আনিসুর রহমান এরশাদ
বার্ধক্যে একাকিত্ব মানেই বড্ড অসহায়ত্ব! শরীরে দানা বাঁধে নানা রোগব্যাধি! নিয়মিত চেকআপ করাতে হয়, চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। এইসময়ে স্বজনহীন জীবনযাপন মানেই প্রতিটি মুহুর্ত একাকিত্বের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া। সময়মত ওষুধ খাওয়া, বাজার করা, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়ার মতো কাজও তখন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। যার খাবারেই অরুচি, অনিদ্রা আছে, নির্ঘুম রাত কাটে- তার এত এত কাজ মোটেই স্বাভাবিক নয়। পরিবার বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা নিয়ে বয়স্ক-অসুস্থ শরীরেও ছুটে চলাটা দুঃস্বপ্নের মতো! অনেকসময় বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সন্তানরা কাজের লোক দিয়ে চালিয়ে নিতে চান! কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম কিংবা কাজের লোক কখনো স্বজনের বিকল্প হতে পারে না।
বড্ড একা হয়ে যাওয়ার পেছনে দায়টা কখনো অন্যের আবার কখনো নিজের! অধিকতর সুখের জন্য যৌথ পরিবার ভাঙ্গা হচ্ছে। আত্নীয়-স্বজনহীন সন্তানকে বড় করছেন পশ্চিমা কালচারে। সন্তানের সফল জীবন, উন্নত ক্যারিয়ার, উন্নত দেশে স্থায়ী করার স্বপ্ন পূরণেই বিদেশে পড়াচ্ছেন। অনেকে কালো-অবৈধ টাকা নিরাপদে রাখতে স্ত্রী-সন্তানদের উন্নত রাষ্ট্রে অভ্যস্ত করছেন। সন্তানের চিন্তা-ধারা ও জীবনাচারণে পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়ছে!
ধর্ম-নৈতিকতা-মূল্যবোধহীন জীবন-যাপন করছে। ভালোবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছে! দিন দিন সবল থেকে সবলতর হলেও দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলছে! এর ফলাফল মৃত্যুর সময়ে কেউ পাশে না থাকা! কথা বললেও কেউ না শোনা, না বোঝা, না মানা! জীবন অশান্তিময়, অস্বস্তিময়, অনিরাপদ এবং অমর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠা! নিদারুণ কষ্টে পরিণত হওয়া! অদ্ভুত ও যন্ত্রনাময় একাকিত্ব ঘিরে ধরা!
সন্তানের স্মার্টনেস-সাফল্য ও আধুনিকতা নিয়ে যিনি গর্ব করছেন, দুহাত মেলে খরচ করেছেন; তিনিও সন্তানের শিকড় ভোলা ও সংস্কৃতি পাল্টে ফেলাকে মানতে পারছেন না। অন্যদিকে সন্তানের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাবা-মাকে আনস্মার্ট মনে করছে, দেশের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। ফলে একসময় সন্তানের সুন্দর জীবন-যাপনের নিশ্চয়তায় উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যাচ্ছে।
নতুন জগৎ ও স্বপ্নের ভূবনে বাবা-মার সাথে বাড়ছে মানসিক দূরত্ব! আর বাবা-মার ঠিকানা হচ্ছে- কখনো বৃদ্ধাশ্রম বা কখনো বাসায় কষ্টকর একাকিত্ব! পরিবার-পরিজন দূরে ঠেলে দেয়ায় নিরুপায় মানুষের অশ্রুসজল চোখ দেখতে হচ্ছে! জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময় সন্তানদের সুখের জন্য ব্যয় করে শেষ বয়সে অসহায় ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ায় বড় আক্ষেপ তৈরি হচ্ছে!
শরীরের সব রক্ত ঝরিয়ে মানুষ করা সন্তানের অবহেলা ও নির্যাতন এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে- যেখানে একান্ত আলাপের মানুষ নেই! শেয়ার করার মানুষ নেই! বড্ড কষ্টও প্রকাশের সুযোগ নেই! এমতাবস্থায়- সন্তানের জন্য ত্যাগকে মনে হয় মহা ভুল! সাহচর্যহীন শেষজীবনে এসে বার্ধক্যের প্রস্তুতি না নেয়ার মহা মাশুল হিসেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! আবেগাপ্লুত হয়ে কান্না করে! যখন ফুরিয়ে আসে বেঁচে থাকার রসদ! টাকা-পয়সায় কেনা যায় না সুখ! বেশি দামে যেন কমদামি জিনিস কেনা! দুঃখ-সংকট-দুর্দশা-অসহায়ত্ব-একা হয়ে পড়াকে জীবনের সব থেকে বড় ভুল মনে করা!
একাকিত্ব থেকে বাঁচতে কি নিদারুণ করুণ আকুতি! সদা হাস্যোজ্বল মানুষের মুখ থেকেও হারিয়ে যায় হাসি! সারা জীবন মানুষকে ভালোবেসে এসেও ভালোবাসার কাঙাল হয়ে পড়া! কত আক্ষেপ! একটা ফোনের অপেক্ষা! খোঁজ না নেয়ায় অসহায়ত্ব। নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্ণতা নিত্যসঙ্গী হওয়া! শারীরিক দুর্বলতা! আর্থিক দৈন্য! সামাজিক অবহেলা! নিঃসঙ্গ জীবনযাপন! বিভীষিকাময় বার্ধক্য! প্রকট খাদ্যসংকট, স্বাস্থ্যসেবার সংকট, জীবন বাঁচানোর সংকট! অনেক না বলা কথা বুকের মধ্যে জমা রেখেই পৃথিবী ছাড়া!
যখন কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়; দেখা দেয়- অসামর্থ্য, পরনির্ভরশীলতা, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ও অসহায়ত্ব। দেখা দেয়- প্রস্রাবে সমস্যা, শ্রবণ ও দর্শনে সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, স্মৃতিভ্রম, ঘুমে অসুবিধা, দাঁতের সমস্যা ও বিষণ্ণতা। দেখা যায়- হাতের চামড়া কুঁচকে যাওয়া, জবুথবু বসে থাকা, দাঁত পড়ে যাওয়া, চোখে নির্বাক অসহায়ত্ব। তখন পাশে থাকতে হবে পরম মমতায়। দিতে হবে- একটু সম্মান, একটু নিরাপদ গৃহাশ্রয়, যথাযথ খাবার আর কাপড়, একটু বিশ্রামের নিশ্চয়তা, শ্রান্ত শরীরে ও ক্লান্ত কপালে সহানুভূতিশীল হাতের ছোঁয়া।