নিয়ে যেতে পারে। এ দিকে বাকি দু’জন পরামর্শ করল যে, খাবার নিয়ে আসা মাত্র অকস্মাৎ আক্রমণ করে ঐ লোকটিকে হত্যা করবে আর ইট ভাগাভাগি করে তারা নিয়ে নিবে। যেই কথা সেই কাজ। ঐ লোকটি খাবার নিয়ে আসামাত্রই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং হত্যা করে ফেলল তারপর তার আনীত বিষমিশ্রিত খাদ্য দু’জনে খেয়ে ফেলল এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তিনখানা স্বর্ণের ইটের পাশে পড়ে রইল ৩টি লাশ। ক’দিন বাদে হযরত ঈসা (আ.) ওই পথ দিয়ে ফিরছিলেন। তিনি এ অবস্থা দেখে আফসোস করলেন। হায়, লোভ! যে লোভে পড়ে, তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।

লোভের বিভিন্ন স্তর

লোভের একটা স্তর তো এমন- কেউ অর্থসম্পদের পেছনেই তার জীবনকে ব্যয় করে দিল। নাওয়া-খাওয়া জীবনের সুখ-আরাম ভুলে গিয়ে কেবলই টাকা আর টাকা! অধিক সম্পদ উপার্জনের লোভে যে এভাবে নিজেকে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিলিয়ে দেয়, নিজের উপার্জিত টাকা সে আর ভোগ করে যেতে পারে না। এখানে অবশ্য ব্যক্তি কেবল তার নিজের আরামকেই হারাম করে, অন্য কেউ তার দ্বারা আক্রান্ত হয় না।

লোভের আরেকটি স্তর হচ্ছে- নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে অন্যকে আক্রান্ত করা, প্রভাব খাটিয়ে কিংবা কোনো কৌশলে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। লোভের উপরোক্ত প্রথম স্তরটিও প্রশংসনীয় নয় মোটেও, কিন্তু দ্বিতীয় স্তরটি সম্পূর্ণই হারাম। বলে-কয়ে হোক আর গোপন চক্রান্তের মাধ্যমে হোক, সর্বক্ষেত্রেই তা নিন্দনীয়, অবৈধ। এ লোভই মানুষের পতন ডেকে আনে। দাপট হয়তো কিছুকাল তাকে সঙ্গ দেয়। কিন্তু একসময় তাকে পতনের মুখে পড়তেই হয়।

রাসূল সা. লোভের দুটি স্তর থেকেই বেঁচে থাকার পথ নির্দেশ করে বলেছেন- হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। জেনে রেখো, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার জন্যে নির্ধারিত রিজিক পূর্ণ না করে ততক্ষণ তার কিছুতেই মৃত্যু হবে না। একটু দেরিতে হলেও তা তার কাছে পৌঁছাবেই। তাই আল্লাহকে ভয় করো। উপার্জনে সহজতা অবলম্বন করো। হালাল যতটুকু তা গ্রহণ করো আর যা কিছু হারাম তা বর্জন করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৪৪)

তিনি একদিকে উচ্চারণ করেছেন আশ্বাসবাণী- তোমার জন্যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যতটুকু রিজিক নির্ধারিত, তা তুমি পাবেই। যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তুমি তা ভোগ না করবে ততক্ষণ তোমার মৃত্যু হবে না। এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলো আর সহজে যতটুকু সম্ভব উপার্জনের চেষ্টা করো। উপার্জনের পেছনে পড়ে তুমি তোমার জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়ো না। এ জীবন অনেক মূল্যবান; একে কাজে লাগিয়েই তোমাকে অর্জন করতে হবে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত জীবনের পাথেয়।

দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, উপার্জন করতে গিয়ে হালাল-হারাম দুটি পথেরই তুমি সন্ধান পাবে। আল্লাহকে ভয় করে সর্বপ্রকার হারাম থেকে তুমি বেঁচে থেকো। হালাল পন্থায় যতটুকু সম্ভব হয় ততটুকুই তুমি অবলম্বন করো। হয়তো একটু বিলম্ব হবে, কিন্তু তোমার নির্ধারিত রিজিক তোমার কাছে আসবেই।

বরকত বিনষ্ট করে লোভ

সম্পদের বরকত বিনষ্ট করে লোভ। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এ জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’

লোভ নৈতিক ত্রুটি

বেশি লোভ ভালো নয়, যার যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। লোভ মানুষের অধপতনের অন্যতম কারণ। লোভ একটি নৈতিক ত্রুটি। লোভ মানুষের জীবন থেকে সুখ কেড়ে নেয়। লোভী মানুষ আল্লাহতায়ালার কোনো নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করে না, বরং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তার চেয়ে সে আরও অনেক বেশি কিছু চায়। যদি সেটা পূর্ণ হয়ে যায়- তাহলে সে আবার নতুন করে আরেক জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেয়। চলতে থাকে তার লোভের চক্র।

লোভের বীজ লিপ্সা

লোভের বীজ হচ্ছে লিপ্সা। লিপ্সা থেকেই লোভ-লালসার জন্ম। মানুষ জীবনে যতই ধার্মিক হোক না কেন, লোভ সামলাতে না পারলে সবই বৃথা, সবই শূন্য, সবই শয়তানি কর্ম! লোভ যে ধ্বংসাত্মক আর এটি যে সবকিছু ধ্বংস করে দেয় তা জানার পরও লোভী ব্যক্তি লোভ দেখিয়ে টাকা হাতায়ে নেন, কাজ না করেই ফল ভোগ করতে চান। অনৈতিক, অবৈধ, বেআইনি এবং অনাহূত আকাঙ্ক্ষা এমন লোভ যা ধ্বংস ডেকে আনে।

লোভে চকচক করে লোভীর চোখ

অনেকের চোখ চকচক করে কামনা-বাসনা ও খায়েশ পূরণের লোভে, পদ-পদবি ও ক্ষমতার মোহে এবং হাজারো হীনস্বার্থ হাসিলের লোভে! তারা মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। স্বার্থের জিভ মেলে পৃথিবীকে গ্রাস করতে চায় অতি লোভীরা! পৃথিবীতে মানুষ যত অনাসৃষ্টি করে, সব লোভের বশবর্তী হয়েই করে। অতিলোভের কারণেই মানুষ নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হয়, দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থপর হয়, অস্বস্তিতে ভুগে এবং শয়তানি কর্মে সময় কাটায়!

অন্যের থেকে বেশি পাওয়ার লোভ

ক্ষণস্থায়ী ছোট্ট জীবনে কত টাকা, কত ক্ষমতা, কত সম্মান ও প্রতিপত্তি প্রয়োজন? এত লোভ, এত অহঙ্কার কেন? মাটির পিঠ থেকে পেটে চলে গেলে এসব কী কাজে আসবে? এতে না পাওয়া যায় দুনিয়ার সুখ-শান্তি এবং আখিরাতের জন্য হয় গোনাহের বোঝা ভারী। দিন যাচ্ছে, বয়স ফুরাচ্ছে, অথচ লোভাতুর হয়েই মানুষ কবর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। ‘একে অন্যের থেকে বেশি পাওয়ার লোভ বা প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলের মধ্যে ফেলে রেখেছে। এমনকি দুনিয়া পাওয়ার এ চিন্তা নিয়েই তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।’ (সূরা তাকাসুর-১ ও ২)

লোভ হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য করে

লোভ-লালসা যদি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বুকের জ্বালা বেড়ে যায়। শয়তান শিরায় শিরায় সফলতার জয়ধ্বনি তুলে অহঙ্কারের সীমা লঙ্ঘন করে এবং মানুষকে চরম ও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। আল্লাহর ভয়, মানবতা, দয়ামায়া, ইমান-আমল, বিবেক ও সুবুদ্ধি লোপ পায়। অন্তরে লু হাওয়ার ঝড় ওঠে। জীবন-জিন্দেগিকে প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। অধিক আশার জগতে প্রবেশ করে জগতের সব কিছু একাই পেতে চায়। কিন্তু তার অস্থির ও অশান্ত চিত্তে এ কথার উদয় হয় না যে, ‘প্রয়োজন ফকিরেরও পূর্ণ হয়, কিন্তু আশা রাজা-বাদশাহরও পূর্ণ হয় না।’ (হজরত আলী)

লোভ-লালসার মুখ্য দাওয়াই

লোভ-লালসার মুখ্য দাওয়াই হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহ ভয়। যার ভেতর আল্লাহর ভয় নেই, সে যেকোনো অপকর্ম করতে পারবে। স্বার্থের জিব মেলে সে দুনিয়াকে গ্রাস করতে চায় না, বরং সে আল্লাহর কুদরত চোখে ডুব দিয়ে সর্বপ্রকার লোভ-লালসা, দুঃখ-কষ্টকে জয় করে নেয়।

বরকতহীনতাকে তরান্বিত করে লোভ

লোভ অতৃপ্তি আর বরকতহীনতাকে তরান্বিত করে। হাকীম বিন হিযাম রা. বলেন, আমি নবীজি সা. এর কাছে সওয়াল করলাম, তিনি আমাকে দিলেন। আবার চাইলাম, তিনি দিলেন। আবার চাইলাম, তিনি দিলেন। আবার চাইলাম, তিনি দিলেন। আবার চাইলাম, তিনি দিলেন। তারপর বললেন: হাকীম! এই সম্পদ হলো সুমিষ্ট সজীব বস্তু! যে এটাকে (নির্লোভ ) উদারচিত্তে গ্রহণ করবে, তাতে বরকত দেয়া হবে। আর যদি কেউ সম্পদকে লোভী হয়ে, পীড়াপীড়ি করে অর্জন করে তার অবস্থা হবে, এমন ব্যক্তির মতো যে, খেয়েই চলছে,কিন্তু তৃপ্তি আসছে না (মুত্তাফাক)।

মনে পেরেশানি বাড়ে লোভে

লালসাগ্রস্থ মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপনে আপারগ হয়। লোভের প্রভাবে এদের মনে অতৃপ্তি, দুশ্চিন্তা, অধৈর্য ও অশান্তির স্থায়ী দাগ পরে যায় যা এদের স্বাভাবিক জীবনাচারকে কুঁকড়ে ফেলে। মনে সার্বক্ষণিক অস্থিরতা আর পেরেশানি লেগেই থাকে যা তাদের এবং তাদের চারপাশকে আক্রান্ত করে সার্বক্ষণিক যন্ত্রণাময় করেতুলে। লোভী মানুষ নিজেরা অসুখী হয় এবং সেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেদের অসুখ ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে।

লোভ থেকে বাচার উপায়

লোভ-লালসা হারাম, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লোভ করা থেকে বেচে থেকতে নির্দেশ দিয়েছেন । কোরআনে এরশাদ হচ্ছে ‘যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না’।

লোভ থেকে বাচার উপায় হচ্ছে নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বেশি বেশি প্রাপ্য নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং দানের হাত প্রশস্ত করা। আল্লাহর রঙে নিজেকে রাঙিয়ে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করতে পারলেই লোভ-লালসা এবং যাবতীয় মন্দ বিলীন হয়ে যাবে।

সন্তানকে লোভ-লালসা থেকে মুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই লোভ-লালসা একটি নেতিবাচক আবেগ এই ধারণাটি দিতে হবে। বাবা-মাকে অবশ্যই লোভ-লালসা পরিহার করে চলতে হবে এবং সন্তানের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে হবে। সন্তানকে তার পারিবারিক সামর্থ্যরে মধ্যে চলতে উৎসাহিত করতে হবে। বেহিসাবি খরচ সন্তানের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনে। নিজের যা আছে তার জন্য শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং সন্তানের মধ্যে এই আচরণটিকে প্রোথিত করতে হবে।

অন্যের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যের প্রয়োজনে সামর্থ্য অনুযায়ী কায়িক শ্রম, অর্থ ও সময় দিয়ে অন্যের প্রয়োজনে সহযোগিতার অভ্যাস করতে হবে এবং সন্তানকে এতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

লোভ মানুষের সব দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল উৎস, তাই ইহলৌকিক ও পরকালীন জীবনে সাফল্যের জন্য লোভ-লালসার কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। লোভ-লালসার মুখ্য দাওয়া হলো খালেস ঈমান ও তাকওয়া বা খোদাভীতি, যার মাঝে ঈমানের আলো নেই, তাকওয়া নেই, সে যেকোনো অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে।

সম্মান ও পদের লোভ

মানুষ যেমন সম্পদের প্রতি লোভ করে, তেমনি মর্যাদা ও সম্মানের প্রতিও লোভ করে। পদমর্যাদার প্রতি লোভ কখনো সম্পদের লোভের চেয়েও ভয়ানক হয়। এ মর্যাদা পার্থিব বিষয় নিয়ে হতে পারে, হতে পারে দ্বীনি বিষয়েও। যেখানেই হোক, যেভাবেই হোক, এ লোভ মানুষের পতন ত্বরান্বিত করে। জাগতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মান ও মর্যাদার আসন চেয়ে নিয়ে মানুষকে যে কতটা অপমান আর অসম্মান সঙ্গে করে সে পদ থেকে নেমে যেতে হয় তা তো আমাদের চোখে দেখা এক বাস্তবতা।

হজরত রাসুলুল্লাহ সা. এর বাণী, ‘হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরা! তুমি কখনোই নেতৃত্ব চেয়ো না। কারণ তুমি যদি চাওয়ার পর তা পাও তাহলে এর পুরো দায়িত্ব তোমার ওপরই ন্যস্ত করা হবে। আর না চেয়ে যদি তুমি তা পাও তাহলে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তোমাকে সে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করা হবে।’ সহিহ্ বোখারি : ৬৬২২

লোভীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি

প্রশংসা শুনতে চাওয়ার লোভ মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। অন্যরা যখন প্রশংসা করে তা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সংকট হয় তখন যখন কেউ কোনো কাজ না করেও সে জন্য প্রশংসা শুনতে চায় কিংবা কেউ তার প্রশংসা না করলে তাকে নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকে।

আল্লাহর ঘোষণা এমন, ‘যারা নিজেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে উৎফুল্ল এবং যা তারা করেনি তা নিয়ে প্রশংসিত হতে ভালোবাসে তুমি অবশ্যই তাদের ভাববে না যে, তারা আজাব থেকে বেঁচে যাবে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ সুরা আলে ইমরান : ১৮৮

লোভীদের ঠিকানা দোজখ

মর্যাদার প্রতি লালসা যখন দ্বীনি কোনো বিষয় নিয়ে হয়, কোনো ইবাদত করে কেউ যখন মানুষের কাছে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে চায়, দান-সদকা করে, বারবার হজ-ওমরাহ আদায় করে কিংবা অনেক জ্ঞানার্জন করে কেউ যখন অন্যের দৃষ্টিতে সম্মানের আসনে বসতে চায়, তার মুক্তির তখন কোনো উপায় থাকে না। কোরআন-হাদিসের ঘোষণা অনুসারে দোজখই তার ঠিকানা!

লোভের ব্যাপারে ইসলাম

ইসলাম মনে করে, অর্থ-সম্পদ নিয়ে হোক, আর সম্মান-মর্যাদা নিয়ে হোক, সব লোভের ক্ষেত্রে সমানভাবে এ কথা প্রযোজ্য-লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অথচ আল্লাহতায়ালা যেভাবে মানুষের হায়াত-মউত সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা যেমন সুনির্ধারিত, ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের জন্যই তার রিজিকও নির্ধারিত। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছেন, এ নির্ধারিত রিজিক দুনিয়াতে পরিপূর্ণরূপে পাওয়ার আগে কিছুতেই কারও মৃত্যু হবে না। তাহলে আর লোভের পেছনে ছোটা কেন? অন্যের সঙ্গে শুধুই সম্মান আর সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা কেন?

আল্লাহ বলেন, ‘কেউ যদি আল্লাহকে ভয় করে তাহলে তিনি তার জন্য কোনো পথ তৈরি করে দেবেন এবং তাকে তিনি এমন স্থান থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ সুরা তালাক: ২-৩

আর মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মর্যাদা লাভ করতে চায়, (সে জেনে রাখুক) সমস্ত মর্যাদা আল্লাহরই হাতে।’ সুরা ফাতির : ১০

লোভে সমাজ  অবক্ষয়ের দিকে যায়

লোভ-লালসা এমন নেতিবাচক আবেগ, যার সঙ্গে ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা. অবসাদ, হতাশা ইত্যাদি জড়িয়ে থাকে। নেতিবাচক তাড়না থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য সে অধিকতর সম্পদ বা ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে সুখানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আত্মতৃপ্তির অভাবে সে কখনই সন্তুষ্ট হতে পারে না বিধায় অধিকতর সূখানুভূতির আশায় অধিকতর সম্পদ বা প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

এ যেন সমুদ্রের লোনা পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণের মতো। তৃষ্ণা কেবল বেড়েই চলে। এসব নেতিবাচক আবেগ এক সময় ব্যক্তিকে নানাবিধ অপরাধ আচরণে অভ্যস্ত করে তোলে। লোভ-লালসা এভাবেই সহমর্মিতা, ভালোবাসা ইত্যাদি ইতিবাচক আবেগকে পরাভূত করে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। সমাজ দ্রুত অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়।

নিয়ন্ত্রণহীন লোভের পরিণতি ভয়াবহ

নিয়ন্ত্রণহীন লোভ কতটা ভয়াবহ পরিণতির মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিতে পারে এর নজির তো আমরা প্রতিদিনই পাই।  সীমাহীন লোভ-লালসা মানুষকে তার সামর্থ্যের বাইরে ঠেলে দেয়। তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ করে তাকে দুর্নীতি ও পাপের পথে পরিচালিত করে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জবরদখল, ঘুষ-দুর্নীতি, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, অপহরণ, গুম, খুনখারাবিসহ অধিকাংশ সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসার বিরাট প্রভাব রয়েছে।

লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়

লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা মেরে ফেলে। তাই তো আমরা দেখি, দুর্নীতির যত অভিযোগ, সবই সম্পদশালীদের বিরুদ্ধে। বরং যে যত বেশি দুর্নীতিপরায়ণ, সে ততটাই সম্পদশালী। এই জগতে হায়, সেই বেশি চায়, যার আছে ভূরি ভূরি।

রাসূল সা. এ বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছেন এভাবে- আদমসন্তানের যদি দুই উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে সে কামনা করে- তার যদি আরেকটি উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণ থাকত! মাটি ছাড়া কোনো কিছুই তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে না! (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৩৭ )

 চলতে থাকে লোভের চক্র

লোভ হ’ল ব্যক্তির সম্পদ ও সম্পত্তি থাকার অত্যধিক আকাঙ্ক্ষা। লোভী মানুষ সর্বদা অশান্তিতে থাকে। লোভ মানুষের অধপতনের অন্যতম কারণ। লোভ একটি নৈতিক ত্রুটি। লোভ মানুষের জীবন থেকে সুখ কেড়ে নেয়।

লোভী মানুষ আল্লাহতায়ালার কোনো নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় করে না, বরং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তার চেয়ে সে আরও অনেক বেশি কিছু চায়। যদি সেটা পূর্ণ হয়ে যায় – তাহলে সে আবার নতুন করে আরেক জিনিসের প্রতি দৃষ্টি দেয়। তার জীবনে চলতে থাকে তার লোভের চক্র।

লোভী মানুষ পশুর মতো

লোভ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য করে ফেলে যার জন্য মানুষ এমন কোনো হীন কাজ নেই যা করে না। লালসাগ্রস্থ ব্যাক্তির হালাল হারাম বিবেচনা বোধের ক্ষমতা লোপ পায়, এরা সম্পদ সম্মান লাভের জন্য হিংস্র পশুর মতো হতেও পিছপা হয় না। লোভের কারণে মানুষ্যবৃত্তির মৃত্যু হয়ে জন্ম নেয় অনমনীয়, অবিবেচক পশুবৃত্তি। লোভের বশর্বতী হয়ে সব ‍কিছুই করতে পারে। সামাজিক অনাচার বা বিপর্যয়ের পেছনে লোভ-লালসাই অন্যতম নিয়ামক।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *